#বিষাদময়_নিষাদ
পর্বঃ ০৭
জাহান আরা
চন্দ্রর জ্ঞান ফিরে অনেকক্ষণ পর।
চোখ মেলে দেখে তার এক পাশে নিষাদের বেড রাখা,নিষাদ তাকিয়ে আছে তার দিকে।হাসনাত সাহেব বসে আছে তার বেডের পাশের চেয়ারে সাথে তুসি।তুসির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় চন্দ্র।
এই জীবনে সবাই স্বার্থপর,নিজের স্বার্থের জন্য সবাই প্রতারণা করে যায়।
একটু পরে সুমন এসে উঁকি দিলো কেবিনে।
সুমন কে দেখে চন্দ্রর মন আরো বিষিয়ে যায়।
হাসনাত সাহেব বের হয়ে যায় কেবিন থেকে।সুমন ভিতরে আসে।
চন্দ্র কিছু বলার আগে নিজেই বলে,”নিষাদ ভাইয়ের অপারেশন ভালোভাবে শেষ হয়েছে ভাবী,ভাইয়ের জ্ঞান ও ফিরে এসেছে একটু আগে,জানেন ভাবী,ভাই চোখ মেলে আগে জিজ্ঞেস করেছিলো চন্দ্র কই।”
সুমনের চোখ জলে টলমল করছে।
চন্দ্র একনজর তাকায় নিষাদের দিকে।নিষাদ তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে।চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফোঁটা জল।
চন্দ্রর বুকের ভিতর কেঁপে উঠে,কেঁপে উঠে পুরো শরীর।এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না।
কেনো এসব হচ্ছে তার সাথে?
কি নাম এই কাঁপুনির?
ভালোবাসা?
“ভাই আপনাকে সেই কবে থেকে ভালোবাসে আপনি জানেন না ভাবী,শুধুমাত্র ভয়ে আপনাকে কখনো সরাসরি বলতে পারে নি,সবসময় আপনি ভাইকে অপছন্দ করে আসছেন বলে।
যেদিন ভাই শুনলো আপনার প্রিপারেশন খারাপ,পাগলের মতো হয়ে গেলো।
এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার,কথাটা সারাজীবন শুনে এসেছি,সেদিন প্রমাণ পেলাম ভাবী।
কিন্তু কি লাভ হলো ভাবী?
আপনি বুঝলেন না ভাইয়ের ভালোবাসা,অথবা আপনাকে বুঝতে দেয় নি কেউ।”
কথাটা বলে তুসির দিকে তাকায় সুমন,তুসির দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে।
লজ্জায় তাকাতে পারছে না তুসি কারো দিকে।
“একটা মানুষ সারাদিনের সব কাজ ফেলে রেখে আপনার কথা শুনতো,আপনি যদি চিনে ফেলেন সেই ভয়ে খুব কম কথা বলতো নিজে,দিন কি রাত আমলে না নিয়ে আপনাকে সময় দিতো,এমন ও হয়েছে ভাবী,সভায় বক্তব্য দেয়ার সময় আপনি কল দিয়েছেন,ভাই বক্তব্য দেওয়া বাদ দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে যেতো আপনার সাথে কথা বলার জন্য,কি অপরিসীম ভালোবাসা থাকলে কেউ কাউকে এভাবে ভালোবাসে ভাবী?
আপনি রাজনীতিতে নেমেছেন,ভাই আপনার বডিগার্ড হয়ে গেছে,আপনার বয়স কম,রাজনীতির অনেক কিছুই বুঝেন না।এই যে রাতদুপুরে আপনি বাড়ি ফিরতেন,কখনো কি একবার ভেবেছেন কে দেয় আপনার নিরাপত্তা?যেখানে দিনদুপুরেই মেয়েদের উপর যৌন আক্রমণ হয়!
আপনি যখন রিকশায় বাসায় ফেরেন আপনার রিকশার পিছন পিছন ভাই আসে আরেক রিকশায়,আপনার আসা যাওয়ার টাইমের উপর লক্ষ রেখে ভাই নিজের কাজ করতো,যেদিন আপনার বের হওয়ার কথা থাকতো সেদিন ভাই সব প্ল্যান ক্যানসেল করে দিতো,আপনার প্রতিটি মিটিং এ,আন্দোলনে ভাই হাজির হয়ে যেতো।
আমরা সবাই জানতাম আপনার জন্য ভাই কতোটা পাগল,শেষে আমার বুদ্ধিতে ভাই ফেসবুকে আপনার সাথে কথা বলে।
যেদিন আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়,ভাই যে কি খুশি হয়েছিলো,আপনি ভাবতেও পারবেন না।
আমি অবাক হয়ে দেখতাম শুধু একটা পাগল প্রেমিক কে।
যে শুধু ভালোবেসেই গেছে আপনাকে।”
চন্দ্র আর পারছে না সহ্য করতে,বুকের ভিতর এক অসহ্যকর ঝড় উঠেছে,সেই ঝড়ে সব উলটপালট করে দেয় চন্দ্রর।
উঠে বসে নিজের চুল চেপে ধরে চন্দ্র,তারপর কেঁদে উঠে চিৎকার করে।
বাহিরে হঠাৎ করেই গুঞ্জন শুরু হয়,তারপর গুঞ্জন রূপ নেয় মারামারি তে।
নিষাদের ইশারা পেয়েই সুমন বের হয়ে যায়।
২ মিনিটের মধ্যে সুমন ভিতরে ঢুকে,সাথে হাবিব আর একটা ছেলে।
দুজনের কলার চেপে ধরে রেখেছে সুমন শক্ত করে।
হাবিব কে দেখে চন্দ্র চমকে উঠে।
মুখ থেকে বের হয়ে যায় চন্দ্রর নিজের অজান্তেই,”হাবিব ভাই!”
সুমন নিজেই বলে নিষাদকে,”ভাই,এই যে হাবিব আর রোমান,হাবিবের কথামতো রোমান আপনার উপর হামলা করেছে।”
চন্দ্র অবাক হয়ে তাকায় হাবিবের দিকে।
কেউ কিছু বলার আগে হাবিব বলে উঠে,”দেখ নিষাদ,আমার কোনো দোষ নেই,আমাকে তোর স্ত্রী নিজেই বলেছে তোকে খুন করতে।”
অবিশ্বাস্য চোখে নিষাদ তাকায় চন্দ্রর দিকে,তারচেয়ে বেশি অবাক হয় সুমন।
চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে বলে,”ভাবী!!!”
এক মুহুর্ত লাগে চন্দ্রর বুঝতে হাবিবের কথা,বুঝতে পারতেই হতভম্ব হয়ে যায় চন্দ্র।
কবে বলেছে সে মনে করতে পারে না।
হাবিব নিজের ফোন বের করে চন্দ্রর মেসেজ বের করে সুমন কে দেয়,সুমন চোখ সরিয়ে নেয়,তার ইচ্ছে করছে না তাকাতে এই মেসেজের দিকে,হাত বাড়িয়ে নিষাদকে দেয় হাবিবের ফোন।
এক নজর তাকায় নিষাদ স্ক্রিনের দিকে,জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে চন্দ্রর লিখা মেসেজ,”আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে হাবিব ভাই ওকে”
মেসেজটা ডিলিট করে দেয় নিষাদ,তারপর ফোন ফিরিয়ে দেয়।
সুমন কে বলে,”ওদের ছেড়ে দে,কেউ যেনো ওদের আর একটা টোকা ও না দেয়।আমার কারো উপর কোনো অভিযোগ নেই।আমি যদি আগে জানতাম আমার চন্দ্র চায় আমি মরে যাই,তবে আমি কিছুতেই তখন বাঁধা দিতাম না।হাসিমুখে বুক এগিয়ে দিতাম ওর ছুরির সামনে।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”
বিজয়ীর হাসি হেসে হাবিব আর রোমান বের হয়ে যায় রুম থেকে,সেই সাথে বের হয়ে যায় সুমন আর তুসি।
চন্দ্র এখনো এক ঘোরের মধ্যে আছে।
কি বলবে সে নিষাদকে?
ক্ষমা চাইবে?
সেই সাহস ও তো নেই চন্দ্রর এখন,সে তো সত্যি সত্যি চায় নি নিষাদকে খুন করতে,শুধু রাগের বশে বলেছে হাবিব কে,কিন্তু চন্দ্র কি জানতো সত্যি এরকম করবে হাবিব?
নিষাদ কোমল স্বরে ডাকলো,”চন্দ্র!”
কেঁপে উঠলো চন্দ্র নিষাদের ডাক শুনে।
“এতো বেশী ঘৃণা করো তুমি আমাকে!
আমার বেঁচে থাকাও তোমার অপছন্দ চন্দ্র?”
চন্দ্র জবাব দিতে পারে না।
“তোমাকে দিবো বলে বুকের ভিতর একটা আকাশ সমান ভালোবাসা বুনেছি,কতোবার কতোভাবে হৃদয়ের মন্দিরে তোমাকে দেবী করে ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছি তুমি জানো না।
মাটিতে গড়া দেবী ও নাকি ভক্তের ভালোবাসা অনুভব করে আর তুমি রক্তমাংসে গড়া দেবী হয়ে বুঝলে না।
না,আমি বুঝাতে পারলাম না।
আমি পরাজিত সৈনিকের মতো রাতভর চোখের পানি ফেলেছি,রাত পোহাতেই আবার পুনরায় উদ্যোমে চেষ্টা করে গেছি অথচ তোমাকে পারি নি বুঝাতে।
আমার এই ব্যর্থতার দায়ভার একান্তই আমার।তুমি ভয় পেও না,তোমার প্রতি আমার যে ভালোবাসা ছিলো তা একবিন্দু ও কমবে না,না কমবে এক ফোটা পরিমাণে সম্মান,তবে আজ থেকে তুমি মুক্ত চন্দ্র,আমি এতোদিন ভালোবেসে যে শিকল তোমাকে পরাতে চেয়েছি বুকের খাঁচায় রাখার জন্য,সেই শিকল ছিঁড়ে ফেলে দিলাম।
তুমি সব বন্ধনমুক্ত চন্দ্র,সব রকমের বন্ধন।আবারও যদি আমার প্রাণ চাও তো অন্য কাউকে না,আমাকে বলো,তোমার সামনে হাসতে হাসতে প্রাণত্যাগ করবো।
তবুও অনুরোধ,অন্য কাউকে কখনো বলো না,কেউ যাতে তোমাকে কখনো অপবাদ দিতে না পারে।
আকাশের বুকের চন্দ্রের ও কলঙ্ক আছে,তবে আমার চন্দ্রে আমি কোনো কলঙ্ক লাগতে দিবো না।
বাহিরের মানুষকে জানিয়ে তুমি এই সুযোগ টা করে দিও না কাউকে যতোদিন আমার আছো।
আর যদি চাও এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে তো তোমার জন্য সেই পথ ও খোলা আছে,তুমি চাইলেই আমাকে ডিভোর্স দিতে পারো।”
চন্দ্র কিছু বলতে পারে না,না পারে কোনো প্রতিবাদ করতে।
ভাগ্য তাকে এমন পরিস্থিতে এনে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে চাইলেও চন্দ্র মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।তবুও কেমন কষ্ট লাগে চন্দ্রর নিষাদের কথা শুনে।
সবচেয়ে বেশি আঘাত পায় ডিভোর্সের কথা শুনে।
চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে বলে চন্দ্র,”আমাকে নিয়ে এই কোন খেলা খেলছো আল্লাহ?
আর কতো কাঁদবো আমি?
আমার ভাগ্যে কি একটু ভালোবাসা লিখা নেই?
আমি না হয় ভুল করেছি,তাই বলে এভাবে ওর মন থেকে আমাকে মুছে দিও না আল্লাহ।
আমাকে ওর ভালোবাসা ভিক্ষা দাও।আমি জীবন দিয়ে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে যাবো।”
চলবে…???
(রিচেক দিই নই,বানান ভুল হলে সরি)