বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-২৫+২৬

0
486

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৫]
প্রভা আফরিন

বাহুতে গভীর ক্ষ’ত, র’ক্তের ধারা নামছে কব্জি বেয়ে। কপালে, ঘাড়ে, হাতে, পায়ে ছোটো ছোটো কিছু ক্ষ’ত সৃষ্টি হয়েছে। তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই তরুণের। ক্ষুদার্ত শিকারি তার শিকারকে নাগালে পেয়ে যেমন হিং’স্র, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, সেও বর্তমানে তেমনই রূপ ধারণ করেছে। ঈগলের ন্যায় শাণিত দৃষ্টিতে নিজের শিকারকে নজরবন্দি করে রেখেছে। অবশেষে…অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে ধরা গেছে।

জামশেদ স্তম্ভিত হয়ে আছেন। বাতাসহীন বদ্ধ ঘরে বসে ঘামে শরীর ভিজে আছে। একটু আগে যা ঘটে গেছে তাকে কোনো অ্যাকশন মুভির চেয়ে কম মনে হয়নি উনার।
সাগর সত্যিই লুকিয়েছিল বাড়িটায়। দীর্ঘদিন নারীর সান্নিধ্য না পেয়ে আসঙ্গলিপ্সায় জর্জরিত হয়ে গার্লফ্রেন্ডকে নিজ ফ্ল্যাটে ডাকে। সাদিয়ার ফোনের ওপর যে পুলিশের কড়া নজরদারি আছে সেটা আন্দাজ করতে পারেনি। সাগর নিজে পরিচয় লুকাতে ভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করলেও কথাবার্তার ধরনের ওপর আন্দাজ করেই ঢিল ছুঁড়েছিল পুলিশ। আর তা দারুণভাবে সফল। কিন্তু ট্রেস পেলেও ধরতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেছে। শাহনেওয়াজ বস্তিতেই সাগরের দেখা পায়। ধাওয়া করলে সাগর নিজের বিপদ বুঝে মড়িয়া হয়ে গেছিল। প্রথমে প্রাণপণে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু একেই ঘিঞ্জি বস্তি, তারওপর সে নিরস্ত্র। এভাবে পালাতে চাইলে ধরা তাকে পড়তেই হবে। কূটিল মস্তিষ্কে ভিন্ন পন্থা বাতলাতে বেশিক্ষণ লাগেনি। যদিও তা অধিকতর বিপদজনক। কিন্তু বাঁচতে হলে রিস্ক নিতেই হবে। সে অনেকক্ষণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় দৌড়ায়। একটি চিপাগলিতে অনেকগুলো নতুন ঢেউটিন সারিবদ্ধ করে রাখা ছিল। হয়তো কারো নতুন ঘর তৈরির জন্য। সাগর সেখানেই নিজেকে আড়াল করে দমবন্ধ রেখে ওঁৎপেতে থাকে। শাহনেওয়াজ সতর্ক পায়ে এগিয়ে তার নিকটবর্তী হতেই সাগর আকস্মিক একত্রিত টিনের সারিটা ঠেলে দেয়। ধারালো টিনগুলো শব্দ তুলে শাহনেওয়াজকে চাপা দিয়ে দেয়৷ কেটে যায় তার বাহু, কপাল, কাঁধসহ দেহের বিভিন্ন অংশ। আকস্মিক ধাক্কা ও হতবিহ্বলতায় তার হাত থেকে পিস্তল ছুটে দূরে ছিটকে পড়ে। সাগর যেন সুযোগটা লুফে নিল। তড়িৎ সেটা হস্তগত করতেই দূর থেকে জামশেদকে আসতে দেখা যায় ঘটনাস্থলে। পালানোর রাস্তা খুঁজে না পেয়ে উত্তেজিত মস্তিষ্কের ভাবনায় সাগর বস্তির এক কিশোরীকে বাহুতে বন্দি করে মাথায় পিস্তল তাক করে। ফাঁকা গু-লি ছোড়ে সতর্ক করতে।

ততক্ষণে শাহনেওয়াজ উঠে দাঁড়িয়েছে ক্ষীপ্র গতিতে। র’ক্তে ভিজতে শুরু করেছে তার গায়ের ইউনিফর্ম। তাতে সে দমে যায়নি মোটেও। বরং আক্রমণের শিকার হয়ে রাগ ও জেদ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সাগর কিশোরীকে পিস্তলের মুখে রেখে পুলিশকে হুমকি দিল দূরত্ব রাখতে। তাকে এখান থেকে বেরোতে না দিলে মেয়েটিকে সে তুরন্ত শ্যুট করবে। বস্তিবাসীর চিৎকার, কান্নাকাটিতে ভরে উঠেছে চারপাশ। জিম্মি কিশোরীর মুখ ভয়ে সাদা। অবস্থা বেগতিক বুঝে শাহনেওয়াজ দুই কদম পিছু হটে যায়। তা দেখে সাগরের চোখে আশার আলো উঁকি দেয়। কিন্তু সে জানত না মাঝে মাঝে বড়ো ঝাপ দিতে হলে কয়েক কদম পেছাতে হয়। চরম উত্তেজনা বুকে চেপে শাহনেওয়াজ একটা মুগ্ধ হাসি দিয়ে শত্রুকে বিভ্রান্ত করে দিল। সেই সুযোগটা লুফে নিলেন কিছুক্ষণের জন্য সীনের বাইরে চলে যাওয়া জামশেদ। অন্যদিক থেকে পা টিপে টিপে শিকারের কাছাকাছি পৌঁছে যান তিনি। সাগরের মনোযোগ সরতেই তড়িৎ ওর হাত বরাবর গু লি করলেন। পিস্তল ছিটকে পড়তেই সাগর আর্তনাদ করে ওঠে। শাহনেওয়াজ ও জামশেদ উভয়েই ছুটে এসে ধরে ফেলে তাকে। কিশোরীকে নিরাপদে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়ে এই আতঙ্কিত পরিবেশ তৈরি করার জন্য নতশিরে দুঃখ প্রকাশ করতেও ভোলে না ওরা।

বন্ধ ঘর, চারিদিকে গুমোট গন্ধ। বাইরে থেকে একফোটা আলো-বাতাস ঢোকার জায়গাটুকুও যেন নেই। একটা হলুদ বাতি জ্বলছে সিলিংয়ে৷ তারই নিচে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে সাগর। ভারী দেহের লম্বাটে যুবক অব্যক্ত ক্ষো’ভে কুইকুই করছে। তার সামনেই চেয়ারে বসে আছে শাহনেওয়াজ। যার দেহের ক্ষত এখনো বিনা চিকিৎসায় রয়েছে। জামশেদ বারবার বলছেন তাকে হাসপাতালে যেতে। কিন্তু তীব্র জেদ যেন এখনো টগবগ করছে তরুণের গায়ে। চোয়ালে ধূর্ত হাসির সঙ্গে লেগে আছে সেই ক্ষোভের ঝাঁঝ। সাগরের মুখোমুখি একটা কনভারসেশন না হলে সে হাসপাতালে যাবে না।
শাহনেওয়াজ পরম তৃপ্তির সঙ্গে বলল,
“অবশেষে সব ঘটনার কান আমাদের হাতে!”

সাগর তীব্র রাগের সঙ্গে বলল,
“আমাকে কেন ধরে এনেছেন? আমার অপরাধ কী?”

“কেন ধরেছি তুই জানিস না? না জানলে গা ঢাকা দিয়েছিলি কেন? আর পালালিই বা কেন? এই ফিল্ডে এত কাঁচা অভিনয়ের ভাত নেইরে ছাগল সরি সাগর।”

রসিক স্বরে বলল শাহনেওয়াজ। পাশ থেকে জামশেদ দাঁত বের করে হাসতে লাগল। অপমানে, ক্ষোভে সাগর ফুঁসতে লাগল। জানতে চাইল,
“এটা তো জেল নয়। কোথায় এনেছেন আমাকে?”

“জেল দেখি ভালোই চিনিস। এটা জেল নয়। অ’প’রাধীদের বদ্ধভূমি। তোকে জেলে নিয়ে তোর বাপকে সতর্ক করে দেওয়ার মতো বোকা আমাদের মনে হয়! এত সোজা! কে তোর বাপ? জন্মদাতা নয়, অ’প’রাধের পালকপিতার কথা বলছি।”

“এসএন শিকদার, আপনি খুব বড়ো ভুল করছেন…”

জামশেদ তার উদ্ধতপনা সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে দুটো ঘু’ষি ক’ষিয়ে দিয়ে বলল,
“সঠিকটা তাহলে বলে দে। পিয়াসাকে তুই-ই তো মে’রেছিস।”

“আমি মা’রিনি।” সাগর একই ক্ষোভে বলে উঠল।

“আচ্ছা! এখন বলবি পরিচয়ও ছিল না, ওর ফ্ল্যাটে তোর যাতায়াতও ছিল না?”

বলে জামশেদ আবারো হাত তুলতে গেলেন।
শাহনেওয়াজ তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করে বলল,
“তোর ডিএনএ আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলেই প্রমাণ হয়ে যাবে তুই কতটুকু নির্দোষ। এরপর থেরাপি কতপ্রকার হাড়েমজ্জায় টের পাবি। আচ্ছা সে কথা নাহয় সাইডে রাখলাম এখনকার জন্য। আস্তেধীরে সব হবে। এখন বল শুভ্রার সঙ্গে ঠিক কী করেছিলি তুই?”

সাগরের মুখে এবার ভড়কে যাওয়ার অভিব্যক্তি নজরে এলো। যেন তীর নিশানা ভেদ করেছে। এসএন শিকদার রহস্যময়ী স্বরে বলল,
“নির্দোষ শুভ্রাকে তো তোরাই ফাঁসিয়েছিলি। তোর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত ছিল। শুভ্রা তোদের কী ক্ষতি করেছিল বল দেখি?”

সাগর অস্থির দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“শুভ্রা আ’ত্মহ’ত্যা করেছিল। এখানে আমার কোনো দায় নেই।”

“অবশ্যই আছে। ওকে ড্রা’গ দিয়ে, বেহুশ করে তুই-ই তো ধ’র্ষ’ণ করেছিলি। যেমনটা করেছিস পিয়াসার সঙ্গেও। অ্যাম আই রাইট?”

সাগরের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখা গেল। শাহনেওয়াজ বুঝল সে সঠিক পথেই আছে। সে ঝুকে এলো। কোমল, আশ্বাসের স্বরে বলে উঠল,
“দেখ সাগর, বুদ্ধিমানের মতো চিন্তা কর। সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে তুই-ই অ’পরা’ধী। কিন্তু আমার বিশ্বাস এসবের পেছনের ঘটনা আরো বর্ধিত। প্রকৃত অ’পরা’ধী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। মাঝখান দিয়ে তুই ছাগলটা ফেঁসে যাবি। কোর্টে চালান করে দিলে ফাঁ’সিটা তোরই হবে। তাই বলছি আমাদের কথা শোন। তুই যে আমাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিস সেটা বাইরের দুনিয়ার কাকপক্ষীতেও জানে না। জানবেও না। তোকে ফুল প্রটেকশন দেওয়ার নিশ্চয়তা আমার। তুই শুধু সত্যিটা বলে দে।”

কথা শেষ করে শাহনেওয়াজ নিগূঢ় চোখে চেয়ে রইল। সাগরের মধ্যে তীব্র দ্বিধাদ্বন্দ্বের যু’দ্ধ লেগেছে সে টের পাচ্ছে।
_______________

সাগরকে ধরা হয়েছে এই খবর কোথাও আপাতত লিক করা হয়নি। তাতে মূলহোতা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। সাগরের সঙ্গী জহির ও সাদিয়াকেও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তবে বস্তির সাময়িক অস্থিরতা মিডিয়ার কানে পৌঁছাতে সময় লাগেনি। সেখানে এই বলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে যে মা’দ’ক ব্যবসায়ীদের ধাওয়া করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে বিপুল বি’স্ফো’রক থাকায় বস্তিবাসীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় পুলিশ পিছু হটেছে। সম্পূর্ণ টিম নিয়ে আজই তাদের পুনরায় ঘেরাও করা হয়েছে। এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মে’রে দিয়েছে শ্রাবণ। এই বস্তিতে মা’দকের কারবার চলছিল সেই তথ্য তাদের কাছে ছিল। সুতরাং এই ঘটনায় সাগরের কথা যেমন আড়াল করা হলো তেমনই টিমকে দিয়ে একটা অভিজানও চালানো হলো। তাতে কারো সন্দেহও রইল না।

সিএমএইচ হসপিটালের বেডে বসে শ্রাবণ অনন্যাকে কল করল। সে খেয়াল করেছে হুট করেই মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলছে। যখন সে ইঙ্গিতে মজা করত তখনও এমন নির্লিপ্ততা দেখা যায়নি। তবে এখন কী হলো! ভেবেই ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হচ্ছে সে। টানা চতুর্থবার ধৈর্যের সঙ্গে ফোন করল ও। এবার না ধরলে একটা হেস্তনেস্ত ঘটাতেই হবে। ভাগ্য সহায় ফোনটা রিসিভ হলো। অনন্যাকে সামান্যতম বাক্য ব্যয় করতে না দিয়ে শ্রাবণ বলল,
“লিসেন অনু, আমি প্রেমের আলাপ করতে ফোন করিনি। এখন যেটা বলব চুপচাপ শুনবে। ঘুণাক্ষরেও মুখ থেকে শব্দগুলো রিপিট করবে না। নিজের মাঝে চেপে রাখবে।”

“কী সেটা?” অনন্যা যেন থমথমে স্বরে জবাব দিল।

“সাগরকে ধরে ফেলেছি।”

“কী!” অনন্যার চাপা চিৎকার ভেসে এলো স্পিকারে।

শ্রাবণ ধমকে উঠল,
“বললাম না চেপে রাখতে হবে! তোমার বাড়ির দেয়ালও যেন বুঝতে না পারে।”

“আচ্ছা, কিছু জানতে পেরেছো?”

শ্রাবণের কন্ঠ এবার দুর্বল হয়ে এলো। যেন সে সত্যিই এবার ভীষণ ক্লান্ত। বলল,
“ফোনে এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না। তাছাড়া আমার কন্ডিশন এখন খোশগল্প করার মতো নয়।”

“কী হয়েছে তোমার?”

“সাগরকে ধরতে গিয়ে যে কসরত হয়েছে তার ফলস্বরূপ সিএমএইচ হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। তাতে কী! তোমার তো তদন্তের অগ্রগতি জানা নিয়ে কথা। বেঁচে থাকলে আমিই গিয়ে জানিয়ে আসব।”

বলে শ্রাবণ কালবিলম্ব না করে কল কেটে দিল। বাইরে অবস্থানরত এক কনস্টেবলকে ডেকে নির্দেশ দিল,
“খাবারের ব্যবস্থা করুন। আমার ভিআইপি মেহমান আসবে আজ।”

চলবে…

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৬]
প্রভা আফরিন

একটা সময় ছিল যখন অনন্যার দুচোখ ভরা আহ্লাদী জলের ফোয়ারা ছুটত। সকলের ছোটো ও আদরের হওয়ায় সামান্য চিমটি, ধমক খেলেও কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিতো। সময়ের পরিক্রমায় সেই অশ্রুসাগরের জল এখন উপচে পড়ে না৷ আপন মানুষের কষ্টে সমান কষ্ট পেলেও হাউমাউ করে কেঁদে প্রকাশ করতে জানে না। তবে শ্রাবণের শরীরের এই করুণ দশা দেখে অনন্যা খুবই ব্যথিত হলো। সারা গায়ে যেন কোনো হিংস্র প্রাণী আঁচড় কেটে গেছে। রোদে পোড়া উজ্জ্বল ত্বকে খয়েরী রঙা ক্ষতগুলো জ্বলজ্বল করছে। বাহুতে মোটা ব্যান্ডেজ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কিঞ্চিৎ দুর্বলতা তাকে পেয়ে বসেছে। ক্লান্ত দেহটি যেন পরম মমতায় একটু আরাম পেতে বিছানায় লুটিয়ে আছে। শক্ত ব্যক্তিত্বের দুর্বল চেহারা মনে নাড়া দেয় বৈকি। অনন্যা পাশে বসে নরম স্বরে বলল,
“ইশ! কী অবস্থা হয়েছে! এখন কেমন আছো?”

শ্রাবণ নিরবে মেয়েটিকে দেখে। খাদি কটনের খয়েরি সালোয়ার কামিজ পরনের এই সুশ্রী রমনীর মেয়েলি গন্ধ কেবিনের গুমোট গন্ধকে দূর করে দিয়েছে যেন। শ্রাবণ প্রাণভরে শ্বাস নেয়। উদগ্রীব চোখে তার শান্ত মুখখানিতে মমতা, মায়া, আবেগের অনুসন্ধান করে ব্যর্থ হয়ে জবাব দিল,
“সেই খবর কে রাখতে চায়? দরকার ছাড়া তো আমার সঙ্গে কারো লেনা-দেনা নেই।”

যেন খানিক অভিমানই উঁকি দিল কথার মাঝে। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই রমনীর কোনো ভাবান্তর হলো না। অনন্যা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে।
“কেন? রিমি আসেনি দেখতে? দরকার ছাড়া আবেগের লেনা-দেনা তো তারই করার কথা।”

দুজন মানুষের মিষ্টি খুঁনসুটিতে তৃতীয় ব্যক্তির নাম ওঠায় শ্রাবণ চমকে উঠল। অনন্যা কীভাবে জানল রিমির কথা! সমীকরণ মিলতে অবশ্য বেশিক্ষণ লাগল না। শ্রাবণের বারন সত্ত্বেও ফাহমিদা গেছিলেন রিমিদের বাড়ি। শ্রাবণ অবশ্য মিটিং-ব্রিফিংয়ের দোহাই দিয়ে সরে পড়েছে। ফাহমিদা রিমিকে দেখে এসে একবার বাপের বাড়িতেও ঘুরে এসেছে। সেখানে নিশ্চয়ই গালভরে গল্প করেছে ছেলের বিয়ে দেওয়া নিয়ে! প্রতিবেশীর বাড়িতে সে খবর পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। অনন্যা সপ্তাহান্তে বাড়ি গিয়ে হয়তো সব শুনেও ফেলেছে। আচ্ছা! এই জন্য নারীর এত নির্লিপ্ততা তার প্রতি! এত অবহেলা ক’দিন ধরে! শ্রাবণ অতিকষ্ঠে নিজের হাসিটা চেপে গেল। বলল,
“বাড়ির কাউকে তো এখনো জানাইনি। মায়ের হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস। বললে উত্তেজিত হয়ে পড়ত। বাড়িতে বউ নেই যে মাকে সামলাবে। আমিও সামলানোর অবস্থায় নেই। তাই গোপন করে আছি। জানলে হয়তো রিমি ছুটে আসত।”

“রিমিকে ঘরে তুলে নাও তবে। আন্টিকে সামলাবে।”

শ্রাবণ ক্রুর চোখে চাইল। পালটা বলল,
“শফিকের সঙ্গে কতদূর এগোলো?”

“কী এগোবে?” অনন্যা আকাশ থেকে সদ্য ভূপতিত হলো যেন।

“ন্যাকা! তুমি বুঝি জানো না ওই বদ ব্যাটা তোমাকে কোন নজরে দেখে?”

অনন্যার মেজাজ খারাপ হলো। তাকে ন্যাকা বলা হচ্ছে! বিরক্ত গলায় জবাব দিল,
“তুমি কীভাবে জানলে?”

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শ্রাবণ শুধু রহস্যময় একটা হাসি দিল। মূলত হাবীবকে ধরার পর থেকেই অনন্যাকে কিছুটা চোখে চোখে রেখেছিল ও। তাতেই এই শফিক নামের এলাচিটা নজর কাড়ে। কে জানে আর কত স্থানে এই রমনীর গুণগ্রাহী ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ভালো জিনিসের কদর তো বেশি হবেই। তাকে যত দ্রুত নিজের অধীনে আনা যায় ততই মঙ্গলজনক। শ্রাবণ মৌনতা তিরোহিত করে বলল,
“এসব আহামরি গোপন খবর নয়। তারচেয়ে আমার প্রশ্নের জবাবটা দাও শুনি।”

“কেউ পছন্দ করলেই তার সঙ্গে এগোতে হবে এতটা ঠুনকো ব্যক্তিত্ব বোধহয় আমার নয়! সেক্ষেত্রে বলতে হয় তুমি আমাকে চেনোনি।”

গাঢ় চোখে চেয়ে একই স্বরে জবাব করল তরুণ ডাটিয়াল অফিসার,
“ঠিক তেমনই কারো সঙ্গে বিয়ের কথা উঠলেই সোনামুখ করে তাকে বিয়ে করে নেব এমন ঠুনকো ব্যক্তিত্ব আমার নয়। এসএন শিকদার তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সঙ্গে প্রিয় মানুষকেও মর্যাদা দিতে জানে। সেক্ষেত্রে বলতে হয় তুমিও আমাকে চেনোনি।”

কথার সমাপ্তিতে দুটো ভ্রুতে ঢেউ তুলল শ্রাবণ। জোকের মুখে নুন পড়ার মতোই অনন্যা চুপসে গেল। সে আসলেই এই ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছিল। মামাবাড়ি গিয়ে যখন শুনল শ্রাবণের বিয়ের তোড়জোড় চলছে, পাত্রী দেখাও হয়েছে তখন এক মুহূর্তের জন্য অনন্যা ভেবেই নিয়েছিল শ্রাবণ বোধহয় ওর সঙ্গে মশকরা করেছে বিগত দিনগুলোতে। অনন্যার বর্তমান পরিস্থিতি তাকে পুরুষের যে রূপ ক্রমাগত পরিচয় করিয়ে চলেছে তাতে শ্রাবণও ওকে তেমনই পেয়ে বসেছে ভেবে রাগও হয়েছিল। তবে এই বাক্যগুলো ওর মনের সেসব রাগ যেন খানিকটা দমন করতে সাহায্য করল। পেলব গালে ফুটতে শুরু করল জড়তার গাঢ় রং। শ্রাবণ তা দেখতে দেখতেই হাত নাড়াতে গিয়ে “আহ!” করে উঠল। অনন্যা সচকিত হয়ে বসা থেকে উঠে দিশেহারা চোখে বলল,
“কী হলো? কোথায় ব্যথা?”

হাসপাতাল দেখলেই যেন অসুস্থতা বেড়ে যায়। নয়তো সাগরকে ধরা, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও এমন যন্ত্রণা অনুভব হয়নি শ্রাবণের। কিন্তু এই ক্ষণে গায়ের ব্যথা যেন বাড়ছে। তবে অনন্যার উদ্বেগে ঠাসা চোখদুটি দেখতে ভালোও লাগল ভীষণ। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,
“বুকে ব্যথা।”
“বুকে! ডাক্তার ডাকব?”

অনন্যা যেতে উদ্যত হলে শ্রাবণ খপ করে ওর হাত মুঠোবন্দি করে ফেলল। বলল,
“সব ব্যথার উপশম ডাক্তার জানে না। তুমি একটু হাত রাখলেই কাজ হবে আশাকরি।”

অনন্যা কটমট করে চাইল। ব্যথায় কপাল কুচকেও দুষ্টুমির সুযোগটা ছাড়ল না অসভ্যটা। ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে বলল,
“হাসপাতাল বলে বেঁচে গেলে।”

“তোমার সাহস তো কম না। পুলিশকে হুমকি দিচ্ছো?” শ্রাবণ অবাক চোখে চায়।

“সাহসের দেখেছো কী? শান্ত থাকি বলে গরম হতে জানি না ভেবো না। টিনেজ আমি কেমন ছিলাম ভুলে গেছো!”

“ভুলি কেমন করে। সর্বনাশের শুরুটা তো সে সময়ই হয়েছিল।”
অনন্যা চমকে উঠল, “বলতে কী চাইছো?”
“বলছি যে, আমার হোম মিনিস্টার হওয়ার সাহসটা কেন করতে পারছ না?”

শ্রাবণের ঠোঁটে ক্রমশ দুষ্টু হাসি প্রসারতা লাভ করতে থাকে। অনন্যা এদিক ওদিক চেয়ে যুতসই উত্তর না পেয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,
“ভালো হবে না কিন্তু। আমি এখানে রসিকতা করতে আসিনি।”

শ্রাবণের মেজাজ খারাপ হলো। যতবারই সে হৃদয়ের উষ্ণতা প্রকাশ করে ধুরন্ধর মেয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে দিতে চায়। বারবার ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে! শ্রাবণ শক্ত গলায় বলল,
“চালাকি করে আমার সব কথাকেই রসিকতার দলে ফেলে দিতে চাওয়াটা কোন ধরনের রসিকতা শুনি? তোমার কী আমাকে টিনেজ মনে হয়? আমি একজন পূর্ণবয়স্ক সচ্চরিত্রবান পুরুষ। হেয়ালি করার বয়সটা ফেলে এসেছি। এখন যাই করব সিরিয়াস হয়েই করব। অদূর ভবিষ্যতের কথাটাও তো ভাবতে হবে নাকি!”

“ভাবো, আমাকে কেন জড়াচ্ছো?”
অনন্যা অন্যদিকে ফিরে বলল। শ্রাবণ বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল। লাফ দিয়ে বসে ক্ষ্যাপাটে স্বরে বলল,
“তুমি বুঝি সংসারধর্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনী হতে চাও?”

অনন্যা থতমত খেয়ে গেল, “তা হতে যাবে কেন?”
“তাহলে তোমাকে নিয়ে ভাবতে অসুবিধা কোথায়? নাকি আমাকে পছন্দ না?”
“তেমন কিছু নয়, শ্রাবণ।”
“তবে কেমন কিছু?”

অনন্যা মুখ নামিয়ে ফেলল। যেন সে এই কথা-পাল্টা কথার আসরে পরাজিত সৈনিক। লম্বা শ্বাস ফেলে ক্লান্ত স্বরে বলে,
“আমি তোমাকে কী করে বোঝাই, শ্রাবন…”

শ্রাবণ বেড থেকে নেমে এলো। অনন্যার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর দুটো হাত শক্ত করে ধরে ধীর স্বরে বলল,
“তুমি আদনানের দেওয়া প্রত্যাখ্যান ভুলতে পারোনি, অনন্যা। নতুন কোনো সম্পর্কের কথা ভাবলেই তোমার মনে শঙ্কা জাগে। তোমার অবস্থান, পারিবারিক সংকট, শুভ্রার সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়েও তুমি ভীত। পাছে কেউ এই অজুহাতে আবারো তোমার হাত ছেড়ে দেওয়ার সাহস করে, তাচ্ছিল্য, অপমান করার সুযোগ পায়। সেই হীনমন্যতা তোমায় নিজের মাঝে গুটিয়ে রাখে। নতুন করে কাউকে ভরসা করতে দৃঢ়তা দেয় না।”

অনন্যা বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। শ্রাবণের বলা প্রতিটা কথাই সত্যি। এইসব আশঙ্কা তাকে ভেতরে ভেতরে সর্বদা হীনমন্য করে রাখে। ও বলল,
“তুমি আদনানের কথা কীভাবে জানলে?”

শ্রাবণ কাঁধ ঝাকিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“তোমার ব্যাপারে আমি সব জানি।”
“হিরোগিরি না করে সত্যিটা বলো।”
শ্রাবণ হার মেনে নিয়ে বলল,
“আমার হলেও হতে পারে শালিকা বলেছে।”
“আচ্ছা! ভেতরে ভেতরে তাহলে ভালোই যোগাযোগ রাখা হচ্ছে! আমাকে নিয়ে গবেষণাও করা হচ্ছে!”

“গবেষণার ফলাফল কিন্তু মিথ্যা নয়। তোমার অতীত নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, অনু। বরং তোমার জন্য কষ্টের হলেও আমার জন্য ভালোই হয়েছে। একজনের শ্বাপে আরেকজনের বর। নয়তো তোমার ভাষায় এইসব রসিকতা কোত্থেকে আসত বলোতো! তুমি এসব হীনমন্যতা ছেড়ে একটু ভরসা করতে পারো না আমায়? কথা দিচ্ছি, তোমাদের হারানো সম্মান খুব শীঘ্রই ফিরিয়ে দেব। সকলের বাঁকা দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে তোমরা। আপন গৌরবে এগিয়ে যাবে। কোনো অপমান, অবজ্ঞা, দয়া তোমায় ছুঁতে পারবে না।”

অনন্যা মৌন দৃষ্টিতে শ্রাবণের আশ্বাসী চোখে চেয়ে থাকে। এমন সময় দরজা ঠেলে জামশেদ ঢুকলেন। হাতে খাবারের প্যাকেট। তিনি ঢুকেই শ্রাবণ ও অনন্যাকে হাত ধরাধরি করে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল শ্রাবণ ও অনন্যাও। শ্রাবণ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হাঁটুতে টান পেল। কোনোমতে বেডে বসে বিরক্ত স্বরে বলল,
“আসুন অফিসার। কোনো দরকারে?”

জামশেদ ঠোঁটে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি এঁটে বলল,
“আপনার ভিআইপি মেহমানের জন্য খাবার আনতে পাঠিয়েছিলেন শুনলাম। আমিই নিয়ে এলাম। বোধহয় ভিআইপি মোমেন্টে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। স্যরি!”

জামশেদ দ্রুত খাবারের প্যাকেটটা রেখে প্রস্থান করলেন। অনন্যা যারপরনাই বিব্রত। সেটা ঢাকতে প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
“সাগরের আপডেট জানা হলো না।”

শ্রাবণ ভাবলেশহীন স্বরে বলল,
“আপাতত আমার পেটের আপডেট শোনো। ওই সাগর নামের পচা পানা পুকুরকে ধরতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া হয়নি। এখন খাবার দেখে খিদেয় ম’রে যাচ্ছি। এসো, খায়িয়ে দাও।”

অনন্যা অষ্টম আশ্চর্য কিছু দেখে ফেলেছে এমন দৃষ্টিতে চাইলো। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“আবদারের কী বাহার! খায়িয়ে দাও!”

শ্রাবণ তার ডান হাত মেলে ধরে দেখালো। গায়ের ওপর থেকে টিন সরাতে গিয়ে কব্জির কাছে, আঙুলের ওপরও আঁচড় পড়েছে। অসহায় মুখ করে বলল,
“খেতে কষ্ট হবে।”
“চামচ দিয়ে খাবে।”
“বাহুতে চোট, ধরে রাখতে কষ্ট হবে। থাক তোমার যেহেতু মায়া হয় না, চলে যেতে পারো। আমার জন্য তোমার কষ্ট হবে এটা মানতে পারব না। আমি কোনোমতে কিছু গলাধঃকরণ করে নেব।”

শ্রাবণ গাল ফোলানো বাচ্চাদের মতো মুখ ঘুরিয়ে রইল। অনন্যা দ্বিধায় পড়ে গেল। তবে শ্রাবণের বর্তমান অবস্থাকেও হেলা করতে পারল না। এখানে যে এই বদ পুলিশের কিছু কারসাজি এটাও সে আন্দাজ করতে পারে। তাই সেও কৌশল অবলম্বন করল। শ্রাবণকে খায়িয়ে তো দিল, তবে চামচে করে। দূরত্বও রইল, আবদারও পূরণ হলো। শ্রাবণের মুখটা তখন এমন হলো, কেউ যেন তাকে আদর করে চামচ ভরে তেতো করলা খাওয়াচ্ছে। না পারছে মানা করতে, আর না সন্তুষ্ট হচ্ছে। তবুও সান্ত্বনা, মেয়েটি তার জন্য একটু তো ভাবছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে