বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-১১+১২

0
1036

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১১+১২

আহান দ্রুত ফোন রিসিভ করে বললো, কোনো ইনফরমেশন পেয়েছিস ?

ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ভাই ঢাকা শহর মোটেও ছোট জায়গা নয়। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস করে এই ঢাকা শহরে। এখানে একটা নাম আর একটা ছবি দিয়ে কাউকে খোঁজা মানে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। তুই মেয়েটার পুরো নামও জানিস না, কীভাবে খোঁজে পাবো ?

আসলে ভাইয়া যখন পাখিকে এখানে রেখে যায় আমি ওর উপর প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম তাই কিছু জানার আগ্রহ দেখায়নি। এখন যদি ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করি সন্দেহ করতে পারে।

তুই মেয়েটার পাসপোর্ট খোঁজে বার কর। সেখানে অনেক তথ্য পাবি আশা করি।

আরে ইয়ার এটা তো আমার মাথাতেই আসেনি।

তোর মাথায় তো এখন শুধু পাখি উড়ছে তাই আসেনি। এখন বাজে না বকে পাসপোর্ট খোঁজে দেখ, আরো কিছু জানতে পারিস কিনা।

ঠিক আছে।

আহান কল কেটে পাখির রুমের দিকে গেলো পাসপোর্ট খোঁজে বার করতে। পাসপোর্ট পেলে অনেক কিছুই জানা যাবে। তিতিরের সারা রুম তন্নতন্ন করে খোঁজে কিছুই পেলো না। হতাশ হয়ে বসে পড়লো আহান। একটা সূত্র পাওয়ার আশা করেছিলো সেটাও ব্যর্থ হলো।

১৩.
নিজের কেবিন এলোমেলো করে কিছু খুঁজছে রায়হান। জিনিসটা যে তার কাছে অনেক বেশি দামী। কতগুলো বছর ধরে সেটা আগলে রেখেছে সে। আজ কীভাবে হারিয়ে গেলো, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। মৌ রায়হানের কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে তার অস্থিরতা দেখছে।

কিছু সময় পর শান্ত গলায় বললো, এটা খুঁজছিস রায়হান ?

মৌয়ের আওয়াজে চমকে পিছনে ফিরে তাকালো রায়হান। মৌয়ের হাতে কাংখিত জিনিস দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো। দ্রুত পায়ে মৌয়ের কাছে এসে জিনিসকে নিজের হাতে নিয়ে নিলো।

হাসি মুখে বললো, এটাই তো খুজছিলাম। তুই এটা কোথায় পেলি ?

মৌ স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতিরের বেডে পরে ছিলো।

রঙ বদলে গেলো রায়হানের চেহারার। ভীত চোখে তাকালো মৌয়ের দিকে।

মৌ চেয়ার টেনে বসে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো, একই রকমের দুটো কলম কিনেছিলাম আজ থেকে তাও কয়েক বছর আগে। একটা তোকে দিয়েছিলাম আর একটা তাজকে। দেওয়ার দুদিনের মাথায় তাজের কলমটা হারিয়ে ফেললেও তোর বুক পকেটে সবসময় কলমটা আমি দেখেছি এতবছর ধরে। কিন্তু আজ সেটা তিতিরের বেডে গেলো কীভাবে বল তো ?

রায়হান কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে সাজাতে লাগলো কী বলে এই পরিস্থিতি থেকে বের হবে।

মৌ আবার বললো, প্রথমদিন তোকে দেখে তিতিরের ভয় পাওয়া আমার সন্দেহ তৈরি করে। আমি খেয়াল করেছি তিতির তোকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। আজও দেখলাম ডুকরে কাঁদছে মেয়েটা আর বেডে পরে থাকতে দেখলাম তোর কলম। এবার বল তিতিরের সাথে তোর কী সম্পর্ক ?

রায়হান আমতা আমতা করে বললো, তুই ভুল বুঝছিস মৌ। তিতিরের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

মৌ কঠিন গলায় বললো, সত্যিটা বল রায়হান। আমার সাথে মিথ্যা বললে তার ফল ভালো হবে না।

রায়হান এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতির আমার মামাতো বোন।

মৌ অবাক চোখে তাকালো রায়হানের দিকে। যদি বোনই হয় তাহলে পরিচয় দিতে এতো সংকোচ কেনো রায়হানের আর তিতির ভয় কেনো পাচ্ছে নিজের ভাইকে।

মৌ সন্দেহাতীত ভাবে বললো, তিতির যদি তোর বোন হয় তাহলে ও ভয় কেনো পাচ্ছে তোকে আর তুই পরিচয় কেনো দিতে চাইছিলি না।

রায়হান নিজের চেয়ারে বসে বললো, তিতির ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় আমাকে। মাঝে অনেক বছর যোগাযোগ ছিলো না তাই ভয়টা বেড়েছে হয়তো।

তিতির কাঁদছিলো কেনো তুই ওর কাছে যাওয়ার পর।

সেটা আমি জানি না।

মিথ্যা বলবি না রায়হান।

আমি কোনো মিথ্যা বলছি না। জানি না কেনো কাঁদছিলো তিতির।

এদিকে থম মেরে বসে আছে তাজ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তার।

ভাঙা গলায় গার্ড তারেকের উদ্দেশ্যে বললো, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে তারেক।

তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না স্যার। নাম্বারটা আমার বন্ধু রায়হান চৌধুরী ইউজ করছে জেনে বারবার চেক করেছি কিন্তু বরাবরই এক ফলাফল।

তাজ বিধস্ত গলায় বললো, রায়হান আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু। ও কেনো আমার সাথে এমনটা করবে তারেক ?

তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, এটুকু জেনেই ভেঙে পড়েছেন স্যার ? বাকিটা কীভাবে সহ্য করবেন তাহলে ?

তাজ হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো তারেকের দিকে, আর কী বাকি আছে তারেক ? আমার জীবনে প্রিয় বন্ধুর তালিকায় দুজন মানুষ আছে। তাদের একজন আমার এতবড় ক্ষতি করলো, বিশ্বাসঘাতকতা করলো আর কী বাকি আছে ?

স্যার, আপনার বন্ধু দিনের আলোতে একজন দয়াবান ডক্টর আর রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে তার আরেক রুপ।

মানে কী বলতে চাইছো ?

যে হসপিটালে রায়হান চৌধুরী আছে, গরীব অসহায় মানুষদের অল্প ব্যয়ে চিকিৎসা দিয়ে সবার সামনে মহৎ সাজে তারা। রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে সেই হসপিটালের আরেকটা রুপ। সেটা সবার চোখের আড়ালে।

তুমি কী বলতে চাইছো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তারেক।

ঐ হসপিটালের রাতের অন্ধকারে একটা নোংরা রহস্য লুকিয়ে আছে স্যার। আমাদের কাছে প্রমাণ নেই, তবে এসব সত্যি। আপনি চাইলেই রায়হানের সাথে পেরে উঠবেন না। সে অন্ধকারে নিজের একটা রাজত্ব তৈরি করেছে। সেখানে কেবল তারই রাজ চলে। স্যার আমাদের যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে কেবল বিপদ বাড়বে।

তাজ কিছু ভাবতে পারছে না। সে এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারছে না। বন্ধু যদি শত্রু হয়ে তাহলে সেটা অনেক ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তার জানা থাকে আপনার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে।

তাজ টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি কিছু ভাবতে পারছি না তারেক।

তারেক আশ্বস্ত করে বললো, স্যার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। রায়হান চৌধুরী কেনো আপনাকে নিজের শত্রু মনে করে একটু চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন। একটু চেষ্টা করুন, বুঝার।

তাজ এলোমেলো পায়ে নিজের গাড়ির দিকে গেলো। কোনরকমে বাড়ি পৌছে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাদের এত বছরের বন্ধুত্ব।

রাজ তুই কেনো কম্পিটিশন থেকে নাম কেটে দিয়েছিস ?

আমাকে রাজ বলবি না। আমার নাম রাজ নয়, রায়হান।

তাজ বিরক্ত হয়ে বললো, এতবড় নাম বলতে ভালো লাগে না আমার। তাই তো কত সুন্দর করে আমার নামের সাথে মিলিয়ে তোর নাম রেখেছি রাজ। তাজ আর রাজ কত সুন্দর মিলে গেছে।

রাজ আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আজ তাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাজ আর রাজ দুজনেই কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিলো। দুজনের গানের গলায় অনেক ভালো আবার অভিনয়ও করবে একটা নাটকে। তারা সহপাঠীরা মিলে একটা নাটক করবে আজ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজ নিজের নাম কেটে দিয়েছে।

তাজ বললো, এখন বল নাম কেটে দিয়েছিস কেনো ?

আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।

তুই কত কষ্ট করে রিয়ার্সেল করেছিলি। এখন এসে এমন বলছিস কেনো ?

তোর কাজ তুই কর গিয়ে, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

রাজ হনহনিয়ে চলে গেলো তাজের সামনে থেকে। তাজ হা করে তাকিয়ে আছে রাজের যাওয়ার পানে। রাজ এখন সবসময় তার সাথে এমন রেগে থাকে কেনো বুঝে উঠে না তাজ। যেদিন থেকে মৌ তাজকে প্রপোজ করেছে সেদিন থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে তাজ। তাজ আর বেশি না ভেবে নিজের কাজে চলে গেলো। একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।

রাজ স্কুলের পেছন দিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হলো স্কুল ড্রেস পরা কিউট একটা মেয়ে।

রাজের পাশে বসে বললো, তুই রাগ করেছিস রাজ ?

আমার নাম রাজ নয় রায়হান।

এতদিন তো রাজ বলেই ডাকতাম আমরা।

এখন থেকে রায়হান বলে ডাকবি। রাজ রাজ বলে মাথা নষ্ট করবি না।

মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই রাগ করেছিস আমার উপর। ঠিক আছে যা তুই কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট কর, আমি কিছু বলবো না।

মৌ উঠে চলে আসতে গেলে রাজ হাত টেনে ধরলো তার, তোর মুখের হাসি দেখার জন্য এতো কষ্ট করার পরও কম্পিটিশন থেকে সরে এলাম তাও এমন করে কাঁদবি ?

তুই তো রেগে আছিস, কাঁদবো না কী করবো, নাচবো ?

রাজ মুচকি হেসে বললো, তুই তো নাচতেই পারিস না।

মৌ নাক ফুলিয়ে তাকালো রাজের দিকে। রাজ নাক টেনে দিলো মৌয়ের। এই মেয়েটাকে খুশি করতেই রাজ নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছে।

মৌ রাজের পাশে বসে বললো, আসলে তাজ অনেক কষ্ট করেছে এই কম্পিটিশনে জেতার জন্য। এই কম্পিটিশনে জিতে গেলে আন্টি একটা গিটার কিনে দিবে বলেছে। তাজের সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর তুই, কারণ স্কুলে তোরা দু’জনই সবচেয়ে ভালো গান গাইতে পারিস আর অভিনয় করতে পারিস। তাই তোকে বলেছি নাম কেটে দিতে। প্লিজ রাগ করসি না তুই। তুই তো আমার বন্ধু না ?

রাজ মনে মনে বললো, তাজের কষ্টটা তুই দেখলি আর আমারটা দেখলি না। আমিও কী কম কষ্ট করেছি এই কম্পিটিশন জেতার জন্য ? আজ শুধুমাত্র তোর হাসিমুখ দেখার জন্য সরে এলাম। তোর জন্য আমি সব করতে পারি মৌমাছি আর তুই তাজের জন্য।

শেষের কথাটা মনে মনে আওড়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো রায়হান।

রুমে ফোনটা তখন থেকে বেজে চলেছে। ফোনের আওয়াজে বর্তমানে ফিরে এলো তাজ। মৌয়ের কথায় রাজ সরে গিয়েছিলো, সেটা অনেক পরে জানতে পারে তাজ। সেই কম্পিটিশন অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতে যায় তাজ। কিন্তু সব জানার পর সেই জিতে কোন আনন্দ খোঁজে পায়নি সে৷ মৌকে অনেক বকেছিস এর জন্য। মৌ তাজের জন্য সব করতে রাজি ছিলো তো, রাজ মৌয়ের জন্য সব করতে রাজি। দশম শ্রেণিতেই মৌ প্রথম তাজকে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু তাজ মজা ভেবে উড়িয়ে দেয় আর রাজের ব্যবহার পরিবর্তন হতে থাকে তখন থেকে। তাজের সাথে দুরত্ব বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে থাকে তাদের জীবন। মৌ অনেকবার গোপনে তাজের পথ থেকে সরিয়ে এনেছে রাজকে। তাজ সেটা কোনো না কোনোভাবে পরে জেনেও গেছে।

তাজ বিড়বিড় করে বললো, সেসবের প্রতিশোধ নিতেই কী রায়হানের এই পদক্ষেপ। সেসব তো ছোটবেলার বাচ্চামি ভেবে কবেই ভুলে গেছি আমি। রায়হান কী সে সবই পোষে রেখেছে নিজের মনে ? কিন্তু পরে তো রায়হান নিজের ইচ্ছায় মৌয়ের সাথে মেডিক্যালে পড়েছে আর আমি বিজনেস। এই সবকিছুর উত্তর কেবল রায়হানের কাছেই আছে।

কে*টে গেছে আরো এক সপ্তাহ। তিতির এই এক সপ্তাহ হসপিটালেই ছিলো। তার সাথে ছিলো তাজ, তবে তাজের হসপিটালে থাকার উদ্দেশ্য ছিলো অন্য। তাজ নজর রেখেছে হসপিটাল আর রায়হানের উপর। হসপিটালে গোপন কিছু চলছে সেটা আন্দাজ করতে পারলেও সঠিক তথ্য পায়নি। এদিকে রায়হানের উপর নজর রেখে এটুকুও বুঝতে পেরেছে মৌ তাজের আশেপাশে থাকলে সেটা রায়হান ভালোভাবে নিচ্ছে না। কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে তাদের আলাদা করার চেষ্টা করে। তিতিরের দেখাশোনার জন্য নার্স আছে তাই তার দিকে নজর দিতে হয়নি তাজের। আজ হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে তাজ। তিতির বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে আর তাজ বেডের পাশের টেবিল থেকে রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।

তিতির ভাঙা গলায় বললো, নিজের নাক কে*টে পরের যাত্রা ভঙ্গ। কথাটা শুনেছেন স্যার।

তিতিরের গলা পুরোপুরি ঠিক হয়নি তবে কথা বুঝা যায়। তাজ তার কাছাকাছি থাকায় স্পষ্ট বুঝতে পারলো তিতিরের কথা।

তাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানে ?

তিতির মুচকি হেসে বললো, আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন ? আমি নিজেকে কষ্ট দিয়ে আপনাকে নাকানিচুাবানী খাইয়ে দিলাম।

তাজ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো তিতিরের দিকে, তারমানে তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো ?

তিতির হাসিটা বজায় রেখে বললো, তো আপনার কী মনে হয় ? ওয়াশরুমে ভূতে এসে আমাকে বাথটবে ফেলে রেখে গিয়েছিলো ?

তাজ গাল চেপে ধরলো তিতিরের, তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের দ্বারাই এসব সম্ভব। আর আমি কিনা নিজেকে দোষারোপ করে অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আই জাস্ট হেইট ইউ তিতির।

তাজ রেগে বের হয়ে গেলো তিতিরের কেবিন থেকে।

টলমলে চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তিতির, আপনি কোনো অপরাধ করেননি স্যার। তাই আপনার চোখে অপরাধবোধ দেখে নিজেকে আরো বেশি অপরাধী মনে হচ্ছিল। আজকে বলা কথাগুলোর জন্য আপনি হয়তো আরো বেশি ঘৃণা করবেন আমাকে, তবে নিজেকে তো অপরাধী মনে করবেন না। আপনার চোখে আমার জন্য অপরাধবোধ নয় ঘৃণা মানায়। আপনার ঘৃণা যে আমার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমি আর যে কয়েকদিন আপনার সাথে আছি, আপনার ঐ চোখে আমার জন্য তীব্র ঘৃণা দেখতে চাই কেবল। আমি যতদিন এই পৃথিবীতে শ্বাস নেই ততদিন যেনো আপনার চোখে আমার জন্য তীব্র ঘৃণা থাকে। আপনার ঘৃণা আমার আসক্তি। আপনার মনে আমার জন্য যদি একটুও মায়া তৈরি হয়, ভ,,ভালোবাসা তৈরি হয়, তার প্রকাশ যেনো হয় আমার মৃ*ত্যু*র খবরে আপনার চোখের দুফোঁটা নোনাজল।

তিতির চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখের কোণ বেয়ে পড়ছে নোনাজল। কেবিনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে চোখ মেলে তাকালো তিতির। মৌ এসেছে সাথে তিতিরের চিকিৎসা করা ডক্টর।

ডক্টর ইশরাক তিতিরের উদ্দেশ্যে বললো, নিজের প্রতি একটু যত্নশীল হন মিসেস খান।

মিসেস খান শব্দটা মৌয়ের বুকে তীরের মতো বিঁধল। এই ডাকটা শোনার অধিকার তো তার হওয়ার কথা ছিল। মৌ তিতিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। ইশরাক আরো কিছু কথা বলে চলে গেলো। মৌ এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে।

তিতির মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার উপর তোমার অনেক রাগ তাই না আপু ?

মৌ মলিন হেসে বললো, সত্যি বলবো নাকি মিথ্যা ?

মিথ্যা শুনতে ইচ্ছে করছে না, সত্যিটা বলো।

মৌ বসলো তিতিরের পাশে চেয়ার টেনে, তাজকে আমি কবে থেকে ভালোবাসি সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, ভালোবাসা কী সেটা বুঝার আগে থেকে আমি তাজকে ভালোবাসি। বিয়ের আসরে তোমার কথা শুনে আমার সারা পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো। এত ভালোবাসার প্রতিদান কী এমন হওয়ার কথা ছিলো ? কিন্তু সেদিন বাসায় গিয়ে তুমি যখন বললে তাজ নির্দোষ তখন তোমাকে খু*ন করতে ইচ্ছে করেছিল আমার। সেটাকে তুমি রাগ বলবে নাকি অন্যকিছু সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে ঠান্ডা মাথায় তোমার বলা সব কথা চিন্তা করার পর বুঝতে পারি তুমি পরিস্থিতির স্বীকার। কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা হয়তো তুমি চেয়েও সবার সামনে আনতে পারছো না। তারপর তোমার উপর থেকে রাগ চলে গেছে। তাজকে আমি ভালোবাসি আর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বাসবো। এখন কোনোদিন তাজ আমার হবে কি, হবে না। সেটা আমি নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। তাজ যদি আমার হয় তাহলে হাজার বাঁধা পেরিয়ে সে আমার হবে। আমার ভালোবাসা মিথ্যা কিংবা আবেগ নয় তিতির। আর যদি সে আমার না হয়,,,

মৌ কথা অসমাপ্ত রেখে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। তিতির কাঁদছে, সে একজনের এতবছরের ভালোবাসায় আঘাত করেছে। নিজেকে আবর্জনা মনে হচ্ছে তাজ আর মৌয়ের জীবনের।

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, তাজ তোমার হবে আপু, হতেই হবে। তাজ তোমার ছিলো আর তোমারই থাকবে।

১৪.
সময় বহমান দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে গেছে। তিতিরের প্রতি তাজের ঘৃণা বেড়েছে। তিতির নিজেই সেটা তৈরি করেছে নতুন নতুন কারণ দিয়ে। তাজের মুখে আই হেইট ইউ শব্দটা তিতিরকে অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। তাজ যখন তার দিকে একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকায়, সেই দৃষ্টি বুকে লাগে তিতিরের। তিতির কখনো ভুলতে পারবে না তাজকে আর ভুলতে চায়ও না। কিছুদিন ধরে সবকিছু অনেক অস্বাভাবিক শান্ত মনে হচ্ছে তিতিরের কাছে। যেনো আবার কোন বড় ঝড় আসতে চলেছে তাদের দিকে।

তিতির এক কাপ চা দিয়ে যাও।

ইরিনার ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে এলো তিতির। এ বাড়িতে আছে প্রায় দেড় মাস হতে চললো। তাজ আর ইকবাল খানের চোখের বিষ বলা চলে তিতিরকে। কিন্তু ইরিনা প্রথমদিকে তিতিরকে এড়িয়ে চললেও এখন খানিকটা স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করে। হয়তো একা একা থাকেন তাই তিতিরের সাথে টুকটাক কথা বলে নিজের একাকীত্ব কাটাতে চান। তিতির চা নিয়ে গেলো ইরিনার কাছে। ইরিনা বেলকনিতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

তিতির চায়ের কাপটা রেখে বললো, আপনার চা।

ইরিনা তিতিরের দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলো, তোমাকে কেমন অসুস্থ দেখা যাচ্ছে। সারাদিনে কিছু খাওনি।

বেশ কিছুদিন ধরে তিতির অসুস্থ ফিল করছে, অস্বস্তি হচ্ছে, শরীরটাও দূর্বল লাগছে। আজ সকালে তো বমিও করেছে। প্রেশার আর গ্যাস্টিকের সমস্যা মনে হচ্ছে তার কাছে। খাবার খেতে ইচ্ছে করেনি তাই আর খায়নি।

তিতির নিচু গলায় বললো, গ্যাস্টিকের সমস্যা হয়েছে একটু।

ইরিনা সন্দেহাতীত ভাবে বললো, বেশি অসুস্থ ফিল করলে বলো আমাকে। এখন একটা মেডিসিন নিয়ে কিছু খেয়ে নাও।

তিতির মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বুঝিয়ে ইরিনার রুম থেকে চলে এলো। তার খাবার দেখে বমি পাচ্ছে তাই আরো খেলো না। সে ছাঁদে চলে গেলো একটু ফ্রেশ বাতাস নিতে। পাখির কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। শেষ কথা বলেছিলো আরো সাতদিন আগে। পাখির সাথে কথা বলার সময় রায়হান সবসময় তাদের মধ্যে থাকে। কখনো একা কথা বলার সুযোগ হয়নি। সেদিন কথা বলার পর রায়হানেরও কোনো খোঁজ নেই। তিতিরের কেমন ভয় ভয় করছে, কিছু তো একটা হতে চলেছে আবার।

***
বিয়েটা আমি করতে কারবো না বাবা, হতাশ গলায় কথাটা বলে বাবার দিকে তাকালো মৌ।

মহিবুল রহমান গম্ভীর গলায় বললো, কেনো করতে পারবে না ? রায়হান তোমার ছোটবেলার বন্ধু, দু’জন দু’জনকে বুঝবে। ছেলেটা তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে প্রবলেম কোথায় ?

বাবা তুমি ভালো করেই জানো আমি তাজকে ভালোবাসি।

মহিবুল এবার কঠিন গলায় বললো, তাজ এখন বিবাহিত অন্যকারো স্বামী সেটা তুমিও ভালো করেই জানো।

মৌ অসহায় গলায় বললো, বাবা।

মহিবুল গম্ভীর গলায় বললো, বিয়েটা তুমি না করলে আমার মরা মুখ দেখবে। প্রত্যেক বাবার স্বপ্ন থাকে নিজের রাজকন্যাকে সাজিয়ে এক রাজপুত্রের হাতে তুলে দেওয়ার, আমারও আছে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার উপর।

মহিবুল বের হয়ে গেলো মেয়ের রুম থেকে আর মৌ ধুপ করে বসে পড়লো নিজের বেডে। সে কিছুতেই তাজের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবে না।

মৌ বিড়বিড় করে বললো, এটা তুই ঠিক করছিস না রায়হান।

***
কাবার্ড থেকে বাসায় পড়ার পোশাক বের করতে গিয়ে একটা ছোট ব্যাগ চোখে পরে আহানের। পাঁচদিন ধরে বড্ড বেশি উদাসীন হয়ে আছে সে। পাঁচদিন আগে রায়হান হঠাৎ হাজির হয় আহানের ফ্ল্যাটে। আহানের হাতে এই ব্যাগটা দিয়ে বলে আহান যেনো তার বলার সাথে সাথে পাখিকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। রায়হান অপেক্ষা করেনি, ব্যাগটা দিয়ে আবার চলে গিয়েছে। আহান কিছু না বুঝে রায়হানের দিকে কেবল তাকিয়ে ছিলো। পাখিকে ফিরিয়ে দিতে হবে ভাবতেই আহানের বুকের ভেতর কেমন করে উঠে। মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। পারবে না তাকে ছাড়া থাকতে। পাখিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনে সেই ব্যাগের প্রতি আর আগ্রহ হয়নি আহানের। এখন চোখে পড়তেই ইচ্ছে হলো এটাতে কী আছে দেখার জন্য। আহান ব্যাগটা নিয়ে নিজের বেডে বসলো। ব্যাগ খোলে ভেতরের জিনিস দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো আহানের। এটাতে পাখির পাসপোর্ট সহ যাবতীয় কাগজপত্র রাখা। আহান তাড়াতাড়ি পাসপোর্টটা নিয়ে খোললো। সবার আগে নামটা দেখলো, মানহা মাহমুদ পাখি। নামটা দেখে আহান থমকে গেলো।

মনে হচ্ছে স্পষ্ট স্বরে ছোট মেয়েলি কণ্ঠে বলছে, আহু আমার বোন হলে নাম রাখবো মানহা মাহমুদ পাখি।

সাথে সাথে ছোট একটা ছেলে বলছে, আর যদি বোন না হয়ে ভাই হয়।

নাহ আমার ভাই হবে না, আমার বোন চাই তাই বোন হবে। আমি আমার বোনকে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো, অনেক ভালোবাসবো।

বাহ্ ভালো তো তুতুলের বোন পুতুল। আমি ওকে পুতুল বলেই তাকবো। আমার কাছে বিয়ে দিবি তোর বোনকে ?

খানিকটা চিন্তা ভাবনার পর মেয়েটা উত্তর দিলো, নাহ তোর কাছে আমার বোনকে বিয়ে দিবো না। আমার বোন সবসময় আমার কাছে থাকবে। আমি দুইভাই দেখে বিয়ে করবো, বড় ভাইকে আমি বিয়ে করবো আর ছোট ভাইয়ের সাথে আমার বোনুর বিয়ে দিবো। তারপর সবসময় আমার বোনু আমার সাথে থাকবে।

আমরাও তো দুই ভাই রে বোকা, তুই ভাইয়াকে বিয়ে করে ফেলবি আর আমি তোর বোনুকে।

নাহ্ রাজ ভাইয়া পঁচা, আমি তাকে বিয়ে করবো না।

আমাকে বিয়ে করবি তুতুল।

তুই না বললি আমার বোনুকে বিয়ে করবি।

তুই আমাকে বিয়ে করলে অন্য কাউকে বিয়ে করবো না, গড প্রমিস।

তুই আগে ঠিক কর আমাকে বিয়ে করবি, নাকি আমার বোনুকে।

তোকে।

টপ করে চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়লে হুঁশ ফিরে আহানের। কত বছর হয়ে গেছে স্মৃতিগুলো আজও তরতাজা। মুখটা স্পষ্ট হয়ে গেছে স্মৃতিতে, তবে অনুভূতিগুলো সতেজ। শুধু মানুষটা হারিয়ে গেছে কোথাও।

আহান চোখ মুছে বললো, তোকে আমি মাফ করবো না তুতুল। তুই আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলি। এতো বছরেও তোকে ভুলতে পারিনি আমি।

আহান পাখির বাবা-মার নাম দেখে আরো একবার হোঁচট খেলো, আবির মাহমুদ ,সুলতানা পারভীন মামা মামী ? এজন্যই কী ভাইয়া বলেছিলো পাখি আমাদের আপন কেউ ?

আহান বিড়বিড় করে বললো, এক মিনিট তবে পাখির আপুনি তিতির, মুসকান মাহমুদ তিতির ?

আহানের সব হিসেব মিলে গেলো মুহুর্তে। পাখির আপুনি আর কেউ নয় মুসকান মাহমুদ তিতির।

খুশিতে চকচক করে উঠলো আহানের চোখদুটো, পাখির আপুনি তিতির আর কেউ নয় আমার তুতুল। পাখির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আমি আমার তুতুলকে পেয়ে গেছি। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও অন্য কোনো মেয়েকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারিনি রে তুতুল। পাখির মধ্যে হয়তো তোর ছায়া খোঁজে পেয়েছিলাম তাই ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। এবার তোকে খোঁজে বের করবো আমি।

আহান হাসিমুখে নিজের চোখের পানি মুছে ফেললো। উঠে দাঁড়ালো পাখির কাছে যাওয়ার জন্য।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে