#বিবাহ_বিভ্রাট (৯)
*********************
মা আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছিলেন না। আমি কোনও প্রশ্ন করলেও ঠিকঠাক উত্তর দিচ্ছেন না কয়দিন ধরে; কিন্তু আজ বাসায় ঢুকতেই মা আমার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। আমি রুমে ঢুকে কেবলমাত্র ব্যাগটা টেবিলে রেখেছি, মা পেছনে এসে বাজখাঁই গলায় বললেন, “কী ফাজলামো শুরু করেছিস তুই? ”
আমি মা’র প্রশ্নের ধরণে বুঝে গেছি, যে কোনোভাবেই হোক, আরোহীর বিষয়টা মা জানতে পেরছেন৷ তবুও না বোঝার ভান করে বললাম, “মা, ফাজলামো আমি করছি, নাকি তুমি অযথা আমার ওপর রাগ করে বাড়ির পরিবেশটা খারাপ করে রেখেছ?”
“আমি পরিবেশ খারাপ করেছি? তুই নিজের ভালোটাও বুঝলি না? ঐ ছেলের সঙ্গে আরোহীর বিয়ে হচ্ছে কী করে? আরোহীকে ঐ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবি বলেই, তুই এইসব নাটক করলি, তাই না?”
“আরে, কিসের মধ্যে কী! মা, তুমি কী বলো এইসব! আমি নাটক করব কেন? আমি তো তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম, আমার যদি ভালো না লাগে তাহলে এখানে বিয়ের কথা এগোবে না। আরোহীকে খামোখা এর মধ্যে টানছ কেন?”
“আমি সব বুঝি। তোর বাপও সারাজীবন নিজের ভালোটা না দেখে, মানুষের উপকার করে বেড়িয়েছে, এখন তুইও সেই একই পথ ধরেছিস।”
“মা, তুমি অকারণে উত্তেজিত হচ্ছ। এখানে আরোহীর একফোঁটা দোষ নেই। আমি না করার পরই আরোহীর সঙ্গে সিয়াম ভাইয়ার পরিচয় আর আলাপ হয়েছে।”
“তুই পরিচয় না করিয়ে দিলে, আরোহী ঐ ছেলেকে কী করে চিনল?”
আরোহী যে নিজেই সিয়ামকে খুঁজে বের করেছে, এই সত্যিটা মা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। তবুও আমি ফেসবুকের কথাটাই বললাম। মা বললেন, “তুই খুব সুন্দর করে মিথ্যা বলা শিখেছিস, জবা। তোর কাছে বাপ-মা’র চেয়ে বন্ধু বড়ো হয়ে গেল? ঐরকম একটা মেয়ের জন্য…..”
“মা, তুমি এভাবে কথা বলো না। প্লিজ সবসময় আরোহীকে খারাপ কথা বলা বন্ধ করো। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, আরোহীর বিয়ের কথা তুমি কোথায় শুনলে?”
মনে হল মা আমার কথাগুলো শুনতেই পেলেন না। রুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজাটা এত জোরে বন্ধ করলেন, যে মনে হল পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠল! মা একবার রাগ হলে, সেই রাগ এত তাড়াতাড়ি কমে না। বিষয়টা আরোহীর হওয়ায় এখন তো রাগ আরও কমবে না। আপাতত মা’র রাগের চিন্তা বাদ দিয়ে আরোহীর বাবার কথা ভাবতে হবে। খালু বিষয়টা সহজভাবে নিলেই হয়।
————————-
আমি রাতের খাবারের জোগাড় করে, আরোহীকে ফোন করলাম। খালুর সঙ্গে এখনই কথা বলা দরকার। পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আরোহী ফোন ধরে জানাল, খালু এখনই বাইরে গেছে ওষুধ আনতে। আমি দেরি না করে বাসা থেকে বের হলাম। আরোহীদের বাসায় গিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না৷ আন্টি বিরক্ত হতে পারেন অথবা আরোহীর সঙ্গে ওঁদের ঝগড়াও লেগে যেতে পারে।
আমাকে বেশিদূর যেতে হল না। বাসা থেকে বের হয়ে ফার্মেসির দিকে তাকাতেই খালুকে দেখতে পেলাম। আমি বাসার সামনে দাঁড়িয়েই খালুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। খালু ডিসপেনসারি থেকে কেনাকাটা শেষ করে, পাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকলেন। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট পর বের হয়ে বাসার দিকে আসছেন, তখন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। খালু তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, “কী গো মা, কেমন আছ?”
“ভালো আছি, খালু। আপনি ভালো তো?”
খালু হাতের ছোটো প্যাকেটটা দেখিয়ে বললেন, “আমাদের ভালো থাকা এখন এগুলোর ওপর নির্ভর করে রে মা। কিডনির ঝামেলা, হার্টের ঝামেলা, সুগার কন্ট্রোলে থাকে না। ওষুধ খেয়ে যতদিন টিকে থাকা যায়। তোমার চাকরি কেমন চলছে?”
“জি, ভালো। খালু, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।”
“কী কথা রে মা?”
“খালু, আরোহী আপনাকে কিছু বলেছে?”
“আরোহী? কই না তো। কিসের কথা বলো তো? ওর পার্লারে কিছু হয়েছে নাকি?”
“না, না। পার্লার ঠিক আছে।” এই পর্যন্ত বলে আমি আর কথা এগোতে পারছি না। কেন জানি বিয়ের কথাটা উচ্চারণ করতে ভয় লাগছে। খালুর কী প্রতিক্রিয়া হবে, বুঝতে পারছি না। খালু আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাসায় এসো। আরোহীকে তো বাসায় দেখে আসলাম।”
“আরোহীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, খালু। আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
“খালু, আরোহী কী আপনাকে বিয়ের ব্যাপারে কোনও কথা বলেছে?”
“কার বিয়ে, তোমার নাকি?”
আমি বিষম খেলাম। “আমার না, খালু। আরোহীর বিয়ের কথা বলছি।”
“আরোহী! আমাদের আরোহীর কথা বলছ? কে আনলো বিয়ের প্রস্তাব?”
ঝট করে মিথ্যাটা বললাম, “আমার এক মামাতো ভাই প্রস্তাবটা এনেছে।”
“তাই নাকি? ঠিক আছে, ছেলের একটা বায়োডেটা দিয়ো তাহলে। তোমার বান্ধবীকে বলেছ কথাটা?”
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। উনি তো সাধারণ বিয়ের প্রস্তাব ভেবেছেন। আমারই হয়ত বলতে ভুল হয়েছে। এবার কথাটা সরাসরি না বললে আর হচ্ছে না। বললাম, “খালু, আরোহী জানে। মানে আরোহী আর সিয়াম ভাইয়া, দু’জন দুজনকে পছন্দ করেছে।”
“ছেলে আরোহীর পরিচিত? আরোহী বলেনি তো কখনও!”
আমার কথাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি খুব গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না। পুরো সত্যিটা বলতেও সাহস হচ্ছে না। শুধু বললাম, “খালু, সিয়াম ভাইয়া আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।”
“আচ্ছা, আমি বাসায় কথাবার্তা বলে দেখি। তারপর…..”
“ওনার সময় নেই। উনি কালকেই দেখা করতে চাচ্ছেন।”
“সময় নেই মানে?”
“উনি তো বাইরে থাকেন। ওনার ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।”
“কালকে কেন দেখা করব? বায়োডেটা দাও আগে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলি।”
আরে ইনি তো জিনিসটা পেঁচিয়ে ফেলছেন। ওনার তো কিছু করতে হবে না। সব তো রেডিই আছে। মিথ্যা বলতে শুরু করলে, এক মিথ্যা ঢাকতে লাগাতার অনেক মিথ্যা বলতে হয়। আমাকেও এখন মিথ্যা বলতে হবে। নির্দ্বিধায় বলে ফেললাম, “পাত্র খুব ভালো। আমার মাধ্যমেই আরোহীর সঙ্গে ওনার পরিচয় হয়েছিল। কথাবার্তা বলে ওরা অনেকদূর এগিয়েছে। আমি আসোলে ওদেরকে কথা দিয়ে ফেলেছি। কালকে সন্ধ্যায় সিয়াম ভাইয়া আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তমাল ভাইয়াও থাকবে।”
“তমাল কে?”
“আমার মামাতো ভাই।”
“এটা তোমার কোন মামাতো ভাই? আমি তো তোমার সব মামাতো ভাইকেই চিনি।”
“তমাল ভাইয়া, আমার বড়ো খালার ভাসুরের ছেলে। সিয়াম ভাইয়া হচ্ছেন তমাল ভাইয়ার বন্ধু।”
“আচ্ছা, তাই বলো। কথা দেওয়ার আগে তোমার উচিত ছিল একবার আমাকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া।”
মনে মনে বিরক্ত হলাম; কিন্তু মুখে হাসি ধরে রাখলাম। ওনার মেয়ে তো শুক্রবার বিয়েই করে ফেলবে। বাবাকে তো সে জানাতেই চায়নি। আমিই না মাঝখান থেকে উপযাচক হয়ে মাতুব্বরি করতে এসে ফেঁসে যাচ্ছি। শুক্রবারের খবর যদি উনি এখন শোনেন, তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হবে, আমি শুধু সেটাই ভাবছি। আমি বললাম, “খালু, ওদেরকে কখন আসতে বলব? সাতটায় বলি?”
“সাতটায়? ঠিক আছে বলো। একটা কাজ করো, তুমি ওদেরকে বলো সাতটায় যেন তোমাদের বাসার গ্যারেজে চলে আসে। ওখানে বসার জায়গা আছে৷ বসে কথাবার্তা বলে নিলাম। ছেলেটাকেও দেখলাম।”
“ইয়া আল্লাহ্, এই লোক পাগল নাকি! উনি কী বলেন এইসব? গ্যারেজে বসে কথা বলবেন? এখন বুঝতে পারছি আরোহী কেন ওর আব্বাকে বিয়ের কথাটা জানাতে চায়নি। খালুর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার তো রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। আমি বললাম, “খালু গ্যারেজে কেন বসবেন? আপনাদের বাসায় আসুক।”
“বাসায় না, বাসায় না। তোমার আন্টিকে আগে থেকে না জানিয়ে বাসায় ঢুকালে, ঝামেলা হয়ে যাবে। কালকে বাইরে দেখা করি।”
কী যে ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি, নিজেও বুঝতে পারছি না। বিরক্তি চেপে বললাম, “ঠিক আছে, আমি ওদেরকে আশপাশের কোনও রেস্টুরেন্টে আসতে বলছি।”
“রেস্টুরেন্টে বসার কী দরকার? তোমার মামতো ভাই যখন আছে, তখন আমরা তোমাদের বাসায় বসে কথা বলতে পারি। সমস্যা হবে?”
সমস্যার আপনি কী বুঝবেন, খালু? এমনিতেই দৌড়ের উপর আছি। কাল আপনাদের দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলে, মা নির্ঘাত আমাকে বাড়িছাড়া করবেন। ওনাকে বললাম, “চৌরঙ্গীর মোড়ে রেস্টুরেন্টটা আমার এক বন্ধুর। ওর ওখানে বসে কথা বলা যাবে।”
“ঠিক আছে। তুমি আমাকে বিকালে একবার ফোন করে মনে করিয়ে দিয়ো।”
খালুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ঢোকার পর আরোহী ফোন করল। “হ্যালো জবা, আব্বাকে পেয়েছিলি?”
“হুম, কথা হয়েছে।”
“ওদের আসার কথা বলেছিস?”
“বললাম।”
“শুনে কী বলে?”
“অবাক হলেন। শোন, তোদের বাসায় দেখা করা যাবে না। তোর আম্মাজানের পারমিশন পাওয়া যাবে না।”
“খবরদার জবা, ঐ মহিলা আমার আম্মা না। এইটা নিয়ে মজা করবি না।”
“স্যরি, আরোহী। আর বলব না। শোন, কাল সন্ধ্যায় তপনের রেস্টুরেন্টে বসব সবাই। তুই সিয়াম ভাইয়াকে জানিয়ে দিস।”
“জবা, আমার কেন জানি আব্বার সঙ্গে সিয়ামকে পরিচয় করিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে না।”
“এমন করিস না, আরোহী। এটুকু অধিকার তো ওনার আছে। এখন তুই খালুকে সহ্য করতে পারছিস না। যেদিন উনি থাকবেন না, সেদিন ঠিকই ওনার জন্য তোর অন্তরাত্মা কাঁদবে, দেখিস।”
কথাটা শুনে মনেহয় আরোহীর মন খারাপ হল। আর কোনও কথা না বলে ফোন রাখল সে।
—————————
আরোহী, সিয়াম আর তমাল ভাইয়া রেস্টুরেন্টে চলে এসেছে। আরোহী আমাকে ফোন করে জানাল, ওর আব্বা এখনও আসেনি। আমি খালুকে ফোন করে, ওনার ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম বারবার। কী ব্যাপার, উনি আসবেন না দেখে কী ফোন বন্ধ করে রেখেছেন নাকি? তাহলে তো আরেক ঝামেলা হয়ে যাবে। আমি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে দেখলাম খালু দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেশ কেতাদুরস্ত হয়ে এসেছেন। দেখতে ভালো লাগছে। খালু, আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি আধাঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছি।”
“স্যরি, খালু। আমার কাজ শেষ হতে একটু দেরি হয়েছে আজকে। আপনি ভেতরে চলে যেতেন। ওরা তো ভেতরে অপেক্ষা করছে। আপনাকে অনেকবার ফোন করেছি৷ ফোন বন্ধ কেন?”
“ফোনটা দুপুর থেকে অন হচ্ছে না।”
“ঠিক আছে, চলেন, ভেতরে যাই।”
“ছেলেটার নাম যেন কী বলেছিলে?”
“সিয়াম।”
“আচ্ছা।”
ওরা তিনজন বসে কথা বলছিল। আরোহী গোলাপি রঙের মসলিন একটা শাড়ি পরেছে। ওকে আজ দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমাদেরকে দেখে সিয়াম আর তমাল ভাইয়া উঠে দাঁড়াল। আমি খালুর সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওরা খাবার অর্ডার করে রেখেছিল। আমরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এল। খালু খাচ্ছেন আর সিয়ামের সঙ্গে কথা বলছেন। বাড়িঘর কোথায়, ইউএসএ কী কাজ করে, সিয়ামের বাবা-মা কেন আজকে আসলেন না, একের পর এক জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন। সিয়ামও প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। তমাল ভাইয়া কথার মাঝখানে বলল, “আংকেল, সবকিছু তো ঠিক হয়েই গেছে। বিয়ের দিন সবার সঙ্গে পরিচয় তো হবেই।”
“কার বিয়ে?”
“কেন, সিয়াম আর আরোহীর।”
“ও, হ্যাঁ। আরোহী সকালে আমাকে বলেছে, তোমরা শুক্রবারে বিয়ে পড়াতে চাচ্ছ। এত তাড়াহুড়া কেন করছ, বাবারা?”
“সিয়াম বললেন, “আংকেল, আমি তো ছুটিতে এসেছি। সময়মতো আমাকে কাজে জয়েন করতে হবে। তাই হাতে একদমই কম সময়।”
“তাই বলে তো শুক্রবারে সম্ভব না। তোমাকে ঠিকমতো চিনলাম না। তোমার পরিবারের কাউকে দেখলাম না। এমন হুট করে বিয়ে হয় নাকি? তাছাড়া আমার আত্মীয়স্বজন আছে। আমার বড়ো মেয়ের বিয়ে তো আমি আত্মীয় ছাড়া দেবো না। আমি আমার ভাইদের সঙ্গে কথা বলে দেখি, সবাই কী বলে। তারপর আমি তোমাকে জানাব।”
“সিয়াম, তমাল আর আরোহী তিনজনই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমিই যেন মূল আসামি! আমি তো আরোহীর আব্বার সঙ্গে দেখা করার কথা বলিনি। তারা দেখা করতে চাওয়ায়, আমি খালুর সঙ্গে কথা বলে, দেখা করার ব্যবস্থা করেছি। আমি কী জানতাম এখানে এমন কোনও জটিলতার সৃষ্টি হবে?……………………..