বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৭]
প্রভা আফরিন
“সাগর মুখ খোলেনি। শুরুতে কেউই খোলে না। একটু কসরত তো করতেই হবে।”
সাগরের প্রসঙ্গ উঠতেই অনন্যার চোখদুটি ক্ষো’ভে জ্বলজ্বল করে উঠল। ঘৃণায়, বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল সর্বাঙ্গ। শ্রাবণ তা খেয়াল করে পুনরায় বলল,
“তবে একটা ইন্ট্রেস্টিং তথ্য সে দিয়েছে।”
“কী সেটা?”
“পিয়াসার ব্যাপারে।”
শ্রাবণের মস্তিষ্কে হসপিটালে আসার আগের সময়টা ধরা দেয়৷ বদ্ধ ঘরে সাগরের উদ্দেশ্যে লোভনীয় প্রস্তাব রাখলেও সাগর তাকে বিশ্বাস করেনি। সবদিকে ফেঁসে গেলেও মুখ না খোলার ব্যাপারে অটল৷ জামশেদ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আরো দুইবার ছুটে গেছিল ওর দিকে। তখনই র’ক্তাক্ত থুতু নিক্ষেপ করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেছিল,
“আপনারা যার মা’র্ডার মিস্ট্রি সলভ করতে নেমেছেন সে-ই শুভ্রার মৃত্যুর জন্য দায়ী। শালী খুবই স্মার্ট ভাবত নিজেকে। অথচ নিজের খোঁড়া গর্তে নিজেই পড়ে গেল।”
এরপর আর কথা বলানো যায়নি সাগরকে দিয়ে। শ্রাবণেরও তেমন অবস্থা ছিল না যে চেপে ধরে। দ্রুতই হসপিটালের স্মরণাপন্ন হতে হয়। অনন্যা সাগরের বক্তব্যটা শুনেই চমকে উঠল। স্মরণ হলো পিয়াসার মৃ’ত্যুর দিন রাতে তার ভাইয়াকে ফোন করে কিছু বলতে চাওয়ার আকুতির কথা। ও ব্যগ্র স্বরে বলল,
“ভাবি কীভাবে আপার মৃ’ত্যুর জন্য দায়ী! সাগর নিজেই তো মেইন কালপ্রিট।”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে বলল,
“সে একটা অংশ মাত্র অনু। এখানে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা জানি না। কিংবা জানি শুধু প্রমাণের অভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। আচ্ছা একটা কথা বলো, বিয়ের পর রাশেদ কি শুভ্রার ব্যাপারে পসেসিভ ছিল?”
অনন্যা মাথা দোলায়, “অবশ্যই। ভাইয়া কোথাও বের হলে ছায়ার মতো আপাকে আগলে রাখত। কোনো বিজনেস পার্টি বা প্রোগ্রামে আপাকে নিজের বাহুতে বন্দি রাখত। পুরুষদের কাছ ঘেসতে দিতো না। এমনকি আপার কোনো ছেলে ফ্যান যদি আবেগ প্রকাশ করত তাতেও ভাইয়া ভীষণ জেলাস ফিল করত।”
শ্রাবণ এক ভ্রু উঁচিয়ে ভাবুক চোখে চেয়ে বলল,
“যে পুরুষ তার বউকে নিয়ে এতটা পসেসিভ সে বোনের দেবরের সঙ্গে বউয়ের অন্তরঙ্গতা দেখেও তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিল! অদ্ভুত না?”
অনন্যা সম্মতি দিল। আসলেই অদ্ভুত! শ্রাবণ পুনরায় বলল, “পিয়াসা-তুষার কেমন কাপল ছিল জানা হয়নি। তুমি তো কাছ থেকে দেখেছো। বলো দেখি।”
“ঠিকই ছিল। ভাবি আমাদের একটু নিচু নজরে দেখত যদিও, কথার মাঝে তাচ্ছিল্য ছিল বেশ। তবে ভাইয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা মধুর ছিল। ভাবিকে আমরা টেককেয়ার কম করিনি। কোনো অসুবিধা যেন না হয় সবদিকে ভাইয়া খেয়াল রাখত।”
বলতে বলতে অনন্যা চমকিত হয়ে উঠল। যোগ করল, “কিন্তু আপার মৃ’ত্যুর পরই সব বদলে যায়। ভাবি সংসার ত্যাগ করে। ভাইয়াকে ছাড়তে চায়। আমাদের সঙ্গে নাকি টেকা যায় না। অথচ সে এমন কোনো ফ্যাসিলিটি নেই যা উপভোগ করেনি আমাদের বাড়িতে। এরই মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাচ্চার খবরটা এসে গেলে সংসারটা কোনোমতে একটা ছেঁড়া সুতোয় আটকে যায়। ভাইয়া সেই ছেঁড়া সুতোটাই আঁকড়ে ধরতে আমাদের ফেলে ভাবির সঙ্গে চলে যায়৷ কিন্তু ভাবি ক্রমাগত আঘাত করে করে ভাইয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা তিক্ত করে ফেলে। ভাইয়া নিরাশ হয়ে ফিরে আসে বেবি ডেলিভারির আগেই। আর ডেলিভারির নির্মমতা তো শুনেছোই। বাবা হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের মুখটা একবার দেখতে পায়নি ভাবির ইচ্ছেতেই। এরপর ডিভোর্স হয়। আমরা আর খবর রাখিনি তার।”
শ্রাবণ নিরবে সবটা শুনে গম্ভীর গলায় বলল,
“অর্থাৎ সমস্ত দ্বিধার সূচনা এক শুভ্রার মৃ’ত্যুতেই শুরু।”
অনন্যা চমকে উঠে বলল,
“আপার ফটো ভাইরাল হওয়ার বিষয়টা কিন্তু ভাবিই আমাদের সর্বপ্রথম জানিয়েছিল। না কোনো আত্মীয়, না মিডিয়া। এরপর ধীরে ধীরে ছড়ায়।”
“আই সী! রাশেদ এরপর আর তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি?”
“উহু, আপার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বড়ো ভাইয়ের মতো মানুষটার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কও যেন মিলিয়ে গেছে। তাছাড়া আপার শ্বশুরবাড়ির লোকের চোখে তো আমরা বিষ ছিলাম। তাদের অমূল্য সম্মানটা আমার আপা একাই পদদলিত করেছিল কিনা!”
তাচ্ছিল্য করল অনন্যা৷ ক্রোধে কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গ। শ্রাবণ নিজের আশঙ্কাটাকে এবার প্রকাশ করেই ফেলল।
“আচ্ছা অনু, শুভ্রার মৃ’ত্যুর আগে রাশেদ ও পিয়াসার সম্পর্কটা কেমন ছিল?”
কথাটা যেন মনের গোপনে বাজছিল অনন্যার। ও বলল,
“রসিকতাপূর্ণ। আর ভাবির যে দিকটা আমার সবচেয়ে খারাপ লাগত তা হলো আপাকে প্রায়ই খোঁচা দিয়ে বলত বড়োলোক জামাই জুটিয়ে ফেলেছে। এদিকে ভাবি আমার ভাইয়ের মতো একজন ছাপোষা স্বামী জোটাতে পেরেছে তা নিয়ে আফসোসও করত। পুরোটা মজার ছলে হলেও আমার ভালো লাগত না শুনতে।” অনন্যা একটা ঢোক গিলে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“আমি যা ভাবছি তাই কী সত্যি? ভাবি আর রাশেদ ভাই…”
অনন্যার কণ্ঠ রোধ হলো। ভাবি, ভাই বলে সম্বোধন করতেও যেন জিভে বাধছে। শ্রাবণ বুঝে বলল,
“কিছুই অসম্ভব নয় অনু। বরং এর সম্ভাবনাই বেশি।”
“অর্থাৎ আপাকে পথ থেকে সরাতে সাগরকে ব্যবহার করে রাশেদ ভাই ও পিয়াসা ভাবি এই জঘন্য কাণ্ডটা ঘটিয়েছে! তাহলে রাশেদ ভাইয়ের আপার প্রতি সেই পসেসিভনেসটা সম্পূর্ণ মিথ্যা? লোক দেখানো?”
অনন্যা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। নিশ্বাসের বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রাবণ নিজেকে সামলানোর বদলে ওকেই শান্ত করতে চাইল। সময় দিল ধাতস্থ হতে৷ এরপর বলল,
“সবটাই আমাদের ধারণা অনু। সত্যি হওয়ার চান্স ফিফটি ফিফটি। আর যদি সত্যি হয়ও তাতেও কিন্তু এসে যায় পিয়াসার খু’ন হওয়াতেই। কেননা শুভ্রাকে পথ থেকে সরাতে চাইলেও মা’রার ইনটেনশন কারো ছিল না। পিয়াসার বেলায় ওর বাড়ির কাজের লোক শুদ্ধু সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এতটা রিস্ক কেন নেওয়া হলো? তাছাড়া পিয়াসার সঙ্গে পরকীয়ার জেরেই যদি শুভ্রার সেই পরিণতি হয় তবে পিয়াসাকে স্বীকৃতি কেন দিল না রাশেদ? পিয়াসার সংযোগই বা অ’স্ত্র ব্যবসায়ী অ্যালেন অবধি পৌঁছালো কেমন করে? প্রতি পদেই দ্বিধার দেয়াল তোলা আছে। সবটা খণ্ডন করে এই গোলকধাঁধা থেকে বের করার একমাত্র উপায় এখন সাগরই।”
অনন্যা জ্বলন্ত চোখে চেয়ে তীব্র আক্রোশ প্রকাশ করে,
“একটাকেও ছাড়বে না, শ্রাবণ। আমার পুরো পরিবার ধ্বংস করে দেওয়ার পেছনে যারা আছে তারা কেউ যেন রেহাই না পায়। কেউ না।”
শ্রাবণের রুক্ষ হাতজোড়ায় যেন স্নেহ ভর করল। পরম আদরে পেলব হাতটা মুঠোয় পুড়ে আশ্বাস দিল,
“ছাড়ব না। কথা দিলাম। তোমার জীবনের সমস্ত অভিশাপ দূর হবে। শুধু ভরসার হাতটা আমার কাঁধে রাখো।”
“ভরসা আছে তোমায় প্রতি।” অনন্যার বলা এই ছোটো দুটি শব্দে যেন শ্রাবণের মনে শিশির ঝরে পড়ল।
অনন্যা ঘড়ি দেখল। রাত বাড়ছে। ফিরতে হবে ওকে। হঠাৎ মনে পড়তেই বলল,
“তোমাকে জানানো হয়নি, আমি জার্নালিজমের কোর্সে ভর্তি হয়েছি।”
“সাংবাদিক বউ পেতে চলেছি তবে!” বিড়বিড় করে শ্রাবণ। অনন্যা শুনতে না পেয়ে জানতে চাইল,
“কী বললে?”
“বলছি হঠাৎ এই পেশায় ইন্ট্রেস্ট যে?”
“অনেক আগে থেকেই। ক্রা’ইম রিপোর্টার হওয়ার ইচ্ছে।”
“বাব্বা! ক্রা’ইম রিপোর্টার! রিস্কি প্রফেশন কিন্তু।”
অনন্যা ভ্রুকুটি করে বলে,
“তুমি নিজে ক্রা’ইম রিলেটেড প্রফেশনে থেকে ভয় দেখাচ্ছো? নট ফেয়ার!”
শ্রাবণ মাথা দুলিয়ে হাসল। বলল,
“ভয় নয়, সতর্ক করছি। সাহসী, নির্ভীক রিপোর্টারদের শত্রুর অভাব হয় না। আর আমি জানি তুমি দমে যাওয়ার পাত্রী নও।”
“চেনার জন্য ধন্যবাদ। এখন আসি। গেট বন্ধ হওয়ার আগে হোস্টেলে ফিরতে হবে।”
এমন সময় শ্রাবণের ফোন বেজে উঠল। ফাহমিদা সারাদিন ছেলের খোঁজ না পেয়ে ফোন করেছেন। ফোন রিসিভ করে শ্রাবণ মায়ের বকুনিতে মনোনিবেশ করল। ভুলেও নিজের বর্তমান অবস্থার কথা জানাল না। একটু পরই বাড়িতে ফিরবে ও। চিন্তা দেওয়ার বদলে সরাসরি গিয়েই মাকে সামলে নেবে ঠিক করেছে। ও কথা শেষ করে ফোন রাখতে রাখতে অনন্যা বেরিয়ে গেছে। শ্রাবণের তখন খেয়াল হলো এই রাতের বেলা মেয়েটার একা বের হওয়াটা ঠিক হয়নি। ও বিরক্ত হয়ে ফোন করল অনন্যাকে। রিসিভ হতেই বলল,
“এত তাড়া কীসের তোমার? নিচে ওয়েট করো। আমি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”
“আমি বাসে উঠে পড়েছি, শ্রাবণ। তুমি আমাকে নিয়ে টেনশন কোরো না।”
“বাহ! জার্নালিস্ট হওয়ার আগেই তিনি সাহসের পরিচয় দিচ্ছেন! যদি কোনো ঝামেলায় পড়েছো এবার তোমার খাতিরদারি হবেই বলে দিলাম। ফোন কাটবে না। আমি লাইনে থাকব।”
অনন্যা বাসের সিটে পিঠ এলিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
“এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”
“হলে হবে। তুমি ফোন রাখবে না। আমিও বাড়ি ফিরছি। পুরো পথ গল্প করতে করতে যাব।”
সারাপথ এলোমেলো কথার পসরা মেলে রাখল ওরা। ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতায় অনন্যা কখনো রেগে লাল হয়ে গেল, কখনো সকলের সামনে ফিক করে হেসে ফেলল। কলোনিতে পৌঁছে ও বলল,
“এবার ফোন রাখো। আমি বাসার নিচে।”
প্রত্যুত্তর এলো, “আমি কী গল্প করার সঙ্গী হিসেবে এতটাই বোরিং নাকি যে ফোন রাখো, ফোন রাখো করো? উলটে আমার তো মনে হয় তুমি বেশ বোরিং।”
অনন্যা জ্বলে উঠল,
“আমি বোরিং! তুমি জানো তোমার সঙ্গে আমি যতগুলো কথা বললাম তা এক সপ্তাহেও কারো সঙ্গে বলি না।”
“দ্যাট মিনস্ আমি তোমার কাছে এক্সেপশোনাল।”
“কচু! যে কচু ধরলে হাত চুলকায়, খেলে গলা চুলকায় সেই কচু।”
অনন্যা মিটমিট করে হাসছে। ফোনের অপরপাশ থেকে শ্রাবণ তা জানল না। উলটে যেন এহেন অপমানমূলক বাক্য জীবনে শোনেনি এমন করেই চাপা চিৎকার করে উঠল। অনন্যা গেইটের সম্মুখে আসতেই একজন মাস্ক পরিহিত লম্বামতো লোক ওর দিকে এগিয়ে এলো। পোশাক দেখে বোঝা গেল ডেলিভারি বয়, মাথা ক্যাপে ঢাকা। নম্র সুরে বলল,
“ম্যাম, আপনার একটা পার্সেল ছিল।”
ফোনের ওপাশ থেকে শ্রাবণ সেটা শুনেই তড়িৎ জানতে চাইল,
“কে তোমার সামনে? এই রাতে কীসের পার্সেল?”
“ডেলিভারি বয়। ই-পার্সেল থেকে এসেছে।” লোগো দেখে বলল অনন্যা।
অনন্যার মনোযোগ লোকটির হাতে ধরা অনাহুত পার্সেলটির দিকে। স্পষ্ট মনে আছে ও অনলাইনে কিছু অর্ডার করেনি। তাছাড়া পার্সেলওয়ালা তাকে চিনবেই বা কেমন করে? বিষয়টা ঠিক লাগল না অনন্যার। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“আমার কোনো অর্ডার নেই।”
“ম্যাম, নামটা দেখুন একবার। আপনারই পার্সেল।” ডেলিভারি বয় হুট করেই অনন্যার নাকের সামনে পার্সেলটা ধরে বসল। এরপর ওর নিজের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ রইল না। চোখে নেমে এলো অদ্ভুত ঘোর। হাতের ফোনটা স্বেচ্ছায় দিয়ে দিল ডেলিভারি বয়কে। এরপর লোকটাকে অনুসরণ করে নিজেই হেঁটে হেঁটে একটা কালো প্রাইভেট কারে উঠে বসল।
চলবে…
বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৮]
প্রভা আফরিন
মানবজীবনের কিছুই পরিকল্পনামাফিক ঘটে না। আজ যা কিছু রঙিন কাল তা বেরঙ হয়ে যায় এক লহমায়। শ্রাবণ ভেবেছিল আজ রাতে আহত, ক্লান্ত শরীরটাকে সামলে উঠতে একটা শান্তির ঘুম দেবে। অথচ বাড়ি ফেরার পথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তার ঘুম উড়িয়ে দিল। কিছু রহস্যময় কথাবার্তার পর অনন্যার ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই শ্রাবণের সতর্ক মন বুঝিয়ে দিল বিপদ ঘাড়ে চেপেছে! গাড়ি ঘুরিয়ে তৎক্ষনাৎ সে আজিমপুরের পথ ধরেছে। গাড়ির স্পিডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ওর হৃৎস্পন্দন। জ্যাম ও সিগন্যাল ঠেলে রাতের দশটায় আজিমপুর কলোনিতে পৌঁছে গেল ও। হোস্টেলের সামনে গিয়ে দারোয়ানের কাছে প্রথমেই অনন্যার খোঁজ করল। দারোয়ান পরিচয় না জেনে প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করে। কিছু উশৃংখল মেয়েদের বয়ফ্রেন্ডগুলোর উদ্ধত স্বভাব থাকে। প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করে রাত-বিরেতে বিরক্ত করতে ছুটে আসে। কিন্তু যখন আগন্তুকের পুলিশ পরিচয় পেল তখন কাচুমাচু হয়ে গেল। এদিকে অনন্যা যে ঠিক কোন মেয়েটা সহসাই মনে পড়ে না। শ্রাবণ নিজ মুঠোফোনে ছবি দেখালে জানায় অনন্যা গেইট পেরোয়নি। এক লোকের সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে গেছে।
“ভালো করে জবাব দিন। নিজ থেকে গেছে নাকি তুলে নিয়ে গেছে?” শ্রাবণ ধমকে উঠল।
“সত্যি বলছি, স্যার। নিজ থেকেই গেছে। একটা লোক অনেকক্ষণ ধরেই তার জন্য গেইটের সামনে অপেক্ষা করছিল। তার সঙ্গেই চলে গেল কালো গাড়িতে।”
শ্রাবণকে দিশেহারা দেখায়। স্বেচ্ছায় গাড়িতে উঠে যাবে কেন অনু? সে স্মরণ করে ফোনকলের শেষ মুহূর্তের কথাগুলো। বিরাট অসঙ্গতি ছিল কথাগুলোতে। ই-পার্সেল থেকে ডেলিভারি ম্যান এসেছিল। কিন্তু পার্সেল অনুর ছিল না। লোকটা যখন ভালো করে দেখতে বলল এরপর থেকে অনন্যার কণ্ঠ শোনা যায়নি। কিছুক্ষণ বাদে ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। এরপর সুইচ অফ। দারোয়ানের ভাষায় অনন্যা নিজেই কারো সঙ্গে চলে গেল। এখানেই অসঙ্গতি। শ্রাবণ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“লোকটাকে খেয়াল করেছেন? ড্রেসকোড কেমন ছিল? আই মিন ডেলিভারি কোম্পানির নির্দিষ্ট ড্রেসকোড কিনা?”
দারোয়ান ছাপোষা মানুষ। কোন লোক কেমন পোশাক পরছে তা দেখে উনার কী ফায়দা! তবে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েছিল বলে সে এটুকু স্মরণ করতে পেরেছিল যে কোম্পানির লোগো খোচিত পোশাকই ছিল। ঠিক তখনই শ্রাবণের মাথায় ক্লিক করল নামটা। ডে’ড রে’প ড্রা’গ! কোনোভাবে সেটার মাধ্যমেই কাবু করা হয়েছে অনুকে? শ্রাবণের শিরা উপশিরায় যেন তরঙ্গ খেলে গেল। বুঝতে আর বাকি নেই এটা ছদ্মবেশ ছিল। সে আশেপাশের রাস্তার সিসিটিভি খেয়াল করল। সামনের দোতলা বিল্ডিংয়ের সম্মুখে একটা সিসিটিভি নজরে এলো। শ্রাবণ পুলিশ পরিচয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি চেক করার পারমিশন চাইল। কিন্তু বাড়ির কর্তা কেমন সংকুচিত হয়ে গেল। বলল,
“আসলে আমাদের সিসিটিভিটা আরো মাস দুয়েক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।”
“ফেইক সিকিউরিটি এলার্ট!” শ্রাবণের মেজাজ বিগড়ালো আরেকদফা। বের হয়ে এক বিল্ডিং পরের গেইটেই আরেকটা সিসিটিভির দেখা মিলল। আগে নিজে চেক করে নিল এক্টিভ কিনা। এরপর পরিচয় দিয়ে গৃহকর্তার অনুমতির সাপেক্ষে চেক করে নিল ফুটেজটা। একটা গাড়ি সন্ধ্যা সাতটার পরই এসে পার্ক করে রাস্তার পাশে। বেশ কিছুটা সময় পেরোতেই ই-পার্সেল এর পোশাকধারী এক লম্বা, ষণ্ডা ব্যক্তি হাতে একটা মোড়ানো প্যাকেট নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়। গাড়ি থেকে আর কেউ বের হয়নি বলে কয়জন ছিল বোঝা গেল না। তবে একা যে নয় এটুকু স্পষ্ট। সাড়ে আটটার দিকে অনন্যাকে রিক্সায় দেখা গেল। তখনই জুম করল শ্রাবণ। অনুর একহাতে ফোনটা কানে চেপে ধরা। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। কী সুখীই না লাগছিল ওকে। অথচ কে জানত কয়েক সেকেন্ড বাদেই সব উলোটপালোট হয়ে যাবে! অনন্যা কয়েক কদম এগোতেই লোকটা এগিয়ে এসে পার্সেল সংক্রান্ত কথা বলে। সেটা ফোনেই শুনেছিল শ্রাবণ। অনন্যা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে হুট করেই নাকের সামনে প্যাকেটটা ধরে লোকটা। এরপরই অনন্যা নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারায়। হেঁটে হেঁটে উঠে বসে প্রাইভেট কারে। শ্রাবণ নিজেকে শান্ত করতে চাইল। বাকিসব বিষয়ে যেই স্থিরতা, বিচক্ষণতা তার মাঝে থাকে তেমনই থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু মনের একান্ত কাছের মানুষটা বলেই বোধহয় অদ্ভুত অস্থিরতা ওকে ঘিরে ধরছে। শ্রাবণ ছুটে গিয়ে গাড়ি থেকে নিজের পেনড্রাইভটা নিয়ে আসে। ভিডিও ক্লিপটা পেনড্রাইভে ভরে নিল। গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। গাড়িতে বসে নিজের ল্যাপটপে ক্লিপটা ইনসার্ট করে একটা কপি প্রেরণ করল টিমের কাছে। গাড়ির নাম্বার ও ব্যক্তিটিকে সনাক্ত করতে নির্দেশ দিল।
সুস্থির হয়ে সিটে গা এলিয়ে দিতে না দিতেই ফোন বেজে উঠল। মায়ের ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠে একজন বলে উঠল,
“শ্রাবণ সাহেব, আমি আপনাদের প্রতিবেশী নাফিজ বলছি। কেউ বা কারা আপনার মায়ের ওপর অ্যাটাক করেছে। আমরা উনাকে ধরাধরি হসপিটালে এনেছি। আপনি প্লিজ আসুন।”
শ্রাবণের মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। বুকে অসম্ভব চাপ অনুভব করছে। যেন মায়ের ওপর নয়, তার কলিজায় কেউ আক্রমণ করেছে। এতগুলো বিপদ একইসঙ্গে কেন এলো। সাগরকে ধরার বিষয়টা নিশ্চয়ই আন্দাজ করে ফেলেছে ওরা। তাই এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রফেশনাল কাজটা যখন ব্যক্তিজীবনে হামলা করে তখন যেন শক্ত খোলসও নড়বড়ে হয়ে যায়। পাষাণ বুকেও ভীতি ছড়ায়।
_______________
ফাহমিদা আজ সারাদিন বাড়ি থেকে বের হননি। আগে চাকরি করতেন, ব্যস্ত সময় কেটে যেত। ছেলে নিজে চাকরি পেয়ে মায়ের চাকরি ছাড়িয়ে ঘরে বসিয়ে দিল। এখন একা বাড়িতে তিনি বই পড়ে, সংসার গুছিয়ে সময় কাটিয়ে দেন। উনার বাড়ি সাজানোর প্রতি একটা ঝোক আছে। ছবি আঁকার হাতও ভালো। ঝোকটা রাতে হঠাৎ মাথাচাড়া দিতেই খেয়াল করলেন ক্যানভাস পেপার শেষ, কিছু রংও নেই। ছেলে কখন আসবে সেই অপেক্ষায় বসে না থেকে তিনি বাড়ির সামনের একটা স্টোর থেকে কিছু দরকারি আঁকিবুঁকির সরঞ্জাম কিনে নেন। সময় তখন রাত আটটা। রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ একটা চলন্ত বাইক ছুটে এসে উনাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। মারাত্মক কিছু না হলেও কপাল কেটেছে, পায়েও ইনজুরি হয়েছে। আশেপাশের মানুষ ছুটে এসে ধরাধরি করে উনাকে ক্লিনিকে নিয়ে আসে। শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার পর ছেলের কাছে কাছে খবর পাঠাতে পেরেছেন। কিন্তু শ্রাবণ যখন উদ্ভ্রান্তের মতো হসপিটালে পৌঁছায় ফাহমিদার অস্থিরতা বেড়ে গেল। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ করা এ কী বিধ্বস্ত রূপ একমাত্র পুত্রের! শক্ত ধাঁচের রমনী ফাহমিদা নিজের যন্ত্রণায় না কাঁদলেও ছেলের অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন।
“শ্রাবণরে, এ কী হয়েছে তোর? কখন হলো?”
শ্রাবণ মায়ের সান্নিধ্যে অনেকটা নরম হয়ে গেল। অপরাধবোধে বুকের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বলতে পারল না মায়ের এই অবস্থার জন্য পরোক্ষাভাবে সেই দায়ী। শুধু হাত চেপে ধরে আশ্বাস দিল,
“কিছু হয়নি, আম্মু। তোমার ছেলে তোমারই মতো স্ট্রং। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
শ্রাবণের ফোনে একটা আননোন নম্বর থেকে প্রাইভেট কল এলো। এমন উত্তেজনাকর মুহূর্তে আননোন ফোনকল কীরূপ হয় সে ধারণা ওর আছে। মায়ের থেকে দূরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে স্বরের হাসির শব্দ শোনা গেল,
“ব্রাভো অফিসার! চাকরিতে নতুন নতুন জয়েনিং-এ এত ভালো পারফরম্যান্স খুব কম পুলিশই করেছে। আপনার তারিফ না করে পারলাম না।”
শ্রাবণ শক্ত গলায় বলে উঠল,
“প্রশংসা শেষ হলে একটু কাজের কথায় আসি?”
“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। অকাজে শব্দ ব্যয়ের মতো উদার আমি নই।”
“আপনার পরিচয়টা দিয়ে ফেলুন তবে।”
ওপাশ থেকে খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেল,
“পরিচয়, দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডা সবই হবে। আগে আসল কথাটা বলে নেই। আপনি বেশ বুদ্ধিমান। সাগরকে ধরেও প্রশাসনের কাছে জানাননি। গুম করে রেখেছেন। কিন্তু অফিসার বুদ্ধিটা এবার নিজের ভালোতে ব্যবহার করুন। মায়ের ওপর দিয়ে হালকা কালবৈশাখী গেল, প্রেমিকাও নাকি নিখোঁজ। তার ওপর কী কী হয়ে যেতে পারে আন্দাজ করতে পারছেন? নাকি সহ্য করতে পারবেন?”
শ্রাবণ চোয়াল শক্ত করে রইল। বলল,
“আপনি চাইছেনটা কী?”
“এটাই যে, আপনি এই কেইসটা থেকে সরে যান। তাতে আমাদের উভয়েরই মঙ্গল। কিছুদিন হলো ক্যারিয়ারের, এখনো কত প্রোমোশন, পদক পাওয়া বাকি। বিয়ে, বউ, বাচ্চাকাচ্চাও তো লাগবে জীবনে নাকি? কী দরকার ঝামেলা ঘাড়ে নেওয়ার? তারচেয়ে নিজের মঙ্গলের কথা ভাবুন। সাগর বাঁচল কী ম’রল তাতে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। আমাদের মাথা ব্যথা এখন আপনি। ভালো চান তো গর্ত খোঁড়াটা এখানেই বন্ধ করুন। এই কেইস নিয়ে ভাবা এখানেই থামিয়ে দিন। নয়তো…”
“নয়তো?”
“অনন্যা কিন্তু অসম্ভব আবেদনময়ী। চোখ ফেরাতে পারছি না। আমার সামনেই বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। ড্রা’গের মাত্রটা বোধহয় বেশিই হয়ে গেছে। হা হা!”
ফোনটা কেটে গেল। শ্রাবণ তড়িৎ ফোন করল নিজের টিমের কাছে। একটু আগে যার সঙ্গে কথা বলেছে তার লোকেশন ট্রেস করতে নির্দেশ দিল। কিন্তু উত্তর এলো এই নম্বরের লোকেশন পাওয়া যায়নি। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস দ্বারা তা গোপন করে ফোন করেছিল। এদিকে গাড়ির নেমপ্লেটটাও ভূয়া সেটাও জানানো হলো। শ্রাবণ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। লোকটা শেষের কথাগুলোতে ওর কানে যেন গরম লোহার শেক দিয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে।
______________
সময়টা শেষরাত। স্তব্ধ রুমে নিশ্বাসের উত্তেজনা ব্যতীত ভিন্ন কোনো শব্দ নেই৷ থেকে থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ মাথা চাড়া দিয়ে আবারো নিভে যাচ্ছে। টিমটিমে আলোর নিচে ঘর্মাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। নিদারুণ পরিশ্রমের পর হাঁপাচ্ছে সে। সামনেই চেয়ার উলটে নোংরা মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সাগর। ঠোঁটে কোণ কেটে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার। শ্রাবণ চুল টেনে ধরে ওকে সোজা করে বসায়। চোয়াল বরাবর আঘা’ত করে পুনরায় বলে,
“বাঁচতে চাইলে মুখ খোল।”
সাগর যন্ত্রণায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আর যদি না খুলি? আমাকে মে’রে ফেলা তো তোর পক্ষে সম্ভব না। কেইসের জন্য আমাকেই লাগবে। তাহলে জেলে কেন পাঠাচ্ছিস না?”
শ্রাবণ অধৈর্যতা সংবরণ করে। চতুর হেসে বলে,
“আমি তোকে জেলে পাঠানো মাত্রই তোর বাপের কাছে খবর যাবে। এরপর নেতা-মন্ত্রী ধরে জামিনে বের করে দেবে। ব্যাস বিপদমুক্তি। এই তো তোর পরিকল্পনা!”
সাগর জবাব না দিয়ে শ্বাপদের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। শ্রাবণ মুচকি হেসে ফোনটা পকেট থেকে বের করতে করতে পুনরায় বলল,
“কে বলেছে তোকে মা’রতে পারব না? তোর বাপের কাছ থেকেই তো সাহসটা পেয়ে গেছি। নিজের কানেই শোন।”
কল রেকর্ডের খন্ডাংশ শুনিয়ে দিল শ্রাবণ। যেখানে স্পটই শোনা যাচ্ছে সাগরের বাঁচা-মরা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। হোলস্টার থেকে পি’স্ত’ল অবমুক্ত করে তাতে সাইলেন্সার লাগিয়ে নিল শ্রাবণ। ঘাড়ের কাছটা নলের আগায় চুলকিয়ে বলল,
“তোকে আমার কাজে না লাগলে বাঁচিয়ে সমাজের আবর্জনা বাড়াব কেন বলতো? মুখ খুলবি না না?”
শ্রাবণ দাঁতে দাঁত পিষে আচমকাই সাগরের কপাল বরাবর পিস্তল ধরল। এরপর নলটা নিচু করে নিঃশব্দে সোজা ওর পায়ে গু লি করল। সাগরের বুকফাঁটা আর্তনাদে ভীত হলো রাতের শেষ প্রহর। অন্যদিকে জলন্ত বুক নিয়ে তড়পাতে থাকা শ্রাবণ হুংকার ছেড়ে বলল,
“আমার মায়ের গায়ে আঁচ লেগেছে, আমার ভালোবাসার মানুষ অনিশ্চয়তায় পড়ে আছে। আমার বুকে জ’খ’ম করেছিস তোরা। তোদের আমি ছেড়ে দেব? সবকটা গু লি তোর শরীরে বিঁধবে আজ। হয় জবান খুলবি নয়তো তোর প্রাণভোমরাকে এই নোংরা দেহ থেকে নিস্তার দেব।”
চলবে…