বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৩]
প্রভা আফরিন
একটা লুকোচুরি থেকে হুট করে পর্দা সরে গেলে মানুষ যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, অনন্যাও তেমনই বাকহারা হয়ে পড়েছে। অনিবার্য বিপদের মধ্যে হুট করে রক্ষা পাওয়ার উপায় পেয়ে সে যেন ক্ষণিকের জন্য নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। নয়তো হুশ, জ্ঞান, পরিস্থিতি, অবস্থান ভুলে কেন শ্রাবণেরই কাঁধ বেছে নেবে অশ্রু ঝরাতে! ধুরন্ধর পুরুষটি কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে একদমই ছাড়েনি। শত্রুর দিকে বুলেট নিশানা করে একহাতে জড়িয়ে ধরা রমনীর কানে ঢেলে দিয়েছে হৃদয়ের গোপন বাসনা। এতটুকু ইঙ্গিত না বোঝার মতো বোকা অনন্যা নয়। বিপত্তিটা এখানেই। একটু দৃষ্টি বিনিময় কিংবা একটু দেখার মাঝে যে গোপন লুকোচুরি চলছিল তা আজ মেঘমুক্ত আকাশের মতোই পরিষ্কার। অনন্যা নিজেকে সামলে নিয়ে ভেবেছিল না বোঝার ভান করবে। কিন্তু স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য তাকে ধরাশায়ী করে দিল। লজ্জা, সংকোচ, আড়ষ্টতায় ও ঠিকমতো তাকাচ্ছেও না শ্রাবণের দিকে। ইতুটা সকালে যা বলল তাই যেন মিলে গেল।
শ্রাবণ নিবিষ্ট মনে ড্রাইভ করছে। ভাবখানা এমন যে পিকনিক করে প্রফুল্লচিত্তে বাড়ি ফিরছে। এই রোমাঞ্চকর নৈশব্দ অনন্যাকে অস্বস্তি দিচ্ছে বলেই ও গলা ঝেড়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“ওই লোকটাকে কোথায় পাঠালে?”
যেন একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা উঠল, শ্রাবণ এমনই ভঙ্গিতে বলল,
“মামাবাড়ি পাঠিয়েছি। একটু খাতির যত্ন করতে হবে তো!”
অনন্যা দৃষ্টি খাটো করে বলল,
“ভালোই খাতিরদারি শিখেছো দেখছি!”
শ্রাবণ যেন একটু অসন্তোষের সঙ্গে তীক্ষ্ণ স্বরেই বলল,
“যেমন পেশা তেমনই শিক্ষা। এখন মনে হচ্ছে তোমারও একটু খাতিরদারি করা উচিত। কেয়ারলেস কোথাকার!”
অনন্যা ভড়কে গেল, “আমার?”
“অবশ্যই। বিপদ পেছনে লাগিয়ে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়ানোর জন্য কঠিন খাতিরদারি প্রয়োজন তোমার। ভাবতে পারছো কী থেকে কী হতে পারত! সামান্য একটা ছু’রি সঙ্গে রেখে মুশকিল আসান করে ফেলবে ভেবেছিলে! জানো ছু’রি চালানোর কৌশল?”
অনন্যা চুপসে গেল। ছু’রি সে মোটেও চালাতে পারত না। ঘাবড়ে গিয়ে ঘামে হাত ভিজে একাকার হয়ে গেছিল। ওই অবস্থায় ছু’রি চালানোর সাহস করলে নিতান্তই ছেলেমানুষী তো হতোই পাশাপাশি বিপরীত পক্ষ আরো আ’ক্র’মণাত্মক হয়ে উঠত। কিন্তু অনন্যারই বা কী করার আছে! কেউ পিছু নিয়েছে সন্দেহ লাগছিল কিন্তু তাই বলে ঘরে বসে থেকে আতঙ্কবিলাস করলে তো দিন চলত না। তাকে তার প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেই হতো। শ্রাবণ ড্রাইভিং এর ফাঁকে এক পলক চেয়েই যেন অভিব্যক্তি বুঝে ফেলল। বলল,
“অন্তত আমাকে জানাতে পারতে। আজ যদি আমি এই রোড ধরে না যেতাম! আগামীকাল নিউজ হেডলাইন হতে পারতে।”
অনন্যা হেসে দিয়ে বলল,
“কিন্তু তুমি আজও এঞ্জেলের মতো এসে গেছো।”
“আজও মানে? আগে কবে?”
“আগেরবার যেদিন ফোন করে আপার ব্যাপারে কথা বলতে ডেকেছিলে। সেদিন তো হাবীবেরর আস্তানাতেই ছিলাম। তার মেয়েকে পড়াতে গিয়ে দেখি বাড়ি ফাঁকা। নেহাৎ তুমি ফোন দিয়েছিলে বলে পুলিশের আত্মীয় ভেবে রক্ষা।”
শ্রাবণ তিরস্কারের স্বরে বলে উঠল,
“চমৎকার! আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিন, তখনও আমাকে কিছু জানাওনি।”
অনন্যা মিনমিন করে বলল,
“ভেবেছিলাম ওইটুকুতেই থেমে যাবে।”
“কেন থামবে? পুলিশের আত্মীয়ের পরিচয়ে! অবশ্য এটা মন্দ নয়। আমার আত্মীয় হতে চাইলে আপত্তি করব না।”
আবারো কৌশলে শব্দের ব্যবহার! অনন্যা চুপ করে রইল। হোস্টেলের সামনে গাড়ি এসে থামতেই ও নামতে দেরি করল না। অদ্ভুত তাড়াহুড়া আজ মেয়েটির সর্বাঙ্গে। কোনোমতে বিদায় নিয়েই ছুটে গেইটের আড়াল হয়ে গেল। একলা গাড়িতে বসে শ্রাবণ নিঃশব্দে একটু হাসল শুধু।
______________
শ্রাবণ আজ অন্যদিনের তুলনায় দ্রুত বাড়ি ফিরেছে। এমনকি মেজাজও বেশ ফুরফুরে। কোনো রকম অনিয়ম ছাড়া সকল কার্য সম্পাদন করছে। ফাহমিদা সন্দিগ্ধ চোখে তাকে পপর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“কী ব্যাপার রে? আজ হঠাৎ এত খুশি কেন? কোনো জটিল কেইস সমাধান হলো নাকি?”
শ্রাবণ নিজেকে সামলে নিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। গম্ভীর হয়ে বলল,
“ভীষণ জটিল। তবে হচ্ছে আস্তেধীরে। কাজ কী আর একটা!”
“কিন্তু কোনো একটা কাজের জন্যই তো এই মিটিমিটি হাসি। সেটা কোনটা?”
শ্রাবণ থতমত খেয়ে বলল, “তেমন কিছু নয়, আম্মু।”
ফাহমিদা বুঝলেন ছেলে এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। ওর প্রফুল্লতা ভালো লাগছিল বলে তিনি কোনোরূপ জেরা করলেন না। স্বামীর মৃ’ত্যুর পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে গোটা জীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। সমস্ত শ্রম ব্যয় করেছেন সন্তানকে মানুষ করতে। শ্রাবণ আজ প্রতিষ্ঠিত। যদিও ফাহমিদার একদম ইচ্ছে ছিল না ছেলে পুলিশ হোক। হঠাৎ মনে পড়ল এমন ভঙ্গিতে তিনি বললেন,
“শোন, সামনের শুক্রবার ফ্রি থাকবি।”
“কেন?” প্রসঙ্গে বদলে শ্রাবণও যেন হাঁপ ছাড়ল।
“আমার বান্ধবীর মেয়ে রিমিকে তোর মনে আছে? ছোটোবেলায় একসঙ্গে পড়েছিস।”
“মনে আছে।”
“ওরা ঢাকায় এসেছে। দাওয়াত করেছে আমাদের। তুই অবশ্যই যাবি আমার সঙ্গে। রিমি এখন ব্যাংকে জব করছে। এত সুন্দর দেখতে হয়েছে না মেয়েটা। ফোনে আমার সঙ্গে এত আপনভাবে কথা বলল যে মনেই হলো না অনেকদিন বাদে কথা বলছি। তোর কথাও জানতে চাইল। মেয়েটা ভীষণ মিশুক। আমার তো ভারী পছন্দ।”
শ্রাবণ মায়ের কথার স্বরেই যেন দেখা করার উদ্দেশ্য টের পেয়ে গেল। মনের প্রফুল্লতা মিইয়ে গেল খানিকটা। নিজের ওপর রাগও হলো। নিজ থেকে কিছু না করলে মা তো এগোবেনই। তবে শ্রাবণ আপাতত সেসব নিয়ে খুব একটা ভাবছে না। তার মস্তিষ্কের এক কোণে তখন আরেকটা পোকা কুটকুট করছিল। অ’স্ত্র ব্যবসায়ী অ্যালেনের সঙ্গে পিয়াসার সম্পর্কের সমীকরণটা বড্ড বেশি বেখাপ্পা লাগছে। মেয়েটির সম্বন্ধে আরো স্টাডি করা দরকার। এদিকে শুভ্রার কেইসটাও স্থবির। এক সাগর নামক ব্যক্তিতেই দুটো কেইস থমকে আছে যেন।
জামশেদ একটা দারুণ ক্লু হাতে পেয়েছে। সাগরের গার্লফ্রেন্ড সাদিয়ার ইমেইলটা খতিয়ে দেখতেই সন্দেহজনক কিছু ইমেইল আদান-প্রদান নজরে আসে। কিছু কান গরম করা কথাবার্তাও তাতে সংযুক্ত আছে। জামশেদের ঘোর সন্দেহ এই ব্যক্তি সাগরই। প্রেমিকার কাছে নিঃসংকোচে এরকম কথাবার্তা সেই চালনা করবে। অন্তত সাগরের স্বভাব তাই বলে। এতকালের চর্চিত অভ্যাস এত সহজে ছেড়ে থাকাটা বেচারার জন্য কষ্টকরই বটে। জামশেদ দেরি না করে তাই আইপি লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলেছে। এবং লোকেশন দেখে সে যারপরনাই হতভম্ব।
________________
পরদিন বেলা বাড়তেই অনন্যার ফোনে শ্রাবণের কল এলো। অনন্যা প্রথমটায় ধরল না৷ ও জানে এখন ঘন ঘন দেখা বা কথা হওয়াটা আশকারাদান হয়ে যাবে। এদিকে আপার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানার হতে পারে। সে দোনোমোনো করতে করতেই ইতু ছো মেরে ফোনটা কেড়ে নিল। রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিয়ে বলল,
“হ্যালো হিরো, আমি আপনার হলেও হতে পারি শালিকা বলছি।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর করল,
“হ্যালো মিস, আমি আপনার হলেও হতে পারি দুলাভাই বলছি।”
অনন্যা বজ্রাহত। নিজের কান যেন মাত্রই ভুল কিছু শ্রবণ করে ফেলেছে। ইতু খুশিতে খলবলিয়ে উঠতে গিয়েও অনন্যাকে দেখে সামলে নিল। আস্তে করে বলল,
“আপনার হলেও হতে পারে বউয়ের বোধহয় কারেন্ট শক লেগেছে। আসলে খুব সাদাসিধে তো। তারওপর মনের ওপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গেছে। তাই মনটা একটু ক্ষ’তবি’ক্ষত।”
“তার ক্ষ’ত সারাতে নাহয় পুলিশি ছেড়ে একটু মনের ডাক্তারি শিখে নেব। চলবে?”
“উফ হিরো, দৌড়াবে। বাই দ্য ওয়ে, আপনার ফ্লার্টিং স্কিল খুবই ভালো। এবার কথা বলুন তার সঙ্গে।”
ইতু অনন্যাকে চোখ টিপে সরে গেল। অন্যদিকে শ্রাবণ ইতুর সঙ্গে যে রসিক স্বরে কথা বলেছে সেটাও পালটে গম্ভীরতর হয়ে উঠল। ভরাট স্বরে স্পিকারটা কেঁপে উঠল,
“অনন্যা, আছো?”
অনন্যা অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল, “আছি। কেন ফোন দিয়েছিলে?”
“হাবীবের ব্যাপারটা ইনফর্ম করতে চাইলাম। থানায় একটু টাইট দিতে পাঠিয়ে তো বেশ উপকার হলো। সে রেপুটেশনের ভয়ে আমাকে মোটা অংক সাধছে। যেহেতু তোমার সূত্রে তাকে পাওয়া তাই ভাবলাম বড়োলোক হওয়ার আগে তোমাকেই জিজ্ঞেস করি ভাগ নেবে কিনা।”
অনন্যা থমথমে স্বরে বলল,
“শ্রাবণ, তুমি ঘুষ খাও?”
শ্রাবণ আয়েশি স্বরে বলল,
“এখনো পর্যন্ত তো খাইনি। তবে বোঝোই তো কোন প্রফেশনে আছি৷ টেবিলের নিচে এসব হরহামেশাই চলে।”
“চলুকগে। নিজেকে নিরাপদে রেখে এড়িয়ে চলাটাই বিবেকবান মানুষের কর্ম।”
শ্রাবণ সেই একই স্বরে বলল,
“অর্থের চেয়ে লোভনীয় ঘুষ যদি পাই তবে আর ওমুখো হবো না। আছে তোমার কাছে এমন লোভনীয় ঘুষ?”
অনন্যা গালের সঙ্গে ফোন ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
“তুমি খুব খারাপ, খুব খারাপ।”
চলবে…
বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [২৪]
প্রভা আফরিন
ব্যস্ত পথের জ্যাম ঠেলে, সিগন্যালে থমকে থমকে চলছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সিটে বর্তমানে জামশেদ বসে আছেন। পাশেই নিমগ্ন শাহনেওয়াজ। দৃষ্টি পথের দিকে হলেও মনোযোগ যে অন্যদিকে বোঝাই যাচ্ছে। এই মানুষটা পেশায় জামশেদের সিনিয়র হলেও তিনি জানেন শাহনেওয়াজ উনাকে যথেষ্ট সম্মান করে। শুধু তাই নয় জামশেদ বেফাঁসে যেকোনো শব্দ অনায়াসে ব্যবহার করতে পারে তার সামনে। যা অন্য কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে করাটাও গর্হিত অপরাধ হিসেবে গন্য। এ কারণেই তিনি এই তরুণকে পছন্দ করেন।
জামশেদ মৃদু কেশে হালকা গলায় ডাকলেন,
“স্যার, আপনি শিওর সাগরের ট্রেস এভাবে মিলবে? উল্টে সতর্ক হয়ে যেতে পারে।”
ভাবনা থেকে বেরিয়ে শাহনেওয়াজ বলল,
“না মিললেও দেখতে ক্ষতি নেই। যদি ক্লুও মেলে তবে বুঝতে হবে সে ঢাকাতেই গা ঢাকা দিয়েছে। অসীম সাহস ও আত্মবিশ্বাস না থাকলে এমন কাজ কেউ করে না।”
জামশেদ মাথা দোলালেন। আসলেই তাই। এতকিছুর পরেও বহাল তবিয়তে ঢাকাতেই লুকিয়ে থাকবে সে! এরজন্য প্রবল আত্মবিশ্বাস ও ভরসা প্রয়োজন। শাহনেওয়াজের যান্ত্রিক কণ্ঠ আবারো শোনা গেল,
“তবে আমার ভাবনা ভিন্ন।”
কথায় এক সেকেন্ডের বিরতি রাখতেই জামশেদ ঢুকে পড়ল,
“অ্যালেনের কথা ভাবছেন, তাইতো? ওকে ধরার কল্পনা করাও বৃথা। এমপির শ্যালক সে। ইন্টারন্যাশনালি কাজ করে। পাওয়ার ছাড়া এত বড়ো অবৈধ ব্যবসা বহাল তবিয়তে চালানো তো মুখের কথা নয়। ওর চুল ছুঁলেও ওপর মহলের কড়া চোখে পড়তে হবে।”
শাহনেওয়াজ জবাব দিল না। এই একটা জায়গাতেই নিজের পেশাটা তার ভীষণ রকম অপছন্দ। পুলিশ আইনের কম ক্ষমতার হুকুম বেশি পালন করে। জামশেদ নিশ্চুপতার সুযোগে নিজের ভাবনাটা উগরে দিল,
“তাছাড়া স্যার, যতদূর জেনেছি পিয়াসাকে আমার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। তার লাক্সারিয়াস লাইফ, উগ্র চলাফেরা দেখে কিন্তু অনেক কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায়। সে অ্যালেনের গার্লফ্রেন্ড ছিল শুনলেও অবাক হবো না।”
শাহনেওয়াজ মাথা নাড়ে। এই সম্ভাবনা সত্যি হওয়ার চান্স বেশি। আর এরকম হলে পিয়াসার মৃত্যুর কারণও অতি সোজা হবে। অ্যালেনের স্বার্থে খোঁচা দিয়েছিল হয়তো। তাই সরিয়ে দিয়েছে। অ’প’রাধ জগতে এসব পাতি ব্যাপার। এরকমটা হলে এই কেইসে তাদের বেশি কসরতও করতে হবে না৷ একদিন হুট করে কোনো ফোনকলে তদন্ত থেমে যাবে অথবা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শাহনেওয়াজের দুশ্চিন্তা সেটা নয়। শুভ্রার মৃ’ত্যুর পেছনের মানুষগুলোকে ধরাটাই তার মূল লক্ষ্য এখন। কান টানলে মাথা আসে। সেই মাথা অবধি পৌঁছাতে পিয়াসার মৃত্যুটাকে কান হিসেবে ব্যবহার করতেই হবে। এ ব্যাপারে সে সতর্ক। কোনো ক্লু বা সন্দেহভাজনের নাম বাইরে ডিসক্লোজ করবে না। জামশেদ বললেন,
“শুনলাম রাশেদ কক্সবাজারের ভিআইপি হোটেল চালু করছে।”
“ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করতে কিছু ইনভেস্টমেন্ট করতেই হয়, তাই না!”
তড়িৎ ও আত্মবিশ্বাসী জবাবে জামশেদ চমকিত হলেন। শাহনেওয়াজ তীব্র ক্ষো’ভের সঙ্গে হিং’স্র স্বরে বলল,
“এটা এমন একটা কেইস যেখানে আমরা জানি ডালপালায় কে কে আছে। শুধু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাব আমাদের দমিয়ে রেখেছে।”
কথার মাঝেই গাড়িটা এসে থামল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কিছুটা দূরে গাড়ি পার্ক করে ওরা একটি বাড়ির সামনে এসে থামে। দোতলা ছিমছাম বাড়ি। নিচের তলায় সেলুন ও স্টেশনারির দোকান। ওপরের তলার বারান্দায় কাপড় মেলে রাখা দেখা যাচ্ছে। পুরুষের শার্ট, প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার। পুলিশ দেখে নিচের তলার দোকানিরা যেন ভড়কে গেল। নিরাক পড়া নির্ঝঞ্ঝাট দুপুরে হঠাৎ তাদের আগমন যেন একেবারেই কাম্য নয়৷ কলাপসিবল গেইট ধরে ভেতরে ঢোকার আগে জামশেদ স্টেশনারি দোকানে গেল। খাতা-কলম দেখতে দেখতে দোকানের অল্পবয়সী ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
“দোকান তোমার?”
“জি…জি না, আমার আব্বার।” ছেলেটি হকচকিয়ে তুতলে উঠল।
“ভাড়ায় চালাও? নাকি নিজেদের?”
“ভাড়ায়।”
জামশেদ এবার আসল কথায় গেলেন। একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“একে দেখেছো আশেপাশে? এ বাড়িতে?”
সদ্য গোফ গজানো কিশোর মাথা নাড়ল বিচিত্র ভঙ্গিতে। হ্যাঁ বা না কিছুই বোঝা গেল না। জামশেদ একটা ধমক দিতে প্রস্তুত ছিলেন। এরা অপরাধকে ভয় করে না আর আইন দেখলেই ঘাবড়ে যায়! শাহনেওয়াজ কাঁধে হাত রেখে উনাকে নিবৃত্ত করে বলল,
“কী দরকার সময় নষ্ট করার। ভেতরে চলুন।”
অতঃপর ইচ্ছাকৃত সন্দিগ্ধ একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলেটাকে ভড়কে দিয়ে তিনি ভেতরের পথে পা বাড়ালেন। সিড়ি ধরে দোতলায় পৌঁছে মুখোমুখি দুটো কাঠের দরজা। অর্থাৎ এখানে দুটো ফ্ল্যাট। জামশেদ বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোন দরজায় কড়া নাড়বেন বুঝতে পারছেন না। শাহনেওয়াজ আঙুল দ্বারা তুলনামূলক নতুন ও বার্নিশ করা কারুকার্য খোচিত দরজা দেখিয়ে বলল,
“বাড়ির মালিকের দরজা সর্বদাই এক্সট্রাঅর্ডিনারী এন্ড কিউট হয়।”
জামশেদ শিকারের গন্ধ পেয়ে মুচকি হাসলেন। দরজার লুপহোলে আঙুলে চেপে ধরে কলিংবেল বাজালেন। প্রথমে দু’বার, বিলম্ব হওয়ায় আরো তিনবার। দরজা খুলে দিল এক রোগাপটকা লোক। তার মুখটা যেন আগেই বিচলিত ছিল, তাই পুলিশ দেখে আলাদা কোনো অভিব্যক্তির ছাপ চেহারায় ফুটে উঠল না। শাহনেওয়াজ লোকটাকে টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। আশেপাশে দেখতে দেখতে বলল,
“আপনার নামটা মিস্টার?”
“জহির।”
“জহির, আপনি এ বাড়ির মালিকের কে হন?”
“মালিক আমার চাচা লাগে।”
শাহনেওয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটার পা থেকে মাথা অবধি দেখে। বলে,
“চাচার বাড়িতে আপনি একাই থাকেন?”
জহিরের দৃষ্টি অস্থির। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ব্যাচেলর সাবলেট নিয়ে থাকি। চাচারা বনানীতে তাদের নতুন বাড়িতে থাকে।”
“আপনার রুমমেটরা কোথায়?”
জিজ্ঞেস করে শাহনেওয়াজ কালক্ষেপণ করল না। নিজেই ভেতরের ঘরে ঢুকল। জহির পেছনে ছুটে এসে বলল,
“আপাতত আমি একাই আছি। রুমমেট ছুটি কাটাতে দেশের বাড়ি গেছে।”
“আচ্ছা! তাহলে টেবিলে দুটো কোকের গ্লাস কেন? আপনি একাই খাচ্ছিলেন বুঝি?”
বলতে বলতে শ্রাবণের মুখ শক্ত হয়ে এলো। ও বুঝে গেছে কেউ একজন একটু আগেও এই রুমে ছিল। সিগারেট ও এলকোহলের তীব্র গন্ধ চারপাশে। গ্লাসের তরলটা যে কোক নয় অনায়াসেই বোঝা যাচ্ছে। সে ক্ষীপ্র গতিতে সারা ফ্ল্যাট খুঁজে ফেলল। কেউ নেই। অর্থাৎ পুলিশের উপস্থিতি তারা আগেই টের পেয়েছে। কিন্তু বের হলে তো ওরা দেখতে পেত। শাহনেওয়াজ জহিরকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাটে কয়েকজন ব্যাচেলর থাকে। সেখানে সন্দেহভাজন কিছু চোখে লাগল না। হতাশ হয়ে সিড়ির মুখে এসে হুট করে এক অত্যন্ত রূপবতী, লাস্যময়ীকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেখল। একে চেনে ওরা। সাগরের গার্লফ্রেন্ড সাদিয়া। আজ ওদের এই ফ্ল্যাটেই মিট করার কথা। তারমানে তীর নিশানাতেই ছুটেছিল। লক্ষ্যভেদে গড়মিল হয়ে গেছে। সাগর কিছুক্ষণ আগেও এখানেই ছিল নিশ্চিত। নয়তো সাদিয়াকে আসতে মানা করে দিতো। অর্থাৎ সে সুযোগটাও পায়নি।
শাহনেওয়াজ জামশেদের দিকে চেয়ে ইশারায় বোঝাল,
“এই মেয়েকে হ্যান্ডেল করুন।”
এরপর একছুটে ছাদে উঠে গেল। সেখানেই ব্যাপারটা যেন আন্দাজ করে ফেলল ও। পুলিশের উপস্থিতি পেয়ে সাগর নিচে নামার সুযোগ পায়নি। ছাদে উঠে রেলিং লাগোয়া বিশাল রেইনট্রি গাছটাকে অবলম্বন করে নিচে নেমে গেছে। প্রস্তুতিবিহীন পালানো। অর্থাৎ বেশিদূর এগোতে পারেনি। শাহনেওয়াজ রিভলভারটা হাতে নিয়ে সিড়ি বেয়ে ছুট দিল। দোতলার ফ্ল্যাটের সামনে জামশেদের থাবার মুখে ছোটো শাবকের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সাদিয়া। যেন দানবের মুখে পতিত হয়েছে রূপবতী রাজকন্যা। আদতে বিষয়টা এমন দেখালেও জামশেদ উলটো এই মেয়ের ন্যাকামো ও আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গির মুখে পড়ে ভীত। শাহনেওয়াজ সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে এক পলক চেয়ে রসিকতার সুরে বলল,
“কাম অন অফিসার। সুন্দরীদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতেও জানেন না দেখছি। একটু রুডলি আদর করতে শিখুন। আলাভোলা মেয়েরা ব্যাড বয়দের রুড বিহেভ দারুণ পছন্দ করে।”
শাহনেওয়াজ চোখের আড়াল হয়ে গেল মুহূর্তেই। জামশেদ কালক্ষেপণ করলেন না। সাদিয়াকে জহিরের সঙ্গে ঘরে লক করে দিয়ে ছুট দিলেন স্যারের পেছনে। এদের পরেও দেখা যাবে৷ বাড়ির পেছনটায় ঘিঞ্জি বস্তি। অলিগলিতে ঠাসা। কিছুক্ষণ গোলকধাঁধার মতো ঘুরে জামশেদ হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে গু’লির শব্দ শুনলেন। মুহূর্তেই আশপাশে হুলুস্থুল পড়ে গেল৷ নিরীহ বস্তিবাসী অনাহুত পরিস্থিতিতে পড়ে আতঙ্কিত। জামশেদ নিজের রিভলবারটাও বের করে সতর্ক পায়ে শব্দ অনুসরণ করে ছুটে গিয়ে দেখলেন সরু পথের ওপর শাহনেওয়াজ উপুর হয়ে পড়ে আছে।
চলবে…