বিরহ ভালোবাসা পর্ব-১৪

0
773

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৪.

রাতের আঁধার কাটিয়ে ধরনীর বুকে সূর্যের আলোয়ে ভূবন ভরা। জানালার কাছে আমগাছের মগডালে বসে কয়েক জোড়া শালিক পাখি কিচমিচ করছে।

মিষ্টি রোদের স্পর্শে চোখ খুলল লতা। চোখ খোলার পর নিজের অবস্থান আবিষ্কার করলো ঘরের মেঝেতে। দুচোখে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি। চোখে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই লতা বুঝতে পারল চোখের পাতা ফুলে গেছে। গতকাল রাতের দৃশ্য আবারও যেন চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্য এনে হাজির করেই চলেছে। সর্বশেষ একটি দৃশ্য যখন লতার চোখের সামনে এলো তখন লতা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। শাদাদ ভাইয়ের তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ যেন এখনও লতার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে। লতা ডানহাতের তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের সাহায্যে নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করে।

লতার আজকের সকালটা কেন যেন অন্যান্য সকালের চেয়েও ভিন্ন মনে হচ্ছে! রোজ হোস্টেলের সেই ছোট্ট বিছানায় ঘুম ভাঙতো নীলাদ্রির ডাকে। কিন্তু, আজ সূর্যের নরম মিষ্টি রোদের স্পর্শ আর শালিক জোড়ার ডাক, কিছু মিষ্টি মূহুর্তের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ। ব্যস, আজকের সকালের মতো এত অবিস্মরণীয় মূহুর্ত পাবে কোথায় লতা?

চট করে উঠে দাঁড়ায় লতা। এলোমেলো শাড়ির কুচিটা হাতে নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমগাছের ডালে থাকা শালিক জোড়াদের দিকে তাকায় লতা। এক জোড়া ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আদরে ব্যস্ত। অন্য জোড়া শুধু কিচমিচ করেছে। সর্বশেষ পাখির জোড়াটার একটা শালিক পাখি হুট করে নীল আকাশের দিকে উড়াল দেয়। একা হয়ে যায় গাছের ডালে বসে থাকা পাখিটা।

লতার হুট করে ওর এবং শাদাদ ভাইয়ের জীবনে কি হতে চলেছে বুঝে ফেললো। শেষের পাখির জোড়াটা থেকে যেমন একজন চলে গেছে আর অন্যজন একা হয়ে পরেছে। ঠিক তেমনি হবে হয়তো ওদের পরিণতি।

এমনসময় লতার ঘরে এসে উপস্থিত হয় ওর মা তৃনা। মেয়েকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুটি করে নিজেও এগিয়ে গেলেন জানালার ধারে। লতা ওর মাকে দেখেও চুপ করে জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত করে। তৃনা মেয়েকে প্রশ্ন করে,

— গতকাল কাউকে কিছু না বলে ওভাবে পার্টি থেকে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে তোর?

নিজের মায়ের প্রশ্ন শুনে লতা মুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মাথাব্যাথা করছিল তাই চলে এসেছি। তাছাড়া একসপ্তাহ পর আমার পরীক্ষা। তাই বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম পড়াশোনা করব ভেবে। কিন্তু, আসার পর মনে হলো বই তো সব হোস্টেলে।

ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে একের পর এক মিথ্যে কথা বলে তবেই মায়ের মুখের দিকে তাকালো লতা। তৃনা মেয়ের কথা কিছুটা বিশ্বাস করেছেন। পার্টিতে যখন লতা এবং শাদাদ কেউই উপস্থিত ছিল না তখন তিনি মনে করেছিলেন যে, হয়তো ওরা একসাথে আছে। কিন্তু, বাড়িতে আসার পর যখন দেখলেন লতা ওর ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তখন আর সন্দেহ করেননি। কারণ, শাদাদ বাড়িতে ফিরে এসেছিল রাত প্রায় একটার পর।

লতার এত সুন্দর সকালটা হুট করে বিষাদে রূপান্তরিত হয় গেছে শুধুমাত্র একটিমাত্র বাক্যে। খুব কি জরুরি ছিল এই দিনটা এত তাড়াতাড়ি জীবনের আসার?

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাগুলো শুনছিল লতা। মনে মনে তখন নয় নম্বর বিপদ সংকেত চলছিল।

— রুপার দেবর রবিন ছেলেটা কিন্তু কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার। ভালো বেতনের চাকরি পেয়েছে গতমাসে। প্রথম বেতন নাকি চল্লিশ হাজার। ধীরে ধীরে নাকি বেতন আরও বাড়বে। গতকাল রাতে তুই তো চলে এলি। রুপার শ্বাশুড়ি আমার হাত ধরে উনার ছেলের জন্য তোকে চাইলো। আমি পাকা কথা দেয়নি। তবে এটা বলে এসেছি যদি ছেলে-মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করে। তবে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আজ বিকেলে রবিনসহ ওদের পরিবার আমাদের বাড়িতে আসবে।
আমি জানি লতা তোর মনে এখন কি চলছে? তবে একটা কথাই বলব, আমি যা কিছু করছি সবটাই তোর ভালোর জন্য করছি। রবিন তোকে শাদাদের থেকেও ভালো রাখবে।

শেষের কথাগুলো লতার গালে হাত রেখে বললেন তৃনা। লতার চিৎকার করে ওর মাকে জবাব দিতে চাইছিল যে,

“মা রবিন কখনোই আমাকে শাদাদ ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালো রাখতে পারবে না। কারণ, ভালো থাকাটা আমি শাদাদ ভাইয়ের মাঝে নিয়েছিলাম”

কিন্তু, আফসোস লতার জবাব লতার মনে রয়ে গেছে। লতার মা লতাকে ফ্রেশ হয়ে চটজলদি নাশতা খেয়ে পার্লারে যেতে বলে গেছেন ফেসিয়াল করার জন্য। লতা হাল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে রইলো। কি করবে সে? শাদাদ ভাই নাহয় বুঝে নিবে লতা ওর বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে বলে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু, লতা নিজের মনকে কি বলে বুঝাবে ? লতার বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না!

লতা কোনোরকম গোসল সেড়ে নাশতা খেয়ে বের হয়ে আসে বাড়ি থেকে। যদিও বাড়ির সবাই জানে লতা পার্লারের যাওয়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। কিন্তু, লতা পার্লার না গিয়ে ওর এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে বসে রইলো। দু-ঘন্টা অতিক্রম হবার পর লতা বেরিয়ে পরে ওর বান্ধবীর বাড়ি থেকে। রিকশা ডেকে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্য।

ঘড়িতে সময় তখন দুপুর সোয়া বারোটা। রুপা এসেছে একটু আগে যেন ওর চাচীর সঙ্গে কাজে সাহায্য করতে পারে। শাদাদ সকাল থেকে বাড়িতে ছিল না। কিন্তু, কিছুক্ষণ আগে যখন বাড়িতে ফিরে এলো তখন বাড়ির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ কোনো অকেশান আছে কিংবা ফ্যামিলি গেট টুগেদার পার্টি।

শাদাদ ড্রইংরুমে বসে জুতো জোড়া খুলে সবে গা এলিয়ে দিয়েছিল। এমনসময় দরজা দিয়ে লতা বাড়িতে প্রবেশ করে। শাদাদ খেয়াল করে দেখলো লতার মুখটা শুকিয়ে আছে। এদিকে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লতাকে দেখতে পেয়ে ওর মা বললো,

—- ফেসিয়াল করেছিস তো নাকি? মুখটা এমন কালো দেখাচ্ছে কেন?

লতা বিরক্তিকর চোখে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরাতে গিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে থাকা শাদাদ ভাইকে দেখতে পেলো। চট করে চোখ ফিরিয়ে ছোট করে ওর মাকে বললো,

— করিয়েছি তো।

কোনোভাবে উত্তরটা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় লতা। শাদাদ ভাই থুতনিতে হাত রেখে ভাবতে লাগলেন বাড়িতে আসলে কি হতে যাচ্ছে?

রুপা আপা কি মনে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে জগ নিয়ে একগ্লাস পানি ঢেলে খাচ্ছিলো। শাদাদ রুপাকে দেখে অবাক হয় জিজ্ঞেস করলো,

— কি রে আপা তুই এই বাড়িতে কখনো এলি?

রুপা আপা গ্লাসটি টেবিলের ওপর রেখে ভেজা হাতটা ওড়নার কোণায় মুছে শাদাদের সামনে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আছে কিনা? না কেউ নেই। শাদাদের পাশে বসে রুপা আপা ফিসফিসিয়ে বললো,

— আজ লতাকে দেখতে আসবে তুই জানিস না গাঁধা?

“আজ লতাকে দেখতে আসবে তুই জানিস না গাঁধা”

কথাটি যেন শাদাদের কানে বারবার প্রতিধ্বনি তুলছে। শাদাদ রুপা আপার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার ভাষা যেন নেই শাদাদের শব্দভান্ডারে। রুপা নিজের ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। শাদাদের হাতের ওপর হাত রেখে রুপা ধীর গলায় বললো,

— দেখ শাদাদ ছোটবেলা থেকে আমরা দুই ভাই-বোন মা ছাড়া বড়ো হয়েছি। কিন্তু, মায়ের অভাববোধ করেনি কারণটা হলেন তৃনা চাচি। আজ পর্যন্ত আগলে রেখেছেন আমাদের নিজের সন্তানের মতো করে।

— তুই কি বলবি আপা সোজাসাপটা বলে ফেল।

যান্ত্রিক গলায় নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কতাটি বললো শাদাদ।

রুপা নিজের ভাইয়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো,,

— চাচিকে একবার বলে দেখ তোর মনের কথা। দেখবি চাচি তোর কথা ফেলতে পারবে না। তাছাড়া, রবিনের থেকেও তুই ভালো অবস্থানে আছিস। সবচেয়ে বড়ো কথা তুই লতাকে ভালোবাসিস। টাকা-পয়সায় কি আসে যায়? সংসারে ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। নয়তো, ভালোবাসাহীন সংসার দীর্ঘ জীবনের এই পথচলা বড্ড কঠিন রে শাদাদ ।

রুপা আপা চলে গেলেন রান্নাঘরে। শাদাদ ভাই তখনও চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছিলেন!

বিকেলবেলা…

রবিনের পরিবার এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। এরইমাঝে রবিনের মা বারবার তাগাদাদ দিচ্ছেলেন লতাকে নিয়ে আসার জন্য। রুপা চলে গেছে লতাকে নিয়ে আসার জন্য।

বাড়ির দোতলার দুটো ঘরে বিষন্ন মনে বসে আছে দুটো মানব-মানবী। দু’জনের মনে একে অপরকে জিতে নেয়ার কি আকুল আবেদন। বাহ্যিক আচরণ দেখে বলার উপায় নেই তারা একে অপরকে কতটা চায়? একটি দেয়ালের ভেদ করে কেউ কাউকে আপন করে নেয়ার সাহস জুটাতে পারছে না।

শাদাদ ভাই অন্ধকার ঘরটায় বসে আছেন। কি মনে হতেই চট করে দরজা খুলে পাশের ঘরটায় চলে যায়। যেখানে তার মনের একচ্ছত্র রাণী মাধবীলতা থাকে।

ঘরের দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই শাদাদ ভাইয়ের দুটো চোখ স্থির হয়ে যায়। কারণ, নীল শাড়িতে জড়ানো নিজের মনের কল্পনার মধুকে দেখে শাদাদ ভাইয়ের হৃদয়টা বোধহয় দুটো বিট মিস করে বসে আছে। লতা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রুপা আপা লতার পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুচি ঠিক করে দিচ্ছেন। শাড়ির কুচি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায় রুপা আপা।

শাদাদ ভাইকে দরজার সামনে দেখে রুপা আপা চমকে যায়। এগিয়ে এসে শাদাদ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

— তুই এখানে এসেছিস কেন?

— আপা তুই একটু বাইরে যাবি? মধুর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

শাদাদ ভাই লতার দিকে তাকিয়ে বললো। লতা শাদাদ ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনে মাথা উঁচু করে তাকায়। রুপা আপা লতার মুখের দিকে তাকায় শাদাদ ভাইকে অনুমতি দেয়ার আশায়। কিন্তু, সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে লতা শাড়ির কুচি উঁচু করে ধরে ধীরপায়ে হেঁটে এসে রুপা আপার সামনে এসে বললো,

—- দেরি হলে মা বকবে। চলো নীচে চলো আপা।

রুপা আপা অসহায় চোখে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। শাদাদ ভাই এই লতাকে চেনে না। চেনাজানা লতা কখনো এমন নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করতে পারে না।

লতাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে রুপা আপা । লতা চলে যেতেই শাদাদ স্বজোড়ে লাথি মেরে বসে দরজায়। দরজায় লাথির শব্দে লতা কেঁপে উঠল। কিন্তু, ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেপোষণ করলো না।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে