#বিবাহ_বিভ্রাট (শেষ পর্ব)
**************************
বড়ো খালা বোধহয় এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বললেন, “ভাবী, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমাদের জবা এমন মেয়েই না। ও কিন্তু খুব গোছানো মেয়ে, খুব সংসারী। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ও-ই তো সংসারের সব দায়িত্ব নিয়েছে।”
আন্টি বললেন, “কত ভালো মেয়ে, তা তো দেখতেই পেলাম। এই মেয়ে অবশ্য আগে থেকেই বেয়াদব। ছোটোবেলায়ই তো দেখেছি ওকে। সবসময় একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াত। মনে হতো যেন কত বড়ো লাটবাহাদুরের মেয়ে!”
বড়ো খালা বললেন, “না, না। জবা একদমই অহংকারী না। ও সবসময়ই খুব চুপচাপ থাকে। এটাই ওর স্বভাব। যাঁরা ওকে চেনে না, তাঁরা ওকে দেখলে অহংকারী মনে করে ভুল করে। আপনিও সেই ভুলটাই করলেন, ভাবী।”
আন্টি বললেন, “এত বছর ধরে মানুষ চরিয়ে খাচ্ছি। কে ভদ্র আর কে অভদ্র, সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে৷”
বড়ো খালা খুব চেষ্টা করছেন, আন্টির সামনে আমার ইমেজটা ঠিক করতে। উনি হয়ত চাইছেন, যে কোনও উপায়ে তমাল ভাইয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে; কিন্তু আমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তা আমি ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছি। আমি কখনোই এরকম কোনও সংসারে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিনি, যেখানে টাকা দিয়ে সবকিছু মাপা হয়। এইসব মানুষরা কখনোই অন্যকে সম্মান করেন না। এঁরা সারাক্ষণ অন্যদের দোষ খুঁজে বেড়ান, নির্দ্বিধায় অন্যদের অহংকারী বলে ফেলেন, অথচ এঁরা নিজেরাই হচ্ছেন সবচেয়ে বড়ো অহংকারী।
আন্টি, বড়ো খালার কথার উত্তরে বললেন, “শেফালি, তুমি তো জানো আমার ছেলের জন্য একের চেয়ে এক সুন্দরী আর বড়োলোকের মেয়ের লাইন লেগে আছে। আজকে এখানে আসার আমার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। এসেছি শুধুমাত্র তমালের কারণে। আমার ছেলেটা তো বোকা। খুব সহজেই ওকে বোকা বানানো যায়। তোমাকে বললাম না, সিয়ামের বউ ওর মাথার ভেতর কী জানি ঢুকিয়েছে, আল্লাহ্- ই জানেন! যা-ই হোক, এখানে এসে ভালোই হয়েছে। সরাসরি কথা হলে, মানুষ চিনতে, বুঝতে সুবিধা হয়। যেহেতু তমাল নিজ থেকে মুখ ফুটে জবার কথা বলেছে, তাই আমি জবাকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই। সে যদি নিজেকে আদর্শ বউ হিসেবে….”
আন্টির কথা কেড়ে নিয়ে বড়ো খালা বললেন, “ভাবী, আজকালকার বাচ্চারা একটু-আধটু স্বাধীনচেতা হয়। বিয়ে হলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বড়ো খালার ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। উনি কেন আমাকে তমাল ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন? আন্টির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। বড়ো খালাকে বললাম, “খালা আমি যাচ্ছি। বাসায় কাজ আছে।”
“একটু পরে যা। ভাবীর কথা তো শেষ হয়নি।”
“আন্টির সঙ্গে তুমি কথা বলো। আমার যা বলার, আমি বলে দিয়েছি আর বাকিটা তমাল ভাইয়াকে বলব।”
আন্টি বললেন, “তমালের সঙ্গে তোমার কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। আমার ছেলেকে কী বলতে হবে সেটা আমি বুঝব।”
“ঠিক আছে আন্টি। আমি তমাল ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব না। আমি তো কখনও নিজ থেকে ওকে ফোন করি না। সবসময়ই সে-ই আমাকে ফোন করে৷ আপনি তাকে বলে দিয়েন, ও আমাকে যেন আর ফোন না করে। বড়ো খালা, তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”
রুম থেকে বেরিয়ে দেখি দেওয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষে তমা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে চমকে উঠে বলল, “আপা যাচ্ছ?”
“হুম।”
“তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে ঢুকিসনি যে?”
তমা আমার পেছন পেছন মেইন গেটের সামনে এসে বলল, “চাচীর কথা শুনছিলাম। আমি জানতাম চাচী এইসবই বলবে।”
“তুই জানতিস? তাহলে আমাকে ফোন করে জানাসনি কেন? আমি আসতামই না।”
“ইচ্ছা করেই জানাইনি। আমি এটাও জানতাম তুমি চাচীর মুখের ওপর এমনই কিছু বলবে। এইজন্যই তোমাকে ফোন করিনি৷ আমার তো সাহস নেই তাঁকে কথা শোনানোর। আমি চাচীকে কিছু বললে, আব্বু আমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবেন।”
“তুই কথা শোনাতে যাবি কেন? তোকে কী করেছেন উনি?”
“চাচীর মাথায় সমস্যা আছে, বুঝতে পেরেছ? চাচীর ধারণা, আমি তমাল ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছি। শুধু আমি কেন, চাচী মনে করেন, এদেশের সব মেয়েই ওনার ছেলের জন্য পাগল!”
“কেন, তোকে কখনও কিছু বলেছে নাকি? আমাকে বলিসনি তো!”
“সুযোগ পেলেই তো বলে, আপা। আমাকে একা না, আমাদের সব কাজিনদেরই বলে। তুমি দেখো আপা, চাচীর কারণে শেষ পর্যন্ত তমাল ভাইয়া বিয়েই করতে পারবে না।”
“যাই রে তমা। বাসায় গিয়ে তোকে ফোন করব।”
————————
আমি বাসায় পৌঁছানোর আগেই সংবাদ পৌঁছে গিয়েছে। আমি ঘরে ঢুকতেই মা বললেন, “আপার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তুই নাকি স্নিগ্ধা ভাবীকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিস?”
“আমি ওনাকে খারাপ কোনোকিছু বলিনি, মা। যেটুকু বলেছি, তা না বললে চলত না।”
“আপা বলল স্নিগ্ধা ভাবী ভীষণ মন খারাপ করেছে। উনি নাকি ভাবতেই পারেননি, তুই এমন করে ওনাকে কথা শোনাবি।”
“কীভাবে ভাবতে পারবেন, বলো মা? তোমরা তো ওনার উলটোপালটা কথাবার্তা সারাজীবন হজম করে গেছ। বড়ো খালা এত কথা বলতে পারেন, অথচ তিনিও আন্টির সামনে কাচুমাচু ভাব করে থাকেন।”
“স্নিগ্ধা ভাবী ওনার ছেলেটার জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। তুই না হয় একটু চুপ থেকে ওনার কথাগুলো শুনতিস।”
“মা, আন্টি যদি শোনার মতো কথা বলতেন, অবশ্যই শুনতাম। আন্টি, তমাল ভাইয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেননি, মা। তোমাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। তমাল ভাইয়ার কাছে ভালো থাকার জন্যই উনি এসেছিলেন। যদি উনি শুরুতেই না বলে দিতেন, তাহলে তমাল ভাইয়া ওনার ওপর রাগ করত বা আন্টিকে ভুল বুঝত। উনি ভীষণ চালাক একজন মহিলা। উনি ছেলের কাছে ভালো থাকতে চেয়েছেন এবং একই সঙ্গে আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেছেন, যাতে আমি নিজেই পিছিয়ে যাই।”
“তারপরও তোর উচিত হয়নি ওনাকে এভাবে বলা৷ ওনার কথা শেষ হলে তুই চুপচাপ চলে আসতি৷ যা বলার, আপা বলে দিত।”
“মা শোনো, আমরা চুপচাপ চলে আসি বলেই, আন্টিদের মতো মানুষরা এতটা দাম্ভিকতা দেখানোর সাহস পান। আমি তোমার মতো মুখ বুঁজে সহ্য করাদের দলে থাকতে চাই না, মা।”
“ওদের সঙ্গে এবার বোধহয় সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে গেল।”
“এমন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা আর না থাকা একই কথা। মা প্লিজ এসব নিয়ে আর কোনও কথা বলতে চাই না। আমার ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। আমি একটু ঘুমাব।”
রুমে এসে কাপড় পালটে শুয়ে পড়েছিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোনের রিংয়ে আমার ঘুম ভাঙল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি, তমাল ভাইয়া ফোন করছে। এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না দেখে ফোন রিসিভ করলাম না। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি আমি, মা বা পলাশ কেউ একবার ডাকল না আমাকে!
রুম থেকে বেরিয়ে দেখি দুই বেডরুমের বাতি নেভানো। পলাশ অবশ্য এই সময়েই ঘুমাচ্ছে কিছুদিন যাবত। সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা। বারোটার পর উঠে পড়তে বসে। তারপর সারারাত পড়ে। টেবিলে খাবার রাখা আছে; কিন্তু আমার একদম খিদে পাচ্ছে না। পানির বোতলটা নিয়ে রুমে ফিরে এলাম। আবারও রিং হচ্ছে। তমাল ভাইয়ার ফোন। “হ্যালো, ভাইয়া……”
“জবা, শুয়ে পড়েছ নাকি?”
“না। বলো। কেমন আছ ভাইয়া?”
“ভালো। তুমি ভালো আছ?”
“হুম।”
“জবা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“করো।”
“জবা, তোমার যদি মত না-ই থাকত, তাহলে সেদিন যখন বিয়ের কথা বললাম, তুমি তখনই আমাকে না বলে দিতে৷ আমি আম্মাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করালাম আর তুমি কি না আম্মাকে এভাবে অপমান করলে জবা?”
“আমি আন্টিকে অপমান করেছি?”
“তোমার সঙ্গে আম্মার কী কথা হয়েছে, আমি জানি না। বাসায় আসার পর থেকেই আম্মা মন খারাপ করে শুয়ে আছেন।”
“তুমি জিজ্ঞেস করোনি আন্টির মন খারাপ কেন?”
“করেছি, অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। আম্মা শুধু একটা কথাই বললেন, আমি যেন ভালো থাকি, এটাই আম্মার চাওয়া; কিন্তু তুমি নাকি বলেছ, তুমি আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করো। আমিই অকারণে তোমাকে বিয়ের কথা বলে বিব্রত করছি! তুমি নাকি আম্মাকে অহংকারী মহিলা বলেছ? জবা, এসব কথা তুমি আমাকে বলোনি কেন? তাহলে আজকে আম্মাকে এভাবে অপমান হতে হতো না।”
আমি ভেবেছিলাম আন্টির সম্পর্কে তমাল ভাইয়াকে কিছু বলব না। কারণ নিজের মা’র সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনতে কোনও সন্তানেরই ভালো লাগে না; কিন্তু তিনি যেভাবে অনবরত মিথ্যা বলে, আমাকেই উলটো দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছেন, এখন আর আমি চুপ থাকতে পারলাম না। “ভাইয়া শোনো, তোমাকে কথাগুলো বলতে চাইনি; কিন্তু এখন আমি বাধ্য হচ্ছি কথাগুলো বলতে। আন্টি আমার নামে যা বলেছেন, এগুলো ডাহা মিথ্যা। আমি এমন কোনও কথা বলিনি। বরং আন্টি বিয়ের ব্যাপারে অনেক রকম শর্ত আর বিধিনিষেধ জুড়ে দিয়েছিলেন।”
“আম্মা!”
“অবাক হচ্ছ? জি, আন্টির কথাই বলছি। এত বিস্তারিত বলতে চাইছি না। শুধু এটুকু বলি, তোমার বউ হিসেবে আমার মতো একজনকে আন্টি কিছুতেই মানবেন না।”
“জবা, তুমি বোধহয় আম্মাকে ভুল বুঝেছ। আমার পছন্দই, আম্মার পছন্দ। চাচার বাসায় যাওয়ার আগেও আম্মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। জবা, তুমি সরাসরি আমাকে জানাতে পারো। আমি কিছু মনে করব না; কিন্তু আমার আম্মাকে ভুল বুঝো না প্লিজ। আমার আম্মা মন খারাপ করলে, আমার সবকিছু এলোমেলো লাগে। আম্মা আমার দুর্বলতার জায়গা। আমার নামে খারাপ কোনও কথা আমি শুনতে পারি না।”
আমার ভীষণ হতাশ লাগছে। সে তার আম্মাকে যেভাবে চেনে, আজকে আমি তাকে অন্যভাবে চেনাতে গেলে বরং আমিই বিপদে পড়ব। ভাগ্যিস আজ বড়ো খালার বাসায় আন্টি এসেছিলেন। তিনি আসাতে, আমার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক সহজ হয়েছে। আমি তো তার প্রতি বেশখানিকটা দুর্বল হয়েই পড়েছিলাম। যা হয়, সত্যিই ভালোর জন্যই হয়। তমাল ভাইয়ার মতো ছেলেরাই পরবর্তী জীবনে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়। মা’র কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ এরা করতে পারে না। আবার বউয়ের করা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করার মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারে না। জীবনে কিছু কিছু সম্পর্কে ব্যালান্স থাকাটা খুব জরুরি। তমাল ভাইয়ার মতো ছেলেরা এই ব্যালান্সটা করতে পারে না। যে কারণে এরা নিজেরাও দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য হয়।
আমি আমার বাবাকে দেখেছি এমন যন্ত্রণার জীবন কাটাতে। আমার দাদী আমার মা’কে সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি সারাক্ষণই বাবার কাছে মা’র নামে নানা সত্যমিথ্যা বলতেই থাকতেন। বাবা অনেক সময় দাদীর মিথ্যা ধরে ফেলতেন৷ আমরাও বুঝতাম দাদী ইচ্ছা করে মা’কে বকা খাওয়ানোর জন্য বানিয়ে কথা বলছেন। বাবাও সেটা বুঝতে পারতেন; কিন্তু দাদী কষ্ট পাবেন ভেবে, দাদীর বলা অন্যায় কথাগুলো বাবা ধরিয়ে দিতেন না। বাবা, দাদীকে কিছু বলতেন না দেখে অনেক সময় মা-ও মন খারাপ করে থাকতেন। এসব কিছু দেখেশুনে আমি নিজে সেইরকম একটা অসুস্থ সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে চাই না। এরচেয়ে এখন যা আছি, যেভাবে আছি, ঢের ভালো আছি।
“হ্যালো জবা, কিছু বলো।”
“ভাইয়া শোনো, আমাদের সম্পর্কটা যেমন আছে, তেমনই থাকতে দাও। শুধু আমরা চেষ্টা করলেই তো হবে না, জোড়াগুলো আসলে উপর থেকে নির্ধারণ করা হয়। তুমি আর আমি হয়ত সঠিক জোড়া না। তুমি নিশ্চয়ই তোমার সঠিক জোড়ার সন্ধান খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে। আমি চাই বিষয়টা এখানেই শেষ হোক। আজকের পর আর কখনও যেন এই প্রসঙ্গটা আমাদের মাঝে না আসে।”
তমাল ভাইয়া বোধহয় মন খারাপ করল। “ভালো থেকো জবা” বলেই লাইনটা কেটে দিল সে। একটা অসম সম্পর্ক থেকে বেঁচে যাওয়ায় আমারও এখন খুব নির্ভার লাগছে।
————————
মাঝখানে দুইদিন আরোহীর সঙ্গে কথা হয়নি। সিয়াম আর সে ঝটিকা সফরে শ্রীমঙ্গলের রিসোর্ট থেকে ঘুরে এল। আজ ঢাকায় ফিরেই আরোহী আমাদের বাসায় চলে এসেছে। আমার রুমে ঢুকেই হৈচৈ শুরু করে দিল। “তোদের দুজনের কী হল, বল তো? তুই নাকি তমাল ভাইকে না বলে দিয়েছিস? আমাকে বললি না যে?”
“তোরা নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছিলি, তাই বলিনি।”
“সিয়াম একটু আগে তমাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলল। তখন জানতে পারল সবকিছু। তুই না বললি কেন জবা? তমাল ভাই তো ভালো মানুষ।”
“আমি তো বলিনি তমাল ভাইয়া খারাপ মানুষ।”
“তাহলে?”
“একটা সংসার শুধু একজনকে নিয়ে হয় না, আরোহী। তমাল ভাইয়া ভালো হলে কী হবে, আন্টি ভীষণ জটিল মানুষ।”
“কী বলিস?”
“হুম।”
আরোহীকে আন্টির সমস্ত কথা বললাম। কথা শুনে আরোহী বলল, “ওর মা’কে দিয়ে তুই কী করবি? ছেলেটা ভালো, এটাই বড়ো কথা।”
“না রে। এভাবে হয় না। ওদের বাড়িতে গেলে আমি কিছুতেই ভালো থাকতে পারতাম না। আন্টির ইশারায় পুরো সংসার চলে। এদিকে আমি আমার পরিবারের কিছুটা হলেও তো দায়িত্ব নিয়েছি। মা আর পলাশ আমার ওপর কিছুটা হলেও তো নির্ভর করে আছে। তমালকে বিয়ে করলে, আমাকে আমার সব দায়িত্ব ছেড়ে চলে যেতে হতো। সেটা তো কিছুতেই সম্ভব না। কয়দিন পর পলাশ এইচএসসি পাশ করবে। ওর পড়ালেখা শেষ হতে অন্তত চার বছর তো লাগবেই। আমার শুধু নিজের চিন্তা করলে চলবে, বল? ভাইটাকে ভালো একটা জায়গায় ভর্তি করাতে হবে। সংসারটাকে আরও একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর না হয় নিজের কথা ভাবব। শুধু তমাল ভাইয়া বলেই বলছি না, ধর, আমি এখন অন্য কারোকে বিয়ে করলাম, তখনও কিন্তু আমাকে একই সমস্যায় পড়তে হবে। আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি থেকে হয়ত চাইবে আমি চাকরি ছেড়ে দিই। চাকরি যদি করিও, তাঁরা আশা করবেন, স্যালারির টাকাটা আমি তাঁদের হাতে তুলে দেবো; কিন্তু আমি তো এমন করব না। আমি আমার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই না রে আরোহী। এই যে আমি না করার পরও প্রতিবার জোর করে পাত্রপক্ষের সামনে আমাকে যেতে হয়েছে, তুই বিশ্বাস কর, সম্পর্কগুলো বিয়ে পর্যন্ত না গড়ানোয় আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি।”
“তুই কী তাহলে কখনও বিয়ে করবি না?”
“করব। আরও কিছুদিন যাক না। মাত্র তো আটাশ চলছে। আরও দুটো-তিনটে বছর না হয় যাক। পলাশ মোটামুটি একটা পর্যায়ে চলে আসবে। আমার টেনশনও তখন অনেক কমবে।”
“আমি তো তোর মতো করে ভাবিনি কখনও।”
“তোর আর আমার বিষয়টা তো এক না। আমি তোর মতো সাহসী হতে পারিনি কখনও, পারবও না। তুই হুটহাট যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারিস। সেটা আমি পারি না। আবার তোকে এতদিন কারও দায়িত্ব নিতে হয়নি। তুই নিজের মতো স্বাধীন জীবন যাপন করেছিস; কিন্তু আমার এখন মা আর পলাশের কথা প্রথমে চিন্তা করতে হয়। তারপর অন্যকিছু। আমাদের সমাজে এখনও মনে করা হয়, বাবা-মার সমস্ত দায়িত্ব শুধু ছেলেরাই বহন করবে। আরও যদি নির্দিষ্ট করে বলি, বড়ো ছেলেই সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেবে। সেখানে একজন মেয়ে তার পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছে, এটা বেশিরভাগ ছেলের বাড়িতে ভালো ভাবে নেবে না। এখনও অনেক মানুষের মানসিকতাটা এমন, বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে মেয়েরা তার বাবা-মার প্রতি আর কোনও দায়িত্ব পালন করতে পারবে না বা করবে না। এরপরের সব দায়দায়িত্ব থাকবে স্বামীর সংসারের প্রতি। সমাজের এই ধারণাগুলোর মূল অনেক গভীরে। এত সহজে একে উৎপাটন করা যাবে না। কাজেই আমি আপাতত বিবাহ নামক কোনও বিভ্রাটে জড়িয়ে পড়ে, জীবটাকে জটিল আর দুর্বিষহ করতে চাই না। যেমন আছি, ভালো আছি। খুব ভালো আছি। তোদের সবার কাছে আমার অনুরোধ, বিয়ে নামক জটিল জিনিসটার মধ্যে আমাকে জোর করে ঠেলে দিস না। জীবনকে আমিও উপভোগ করতে চাই। তবে আরও একটু রয়েসয়ে। আগে নিজেকে আরও একটু শক্ত অবস্থানে নিজে যেতে চাই। কেউ যেন কোনও কথা বলার আগে এটা মনে না করে, একে তো যা খুশি বলাই যায়। একে যেভাবে খুশি, চালানো যায়।
সমাপ্ত।