বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [১৭]
প্রভা আফরিন
ইসহাক রহমানের বাড়ির বসার ঘরের প্রতিটি কোণা স্তব্ধ। মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানের বাতাসের সঙ্গে নিশ্বাসের উত্তাপ মিশে পরিবেশ হঠাৎ গুমোট হয়ে গেছে। বোবা চোখগুলোয় জেগেছে সীমাহীন বিস্ময়। চৈতন্য লাভ করতেই অনন্যা স্থিরতা হারায়। আপার দেহে ড্রা’গ মিলেছিল! কবে? কোথায়? এই তথ্য তো তার জানা ছিল না। কেন জানল না! প্রশ্নটা ঠোকর কাটতেই ও উত্তেজিত স্বরে বলল,
“ভাইয়া, তুমি কী বলছো? আপার শরীরে কবে এই ড্রা’গ পাওয়া গেছিল?”
পরবর্তী বি’স্ফো’রণটা যেন কাম্য ছিল। তুষার ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিল,
“শুভ্রার অটোপসি রিপোর্টে এসেছিল।”
শ্রাবণের কপালে ভাজ। শুভ্রার আ’ত্ম’হত্যার হেতু জানা থাকলেও ভেতরকার খবর তার অজানা। তাই বিষয়ের কূল কিনারা সে ধরতে পারছে না। প্রায় দুই বছর আগে ম’রে যাওয়া মানুষটার সঙ্গে বর্তমান খু’নের কোনো না কোনো যোগসূত্র যে থাকতেও পারে তার সচেতন মস্তিষ্ক সেই বার্তা প্রেরণ করে। শ্রাবণ ভারী স্বর পরিষ্কার করে। ও এসেছিল প্রতিবেশী হয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে ক্রমশ নিজ পেশার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রতিবেশী শ্রাবণ হতে এসপি শাহনেওয়াজ শিকদার করে তুলছে। বলল,
“তদন্ত হয়েছিল?”
“না। ওদিকটা শুভ্রার স্বামী রাশেদ দেখেছে। মামার সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তীতে আমি মামলা করেছিলাম সাগরের বিরুদ্ধে। আ’ত্মহ’ত্যার প্ররোচনা ও সাইবার আইনে।”
“সাগর কে?”
তুষার ঢোক গিলল। মৃ’ত বোনের সম্মান ঘাটতে জিভে বাধে ওর। কিন্তু এই তরুণ, ক্ষুরধার কর্মকর্তার সামনে তাকে বলতেই হবে। বলল,
“যার সঙ্গে শুভ্রার নাম জড়িয়েছিল।”
“আচ্ছা… সেই মামলার ফলাফল কী ছিল? সাগরের শাস্তি হয়েছে?”
তুষার আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে তখন আমাদের কারোই মানসিক স্থিরতা ছিল না। শুভ্রার পর বাবাও চলে গেল। পিয়াসা বাপের বাড়ি গেল। মা অসুস্থ। আবার শুভ্রার শ্বশুরবাড়ির চাপ। সব মিলিয়ে মা-বোন নিয়ে আমার ভেসে যাওয়ার জোগার। তাই ওদিকে জোর দিতে পারিনি। শুভ্রার শ্বশুরবাড়ি থেকেও চাপ দিচ্ছিল। তাই আর এগোইনি।”
“তারা কেন চাপ দেবে?”
“কারণ সাগর শুভ্রার ননদের দেবর ছিল। এমনিতেই সম্মানহানি হয়েছে। তাই তারা আর চায়নি পুলিশের টানাটানিতে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা হোক। রাশেদ ভাইও বলল আমায়। অযথা দুই পরিবারে কাদা ছোঁড়াছুড়ি হতো। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আসলে তখন আমার নিজের সংসারটাই স্রোতে ভাসা ভেলার ওপর। তাই আর ওদিকে খেয়াল দিতে পারলাম না।…”
অনন্যা রাগে ফেটে পড়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি বুঝতে পারছো কত বড়ো ভুল করেছো? আপার দেহে ড্রা’গ পাওয়া গেছে। ড্রা’গ! আমার আপা কখনো কোনো বাজে কিছুতে এডিক্টেড ছিল না। কেউ তাকে ড্রা’গ দিয়েও তো ফাঁ’সাতে পারে। তুমি কেন বুঝলে না? আমাদের কেন জানালে না?”
“শুভ্রা তো মৃ’ত্যুর আগে একবারও অস্বীকার করেনি সেই ভাইরাল বিষয়টা। সন্দেহ আসবে কী করে? পরিস্থিতি তখন এমন ঠান্ডা মাথায় সব বিবেচনা করার মতো ছিল! উলটে সম্মান টানাটানির ভয়ে সবাই পরামর্শ দিল পিছিয়ে যেতে। তোর ভবিষ্যতের কথাও আমাকে ভাবতে হয়েছে।”
“সবাই বলতে?” প্রশ্ন করল শ্রাবণ।
“পিয়াসাও…” তুষার মুখ নামিয়ে নেয়৷ তখনকার পরিস্থিতি এখনকার মতো সুস্থির ছিল না। কীভাবে দিনগুলো পার করেছে সেটা তুষার ও তার ভঙ্গুর পরিবারই জানে। একের পর এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল জীবনের ওপর দিয়ে৷ যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট ছিল তা বাঁচিয়ে রাখতে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। ঘরে বিবাহযোগ্য ছোটো বোনটাও আছে। তার ভবিষ্যতটা বাকি। মামলায় মন দিয়ে একটা ক্ষমতাশালী পরিবারের পেছনে লাগার জন্য যেটুকু সাহস ও ভরসা দরকার তা ওর ছিল না। তুষারের মনে তখন শুধু হারানোর ভয়৷ বাবা গেল, বোন গেল, সম্মান গেল, মর্যাদা ক্ষয়ে যাচ্ছে, পিয়াসাও হাত ছেড়ে দিচ্ছে। হতাশা, বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত মন ঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায় ভুলে গেছিল। ভালোবাসা বুঝি আসলেই মানুষকে অন্ধ করে দেয়! তাই তো প্রেমের সংসার বাঁচাতে মা-বোনকে একা বাড়িতে ফেলে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠতেও দু-বার ভাবেনি। পিয়াসা যা বলেছে, যেভাবে বলেছে সেভাবেই করেছে। আর এখন… সেসব ভাবলে মনে হয় কী পরিমাণ বোকা সে ছিল। সম্পর্কের সুতো আগেই ছিঁড়ে গেছিল। পিয়াসা তার নাটাই কেটে ভোকাট্টা হয়ে উড়ে যাচ্ছিল। তুষারই জোর করে সুতোয় গিঁট লাগাতে মড়িয়া হয়েছিল।
শ্রাবণের কপালে ভাজ। সমীকরণে গণ্ডগোল। শুরু থেকে সবটা জানতে হবে। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে যোগসূত্র আছে। পিয়াসা মার্ডার কেইসের তদন্তের পাশাপাশি শুভ্রার দিকটাও খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
দৃশ্যপটের শেষটায় আগমন ঘটে ইসহাক রহমানের। তিনি সমস্ত শুনলেন শান্ত ভঙ্গিতে। আফসোসও করলেন। কারণ তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। আর না কেউ উনাকে জানিয়েছে৷ সৌদি থেকে ফিরতে ফিরতে মেয়ে ও নাতি-নাতনীদের জীবনটা একদম ছন্নছাড়া অবস্থায়। ভাবলেও বুক ভার হয়ে আসে বৃদ্ধের। তিনি শ্রাবণকে বললেন শুভ্রার বিষয়টা যেন পুনরায় খতিয়ে দেখা হয়। শুভ্রা যদি নির্দোষ হয় তার ইনসাফ তিনি মৃ’ত্যুর আগে নিজ চোখে দেখে যেতে চান। আর যদি নাও হয় তবুও যেন সন্দেহটা পরিষ্কার হয়। নানাজানের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে অনন্যা। আকুল চোখে চায় শ্রাবণের দিকে। নৈশব্দের অনুরোধ শ্রাবণের দৃষ্টি এড়ায় না। বরং বিপরীতে তার চক্ষুদ্বয়ও যেন ভরসা হয়ে ওঠে।
_________________
তদানিন্তন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামশেদকে নিয়ে পিয়াসার মা’র্ডারের ক্রা’ইম সিনে উপস্থিত শাহনেওয়াজ শিকদার। জামশেদ মনে মনে কিছুটা উ’ত্যক্ত। এই কেইসে স্যারের সুনজর পড়েছে। তারমানে দৌড়াদৌড়ি নেহাৎ কম করাবে না। শাহনেওয়াজ ওরফে শ্রাবণ প্রবেশ করে তিন কামড়ার ফ্ল্যাটে। পিয়াসাকে এখানেই পাওয়া গেছিল। পুলিশে খবর দিয়েছিল যে প্রতিবেশী তাকে জেরা করে জানা গেছে ফজরের ওয়াক্তে নামাজ পড়তে যখন বের হন অলক্ষ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় জুতোটা পিছলে যায়। ভড়কে গিয়ে দেখেন পিয়াসার ফ্ল্যাটের নিচ দিয়ে র’ক্তের চিকন ধারা বের হয়েছে। সদ্য ঘুম ভাঙা মস্তিষ্ক হতচকিত হয়ে যায় এমন কিছু দেখে। বিপদের আভাস পেয়ে প্রথমে দরজায় ধাক্কা দেন। দরজা লক করা ছিল। কলিংবেল বাজান, সাড়া মেলে না। পরে আরো দুয়েকজন প্রতিবেশীকে ডেকে পরামর্শ করে নিজেরা দরজা ভাঙার রিস্ক না নিয়ে সরাসরি থানায় যোগাযোগ করেন। এরপরই ক্রা’ইম সিনে আগমন ঘয়ে জামশেদের। তিনি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। পিয়াসাকে উপুড় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন বসার ঘরের ফ্লোরে। বসার ঘর ও বেডরুমটা এলোমেলো ছিল। শ্রাবণ নিজেও খেয়াল করল। ফ্ল্যাটজুড়ে আধুনিক নান্দনিকতা দৃশ্যমান, দামী আসবাবে ভরপুর। ফ্ল্যাটের বাইরেটা যতটাই সাদামাটা, ভেতরটা ততটাই শৌখিন। শ্রাবণ আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে জামশেদকে বলল,
“ফ্ল্যাটে মহিলা একাই থাকতেন?”
“জি স্যার। ডিভোর্সের পর তিনি বাবা-মাকে ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে একাই উঠেছেন। বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকতেন।”
“ফ্ল্যাটের মালিকানা কার নামে?”
“পিয়াসার নামেই কেনা হয়েছে। পুরোনো বাসিন্দারা ইউএস যাওয়ার আগে পিয়াসার কাছে মালিকানা হস্তান্তর করে গেছে।”
শ্রাবণ সন্দেহ প্রকাশ করে বলল,
“বাবা-মা কিনে দিয়েছেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন?”
“জি স্যার, এই বিষয়ে উনারাও বিস্মিয় প্রকাশ করেছেন। কারণ উনারা জানতেন এই ফ্ল্যাটে মেয়ে ভাড়া থাকে। সে জন্য নির্দিষ্ট একটা এমাউন্টও প্রতিমাসে ভিক্টিমের একাউন্টে পাঠাতেন তার ফ্যামিলি।”
“জল তো আগে থেকেই ঘোলা দেখছি। পিয়াসার একাউন্টের লেনদেনগুলোর খোঁজ নিন। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন? সেদিন সন্দেহভাজন কে বা কারা এসেছে গেছে?”
জামশেদ মাথা নাড়লেন, “এই ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো নয়। দারোয়ান বৃদ্ধ মানুষ। একটু টাইট দিতেই কেঁদে কেটে অস্থির। সন্দেহভাজন কেউকে দেখেননি। বিশেষ কিছুই বলতে পারছে না।”
শ্রাবণের মাথায় হুট করে কথাটা লেগে গেল। বলল,
“বিশেষ কাউকে দেখেনি মানে যে বা যারা কাজটা করেছে তার এখানে নিত্য আনাগোনা!”
“হতেই পারে। অচেনা কারো দ্বারা ভিক্টিমের নিজ ফ্ল্যাটে ঢুকে কোনোরকম হুলুস্থুল ছাড়া খু’ন করার সম্ভাবনা কম।” জামশেদ সায় দিলেন।
শ্রাবণ বলল, “বাড়ির কাজের লোক আছে নিশ্চয়ই। তাকে ধরুন। জিজ্ঞেস করুন এ বাড়িতে কাদের নিত্য আনাগোনা ছিল।”
“ছুটা কাজের লোক ছিল। মধ্যবয়সী মহিলা। বর্তমানে তিনিও পলাতক।”
শ্রাবণের কপালে ভাজ। সে হেঁটে সম্পূর্ণ ফ্ল্যাটটা একপাক দিয়ে থেমে গেল। জামশেদের দিকে ফিরে নির্দেশ দিল,
“আপনি ফরেনসিক ডক্টরের সঙ্গে কথা বলুন। নিত্য ব্যবহার বস্তু যেমন গ্লাস, এসির রিমোট, বালিশ ইত্যাদি পরীক্ষা করান৷ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”
শ্রাবণ বেরিয়ে গেল। জামশেদ এই কেইসের তদন্তটা দেখুক। ততক্ষণে নাহয় সে একবার শুভ্রার অতীতটায় উঁকি দিক।
_________________
অনন্যা পরদিন ভোরেই নিজের কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে গেল। সকালের টিউশনটা ধরতে হবে বলে না খেয়েই বেরিয়ে গেছে। তবুও বাসে ঝুলে সময়ের হেরফের হলো দশ মিনিট। একেই একদিন মিস দিয়েছে এরপর আবার লেইট। স্টুডেন্টের মায়ের থমথমে মুখ দেখবে নিশ্চিত হয়েই কলিংবেল বাজাল ও। কিন্তু দরজা খুলল বাড়ির কর্তা হাবীব। অনন্যাকে দেখে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আন্তরিক হাসলেন তিনি।
ভেতরে ঢুকে আজ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো অনন্যার। অন্যদিন এ সময় বাড়িতে ব্যস্ততা থাকে। কাজের লোকেদের ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। রান্নাঘর হতে খুটখাট শব্দ ভেসে আসে। আজ কেমন সুনসান, নিস্তব্ধ চারপাশ। বাড়ির জানালাগুলোর পর্দাও ঠিকঠাক মেলা হয়নি বলে অন্ধকার ঠিকিঠাক কাটেনি।
“বসো অনন্যা।”
খালি বাড়িতে শব্দটা যেন একটু বেশিই বিকট শোনাল। অনন্যা চমকে পেছনে ফেরে। এই লোক তাকে তুমি করে বলছে, আবার নাম ধরেও ডাকছে! আগে তো নিশীর ম্যাম বলতেন। অনন্যা বসল না। ইতস্তত করে বলল,
“বাড়িতে কেউ নেই? নিশী?”
হাবীব সাহেব তিক্ত স্বরে বললেন,
“আর বোলো না। সংসারে কলহ লেগেই আছে। সারাদিন খাটাখাটুনি করে বাড়ি ফিরে একটুও শান্তি পাই না। পরিবার শুধু আমার অর্থটাকে ভালোবাসে। আমার যত্নের বেলায় কেউ নেই। ভীষণ একাকিত্ব অনুভব করি।”
অযথা প্যাচাল! নাকি সুক্ষ্ম ইঙ্গিতের আভাস! অনন্যা প্রশ্নটা মনে করিয়ে দেয়,
“নিশী বাড়ি নেই? পড়বে না?”
“নিশীকে নিয়ে ওর মা মামাবাড়ি গেছে দুদিনের জন্য।”
অনন্যার কপালে এবার ভাজ দৃশ্যমান হয়। আশ্চর্য! কোথাও বেড়াতে গেলে তাকে টেক্সট করে দেন ভদ্রমহিলা। এতে অনন্যাকে সেদিন আর আসার কষ্টটা করতে হয় না। এবার তো তেমন কিছুই হলো না! যাইহোক, এখানে থাকতে তার মন সায় দিচ্ছে না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মনটাকে খোঁচাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে প্রস্থানের উদ্যত হয়ে বলল,
“আজ আসি তাহলে। নিশী এলে বলবেন আমায় টেক্সট করতে।”
সদর দরজার দিকে এগোতেই অনন্যার চলার গতি রোধ করেন হাবীব। লোকটার চোখের চাহনিতে একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার আছে, হাসিটা ভীষণ তেলচিটে ধরনের। অনন্যার বুকের ভেতরটা হঠাৎ অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। ঘাবড়ে গেছে বুঝতে দেওয়া মানেই অসহায়ত্ব পেয়ে বসবে। হাবীব বললেন,
“না খেয়ে চলে যাবে? বসো না। এত তাড়া কীসের? দেড় ঘন্টা সময় হাতে নিয়েই তো এসেছো।”
“আমি খেয়ে এসেছি।”
স্বনামধন্য ফুড এন্ড বেভারেজ কোম্পানির মালিক চল্লিশোর্ধ্ব হাবীব। ফাঁকা বাড়িতে খুব বেশি সময় লাগল না নিজের ভদ্রবেশী মুখোশ খুলে ফেলতে। অনন্যার সুগঠিত, কোমল দেহাবয়বে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে হাবীব। যেন স্ক্যান করে নেয় নারীদেহ। কিছু নোংরা মানুষ নিজের দৃষ্টি ও কল্পনাশক্তি দিয়েই ধ’র্ষ’ণ করতে জানে। হাবীবকে অনন্যার তাই মনে হলো। চোখ দিয়েই দেহে আবর্জনা লাগিয়ে দিচ্ছে যেন। গা ঘিনঘিন করে ওঠে ওর।
হাবীব আশকারাপূর্ণ স্বরে বলেন,
“কত পাও স্যালারি? এ দিয়ে তো খাওয়া-পড়া চালাতেই হিমশিম খাওয়ার কথা। শখ-আহ্লাদ পূরণ হয়? আজকালকার সুন্দরী মেয়েদের আরাম আয়েশে থাকার জন্য কত উপায় আছে! আর তোমাকে দেখি কীভাবে খেটে খেটে সুন্দর দেহ ক্ষয় করছো।”
অনন্যার গা রি রি করে ওঠে। বুকের ভেতরই চেপে রাখে সে অনুভূতি। দৃঢ়, নিষ্কম্পা স্বরে বলে,
“আমি সৎ পথে খেটে খাই। বিনা শ্রমে পরাশ্রিতের মতো জীবন আমার কাম্য নয়।”
হাবীব বিশ্রী হেসে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ইয়াং লেডি, আমায় ভুল বুঝছো তুমি। সব পরিশ্রমে কষ্ট হয় কে বলল তোমায়? ব্যবসায় পুঁজি দিলেই না লভ্যাংশ পাবে। সুন্দরী মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো পুঁজি তার রূপ। ইউ হ্যাভ ন্যাচার র’ বিউটি। দিস ইজ ইয়োর এসেট। ইনভেস্ট ইট। বেনিফিট দেওয়ার গ্যারান্টি আমার। আমরা দুজন চাইলেই একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। তুমি তো শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি। ভেবে দেখো।”
হাবীব খুব মিষ্টি করে সুগার বেবি হওয়ার প্রস্তাব দিলেন অনন্যাকে। এবং এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে যখন প্রত্যাখান করাও মেয়েটির জন্য বিপদজনক। অনন্যার মুখ তখন র’ক্তশূন্য। হৃদকম্পন ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে। ইচ্ছে হয় সম্মুখের নোংরা মুখটায় একদলা থুতু ছুঁড়তে। কিন্তু এখন প্রতিবাদ করাই হবে সবচেয়ে বড়ো বোকামি। সে এখন শ’য়তানের ঘাঁটিতে জিম্মি। ক্ষমতাবান লোকদের সঙ্গে এভাবে পেরে ওঠা যায় না। কে জানত, যে বাড়ির মেয়েকে এতদিন নির্বিঘ্নে নিরাপদ ভেবে পড়িয়েছে একদিন সে বাড়িই অনন্যার জন্য বিপদসংকুল হয়ে উঠবে!
চলবে…
বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [১৮]
প্রভা আফরিন
বেলা দশটা বাজে। সূর্যের তাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনজীবনের ব্যস্ততাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে৷ ক্যাফেটেরিয়ায় মুখোমুখি অনন্যা ও শ্রাবণ। সম্মুখে ধোঁয়া ওঠা কফি কাপ। দীর্ঘদিন বাদে পরিচিত কাউকে দেখলে যেমন হুট করে স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া যায় না, কিঞ্চিৎ অস্বস্তি কাজ করে, এই মুহূর্তে অনন্যার অবস্থা তেমনই। বিপরীতে তরুণ মেধাবী কর্মকর্তা বেশ ধীর, স্থির এবং প্রফেশনালিজম ক্যারি করছে। এখানে সে প্রতিবেশী হিসেবে নয়, এসেছে কিছু দরকারি আলাপের জন্যই। তাই আচরণটাও প্রফেশনের খোলসে বন্দী। শ্রাবণের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর হতে শুরুতেই একটা আশ্বাসের বাণী বের হয়,
“আমার সঙ্গে কো-অপারেট করো, অনন্যা। দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কিছু না জেনে শুধু একটা রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এগোনো এবং খড়ের গাদায় সোনালি সুচ খোঁজা একই ব্যাপার। ঘটনার শুরু থেকে সবটা জানতে চাই। তুমি যতটুকু জানো, যা দেখেছ, বুঝেছ তাই একটু স্মরণ করে ক্লিয়ারলি বলো।”
অনন্যা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। নিজেকে প্রস্তুত করল আরো একবার বেদনাদায়ক স্মৃতি হাতড়াতে। শ্রাবণ ফোনের রেকর্ড অন করে। অনন্যা বলছে,
“শুভ্রা আপা তখন সবে উপস্থাপিকা হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছে। সোস্যাল সাইটেও বিউটি এন্ড ফ্যাশন রিলেটেড ব্র্যাণ্ড নিয়ে কাজ করে বেশ পরিচিত মুখ। একবার একটা ব্র্যাণ্ড আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থাপিকা হিসেবে এটেন্ড করেছিল। সেখানে রাশেদ ভাইও একজন গেস্ট ছিলেন। আপার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়ের সূত্রপাত। আপা শুধু সুন্দরীই নয়, চমৎকার ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ। জীবনটাকে ভীষণ প্র্যাক্টিক্যালি ভাবত। তাই রাশেদ ভাই ভালোবাসার আহবান জানালেও আপা প্রেমের দিকে ঝুকতে চায়নি বিশেষ। অন্যদিকে রাশেদ ভাই আপার ওপর অল্প কয়দিনেই মুগ্ধ হয়ে যায় এবং সরাসরি আমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে আসে। তিনি একজন সনামধন্য ব্যবসায়ী। প্রভাবশালী, ধনবান পরিবার। এমন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে আমাদের শুরু থেকেই দ্বিধা ছিল। বোধহয় রাশেদ ভাইয়ের মায়েরও মত ছিল না। ততদিনে আপা ও রাশেদ ভাই একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই কেউ আর বাধা হতে পারেনি। একটা বছর বাইরে থেকে আমি যতটুকু দেখেছি আপা ভীষণ সুখী ছিল রাশেদ ভাইয়ের সাথে। ঝগড়া হলে একদিনের বেশি কেউ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারত না। আপা স্বামীর অনুগত ছিল খুব। রাশেদ ভাইও খুব ভালোবাসত আপাকে। সেই আপা আরেকজনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়াবে তা কল্পনাও করা যায় না। অন্তত আপার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও সংসারের প্রতি নিবেদিত রূপ সে নির্দেশ করে না। যাইহোক, ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ প্রথম বিবাহবার্ষিকীর ঠিক এক দিন আগে সন্ধ্যার দিকে আপা হুট করে আমাদের বাড়ি আসে।”
শ্রাবণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিল। এ পর্যায়ে প্রশ্ন করল,
“একা আসে?”
“হ্যাঁ, একাই। সঙ্গে কোনো জামাকাপড়ও ছিল না। শুধু একটা পার্স।”
“কত তারিখ ছিল সেদিন?”
অনন্যা সময় নিয়ে মনে করে,
“এপ্রিলের চৌদ্দ তারিখ। পনেরো তারিখ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের পরের দিনই আপার বিবাহবার্ষিকী ছিল।”
“বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন হঠাৎ বাপের বাড়ি এসেছিল কেন?”
“যত দূর মনে পড়ে, রাশেদ ভাইয়ের সঙ্গে কিছু একটা কারণে মনোমালিন্য হয়েছিল বোধহয়। তাই রাগ করে চলে একা আসে। ঠিক করেছিল রাশেদ ভাইয়া রাগ ভাঙাতে এলে সারপ্রাইজ হিসেবে উদযাপন করার কথা। এগুলো অবশ্য মাকে আপার বলা কথা। সচরাচর দুলাভাই সঙ্গে না এলে আমি ও আপা একই ঘরে ঘুমাই। সেরাতে একসঙ্গে ঘুমানো হয়নি। আপাকে অসুস্থ ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।”
“কেমন অসুস্থ?”
“দুর্বল দেহ, সারাক্ষণ অস্থির অস্থির করছিল৷ কারো সঙ্গেই বিশেষ কথাবার্তা বলেনি৷ মানে প্রতিবার বাপের বাড়ি আসার পর যে উচ্ছ্বাসটা দেখা যেত সেবার সেটা ছিল না। একটু যেন খিটখিটেও ছিল। পরের দিনের প্ল্যানিংয়ের কথা দুইবার জিজ্ঞেস করায় আমায় ধমক দিয়েছিল। ভেবেছি হয়তো দুলাভাইয়ের সঙ্গে মনমালিন্য হওয়াতেই মুড ঠিক নেই। রাতে খাবারের পর আমায় ডাকে। ধমক দিয়েছে বলে আমার মন খারাপ ছিল, তাই আদর করে দেয়। পরে বলে, ভালো লাগছে না, একা ঘুমাবে। আমিও নিজের ঘরে চলে যাই। সকালে ঘুম থেকে যখন উঠি ততক্ষণে…”
অনন্যার গলা কাঁপছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো আজও তাজা হয়ে হৃদয়ে র’ক্তক্ষ’রণ ঘটায়। শ্রাবণ একটু নরম স্বরে বলল,
“বি স্ট্রং, অনন্যা। তোমায় ঠান্ডা মাথায়, শান্তভাবে সব মনে করতে হবে। এটা শুভ্রা কেইসে তোমার জবানবন্দি হিসেবে রেকর্ড করছি।”
অনন্যা সামলে নেয় হৃদয়ের তরলতা। বলতে শুরু করে,
“সকালে যখন আমি ঘুম থেকে উঠে বিষয়টা জেনেছি ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যম আপা ও সাগর ভাইয়ার অন্তরঙ্গ ছবিগুলোতে ছয়লাব। আগেরদিন মধ্যরাতে কেউ ফাঁস করেছে। আর আপা যেহেতু সোস্যাল মিডিয়ায় অল্পবিস্তর জনপ্রিয় ছিল, রাশেদ ভাইয়ের সঙ্গে কাপল হিসেবেও ফ্যান ফলোয়ার ছিল, তাই ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। পিয়াসা ভাবি প্রথমে বিষয়টা দেখে তুষার ভাইয়াকে জানায়। এদিকে পরিচিত মানুষের ফোনকল আসতে থাকে। সব মিলিয়ে আমাদের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে পরিস্থিতি বোঝার পর আপাকে আমি একবারই দেখি। যখন সব জেনে বাবার বুকে ব্যথা ওঠে, তখন আপা ঘর থেকে বেরিয়েছিল। মা ভীষণ মে’রেছিল আপাকে। হিট অফ দ্যা মোমেন্ট আমাকেও বকেছে, মে’রেছে। আমিও তখন পরিস্থিতির ক্রমাগত উত্তেজনায় ভেবে বসেছিলাম আপার বুঝি সত্যিই সাগর ভাইয়ের সঙ্গে পরকিয়া আছে। তাই আপা কাতর গলায় আমাকে ডাকার পরও কাছে যাইনি। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে আপা আবারো ঘরে ঢুকে দরজা দেয়। রাশেদ ভাই প্রায় দুপুরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাসায় আসে। আপার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু আপা দরজা খুলছিল না বলে শেষমেষ ভেঙে ফেলতে হয়। তখনই দেখতে পাই আপা… আমার আপা সিলিংয়ে ঝুলছে। আমার ও আপার সবচেয়ে প্রিয় ওড়নাটাই গলায় প্যাচানো ছিল। রাশেদ ভাই বটি দিয়ে কাপড় কেটে আপাকে নামায়। উনার চোখে আমি এক মুহূর্তের জন্যও আপার জন্য ঘৃণা দেখিনি। কাঁদছিলেন খুব। পুলিশ এসেছিল বাড়িতে। এরমাঝে রাশেদ ভাইয়ের পরিবার এসে ভীষণ কলহ করে। আপার চরিত্র নিয়ে কড়া কড়া কথা শোনায়। ভাইয়াও রাগের মাথায় তখন সাগর ভাইয়ের দোষও যে আছে সেটা বলতে তর্কে জড়ায়। একটা তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল মৃ’ত মানুষটাকে সামনে রেখে। আমার কী যে অসহায় লাগছিল!”
অনন্যা মুখ নামিয়ে কাঁদছে। শ্রাবণের মায়া হলো। ভাবল একবার হাত ধরে সান্ত্বনা দেবে কিনা। হাত বাড়াতে গিয়েও পরে আর ধরল না। অনন্যাকে একটু সামলে নিতে সময় দিল ও। এরপর প্রশ্ন করল,
“সাগরের সম্পর্কে বলো।”
“সাগর ভাই আপার একমাত্র ননদের দেবর। প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে। বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসেছিল বেশ কয়েকবার। গায়ে পড়া ধরনের মনে হয়েছে। আমাকে বেয়াইন বলে ভীষণ খোঁ চাতো বলে এড়িয়ে চলতাম। আপাকে সব সময় বলত সে আপার বিগ ফ্যান। পিয়াসা ভাবির সঙ্গে আবার সখ্যতা ছিল। এরবেশি কিছু জানা নেই। আর হ্যাঁ, একে আমি আপার মৃ’ত্যুর মাস কয়েক পরেই একবার দেখেছিলাম। সাথে অন্য মেয়ে ছিল। বহাল তবিয়তেই ঘুরছিল।”
শ্রাবণ রেকর্ড অফ করল। কপালে সুক্ষ্ম রেখা। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিয়ে অনন্যার বলা একটা বাক্য নিয়ে ভাবে। পিয়াসার সঙ্গে সাগরের সখ্যতা ছিল। আবার এই সাগরই সরাসরি জড়িত শুভ্রা রহস্যের সঙ্গে। দুটো মৃ’ত্যু এক রকম না হলেও কিছু মিল প্রকট হয়ে উঠছে। সাগরকে জানার ইচ্ছেটা যেন বেড়েই চলেছে। অনন্যা নিজেও কিন্তু চমকে উঠেছে। পিয়াসা-সাগর, সাগর-শুভ্রা বিষয়টা বড্ড চোখে লাগছে। ও উত্তেজিত চোখে চায় শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ বুঝতে পারল। ওর সামনেই জামশেদকে ফোন করে বলল সাগরের ব্যাপারে খোঁজ খবর চালাতে। রাশেদের ব্যাপারেও খোঁজ লাগালো। তার সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে হবে। স্ত্রীর অটোপসি রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া, মামলা বন্ধ করতে ইন্ধন দেওয়ার কৈফিয়ত তো আদায় করতেই হবে।
অনন্যা বলল,
“আমার আপা ন্যায় বিচার পাবে তো? তুমি পারবে সত্যিটা বের করতে?”
শ্রাবণ দৃঢ় গলায় বলল,
“সত্যি হলো আগুনের মতো। একে ধামাচাপা দেওয়া যায়। নেভানো যায় না। সত্যের ওপরে মিথ্যার পাহাড় গড়ে ফেললেও এক সময় সত্যিটা সেই পাহাড়ের ভূ-গর্ভ থেকে আগ্নেয়গিরির রূপ নিয়ে অগ্নুৎপাত ঘটাবে। শুভ্রার সঙ্গে অন্যায় হলে অ’প’রাধীকে তো বের করতেই হবে। সে শুধু শুভ্রার অ’প’রাধী নয়, তোমার গোটা পরিবারের অ’প’রাধী হবে। একটা গোটা পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
আলোচনা সাঙ্গ হলে কফির বিল এলো টেবিলে। অনন্যা ডাকল,
“মিস্টার শাহনেওয়াজ শিকদার!”
ডাকটা শুনে শ্রাবণের মুখে বিরূপ আভাস দেখা গেল। গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনার কণ্ঠে শ্রাবণ নামটাই বেশ আন্তরিক শোনায়, মিস অনন্যা।”
“পুলিশের জেরা করা শেষ হলে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
“শেষ হয়েছে। বলতে পারো।”
“ওকে, কিপ্টে শ্রাবণ!” অনন্যা ঠোঁট টিপে হাসল। কফির বিলটা নিজের দিকে টেনে নিতে গেলে শ্রাবণ তার বলশালী হাতের থাবায় সেটা নিজের কাছে টেনে নিল। খোঁ চাটা ধরতে পেরে বলল,
“শ্রাবণ আগে মায়ের টাকায় চলত। তাই কিপ্টে ছিল। এখন সে নিজের টাকায় চলে, তাই মিতব্যয়ীতে উন্নিত হয়েছে।”
“তোমরা কী বাড়িটায় থাকো না? এখন আর দেখা হয় না যে? আন্টিকেও তো দেখি না।”
“অফিসের কাছে বাসা নিয়েছি। আমার ও মায়ের ছোটো একটা সংসার পেতেছি। আমাকে নিয়ে অনেক স্ট্রাগল করেছে, মা। এবার একটু শান্তি দিতে চাই। কিন্তু সকালে ফোন করার পর অমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছিলে তুমি?”
অনন্যা স্মিত হাসল। সকালের ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠছে। সাবান দিয়ে ডলে গোসল করলেও যেন দৃষ্টি থেকে লাগা নোংরা গা থেকে সরানো যাবে না। হাবীব যখন ওকে সবদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল তখনই দৈবাৎ একটা কল আসে অচেনা ফোন নাম্বার থেকে। অনন্যা তড়িঘড়ি করে রিসিভ করতেই শুনতে পায় শ্রাবণের কণ্ঠস্বর। তখনই মাথায় যা এসেছে তাই করেছে।
“এসপি শাহনেওয়াজ শিকদার বলছেন?… আর বলবেন না, টিউশনিতে এসে আটকে গেছি। স্টুডেন্টের অভিভাবক ছাড়তেই চাইছে না।… আপনি কখন দেখা করবেন আমার সাথে?… হ্যাঁ, আমি ফ্রি আছি।”
গৃহকর্তা প্রথমটায় ভড়কালেও অনন্যার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। এইসব ট্রিকস এখন পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু অনন্যা যখন হুট করেই উনার কানে ফোন ঠেকিয়ে শ্রাবণকে পরিচয় দিতে বলে তখন আর সন্দেহ থাকে না। অনন্যা প্রায় ছুটে বের হয়ে আসে।
শ্রাবণের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক কিছু ভেবে বলল,
“অনন্যা, ইজ এভ্রিথিং অলরাইট?”
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে হালকা গলায় বলল,
“পুলিশের সঙ্গে পরিচয় থাকাটা মাঝে মাঝে বেশ উপকারী।”
চলবে…