#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akther
৮.
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মেঘলার। চোখদুটো থেকে অঝরে বর্ষিত হতে চাইছে জল। কিন্তু, অনুপযুক্ত জায়গায় কান্না করাটা সমীচীন নয়। তাই তো শত কষ্টের মাঝে কান্নাদের লুকিয়ে মুখে আনন্দের ছাপ ফুটিয়ে সতীনের খুব ঘনিষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীকে সমবর্ধনা জানিয়ে গোলাপ ফুলের তোড়া বাড়িয়ে দেয় তনুজার দিকে।
তনুজা হতবিহ্বল দুর্বল চোখে তাকিয়ে রইলো অতি সুপরিচিত মুখের দিকে। মানুষটাকে এতবছর পর এমন জায়গায় এসে দেখবে কল্পনাও করেনি তনুজা! ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে তনুজা। তনুজার এমন আচরণে মোটেও অবাক হয়নি মেঘলা কিংবা রুদ্র। কারণ, যতবারই মেঘলার সঙ্গে তনুজার দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই তনুজা মেঘলাকে জড়িয়ে ধরেছে ; যেমনটা কোনো বোন তার বোনকে বহুদিন পর দেখলে জড়িয়ে ধরে।
মেঘলার মনের কোথাও না কোথাও হটাৎ করে অজানা আতংক আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। অজানা অতীত, অজানা সম্পর্ক যখন বিভ্রান্তির মায়াজাল থেকে বের হয়ে আসবে তখন তনুজার বোন ভক্তি, শ্রদ্ধা থাকবে তো? নাকি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিবে? দুরুদুরু বুকে তনুজাকে বুক থেকে সরিয়ে এনে মেঘলা জিজ্ঞেস করলো,
— কেমন আছিস, তনু..??
জা বলতে গিয়েও থেমে যায় মেঘলা। কারণ, রুদ্রের বারণ আছে। তনুজা হাসিমুখে উত্তর দেয়।
— ভীষণ ভালো আছি, তবে তোমাকে দেখার পর। নিজের মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার পর মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে আছে! মনে হচ্ছে একদৌঁড়ে এই দেশ থেকে পালিয়ে নিজের দেশে চলে যাই। তুমি কেমন আছো?
মেঘলা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— ভালো আছি। তার আগমনের বার্তা শোনার পর থেকো শরীরটা যাচ্ছেতাই অবস্থা। তবুও, মনের এককোণে প্রশান্তি আসে যে, কেউ একজন আসবে আমার কোল জুড়ে।
কথাটি বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেঘলা। তনুজার দৃষ্টি তখন মেঘলার উঁচু পেটের ওপর। ভীষণ অবাক হয়েছে তনুজা। মনের ভেতর কিছু প্রশ্নেরা খালি আকুপাকু করছে। কিন্তু, এই মূহুর্ত যেন সঠিক মূহুর্ত নয় উত্তর জানার জন্য। তাই তো তনুজা নিজের ভেতর চেপে রাখল অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছেকে।
রুদ্র আগ বাড়িয়ে এসে মেঘলার হাত টেনে ধরলো। মেঘলা চকিত নজরে নিজের বা হাতের দিকে তাকিয়ে রয়। কতদিন পর একটু স্পর্শ পেলো রুদ্রের। একটা মানুষের স্পর্শ পাওয়ার জন্য মেঘলাকে কতটা ছটফট করতে হয় তা একমাত্র ওপর ওয়ালা আর সে নিজেই জানে। চোখের এক ফোঁটা অশ্রু এসে রুদ্র হাতের পিঠে পরতেই রুদ্র হাতের পিঠে তাকিয়ে অবাক হয়ে মেঘলার চোখের দিকে তাকায়। থমকে যায় রুদ্রের পৃথিবী। মেঘলার চোখে অসময়ে অশ্রুরা এসে কেন ভীড় জমাচ্ছে!
ভাগ্যিস, তনুজা সেই দৃশ্য অবলোকন করেনি। নয়তো, পরিস্থিতি খুব একটা ভালো হতো না। এরই ফাঁকে অতি সন্তর্পণে মেঘলা রুদ্রের হাত থেকে নিজের হাত মুক্ত করে নেয়।
তনুজা হাতের পার্সটা শক্ত করে চেপে ধরে অন্যহাতে তনুজার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নিয়ে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— মেঘলা আপু কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?চলো বাড়ির পথে রওনা দেয়া যাক।
তনুজার কথা শুনে রুদ্রের ভ্রম কেটে যায়। ধাতস্থ হয়ে ড্রাইভারকে ডাক দেয় ব্যাগগুলো কারে উঠানোর জন্য। রুদ্র এগিয়ে যায় কারের সামনে। ড্রাইভিং সীটের পাশের সীটে বসে পরে। মেঘলা আর তনুজা ব্যাক সীটে। ড্রাইভার ব্যাগগুলো গাড়িতে রেখে ড্রাইভিং সীটে বসে কার স্টার্ট দেয়।
এয়ারপোর্ট থেকে খুব একটা দূরে নয় রুদ্রদের বাড়িটা। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম শহর হচ্ছে মালে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা টুরিস্টদের আগমনে এই শহর সবসময় মুখরিত হয়ে থাকে। রাস্তার ধারে অসংখ্য সাইকেল, কার পার্কিং করা। রৌদ্রময় আকাশ, চলন্ত গাড়িতে বসে থাকার দরুণ দুধর্ষ হাওয়া এসে তনুজার পরিপাটি চুলকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। তবুও, ভীষন ভালো লাগছে তনুজার। মাঝে মাঝে বাতাসের শো শো আওয়াজ শুনতে শুনতে পার্থিব আনন্দ উপভোগ করছে।
গাড়ি কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌঁছে যায়। রুদ্র আগে নেমে পরে। এগিয়ে এসে মেঘলার দিকের ডোর খুলে দাঁড়ায় রুদ্র। মেঘলা কটমটে চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের মুখের দিকে। কিন্তু, রুদ্রের চাহনি দেখে মনে হচ্ছে সে নির্বিকার। উপায়ন্তর না পেয়ে মেঘলা ধীরেসুস্থে নেমে পরে গাড়ি থেকে। রুদ্র ঘুরে গিয়ে তনুজার পাশে যাবে ততক্ষণে তনুজা গাড়ি থেকে মেঘলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
রুদ্র দীর্ঘ্শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির পথে। লনে অংসখ্য ফুলের গাছ। তাতে রঙ্গিন ফুল ফুটে আছে। বাতাসের দোল খেয়ে এলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একটা প্রজাপতি এসে ফুলের ওপর বসছে।
তনুজার দুচোখ তখন বাগানের অতুলনীয় সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। রুদ্র আর মেঘলার মনে তখন আসন্ন ঝড়ের আঘাত কি করুপ ধারণ করবে তাই নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত?
পত্রিকা পড়ছিলেন জনাব রায়হান আজাদ। রান্নাঘর থেকে তখন মাছ ভাজার ছ্যাতছ্যাতে শব্দ আসছিল। এমনসময় কলিং বেল বেজে ওঠে। রান্নাঘর থেকে তাহেরা রায়হানকে উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে অনুরোধ করলো, কে এসেছে দেখার জন্য?
বিরক্তিকর শ্বাস চেপে রায়হান হাতে পত্রিকা নিয়ে হেটে যাচ্ছেন দরজার কাছে।
দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্র, মেঘলা আর তনুজা তখন ভিন্ন ভয়ে আতংকিত। রুদ্র একহাত পিছিয়ে তনুজার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলো। তনুজা মনের ভয় কমানের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল মানুষ রুদ্রের কনুই চেপে ধরলো।
এমনসময় দরজা খুলে বের হয়ে এলেন রায়হান আজাদ। মেঘলাকে দেখে হাসিমুখে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন পেছনে থাকা দুজন মানব-মানবীকে দেখে। রুদ্রকে দেখেও ততটা অবাক হননি রায়হান। তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছেন রুদ্রের কনুই শক্ত করে চেপে ধরে থাকা নিজের ভাগ্নি তনুজাকে দেখে।
— ওয়াট এ সারপ্রাইজ, রুদ্র! কাউকে না জানিয়ে চলে গেলে বাংলাদেশে। আবার ফিরে এসেছো কাউকে না জানিয়ে। আর, তনু কেমন আছো?
মামার কথায় হাসি মুখে তনুজা উত্তর দেয়,
— আলহামদুলিল্লাহ, মামাজান। ভালো আছি।
রায়হান মুচকি হাসি দিয়ে চুপ করে রইলেন। আগ বাড়িয়ে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না।
রায়হান সাহেব সরল বাক্য শুনে, গম্ভীর মুখখানি দেখে রুদ্র গভীর শ্বাস চেপে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে নিজ পিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— সব কথা পরে হবে। তার আগে আমাদের সবাইকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে তো দাও। মেঘলার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে। বাইরে আজ অনেক রোদ পরেছে।
— নিশ্চয়ই। মেঘলা ভেতরে এসো মা। কে বলেছে এত কষ্ট করে এয়ারপোর্টে যেতে। রুদ্র আসবে জানলে আমরাই চলে যেতাম। কষ্ট করে তোমার যাওয়ার কি দরকার, বলো তো?
শ্বশুরের এমন স্নেহময় কথা শুনে আনন্দে মন ভরে আসে মেঘলার। হাসিমুখে বাড়ির ভেতরে সর্বপ্রথম কদম ফেলে ঢুকো পরে মেঘলা। তারপর, রুদ্র-তনুজা একসঙ্গে, একইসময়ে কদম ফেলে বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
— তনুজা!!!
কারো বিস্ময়ভরা কন্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে যায় তনুজা। মাথা উঁচু করে তাকাতেই চোখের সামনে দেখতে পেলো রুদ্রের মা তাহেরাকে। হুট করে তনুজার মানসপটে ভেসে ওঠে কয়েকবছর পুরনো সেইদিনের কথা। যেদিন এই নারী তার কাছে এসেছিল রুদ্রকে ফিরিয়ে নেবার জন্য।
তনুজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নীচের দিকে। এখানে আসার আগেও ভাবেনি এখানে এলে এই মানুষগুলোর সামনে কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে? কি করে সামাল দিবে তাদের বিস্ময়ভরা দৃষ্টিকে?
এরইমাঝে অভাবনীয় একটি কথা বলে বসে তাহেরা। যা শুনে তনুজার পুরো পৃথিবী থমকে যায়। মনে হচ্ছে নীল আকাশ এসে ওর মাথায় ভেঙে পরেছে।
চলবে….