কনকনে শীতের সকাল ৷ সম্ভবত শৈত্যপ্রবাহ চলছে ৷ কোটি টাকা দিলেও লেপ-কাঁথা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করবে না এমন শীত৷ আমার কলেজ ৮টায়৷ কলেজ বাস ৭:১০ এ চলে আসে৷ আমি রেডি হয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় কয়েক মিনিট আগে, যাতে আমাকে রেখে বাস চলে না যায় ৷ এমন এক কাকডাকা ভোরে আম্মু রীতিমতো যুদ্ধ করে সাড়ে ছয়টার দিকে আমাকে ঘুম থেকে উঠাতে সক্ষম হলেন৷ এত সকালে ক্লাস দেওয়ার কারণে কলেজ কতৃপক্ষের পিন্ডি চটকাতে চটকাতে আমি রেডি হলাম৷ রাজ্যের বিরক্তি আর ঘুম চোখে নিয়ে রেডি হওয়ার পর দেখি ৭টা বেজে গেছে অলরেডি৷ আম্মু নাস্তা রেডি করে এনেছে কিন্তু খাওয়ার টাইম নাই৷ আমি ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলাম৷ আম্মু মন খারাপ করলেন, কিন্তু কিচ্ছু করার নাই ৷ প্রায়ই এমন না খেয়ে চলে যেতে হয় বাস মিস করার ভয়ে৷ আমাদের বাসা থেকে মেইনরোড ২মিনিটের পথ ৷ আমি বের হয়ে কয়েক পা হাঁটার পর পাঁচতলা একটা বিল্ডিং এর গেইটের দিকে চোখ পড়ল৷ আমি সোয়েটারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেদিকে তাকিয়ে হাঁটছিলাম৷ তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিল না আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখা অতীব সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি সেখানে দেখে ফেলব ৷ দেখলাম, গেটের বাইরে একটা মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা ৷ একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে মোটরসাইকেলটিতে চড়লেন কিন্তু স্টার্ট দিলেন না৷ একটু পরই লোকটার ৭-৮ বছর বয়সী মেয়ে ঘুম ঘুম চোখে হালকা গোলাপী কালারের সোয়েটার গায়ে দিয়ে গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল৷ মেয়েটার দু’হাতে হেলমেট ধরা৷ বুঝলাম, বাবা হেলমেট নেওয়ার জন্য বাইক স্টার্ট দেননি এতক্ষণ ৷ মেয়ে তার ছোট্ট হাতে বাবাকে হেলমেট এগিয়ে দিল৷ বাবা হেলমেট নিয়ে কন্যাকে আদর করে দিলেন৷ এই আদরটুকুর লোভেই প্রচণ্ড শীতের সকালে অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাবার জন্য হেলমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷ আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম, বাবা বাইক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মেয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ভেতরে গিয়ে গেইট বন্ধ করে দিল৷
ওইদিকে আমার বাস চলে এসেছে, আমি বলতে পারি না৷ দুই বার হর্ন দেওয়ার পর আমার হুশ হল, আমি ত্বরিত হেঁটে বাসে উঠলাম৷ ঘটনাটা বছর দুয়েক পুরনো ৷ আমি বহুদিন লিখব লিখব করেও এটা লিখতে পারিনি ৷ আজও কতটা গুছিয়ে লিখতে পেরেছি আমি জানিনা, ভুল হলে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন ৷ . ছোটবেলায় আমরা গ্রামে থাকতাম ৷ আব্বু শহরে প্রাকটিস করতেন৷ উকিলদের শুক্র-শনিবার বন্ধের সুবাদে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি চলে আসতেন ৷ আব্বু আসতে আসতে রাতের ১২টা – ১টা বেজে যেতো ৷ গ্রামে যেখানে রাত দশটা মানেই অনেক রাত, সেখানে বারোটাকে নিশুতি বলা যায় ৷ আমি বই নিয়ে জেগে বসে থাকতাম ৷ আম্মু বকা দিত ঘুমানোর জন্য, আমি বসে থাকতাম – ‘একসপ্তাহ পর আব্বুকে দেখব, আব্বুর সাথে বসে খাব’ এগুলোর লোভে৷ আব্বু এই দু’দিন সকালে পুকুরে গোসল করতেন৷ আমি লুঙ্গী-গামছা কোলে নিয়ে পুকুরের সিঁড়িতে বসে থাকতাম- আব্বু গোসল শেষে আমাকে কাঁধে করে ঘরে নিয়ে আসার লোভে ৷ আব্বুর সাথে খাওয়ার জন্য বসে থাকতাম- আব্বুর হাতে এক লোকমা ভাত খাওয়ার লোভে ৷
বাবাও হয়তো মেয়ে একটা জিনিস চাওয়ার সাথে সাথে সেটা হাজির করে দেন – মেয়ের মুখে এক টুকরো হাসি দেখার লোভে ৷ নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বিলিয়ে দিয়ে মেয়েকে পড়াশোনা করান – নিজের মেয়ের একটা স্বতন্ত্র পরিচয়ের লোভে৷ এই বাবা-মেয়ের সম্পর্কগুলো লোভে ভরপুর ৷ এমন লোভ হলে, আমি হাজারবার লোভী হতে রাজি আছি৷ আমরা তিন বোন ৷ এটা নিয়ে কোনোদিন আমার আব্বু-আম্মুকে বিন্দুমাত্র নাখোশ হতে দেখিনি ৷ তাদেরকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতেই তারা খুশি ৷ মেয়ে বলে কোনোদিন অবহেলা করতে দেখিনি, অবহেলিত হইনি ৷ আমার বাবাকে নিয়ে আমার যেমন হাজারটা স্মৃতি আছে, আমাকে নিয়েও আমার বাবার হাজারটা স্মৃতি আছে ৷ প্রথম কোলে নেওয়া থেকে প্রথম বাবা বলে ডাকা, প্রথম বাবার কোলে চড়ে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে ভার্সিটি লেভেল পর্যন্ত অসংখ্য হাসি-কান্নার স্মৃতি ৷ আব্বু একা থাকলে সেসব রোমন্থন করেন, হাসেন আর ভাবেন- আমার সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা আজ কতবড় হয়ে গেছে ৷ আর আমি ভাবি- আমি হুমায়ূন আহমেদের গল্পের চরিত্রের মত অসাধারণ একজন বাবা পেয়েছি৷ আমি এই লেখাটাতে স্বেচ্ছায় ছেলে সন্তানের বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম, মায়েরটাও৷ হয়তো কোনোদিন ইচ্ছে হলে ছেলে আর মা কে নিয়েও কিছু লিখব ৷ আমার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতদের মধ্যে বেবি এক্সপেক্ট করা কোনো বাবা যখন মেয়ের বদলে ছেলে প্রিফার করে তখন আমি একটু ধাক্কা খাই৷ যখন নিজের সন্তান হওয়ার পরও মেয়েটার উপর ছেলেকে গুরুত্ব দিতে দেখি, তখন আমি হতভম্ভ হয়ে যাই৷ বৈষয়িক চিন্তা ভাবনা কাউকে এতোটাই গ্রাস করে ফেলে যে, ছোটবেলা থেকে মেয়ে সন্তানটার ভালোবাসা নজর এড়িয়ে চলে যায়৷ বংশের বাতি চাওয়া এসমস্ত বাবার মনে ‘বাবার ওষুধ আর পানি নিয়ে বসে থাকা মেয়েটা’ কোনো দাগ কাটে না৷ মধ্যরাতে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বাবার জন্য অপেক্ষা করা মেয়েটা জানে না, তার বাবা আল্লাহর কাছে পরবর্তী সন্তানটা ছেলেই চেয়েছে ৷ না জানুক! জানলে যদি মন ভেঙে যায়, তাহলে না জানাই ভালো ৷ . . ‘বাবা-মেয়ে কথন’ Israt Mehzabin Tiha (এই লেখাটা আমি আমার বাবাকে উৎসর্গ করলাম৷ আমি জানিনা উনি কখনও এটা পড়বেন কিনা৷ তবু আশা রাখলাম যেন পড়েন!)