বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-১৪

0
720

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে [১৪]
প্রভা আফরিন [কোনো ক্রমেই কপি করবেন না❌]

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আঁধারের মাঝে বুঝলাম একটা বিদঘুটে, মোটা ও শক্তিশালী হাত আমার গলা চেপে ধরেছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। শ্বাসনালী পিষ্ট হচ্ছে দানবীয়, লোমশ লোকটির হাতে। আমি পা ছুঁড়ছি বিছানায়, হাত দিয়ে খাঁমচে দিচ্ছি না দেখা লোকটির হাত। তবুও মুক্তি পাচ্ছি না। আমি বোধহয় মা’রা যাচ্ছি। ধস্তাধস্তির মাঝেই মনে করছি প্রিয় মানুষের মুখ। মায়ের মুখটাই মনে পড়ছে শুধু। মনে হচ্ছে মা অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ বিরক্তি ভরে তাকিয়ে দেখছেন আমার মৃ’ত্যু। যেন উটকো এক ঝামেলার চির বিদায় দেখছেন। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
“মা…মাগো! শেষবারের জন্য আমায় একটু ভালোবাসো!”

ঘামে জবজবে হয়ে ঘুম ভাঙল অনন্যার। খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছোটাছুটি করছে হৃৎপিণ্ডটি। চোখ মেলে চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না ও। ধাতস্থ হতে সময় লাগল অনেকক্ষণ। গলা শুকিয়ে গেছে৷ খাট থেকে নেমে পানি খাওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই নেই। ভয়ানক স্বপ্নটাকে এখনো জীবন্ত মনে হচ্ছে। এই অন্ধকারেই যদি লুকিয়ে থাকে কোনো অশরীরী দানব, যে এক থা’বাতেই কেড়ে নেবে প্রাণ! বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে সময় দেখল অনন্যা। ভোর চারটে বাজে। স্ক্রিণের স্বল্প আলো চোখে পড়তেই খেয়াল হলো ঘুমানোর আগে পাশের বেডের তমা আপুর সঙ্গে মুভি দেখেছে। সেখানে স্বপ্নের মতোই একটি দৃশ্য ছিল। ঘুমের ঘোরে তারই প্রতিফলন দেখিয়েছে মস্তিষ্ক। বুক চিড়ে স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে আসে। অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে নিল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আজ মায়ের কাছে যাবে একবার। আপন মানুষদের সঙ্গ পেলে মনটা যদি একটু শান্ত হয়।

পুনরায় বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজল অনন্যা। ভেঙে যাওয়া ঘুম জোড়া লাগানো কষ্টসাধ্য। ক্লান্ত দেহ এক্ষেত্রে অব্যর্থ ওষুধ। শরীর যখন নিজ থেকে বিশ্রাম প্রার্থী হয় তখন ময়লা, শক্ত বিছানাও আরামদায়ক মনে হয়। কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে মাথা ব্যথা হয়ে গেল ওর। বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। অপেক্ষায় রইল ভোরের আলোর। হঠাৎই বুকের ভেতর চিড়চিড় করে ওঠে পুরোনো ব্যথা। বাবা কী কোনোদিন ভেবেছিল তার আদরের মেয়ে একদিন হোস্টেলের শক্ত বিছানায় একাকিত্ব আঁকড়ে পড়ে থাকবে? নাকি অনন্যা নিজে কখনো ভেবেছিল পরিবার ছেড়ে আহ্লাদী মেয়েটি একদিন নিজে নিজে বাঁচতে শিখে যাবে?

পরিবার ছেড়ে থাকতে না পারা মেয়েটি এখন একা হোস্টেলে থাকছে। বিশাল বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস যার সে এখন সিঙ্গেল বেডে গুটিসুটি হয়ে ঘুমায়, স্বল্পচেনা মেয়েদের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে, বাথরুম ব্যবহার করতে হয় সিরিয়াল অনুযায়ী। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করা মেয়েটা এখন ক্ষীণ স্বরে কথা বলতে জানে। গত দুই বছরে এই পরিবর্তন কী কল্পনাতেও ভেবেছিল অনন্যা? রান্না করলে পেটে কিছু পড়ে, নয়তো না খেয়ে দিন চলে যায়। সাবলেটে থাকে ও। মাস শেষে ভাড়া গুনতে হয়। সাথে নিজের খাওয়া-পড়ার খরচ! ভাইয়ার কাছে হাত পাততে সংকোচ হয়। আগে কোনোকিছু আবদার করতে অসুবিধা হতো না অনন্যার। কিন্তু এখন সে আবদার ও চাহিদার পার্থক্য বুঝতে শিখেছে। টিউশনের পাশাপাশি একটা পার্ট টাইম জব নিয়েছে মাস দুই হলো। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ক্লোথিং এণ্ড বিউটি ব্র‍্যাণ্ডের ধানমণ্ডি আউটলেটে বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োজিত আছে।

ফযরের আযান কানে আসতেই অনন্যা সকল ভাবনার দরজায় খিল এঁটে দিল। নানাজানের বাড়িতে থেকে নামাজ পড়ার অভ্যাসটা তার রপ্ত হয়ে গেছে। ও শান্ত মনে নামাজ আদায় করে। দুমুঠো ভাত চড়ায় হাড়িতে। সঙ্গে আলুভাজা। খেয়েদেয়ে সকাল সাতটায় হোস্টেল ছেড়ে বের হয়। দেড় ঘণ্টা টিউশন করিয়ে ছোটে ক্যাম্পাসে৷ নয়টা থেকে ক্লাস। বেলা বারোটায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করে ছুটবে ধানমণ্ডি। রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি টাইম। ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে, খেয়েদেয়ে বইপত্র নিয়ে বসতে হয়। অনন্যা এবার ফাইনাল ইয়ারে। পড়াশোনায় একটু মনোযোগ দিতে হচ্ছে। চাকরির পড়াটাও এখন থেকেই শুরু করেছে। কিন্তু সারাদিনের দৌড়ঝাপের ক্লান্তিতে অতিরিক্ত পড়াটা ঠিকমতো হয়ে ওঠে না।

দুটো ক্লাস করে অনন্যা শো-রুমে পৌঁছায় ঠিক বারোটায়। ইনচার্জ শফিক ওকে দেখে হেসে বলল,
“তুমি বেশ পানচুয়াল। পারফরম্যান্সও ভালো। এ মাসটা দেখে পরের মাসেই তোমাকে পার্মানেন্ট হিসেবে নেওয়া হবে।”
অনন্য স্মিত হেসে বলল,
“কিন্তু স্যার, আজ আমার একটু জলদিই ছুটি প্রয়োজন।”
“পার্মানেন্টের নাম উঠতেই ফাঁকিবাজি শুরু?”
“না স্যার, আসলে আজ মাকে দেখতে বাড়িতে যাব। দরকার না হলে চাইতাম না।”

শফিক জানাল ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে। এই শো-রুমের প্রত্যেকটা কর্মীই শিক্ষার্থী। কেউ পার্ট টাইম জব করে, কেউ ফুল টাইম। তাই ছুটিছাটা পাওয়া বিশেষ কষ্টের হয় না। কিন্তু কাজের ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। কর্মীদের সাজগোজ থেকে অঙ্গভঙ্গি প্রতিটি বিষয় নজরে রাখা হয়। শো-রুমে ঢোকার পর থেকে অনন্যার ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলে থাকে। কাস্টমারদের সঙ্গে ডিল করতে হবে হাসিমুখে। তার সামান্যতম আচরণেও তখন ব্যক্তিগত শোক-তাপের লক্ষণ দেখা দেওয়া যাবে না। দেখা গেলেই সিনিয়রের ঝাড়ি সহ্য করতেন হবে মুখ বুজে। অনন্যার শুরুতে কিছুদিন মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়েছে। কয়েকবার রাগে চাকরিও ছাড়তে চেয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজের পরিস্থিতি বিবেচনায় আর পারেনি। কেউ তো আর তাকে আরাম আয়েশের চাকরি দেবে না!

বিকেল পাঁচটায় ছুটি ম্যানেজ হলো অবশেষে। অনন্যা তড়িঘড়ি করে বের হওয়ার সময় শফিক একবার পিছু ডাকল,
“অনন্যা, আমি আসব পৌঁছে দিতে?”
অনন্যা শফিকের চোখের দিকে তাকায়। সে চোখে যেন এক ক্ষীণ প্রদীপ শিখা প্রজ্জ্বলিত হতে অনুমতি চাইছিল। অনন্যা ক্ষীণ শিখাটিকে নিভিয়ে দিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ স্যার! আমি একাই চলে যেতে পারব।”

অনন্যা নানাজানের বাড়ি এসে পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। চারিদিকে নামছে অবিশ্রান্ত নিকষ আঁধার। অনন্যার মা ও ভাইয়া এখন নানাজানের বাড়িতেই থাকেন। তুষার মাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে ওঠার ভরসা পায় না। এখানে আপন মানুষদের কাছে মা তবুও কথাবার্তা বলেন। কিন্তু একা থাকলে যদি বিষণ্ণতার কবলে পড়ে আবারো অসুস্থ হয়ে যায়! আঁখি বেগমের মানসিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্থির। কথা একদমই কম বলেন। অনন্যা বাড়িতে ঢুকে মাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। মমতাঘেষা গায়ের গন্ধে ওর মনের সমস্ত অস্থিরতা, ক্লান্তি যেন উবে গেল। অনন্যা সেই আগের নির্ভার ছোটো মেয়েটির মতো কাঁধে মুখ ঘষে আদুরে কণ্ঠে বলে উঠল,
“মা, মা, কেমন আছো তুমি?”
আঁখি মেয়ের প্রতি একই আবেগ প্রকাশ করতে পারলেন না৷ হতে পারলেন না আগের সেই আহ্লাদ করা মমতাময়ী। আলতো হাতে মেয়েকে ধরে নির্জীব স্বরেই বললেন,
“ভালো আছি। ঘরে যা। হাত-মুখ ধুয়ে নে। আমি দেখি রান্না হলো কিনা।”
অনন্যার উষ্ণতা প্রত্যাশি মন মায়ের শীতল স্পর্শে তৃপ্ত হয় না। অবশ্য মায়ের এই শীতল ব্যবহারের কারণ অনন্যার জানা। মা তাকে অনেকবার বিয়ে দিতে চেয়েছেন। অনন্যা রাজি হয়নি। এ নিয়ে বিস্তর মন কষাকষি আছে দুজনের মধ্যে।

অনন্যা গোসল সেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই পরিচিত আতরের গন্ধটা ওর নাক ছুঁয়ে যায়। নানাজানের উপস্থিতি আশেপাশেই আছে। অনন্যা মাথায় ওড়না দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বের হয়। মুখোমুখি হয় ইসহাক রহমানের। ইসহাক রহমানের বয়স হলেও এখনো মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটেন। ঘন, শুভ্র মেঘের মতো চুল-দাড়ি উনার। গায়ে সাদা জুব্বা। লালচে ফরসা মুখশ্রীতে মিষ্টি একটি হাসি প্রশস্ত হয় নাতনিকে দেখে। মেয়েটা বাড়ি এসেছে শুনেই দেখা করতে আসছিলেন তিনি।
“আসসালামু আলাইকুম আপু।”
অনন্যার চোখে-মুখে প্রশান্তি থাকলেও কপট অসন্তোষের সঙ্গে সালাম গ্রহণ করে বলল,
“একবারও আগে সালাম দিতে পারি না আমি। আপনার সামনে এলেই কিছুক্ষণ সম্মোহিতের মতো কথা ভুলে যাই।”
“এ তো খুবই অন্যায়!”
নানাজান হেসে ফেললেন। অনন্যাকে একপলক দেখেই পুনরায় বললেন,
“সারাদিন কিছু খেয়েছেন?”
“সকালে খেয়েছি।”
“এরপর?”
অনন্যা চুপ করে গেল। সকালে রান্না করে খাওয়ার পর পেটে পানি ছাড়া আর কিছু পড়েনি। খারাপ স্বপ্নটার প্রভাবেই বোধহয় আজকে সারাদিনটা বিক্ষিপ্ত গেল। নানাজান আবার বললেন,
“আপনি কোনো কারণে অস্থির?”
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে। এই একটা মানুষের সামনে কী করে যেন সব ধরা পড়ে যায়। জিভও মিথ্যা বলতে পারে না। নানাজান বললেন,
“পরে কথা বলব আমরা। আসুন, আমার সঙ্গে বসে খাবেন।”

সকলে একসাথে খেতে বসলে বড়ো মামী বললেন,
“কাল থেকে যা, অনু।”
“কেন?”
“ভালো একটা ছেলে আছে হাতে। কাল আসতে বলি? দেখে যাক তোকে। এমন ছন্নছাড়া জীবন আর কত? এবার একটু থিতু হ।”
অনন্যা কোনো জবাব দিল না। এমন সময় তুষারের ফোন বেজে উঠল। সে অবাক হয়ে দেখল আজ প্রায় বছরখানিক পর তার প্রাক্তণ স্ত্রী পিয়াসা ফোন করেছে। তুষার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। রুমে গিয়ে ফোন ধরতেই শুনতে পায় নারী কণ্ঠের আর্তনাদ,
“তুষার, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল ছিলাম। তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। অনেক…”
“হ্যালো! হ্যালো! পিয়াসা, শুনতে পাচ্ছো?”

ফোন কেটে গেছে। তুষার হকচকিয়ে গেল। ডিভোর্সের আগে কম অনুনয় করেনি সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে। পিয়াসা নির্দয়ের মতো তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মুখটা পর্যন্ত দেখতে চায়নি। তাহলে আজ এই স্বীকারোক্তি কীসের জন্য? কী বলতে চায় ওকে? তুষার ফোন করল বারবার। প্রথমে একবার বাজল। এরপর থেকে সুইচ অফ। তুষারের বুকের ভেতরটা খচখচ করে। হঠাৎ এভাবে ফোন, এমন কম্পিত স্বরের অসমাপ্ত বাক্য এবং হুট করেই ফোন সুইচ অফের কারণ কী? এত রাতে যোগাযোগের আর উপায় নেই। তুষার ভাবল সকালে একবার দেখা করতে যাবে কিনা।
সকালে তুষারের ঘুমটা ভাঙল ফোনের শব্দে।
“হ্যালো! আমি এসআই জামশেদ বলছিলাম। আপনি কী মি. তুষার বলছেন?”
“জি!” পুলিশের ফোনে তুষারের ঘুমের রেশ ছুটে পালিয়েছে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। অপর পাশ থেকে জবাব এলো,
“আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে।”
“কেন?”
“পিয়াসার খু’নের ব্যাপারে কথা বলতে।”
“পিয়াসা খু’ন হয়েছে?”
তুষার যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। নতুন করে কোন ঝড় আসছে তাদের জীবনে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে