বাদলে ঘেরা আকাশ পর্ব-০১

0
4331

#বাদলে_ঘেরা_আকাশ
#Part_1_
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha

হয় আমায় ভালোবাসুন না হয় আমায় ছেড়ে দিন, মুক্তি দিন আমায়। জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠে বর্ষা। ‘তোর রুহ যদি বের হয়ে যায় দেহ থেকে ওই রুহকে ও আমায় বিয়ে করতে হবে। আকাশ যুবায়ের বর্ষার উপরে পুরো শরীর ছেড়ে দিয়ে এক হাতে মুখ চেপে ধরে আবার বলতে লাগলো
‘ আর তুই তো এখনো জীবিত তাহলে আমাকে বিয়ে না করার কথা ভাবলি কি ভাবে? কি ভাবে ভাবলি আমায় রেখে ওপারে চলে যাবি? বা পালিয়ে যাবি৷ এই দুনিয়ার কোন কোনায় ও তোর ঠায় হবে না একমাত্র আকাশ যুবায়েরের বাহু ছাড়া ।

বর্ষা হাত-পা ছুটাছুটি করছে আকাশের নিচ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কিন্তু পারছে না। আকাশের বুকে পিঠে খামচাচ্ছে তবু ও আকাশ ছাড়ছে না বর্ষাকে। বর্ষা যত ছাড়াতে চাইছে ততই এটে যাচ্ছে আকাশের সাথে। বর্ষা ক্লান্ত হয়ে চোখের পানি ছেড়ে শান্ত হয়ে যায়। তবু ও আকাশের বর্ষাকে ছাড়ার কোন নাম গন্ধ নেই। বর্ষা পুরোপুরি শান্ত হবার পর আকাশ বর্ষার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বর্ষার বুকে মাথা রেখে বর্ষার সাথে লেপ্টে যায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বর্ষাকে।

বর্ষা আস্তে-ধীরে দু’হাত তুলে দেয় আকাশের পিঠে। খামচে ধরে আকাশের সাদা শার্ট আর চুল। ডুকরে কেঁদে উঠে বর্ষা।

‘ কেন করছেন আমার সাথে এমন? এমন বাঁচা মরার মাঝে কেন রেখেছেন আমায়? কেন এমন শাস্তি দিচ্ছেন আমায়? আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি।

একটু থেমে
হয় আমায় ভালোবাসুন না হয় আমায় ছেড়ে দিন মুক্তি দিন আমায়। ( আবার জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠে বর্ষা)
আমি যখনি ভাবি আপনি আমায় ভালোবাসুন আপনার কাছে যেতে চাই ভালোবেসে বলতে চাই ভালোবাসি, তখনি আমায় দূরে ঠেলে দিন। মনে হয় আমি খুবই তুচ্ছ বিষয় আপনার জন্য। এক কাপ চায়ের মাঝে পড়ে যাওয়া কোন এক পিপড়ে। যাকে বিষম রাগে কাপ থেকে আঙুল দিয়ে তুলে ফেলে দিন।

আবার যখন ভাবি আপনি আমায় ভালোবাসেন না আপানার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই তখনি আপনি আমায় কাছে টেনে দুবাহুতে ভরে পিষে দিন।মনে হয় আমি ছাড়া আপনার বাঁচা দায়। আমায় ছাড়া আপনি নিজেকে কল্পনা করতে পারেন না। পারেন না নিজেকে সাজাতে। এলোমেলো অগোছালো হয়ে যান। মনে হয় আপনার আকাশ আষাঢ় ভাঙা ঝুম বৃষ্টির পর এক মুষ্টি রোদের অপেক্ষা করছে। কেন মনে হয় কোন পাখি বাসা হারিয়ে ছটফট করছে তার রাত অতিবাহিত করার জন্য একটু খানি আশ্রয়ের।
তবে কেন এই দোটানা আমার? কেন মনে হয় আপনি ভালোবাসুন আমায় আবার কেন মনে হয় বাসুন না? কেন মনে হয় আপনি হাজার বছরের চেনা আবার কেন মনে হয় আপনাকে আমি চিনি না।

আপনার এক বাহুতে জান্নাত জাহান্নাম দুটোই মেনে নিতে পারছি না আমি। প্লিজ আমায় মুক্তি দিন। আমি অনেক কষ্ট করে সাহস জুগিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সবাইকে জানিয়েছি আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই না। আমি এই ভাবে বাঁচতে পারবো না আকাশ। এই ঘৃনা ভালোবাসার মাঝে কেন রেখেছেন আমায়? কি অপরাধ আমার?

আকাশের চোখ দিয়ে ও পানি ঝরছে অনবদ্য।
বর্ষার জামা ভিজে গেছে আকাশের চোখের পানি দিয়ে। বর্ষা অনুভব কর‍তে পারছে আকাশ কান্না করছে। তাই বর্ষা আকাশকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আপনি প্রতিবার এমন কান্না করেন যখন আমি চলে যেতে চাই , আর এমন করবেন না প্লিজ। আমায় যেতে দিন। মানুষ এমন দোটানায় বাঁচতে পারে না। তার সারি সারি সপ্ন সাজাতে পারে না। সপ্ন সাজানোর ও কিছু নিয়ম থাকে ধাপ থাকে। আমার পছন্দ, রাগ আবেগ,অভিমান, অনুভুতি, আর ভালোবাসা কিছুই জায়গা করে নিতে পারেনি। ( এক হাতের পিঠ দিয়ে আবার চোখ মুছে নেয় বর্ষা।

দিন না আমায় মুক্তি আমি হাত জোর করছি। আমি আর পারছি না। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাইকে বলে দিন আপনি ও আমায় বিয়ে করতে চান না। আমায় মুক্তি দিন আমার এই নরকসমান অনুভব থেকে। মুক্তি দিন আমার এই দোটানায় পড়া অনুভুতি থেকে।

আকাশ কিছু বলছে না চুপ করে আছে বর্ষার বুকে। আকাশের এই পিনপতন নীরবতা বর্ষাকে আরো অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নিরবতা ভীষণ কষ্ট দেয়। এই নিরবতা আরো দোটানায় ফেলে দেয় বর্ষাকে। কি চাই সে কেন স্পষ্ট করে বলে না? কেন এই জঠিল মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে বর্ষাকে!? বর্ষা বুঝতে পারে না।

আফরা গওহর বর্ষা বাবা মায়ের বড় মেয়ে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। বর্ষার মা বেঁচে নেই।
বর্ষার ছোট একটি বোন আছে আযহা গওহর তনিমা,তনিমা সবে কলেজে পা দিয়েছে । বর্ষার বাবা আনিস গওহর নাইম একজন ব্যবসায়ী। দু-মেয়ের কথা ভেবে আর বিয়ে করেনি। বর্ষা যখন বছরের মাঝামাঝিতে তখন তার এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের মাধ্যমে আকাশ যুবায়েরের সাথে পরিচয় হয়। বর্ষার ওই ফ্রেন্ড আকাশের কাজিনও ছিলো। আকাশ ছিলো সদ্য পাশ করে বের হওয়া ডাক্তার। ইন্টার্নশিপ শেষে যোগ দিয়েছে একটা হসপিটালে। প্রথম দেখায় আলাপালোচনা ছিলো দুজনেরই অসাধারণ। এরপর ক্যাম্পাসে প্রায়শই দেখা যেতো আকাশকে। কখনো বাহানায় কখনো বা বলতো বর্ষার সাথেই দেখা করতে এসেছে।

একদিন বর্ষা কাধে ব্যাগ নিয়ে হল থেকে বের হচ্ছিলো
‘ কেমন আছেন?
‘ আপনি?! আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি কেমন আছেন?
‘ হ্যা আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেক ভালো আছি।
‘ কেন আগে ভালো ছিলেন না?
‘ ছিলাম হয়তো, তবে এতোটা না।

বর্ষা একটা মুচকি হাসি দিয়ে হাটতে থাকে। গাছপালার ডাল আর পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশের মুখে বার বার রোদ এসে পড়ছে। বর্ষা লক্ষ করলো আকাশকে তাতে চমৎকার লাগছে। নিরবতা কাটিয়ে

‘ কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন?
‘ কেন কারো সাথে দেখা করতে না আসলে কি আপনার সাথে কথা বলা যাবে না?
‘ ঠিক তা নয় তবে আমি ভাবি কোন প্রয়োজনে আসেন।
‘ আপনার সাথে দেখা করা ও কিন্তু প্রয়োজন।
‘ আর সেটা কি?
‘ সব কথা বলতে হয়না। ওটা না হয় উহ্য থাক।

বর্ষার বিষয় গুলো খুব ভালো লাগতো। আকাশের এমন সরল উক্তি বর্ষাকে আরো উম্মাদ করে তুলতো।

আকাশ কখনো বলেনি সে বর্ষাকে ভালোবাসে। কিন্তু বর্ষা হয়তো আকাশকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। একদিন আকাশ সরাসরি বর্ষাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।

‘ আপনাকে বিয়ে করতে চাই আপনার মতামত কি?

বর্ষা প্রচন্ড অবাক হয়ে

‘ এই ভাবে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দেয়?? তাছাড়া একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তার কে বিয়ে করে। আপনি কেন আমায় বিয়ে করতে চাচ্ছেন?

‘ কোথাও কি লেখা আছে একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারকে বিয়ে করতে হয়? যদি ও বা কোন বইয়ে থাকে আমি সেই বই আবার নতুন করে লিখবো।

‘ আসলে এমনই হয় তাই বললাম। কোথাও লেখা আছে কিনা জানা নেই আমার।

বর্ষা আকাশকে বলে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য । আকাশের পরিবারের সাথে বর্ষার পরিবার বসে কথা বলে। বিয়ের সব ঠিক ঠাক হবার পর থেকে আকাশকে চিনতে পারে না বর্ষা। বর্ষার কখনো মনে হয় তার আকাশ আকাশ সমানই দূরে। আবার কখনো মনে হয় এইতো আকাশ জমিনে তাকে ইচ্ছে হলেই ছোঁয়া যায়।

আকাশ মাঝে মাঝে প্রচন্ড হিংস্র হয়ে উঠে মনে হয় বর্ষার সাথে ওর অনেক পুরনো হিসেব বাকি। আবার মনে হয় বর্ষাকে সে শত বছর আগে থেকে ভালোবাসে।

একদিন বর্ষা আকাশের জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলো হসপিটালে। ভেবেছিলো আকাশ হয়তো অনেক খুশি হবে। কিন্তু আকাশ খুশি না হয়ে সব গুলো খাবার ফেলে দেয় রাগে। আর টেবিলে জোরে আঘাত করে বলে

‘ আমি তোমায় বলেছিলাম খাবার নিয়ে আসতে?

বর্ষা দু-হাত কানে চেপে ধরে এমন শব্দদূষণে। কান্না করে বের হয়ে যায় হস্পিটাল থেকে। বর্ষা পথে বসে অনেক কান্না করেছিলো। স্বাভাবিক হয়ে একটু লেট করে বাসায় যায় বর্ষা। বর্ষা বাসায় পৌছানোর আগে গিয়ে দেখে আকাশ বসে আছে। আকাশের সাথে কোন কথা না বলে
বর্ষা রুমে চলে যায় বর্ষার, পিছনে আকাশ ও বর্ষার রুমে গিয়ে বর্ষাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
‘ সরি আসলে তখন আমার মাথা কাজ করছিলো না। একটা পেসেন্টের অবস্থা অনেক ক্রিটিকেল ছিলো তাই মন ভালো ছিলো না।
‘ বর্ষা কিছু না বলে আকাশকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। প্রায় আধা ঘন্টা কান্নার পর বর্ষা আবার আকাশের জন্য খাবার নিয়ে আসে।
.
.
.
বর্ষার বুক থেকে আকাশ মাথা তুলতেই বর্ষার ভাবনার ছেদ ঘটে। আর একটা বড় দীর্ঘশ্বাস আসে। এটা ভেবে এমন আরো অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু কেন করে আকাশ এমন বর্ষার সাথে? ভেবে পায় না বর্ষা৷

আকাশ উঠে বসে বর্ষার দু-হাত ধরে
‘ বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য তুমি বাহিরে গিয়ে এখনই বলবে বিয়ে ভাঙার কথা তুমি আমার সাথে অভিমান করে বলেছো। যা বলেছো আমার উপর রাগ করে। তুমি আমাকেই বিয়ে করতে চাও।

বর্ষা কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। মুখ ধোয়ার জন্য।

এই দিকে আকাশ মিনমিন করে বলছে।
‘ আ’ম সরি বর্ষা। আমি তোমায় আকাশ সমান ভালোবাসি তবে সাথে আকাশ সমান ঘৃণা ও করি। আর দুটোই তোমার সহ্য করতে হবে। তোমার হাতে আর কোন অপশন নেই……

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে