বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-১৩+১৪

0
2228

#বিবাহ_বিভ্রাট (১৩)
**********************
যতক্ষণ বিয়ের পুরো কার্যক্রম শেষ হচ্ছিল না, ততক্ষণ আমার কেবলই বুক ধুকপুক করছিল। মনে হচ্ছিল, এখনই না জানি আবার কোনও ঝামেলা শুরু হয়ে যায়? অবশেষে কোনোরকম ঝঞ্ঝাট ছাড়া বিয়ে পড়ানো শেষ হল। বিয়ে পড়ানোর সময় আরোহীকে দেখে আমার একইসঙ্গে মন খারাপ আর ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছিল। মন খারাপ হওয়ার কারণ, আজকের দিনে ওর আপনজন, মানে রক্তের সম্পর্কের একজন মানুষও ওর পাশে নেই। ওর নিশ্চয়ই খালা, মামা, চাচা, কেউ না কেউ আছেই। বাবার কথা নতুন করে আর না-ই বা বললাম। ভালো লাগার কারণ হল, সিয়ামকে যতটুকু দেখেছি, তাকে আমার কাছে ভালো মানুষ মনে হয়েছে। যদিও এত সহজে মানুষ চেনা সম্ভব না, তবুও কিছুটা তো আন্দাজ করা যায়ই।

আরেকটা বিষয় খুব ভালো লাগল, সিয়ামের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেশ কিছু লোক এসেছেন। সিয়াম, আরোহীর সঙ্গে তাঁদের সবার পরিচয় করিয়ে দিল। তাঁরাও আরোহীর সঙ্গে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বললেন। একইদিনে আমার নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হল!

প্রচুর খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর, সিয়াম, বাড়িতে আসা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আরোহীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আর আমরা যারা আরোহীর সঙ্গে এসেছি, তারা নিজেরা গল্প করছিলাম। তমাল ভাইয়াকে অনেকক্ষণ আগে দেখলেও এতক্ষণ কথা বলা হয়নি। কারণ সে দূরে দূরেই ছিল। এখন নিজেই সামনে এসে দাঁড়াল, “জবা, কেমন আছ?”

“ভালো। তুমি ভালো তো?”

“হুম। আম্মা এসেছে তো। দেখা হয়েছে আম্মার সঙ্গে?”

“না, দেখা হয়নি।”

“আসো, আম্মা ঐ রুমে আছেন।”

আমি সালমাদেরকে বসতে বলে তমাল ভাইয়ার পেছন, পেছন এসে, একটা বেডরুমে ঢুকলাম। বেডরুমটা বেশ বড়ো। বিছানা আর সোফায় বসে যে যার মতো কথা বলছেন। আন্টিকে দেখলাম ওনার সমবয়সী কয়েকজনের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তমাল ভাইয়া ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আম্মা, এই যে জবা।”

আন্টি আমার দিকে তাকানোর পর সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আন্টি ভালো আছেন?”

আন্টি উত্তর দিয়ে বললেন, “ও কে যেন?”

তমাল ভাইয়া বলল, “তুমি ওকে চিনতে পারছ না! তমার খালাতো বোন, জবা।”

আন্টি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আমাদের তমা? ও আচ্ছা, চিনেছি।”

আমার একটু মন খারাপ হল। তমাল ভাইয়ার সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা হলেও, আন্টির সঙ্গে বছরখানেক আগেই বড়ো খালার বাসায় দেখা হয়েছে। তাছাড়া ছোটোবেলায় তো সবসময়ই ওনাদের সঙ্গে দেখা হতো। আমাকে তো ওনার ভুলে যাওয়ার কথা না।

আমি ওখান থেকে চলে আসতে চাচ্ছিলাম; কিন্তু তমাল ভাইয়া জোর করে তার মা’র পাশে বসিয়ে দিল।

আমি বসে আছি। তমাল ভাইয়া আরোহী আর সিয়ামের প্রসঙ্গে কথা বলছে। আন্টি বললেন, “ও আচ্ছা, সিয়ামের বউ, তোমার বান্ধবী?”

“জি আন্টি।”

তিনি সামনে বসা অন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, “মেয়েটার কপাল ভালো বলতে হবে। না হলে এমন একটা পরিচয়হীন মেয়ে এই ফ্যামিলিতে আসতে পারে?”

সামনে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা সমস্বরে বললেন, “হুম তাই তো, তাই তো।”

পরিচয়হীন কথাটা শুনতে ভালো লাগল না। আরোহী পরিচয়হীন হবে কেন? এটা কেমন কথা? হয়ত এঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে; কিন্তু তাই বলে তো কাউকে এভাবে পরিচয়হীন বলা মোটেও ঠিক না। আন্টি অবশ্য এভাবেই কথা বলেন। আমার বড়ো খালাও ওনার কথার ভয়ে তটস্থ থাকেন।

আমি ওঠার কথা বলতেই তমাল ভাইয়া বলল, “আরে বসো না কিছুক্ষণ। এতক্ষণ তো বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলে। আচ্ছা শোনো, সিয়ামের তো চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ও বোধহয় আর বারো-তেরোদিন আছে।”

“হুম, আরোহী বলেছে আমাকে।”

“আমরা বন্ধুরা মিলে পরশুদিন মানিকগঞ্জে যাচ্ছি। ওখানে আমাদের এক বন্ধুর রিসোর্ট আছে। তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে।”

“আমি?”

“হুম। কোনও সমস্যা?”

“না, সমস্যা না; কিন্তু আমার তো কাজে যেতে হবে।”

“ছুটি নিতে পারবে না?”

“তা হয়ত পারব।”

“তাহলে ছুটি নিয়ে নাও। তুমি গেলে ভাবীরও ভালো লাগবে।

আন্টি গল্প থামিয়ে তমাল ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা বন্ধুরা যাচ্ছ। ওখানে জবার কাজটা কী? ওকে কেন যেতে বলছ? তাছাড়া তোমাদের বন্ধুদের মাঝে গিয়ে সে তো অস্বস্তিবোধ করবে। সে কী কাউকে চেনে?”

তমাল ভাইয়া বলল, “আম্মা, তুমি যে কী বলো না! শুধু কী আমাদের বন্ধুরাই যাচ্ছে নাকি? নাফিজ আর জুবায়েরের বউরাও তো যাবে। তাছাড়া জবা তো আমাকে আর সিয়ামকে চেনেই। আর সবকিছুর ওপরে হল, সে তো আরোহী ভাবীর বেস্ট ফ্রেন্ড। কাজেই জবা তুমি মোটেও টেনশন করো না। ছুটি নিয়ে নাও।”

আন্টি হুট করে বলে বসলেন, “তোমার সাথেই কী আগে সিয়ামের বিয়ে ঠিক হয়েছিল?”

আমি “থ” বনে গেলাম আন্টির কথা শুনে। সাধারণ একটা দেখাদেখির ব্যাপারকে কেউ “বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া” কীভাবে বলতে পারে! তমাল ভাইয়া কী আন্টিকে এভাবেই কথাটা বলেছে নাকি? আমি উত্তর দেওয়ার আগে তমাল ভাইয়া বলল, “আম্মা, কিসের মধ্যে কী বলো তুমি? সিয়ামের সঙ্গে আরোহী ভাবীরই বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

আন্টি বললেন, “তুমি না বললা সিয়ামকে নিয়ে ওদের বাসায় গেছ। জবার সাথে না…..”

আমি তমাল ভাইয়ার মুখে দিকে তাকালাম। সে হেসে বলল, “আম্মা, তুমি এক গল্পের সঙ্গে অন্য গল্প মিলিয়ে ফেলছ। তুমি না বিকালে রেণু ফুপির ওখানে যেতে চেয়েছিলে। যাবে নাকি?”

আন্টি বললেন, “আজকে আর কোথাও যাব না। তোমার আন্টিদের সঙ্গে এতদিন পর দেখা হল। এখানেই ভালো লাগছে।”

দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন নাম ধরে ডাকলে, তমাল ভাইয়া বলল, “জবা তুমি বসো, আমি আসছি।”

তমাল ভাইয়া চলে গেলে আন্টির সামনে বসা আরেক আন্টি বললেন, “ভাবী, তমালের বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?”

আন্টি আফসোসের সুরে বলতে আরম্ভ করলেন, “আর বলবেন না ভাবী, আজকালকার বাচ্চারা একদম কথা শুনতে চায় না। আমি কবে থেকে তাকে বলে যাচ্ছি বিয়ে করার কথা; কিন্তু সে যে কোথায় কী করছে, আমি বুঝি না। বিয়ের কথা তুললেই পাশ কাটিয়ে যায়।”

“রিলেশন আছে নাকি? তাহলে ওখানেই বিয়ে দিয়ে দেন।”

“আমার ছেলে রিলেশন করার মানুষ না। সে মেয়েদের থেকে দশহাত দূরে থাকে সবসময়।”

“ওর বন্ধুদের অনেকেই তো বিয়ে করেছে, তাই না?”

“অনেকে কোথায়? মোটামুটি সবাই তো বিয়ে করে ফেলেছে। বাচ্চাকাচ্চাও হয়ে গেছে অনেকের।”

সামনের আন্টি বললেন, “এখনই জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন ভাবী। আপনারা কেমন মেয়ে খুঁজছেন, বলেন তো?”

“মেয়ে আছে নাকি?”

“আছে তো কয়েকজন।”

“মেয়ের ফ্যামিলিকে তো অবশ্যই আমাদের ফ্যামিলির সমকক্ষ হতে হবে। আপনার খোঁজে আছে নাকি এমন কোনও মেয়ে?”

“আমার পরিচিত একজন আছে। আপনাদের সঙ্গে ভালো মানাবে। মেয়ের বাবা ব্যবসায়ী। মেয়ে মালয়েশিয়া থেকে পড়ালেখা করে দেশে এসে চাকরি করছে।”

আন্টি বললেন, “চাকরিজীবী মেয়ে নিয়ে ঝামেলা আছে, বুঝলেন, ভাবী?”

সামনের আন্টি, “কিন্তু এখন তো চাকরিজীবী ছাড়া মেয়ে পাওয়াই যায় না।”

আন্টি বললেন, “তা অবশ্য ঠিক। তবে আমার চাকরিজীবী মেয়ে পছন্দ না। এরা নিজের মতো থাকে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে দাম দেয় না। এরা সকালবেলায় চাকরিতে চলে যায় আর রাতে ফিরে এসে টেবিলে বেড়ে রাখা খাবার খায়। চাকরির গরমে এরা কারও সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। আমাদের তো চাকরি করা বউ দরকার নেই। টাকাপয়সার কোনও সমস্যা নেই। তাহলে ছেলের বউকে কেন চাকরি করাব?”

আন্টির মুখোমুখি বসা আরেক আন্টি বললেন, “আপা, আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে এটা কেমন কথা বলছেন? চাকরিজীবী মেয়ে মানেই কী খারাপ? আমি নিজে কলেজে পড়াই, আমার ছেলের বউ নিশিতাও ডাক্তার। সে তো চাকরি করছে, সব সামাজিকতাও করছে। আমার ছেলেমেয়ে, আমার ভাইবোন সবাই নিশিতাকে এত পছন্দ করে, কী বলব?”

আন্টি বললেন, “আপনার কপাল ভালো তাই এমন বউ পেয়েছেন। নিশিতা আসলেও ভালো মেয়ে; কিন্তু এমন মেয়ে তো আজকাল পাওয়া যায় না।”

আমার এত রাগ হচ্ছিল তমাল ভাইয়ার আম্মার কথা শুনে! থাকতে না পেরে বললাম, “কিছু মনে করবেন না আন্টি। একটা সম্পর্কের সমতা রাখতে হলে, দুইদিক থেকেই জোর দিতে হয়। আপনি যদি শুধু পেতেই চান, তাহলে তো একটু ঝামেলাই হয়ে যাবে।”

আন্টি বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুমি কী কথাটা আমাকে বললে?”

“না, আন্টি। আপনাকে বলিনি। সবার কথাই বলছি। আমি আমার নিজের কথাও বলছি।”

“বলা সহজ, বুঝতে পেরেছ, জবা। তোমরা এই যুগের মেয়েরা শুধু নিতে শিখেছ। বিয়ে হতে না হতেই কতক্ষণে স্বামীকে তার ফ্যামিলির কাছ থেকে বের করে নিয়ে যাবে, এটাই আজকালকার মেয়েদের মেইন টার্গেট থাকে।”

“আন্টি, সবাই তো একরকম না। সব বউও না, সব শাশুড়িও না।”

“শোনো মেয়ে, তোমার চেয়ে ঢের বেশি জীবন দেখেছি আমি। দুনিয়ার সাতাশটা দেশ ঘুরেছি। জীবনকে আমি তোমার চেয়ে বেশি চিনি।”

আমার মনে হল এখানে আর থাকা উচিত হবে না। তমাল ভাইয়ার আম্মার কথাবার্তার ধরণ আমার আগেও ভালো লাগেনি, আজও ভালো লাগল না। উনি সারাক্ষণই তাঁর কোথায়, কী আছে, কী কিনলেন, কী বিলিয়ে দিলেন, এসব নিয়েই চর্চা করতে থাকেন। এতবছরেও ওনার ভাবনাচিন্তার কোনও পরিবর্তন নেই। আশ্চর্য এসব মানুষ আর আশ্চর্য তাঁদের ভাবনা!

আমি বললাম, “আন্টি আমি যাই।”

আন্টি বললেন, “যাবে কেন? বসো। তোমার সঙ্গে তো কথাই বলতে পারলাম না। তোমাদের এখন কী অবস্থা, বলো তো? তোমার আম্মা ভালো আছে?”

“জি, মা ভালো আছেন।”

“তোমাদের সংসার চলে কীভাবে?”

“আমি চাকরি করছি। সবকিছু মিলে চলে যাচ্ছে।”

“মানে তোমাকেই এখন সংসার চালাতে হচ্ছে?”

“না। সংসার মা চালান। আমি মা’কে কিছুটা সহযোগিতা করি।”

“তোমার ভাইটা কী করে?”

“পলাশ তো ছোটো। এইচএসসিতে পড়ছে।”

“এই যে একটু আগে তুমি আমাকে কথাটা বললে, এখন নিজেই চিন্তা করে দেখো, তোমার যদি দুইদিন পর বিয়ে হয়ে যায়, তুমি চেষ্টা করবে, তোমার বেতনের টাকা তোমার মা’কে দিতে; কিন্তু তোমার স্বামী কিছু বলতে গেলেই, সে তখন খারাপ হয়ে যাবে।”

“আমার স্বামী আমার টাকার বিষয়ে কথা বলবেন কেন, আন্টি?”

“কেন বলবে না? তুমি এখন এই সংসারের মানুষ। তোমার এখন দায়িত্ব তোমার নতুন সংসারের প্রতি।”

“নতুন সংসারের প্রতি অবশ্যই দায়িত্ব থাকবে; কিন্তু আমার মা-বাবার প্রতিও আমার দায়িত্ব আর কর্তব্য আছে। সেটা আমি কিছুতেই এড়াতে পারি না, চাইও না।”

আন্টি তাঁর সামনে বসা অন্য মহিলাদের বললেন, “আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এখনকার মেয়েরা শুধু নিজে আর নিজের বাপ-মা, এর বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছু মনে করো না জবা, তোমাদের জেনারেশনটাই এমন। এরা সবসময় শ্বশুর-শাশুড়িকে বাবা-মার নীচে রাখতে চায়। বেশি স্বাধীনতা পাওয়ার এ-ই এক কুফল।”

“আন্টি, আপনার কথাই যদি ধরি, তমাল ভাইয়া বিয়ের পর ওনার শ্বশুর-শাশুড়িকে যদি আপনাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়, সেটা আপনার ভালো লাগবে?”

আন্টি আমার দিকে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, “শ্বশুর-শাশুড়ি অবশ্যই অনেক সম্মানের জায়গায় থাকবেন। তাঁরা আমাদের কাছে আমাদের নিজের বাবা-মার মতোই; কিন্তু কিছুতেই আমার বাবা-মায়ের ওপরে না। বাবা-মা’র ওপরে কাউকে স্থান দেওয়া যায় না, স্যরি আন্টি।”

বুঝলাম আমার কথাগুলো আন্টির একদম পছন্দ হয়নি৷ তিনি আমাকে অগ্রাহ্য করে অন্যদের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওনাকে সালাম দিয়ে, উত্তরের অপেক্ষা না করে সরে এলাম।…………………….

#বিবাহ_বিভ্রাট (১৪)
*********************
বড়ো খালা যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমি বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর একেবারে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন, “কী রে জবা, এই কয়দিনের মধ্যে এতকিছু কী সব ঘটে গেল! এত ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব আনলাম আর তুই কি না নিজের কপাল পুড়িয়ে, আরোহীকে রাজরানী করে দিলি!”

ওহ, অসহ্য। শেষ পর্যন্ত মা’র হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম; কিন্তু এখন বড়ো খালা আবার এটা নিয়ে কতক্ষণ প্যাঁচাবেন! আমাকে কতরকম কথা শোনাবেন, কে জানে? আমি কিছু না বলে রুমে চলে যাচ্ছি দেখে, বড়ো খালা আমার পেছন, পেছন এসে রুমে ঢুকলেন। “কী রে জবা, কথার উত্তর দিলি না যে?”

“কী উত্তর চাও, বড়ো খালা?”

“তুই এই কাজটা কেন করলি?”

“বড়ো খালা শোনো, আমি কোনও কাজ করিনি। আগে থেকে যা নির্ধারিত ছিল, সেটাই হয়েছে।”

“এইসব পাকামি কথা বলবি না, জবা। কোনটা নির্ধারিত ছিল আগে থেকে? খুব সহজে পেয়ে যাচ্ছিলি তো, তাই মর্ম বুঝলি না। আরোহী চালাক মেয়ে৷ সময়মতো ঠিক চালাকিটা করে ফেলল, দেখলি?”

“বড়ো খালা প্লিজ, এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তমাকে আনলে না কেন? ওকে নিয়ে আসতে।”

“কথা ঘোরাচ্ছিস, তাই না? ঠিক আছে আরোহীকে নিয়ে কথা বলব না। এখন তুই আমাকে বল, তমালের মা’কে সেদিন কী বলেছিস?”

“আমি!”

“কেন সেদিন বিয়েতে তোর দেখা হয়নি ভাবীর সঙ্গে?”

এবার মনে পড়ল। সেদিনের কথাগুলোয় আন্টি তাহলে মাইন্ড করেছেন। বললাম, “কেন, কী হয়েছে?”

“তুইই বল, কী নাকি বড়ো বড়ো লেকচার দিয়েছিস ওনাকে। ভাবীকে আমিই ভয় পাই আর তুই গেছিস তাঁর সঙ্গে টেক্কা দিতে!”

“কী আশ্চর্য, আমি ওনার সঙ্গে টেক্কা দিতে যাব কেন? আন্টি যেসব কথা বলছিলেন, আমি শুধু দু’একটা কথার উত্তর দিয়েছি।”

“কী দরকার ছিল তোর উত্তর দেওয়ার? তোর কারণে, ভাবী খামোখা আমাকে এত্তগুলা কথা শুনিয়ে দিল।”

“তুমি কথা শুনলে কেন?”

“আমি কথা শুনলাম কারণ আমার বোনের মেয়ে তাঁকে কথা শুনিয়েছে।”

“ভুল বললে বড়ো খালা। আমি ওনাকে কোনও কথা শোনাইনি৷ ওনার মতো মানুষরা কিছু ভুল ধারণা আঁকড়ে বাঁচেন। ওনারা মনে করেন, জীবনের গল্পগুলো তাঁরা নিজেদের ইচ্ছা আর প্রয়োজন মতো সাজাবেন। তা তো হয় না, তাই না? দিন পালটাচ্ছে। মেয়েরাও যে মানুষ, তাদের মতামতের সমান গুরুত্ব আছে, এটা সবাইকে বুঝতে হবে। আন্টি বলতে চেয়েছিলেন, একজন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি হয়ে যায়। আমি ওনার এই ভুল ধারণাটা একটু শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর কিছু না।”

বড়ো খালা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ছোটো খালার ডাক শুনে কথাটা বলতে পারলেন না। রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমি তমাল ভাইয়ার মা’র চরিত্রটা বুঝতে চেষ্টা করছি। ওনাকে আমি এমন কিছুই বলিনি, যা নিয়ে উনি বড়ো খালার কাছে আমার নামে নালিশ করতে পারেন। অথচ বড়ো খালা বললেন, উনি নাকি এটার জন্য খালাকে কথা শুনিয়েছেন। উহ, কত যে বিচিত্র রকমের মানুষ দিয়ে এই দুনিয়াটা ঠাসা! এঁদের সঙ্গে ডিল করা এক বিশাল ঝকমারি!

———————

“হ্যালো, জবা……”

“হুম, বল। কেমন আছিস?”

“আমি তো খুব ভালো আছি। তোকে এত করে থাকতে বললাম, তুই থাকলিই না!”

“আমার অফিস ছিল তো। তুই বুঝিস না কেন, আরোহী?”

“আচ্ছা বুঝলাম। কাল সকালে কিন্তু তোকে বাসা থেকে তুলে নেব।”

“তোরা যা প্লিজ। আমি কাউকে চিনি না, আমি যেতে চাই না।”

“আমাকে তো চিনিস। তমাল ভাইকে তো চিনিস, নাকি চিনিস না? আমি এত কথা শুনতে চাই না। সকাল আটটায় তোকে তুলে নেব। আমি এখন রাখি।”

“আরোহী শোন…”

“সিয়াম ডাকছে। কাল সকাল ঠিক আটটায় দেখা হচ্ছে।”

আরোহী আমার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ফোন রেখে দিল। ও এমনই। যা বলবে, সেটা করেই ছাড়বে। আমি এখন যা-ই বলি না কেন, সকাল আটটায় সে আমাকে নিতে আসবেই।

রাতের খাবার শেষ করে, মোবাইলটা নিয়ে মাত্র বসেছি, তখনই তমাল ভাইয়ার ফোন এল। স্ক্রীনে ওর নামটা দেখে বিরক্ত লাগল। একটু আগে বড়ো খালা একগাদা কথা শুনিয়ে গেলেন, এখন এ-ও নিশ্চয়ই কথা শোনানোর জন্য ফোন করেছে। আমি কী আন্টিকে এমন ভয়াবহ খারাপ কোনও কথা বলেছিলাম, যার কারণে এরা এখন আমাকে কথা শোনাতে ফোন করছে? ধরব না ফোন। বেজে, বেজে থেমে যাক।

দশ মিনিট পর আবারও ফোন এল। একবার, দুইবার, তিনবারের সময় বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ কারলাম। “হ্যালো…”

“জবা, আমি তমাল।”

“হ্যাঁ তমাল ভাইয়া, বলো।”

“ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”

“রাত নয়টা বাজে আর রাত নয়টায় ঢাকা শহরে কেউ ঘুমায় না।”

“না, মানে আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় ঘুমাচ্ছ। কয়েকবার ফোন করলাম, তুমি ধরছিলে না।”

“কেন ফোন করেছিলে? কোনও দরকার ছিল?”

“দরকার ছাড়া তোমাকে ফোন করা যাবে না?”

আমার মনে হল, আমি তমাল ভাইয়ার সঙ্গে একটু বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি। বললাম, “আমি সেটা বলিনি।”

“তোমার কথায় মনে হচ্ছে, কোনও কারণে বিরক্ত হয়ে আছ।”

আমি একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম, “বিরক্ত হব কেন? একটু টায়ার্ড হয়ে ছিলাম।”

“আচ্ছা, তাহলে আর কথা না বাড়াই। কাল আসছ তো?”

“কোথায়?”

“কোথায় আবার? আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ না?”

“আমার ঠিক নেই।”

“ওমা, কেন? আরোহী ভাবী যে বলল, তুমি যাচ্ছ।”

“আরোহী খুব জোরাজুরি করছে যাওয়ার জন্য; কিন্তু…”

“ঐসব কিন্তু-টিন্তু বলো না, প্লিজ। চলো, সবাই একসঙ্গে গেলে, অনেক ভালো লাগবে।”

তমাল ভাইয়ার হঠাৎ এত আগ্রহের কারণ বুঝতে পারছি না। সিয়াম ভাইয়া বা আরোহী আবার উলটোপালটা কিছু বলেনি তো ওকে? আরোহীর কোনও বিশ্বাস নেই। সে গতকালও আমাকে বলেছে, আমার বিয়ে দিয়েই তবে সে থামবে আর পাত্র হিসেবে তমাল ভাইয়াকে তাদের খুব পছন্দ। আমি বারবার করে নিষেধ করার পরও সে তমালের সঙ্গে কথা বলবে বলেছে। ইশ, কথাটা যদি বলেই ফেলে, সেটা ভীষণ খারাপ হবে।

“হ্যালো জবা, আছ?”

“হুম।”

“একদম চুপ হয়ে গেলে যে? শোনো, এখন আর কথা বলছি না। তুমি রেস্ট নাও। কাল দেখা হবে। বাই।”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তমাল ভাইয়া ফোন রেখে দিল। আমি এতক্ষণ যাব কি যাব না, এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ছিলাম। এখন তমাল ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, কাল আমি ওদের সঙ্গে যাব না। আরোহী যতই জোর করুক, আমাকে নিতে পারবে না।

———————-

আরোহী সকাল আটটায় আসবে বলেছে। আমি ভেবেছিলাম ওরা আসার আগেই, আমি হসপিটালে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যাব; কিন্তু সকাল ছয়টায় ঘুম ভেঙেই আরোহীর ম্যাসেজ পেলাম। “জবা, আমি এসে যদি তোকে না পাই, তাহলে আমিও যাব না, বলে দিলাম। তুই কিন্তু জানিস আমি যা বলি, তা করে ছাড়ি।”

উহ, এই মেয়েটা এত জ্বালায়! আমি যে হসপিটালে চলে যাব, এটা সে ঠিক বুঝে গেছে। এখন আমি যদি সত্যি হসপিটালে চলে যাই, তাহলে সে রিসোর্টে যাবে না। কাজেই এখন আর ওদের সঙ্গে না গিয়ে উপায় নেই। আমার আজকে ছুটি নেওয়া হয়নি। আজ সুদীপ্তার অফ ডে। ওকে নক করে জিজ্ঞেস করলাম, আমার জায়গায় সে আজ কাজ করতে পারবে কি না। সুদীপ্তা সঙ্গে, সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল। যাক বাবা, একটা ঝামেলা তো কমলো। ছুটি না নিয়ে হুট করে কাজে না যাওয়া আমার একদম পছন্দ না।

আরও কিছুক্ষণ বিছানা গড়াগড়ি খাওয়ার পর, সাতটায় উঠে পড়লাম। টুকটাক কাজ সেরে তৈরি হতেই আটটা বেজে গেল এবল আরোহীও ঠিক সময়মতো চলে এল। ঘরে ঢুকেই সে রান্নাঘরে গিয়ে মা’কে টুক করে সালাম করে ফেলল। মা আরোহীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “টেবিলে বসো। জবার সঙ্গে নাস্তা করে তারপর বেরোবে।”

আরোহী বলল, “আন্টি গাড়িতে ওরা অপেক্ষা করছে। এখন নাস্তা করলে দেরি হয়ে যাবে।”

“হায় আল্লাহ, তুমি জামাইকে নীচে বসিয়ে রেখেছ! ফোন করে ওপরে আসতে বলো।”

মা’র এই বদলে যাওয়া ব্যবহারটা আমার খুব ভালো লাগল।

আরোহী বলল, “এখন না আন্টি। গাড়িতে অনেক মানুষ। আমি যে কোনোদিন ওকে নিয়ে চলে আসব।”

আরোহী খেতে না চাইলেও, মা জোর করে আমাদের দুজনকে রুটি-আলুভাজি খাইয়ে দিলেন।

আমাদের বাড়ির গেটের সামনে বড়ো একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। তমাল ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। সে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আমাদের আসতে দেখে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। আরোহী একটা সিট দেখিয়ে বলল, “জবা, তুই ঐখানে বস।”

আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। সিয়াম ছাড়া কাউকেই চিনি না। জবা উঠে সিয়ামের পাশে বসে পড়ল। তারপর তমাল ভাইয়াকে বলল, “তমাল ভাই, আপনি এখানে বসেন।”

এখানে মানে যে আমার পাশে, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। আরোহী ইচ্ছা করে এই কাজটা করল। এখন আর কিছু বলার নেই। কারণ গাড়িতে ঐ একটা সিটই খালি আছে।

তমাল ভাইয়া গাড়িতে উঠে আমার পাশে বসার পর, গাড়ি ছেড়ে দিল। সিয়াম, তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “জবা কিন্তু তমালের কাজিন হয়।”

সবাই গল্পগুজব করছে। কে যেন ফ্লাস্কে করে চা এনেছে। ডিসপোজেবল গ্লাসে সবাইকে চা দেওয়া হল। আড্ডার ফাঁকে এক ভাইয়া বলল, “তোমরা সবাই কী জানো, আমরা তো শিগগির তমালের বিয়ে খাচ্ছি।”

এক আপু বলল, “তাই নাকি? পাত্রী কী রেডি? কী রে তমাল, আমাদের কিছু বলিসনি কেন? বাহ, ভালোই তো। সিয়ামের বিয়ের রেশ না কাটতেই তমালের বিয়ে! আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।”

তমাল ভাইয়ার বিয়ে হবে, এটা নিয়ে তাদের সবার আনন্দ হচ্ছে আর আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আরোহী আর সিয়াম মিলে আমাকে আর তমাল ভাইয়াকে জড়িয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। এত মানুষের মধ্যে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। আরোহী আমাকে যা বলেছিল, সেই কথা কী ইতোমধ্যে ওরা দুজন অন্যদেরও বলে ফেলেছে নাকি?…………………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে