বৃষ্টি এসো সাঁঝের বেলা ১১তম পর্ব

0
1872

#বৃষ্টি_এসো_সাঁঝের_বেলা
#১১তম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



তারপর আমার কাছে এসে সর্দার ছেলেটা আমার উড়নায় হাত দিতেই খুঁটিতে ঝুলন্ত ছেলেটা পিঁপড়ার কামড়ের অসহ‍্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে সর্দারকে গাল বকে দিলো।সে অশ্লীল ভাষায় বললো,’আমি তোর দুলাভাই লাগিরে শুয়োরের বাচ্চা যে আমার লগে মজা করস?’
এই কথা শুনে আমার উড়না ছেড়ে দিয়ে সে দৌড়ে গেল ওই ছেলেটার কাছে।আর ঠিক এই মুহূর্তে ছাদে উঠে এলো চারজন দীর্ঘ দেহী পুরুষ। তাদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত।তার নাম নিতুল। আমার বর নিতুল।ওরা কীভাবে খুঁজ পেলো আমি যে এখানে কী জানি!ওরা এসেই প্রথমে সর্দার ছেলেটাকে ধরে ফেলল।মুক্তির আনন্দে তখন আমার চোখে জল এসে গেল। কিন্তু ততক্ষণে একটা বিপত্তিও বেঁধে গেলো এখানে।একটা ছেলে পেছন থেকে এসে আমায় জাপটে ধরে ফেললো। তারপর আমার গলায় চাকু ধরে বললো,’মাইরা দিমু কইলাম। সর্দাররে ছাড়।ছাইড়া দে সর্দাররে।’
ওরা আমার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো ছেড়ে দিলো সর্দারকে।
তারপর ওই ছেলেটা আমার উড়নাটায় হাত দিলো। ঠিক তখন আমার কাছে দৌড়ে এসে নিতুল ওই ছেলেটার কলার টেনে ধরতেই নিতুলের তলপেটে চাকু বসিয়ে দিলো ছেলেটা।
আমি আগে বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমার পায়ে তরল কিছু গড়িয়ে পড়ায় নিচ দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিৎকার করে উঠলাম।ওই ছেলেগুলো ততক্ষণে পালিয়ে গেছে।নিতুলের সাথে আসা আরো তিনজন লোক দৌড়ে এসে নিতুলকে ধরলো। তারপর ওরা বললো,’ভাবী,আমরা নিতুলের বন্ধু।ভয় নেই। আল্লাহ আছেন। ওকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।’
আমি কোন কথা বললাম না। চুপ করে শুধু নিতুলকে দেখছি।নিতুলের সাথে কেন রাগ করে আমি চলে এসেছিলাম!ও আমার উড়নার সম্মান রক্ষায় তার জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে পারে! আচ্ছা নিতুলকে কী আমি ভুল বুঝেছি কোথাও? যদি ভুল বুঝে থাকি আর নিতুল সঠিক হয় তবে কী আমি তার কাছে ক্ষমা পাবো?
আমি নিতুলের দিকে তাকিয়ে আছি।ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।চোখের পাতা কেমন ভিজে উঠছে জলে। ওরা ওকে ধরাধরি করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামাচ্ছে। ওদের মধ্য থেকে হঠাৎ একজন বললো,’অনেক ব্লাড যাচ্ছে ওর পেটে কোন কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধা প্রয়োজন।’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি টেনে খুলে ফেললাম আমার উড়না। তারপর সেই উড়না তার পেটে বেঁধে দিয়ে বললাম,’যে উড়নার সম্মান বাঁচাতে গিয়ে আজ তোমার এ হাল সেই উড়না আজ তোমার শরীরে বেঁধে দিলাম।’
নিতুল তখন কী যেন বলতে চাইছে ঠোঁট নাড়িয়ে কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না বলার।ওর চোখ থেকে শুধু টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল।
আমি কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদছি।আর মনে মনে ভাবছি, আমার জীবনে এতো পরীক্ষা কেন বারবার ফিরে আসে?
একটু পরই তো সবকিছু জেনে যাবে বাবা- মা। তারপর ওরা ছুটে আসবে হসপিটালে। তখন আমার কী হবে?
ওরা যখন জিজ্ঞেস করবে,’তোকে বাঁচিয়েছে আমার ছেলে তুই কেন পারলে না আমার ছেলেকে বাঁচাতে?তোর জন্য আমার ছেলে জখম হয়ছে। তোকে আমি ছাড়বো না!
তখন? তখন আমি কী করবো?কী বলবো তাদের?

হসপিটালে নেয়ার পর ডাক্তার জানালো ইমার্জেন্সি কেস।প‍্যাসেন্টকে রক্ত দিতে হবে। কিন্তু ওর রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ।ওর গ্রুপের সাথে আমাদের কারোর গ্রুপের মিল নেই। আমি অসহায় মুখে ওর বন্ধুদের বললাম,’আপনাদের চেনা জানার মধ্যে কেউ এমন নাই যার সাথে ওর ব্লাড গ্রুপের মিল আছে।’
দুজন সরাসরি না বললো। একজন খানিক সময় চুপ থেকে কী যেন চিন্তা করে বললো,’আছে। বিন্দুর সাথে ওর ব্লাড গ্রুপের মিল আছে।’
আমার এই মুহূর্তে এইসব কিছু ভাবার সময় নেই বিন্দুর সাথে নিতুলের সম্পর্ক কী। আমি নিতুলের বন্ধুকে অনুনয় করে বললাম,’প্লিজ ওকে নিয়ে আসুন না ভাইয়া! প্লিজ!’
নিতুলের বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বড় রাস্তাটার দিকে গেল। আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

ডাক্তার বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। খুব দ্রুত রক্ত দিতে না পারলে প‍্যাসেন্ট মারাও যেতে পারে।শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।নিতুলের বন্ধু এখনও ফিরে আসছে না বিন্দুকে নিয়ে।বিন্দু কী তবে গা ধরে বসে আছে।ও কী আসবে না!
বিন্দু যদি না আসে নিতুলের কী হবে!
নিতুল,নিতুল বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম আমি।

বাবা -মা এসে গেছেন।কার কাছে জানি তারা খবর পেয়েছেন।বাবা এখানে ওখানে খোঁজ নিচ্ছেন রক্ত ম‍্যানেজ করতে। আর মা চিৎকার করে কাঁদছেন। তিনি কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছেন।জোর করেই চলে যেতে চাচ্ছেন অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে যেতে দিচ্ছে না।
নিতুলের এক বন্ধু মাকে টেনে নিয়ে এলেন বারান্দায়।মা বললো,’নিতুল, আমার নিতুলের কী হবে?’
ওর বন্ধুটি বললো,’ব্লাড ম‍্যানেজ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ব্লাড ম‍্যানেজড মানে? বিন্দু কোথায়?বিন্দু?’
মার মুখে বিন্দুর নাম শুনে আমি অবাক হলাম। তবে কী মাও বিন্দুর ব‍্যাপারে সবকিছু জানেন!
ওর বন্ধুটি বললো,’আন্টি শুভ্র বিন্দুকে আনতে গেছে। এখনও ফিরছে না!’
মা তখন দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে ডাকলেন,’পৃথু !’
আমি মার দিকে তাকালাম।মা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,’পৃথু, মাত্র দুদিনে কী সব হয়ে গেল বল তো মা!তোরা আমায় না জানিয়ে এভাবে পালিয়ে গেলি কেন?আমায় জানালে কী তোদের কথা আমি শুনতাম না?তোরা যদি আমার কাছে থাকতি তবে কী এই বিপদ হতো?’
আমি কাঁদছি।মার মহানুভবতা, আমার ভুল রাগ আর নিতুলের ভুল সিদ্ধান্ত এবং দুঃখের কথা ভেবে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।মা বলছেন,’বিন্দু আসছে না কেন এখনও? বিন্দু তো এই খবর শুনে দেরি করার কথা না।ওর তো পাগল হয়ে ছুটে আসার কথা!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে