বাদলে ঘেরা আকাশ পর্ব-০৬

0
1876

#বাদলে_ঘেরা_আকাশ
#Part_6_
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha

আস্তে আস্তে নিচে নামতে নিলেই বর্ষা ওই রুমের সামনে থেমে যায় যেখানে আকাশ যেতে মানা করেছিলো। ভিতর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আর এই শব্দ আকাশের। বর্ষা ভয় পেয়ে যায়। আকাশের কিছু হলো না তো? আকাশ এই ভাবে কান্না করছে কেন? বর্ষা দরজা খুলতে নিলেই দেখে দরজা ভিতর থেকে লক করা। বর্ষা আর কিছু না ভেবে আস্তে করে আকাশ বলে ডাক দেয়। কোন পরিবর্তন না হওয়ায় আবার আকাশ বলে ডাক দেয়। তিন ডাকের মাথায় সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কান্নার আওয়াজ আর নেই। বর্ষা দরজায় ধাক্কা দিয়ে আবার আকাশ বলে ডাক দিতেই আকাশ দরজা খুলে রক্তিম চোখ নিয়ে দাঁড়ায় দরজায়। মনে হচ্ছে ডাক দিয়ে বর্ষা বিশাল অপরাধ করে ফেলেছে। বর্ষা আকাশের চোখ দেখে ভয় পেয়ে যায়। কান্নার ফলে চোখ এমনিতেই ফুলে লাল হয়ে গিয়েছে তার সাথে বিদ্রোহী রাগ নিয়ে তাকানোর ফলে চোখ ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। বর্ষা আকাশের তাকিয়ে থাকা দেখে ভয়ে কিছু না বলে নিচে তাকায়। আকাশ কিছু না বলে দরজা লক করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।

বর্ষা এখনো তাকিয়ে আছে নিচে। এতো অদ্ভুত সব কেন ঘটছে বর্ষার সাথে? আকাশেরই বা কি হয়েছিলো কেন কান্না করছিলো সে? আকাশ কি তাহলে এবনরমাল? এবনরমাল কি ভাবে হবে? বাকি সবই তো সে নরমাল ভাবে করে। সবার সাথেই সে ভালো কিন্তু বর্ষার সাথে কেন করছে এমন আকাশ? আর এই রুমের ভিতরেই বা কি আছে? এতো এতো প্রশ্মের জবাব বর্ষা কোথায় পাবে কার কাছে গেলে পাবে?বর্ষার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

রুমে গিয়ে আকাশ ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গিয়েছে নাকি ঘুমানোর ভান ধরছে সেটা আকাশ ভালো করে জানে। বর্ষা কথা না বাড়িয়ে পাশেই শুয়ে পড়ে আকাশের। বর্ষা ছটফট করছে শুয়ে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না আর। এমন কিছু ঘটার পর ঘুম আসারও কথা না । শুধু মনে হচ্ছে বুকে নিদারুণ ব্যাথা হচ্ছে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হাওয়ার পরে সুদুর কোন মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে বর্ষার কানে। আযানের শব্দ শুনে বর্ষা উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় ওজু করে এসে নামাজে বসে। চোখ দিয়ে কেন যেন ঝর্নার মতো অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পরছে।

বর্ষা নামাজ পড়ে বেল্কুনিতে বসে পড়ে আকাশ দেখার জন্য। বর্ষার খুব ভালো লাগে অন্ধকার আকাশ কিভাবে আস্তেধীরে আলোতে ভরে যায় তা দেখতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বর্ষার চোখ লেগে যায়। আর ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে।
আফিফের ডাকে ঘুম ভাঙে বর্ষার।
‘ সরি ভাবি ডিস্টার্ব করার জন্য । ভাইয়া সেই সকালে উঠে হসপিটালে চলে গেলো। আপনার কোন সারাশব্দ নেই তাই আম্মু পাঠালো দেখতে আপনি কি করছেন। অনেকক্ষণ নক করার পরও রেসপন্স না পেয়ে চিন্তায় পড়ে ভিতরে আসলাম। কিছু মনে করেননি তো?

বর্ষা গুটিসুটি হয়ে
‘ না কিছু মনে করিনি। কয়টা বাজে?
‘ ঘড়িতে দশটা বাজে কিন্তু আপনার জন্য ছয়টা, আম্মু বলেছে আপনি ঘুমিয়ে থাকলে যেন না ডাকি।

বর্ষার লজ্জা লাগছে। নতুন বউ হয়ে দশটা পর্যন্ত ঘুমানো নিশ্চয়ই ভালো দেখায় না। সবাই কি ভাববে? বর্ষা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে
‘ তোমার ভাইয়া কি দুপুরে ফিরবে?
‘ কখনো আসে কখনো আসে না। আম্মু বলেছিলো না যেতে হাসপাতালে। বিয়ে করে কেউ পরের দিন ছুটি না নিয়ে হাসপাতালে যায়? বড়ই আজব।

সবই আজব ( মনে মনে)
‘ আচ্ছা আফিফ তোমাদের ওই রুমে কি আছে? যেখানে লেখা ভিতরে কেউ প্রবেশ করবে না।

আফিফের মুখখানা সাথে সাথে কেমন মলিন আর চুপসে গেছে।
আফিফ তালহীন হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি মনিরা বেগম এসে
‘ কিরে মা উঠে গেছিস?

বর্ষা লজ্জা নিয়ে নরম সুরে
‘ জ্বী মা।

‘ আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নিচে আয় নাস্তা করবি। আফিফ তুই আমার সাথে আয় গেস্টদের একটা লিস্ট বানাতে হবে।

বর্ষার মনে কেমন খচখচ করছে। আকাশের বিষয়ে তার সব জানতে হবে। এখন এটা তার অধিকার। কিন্তু কিভাবে জানবে সব? ওই ঘরেই কি আছে সব উত্তর? কিন্তু আকাশ তো ওই ঘরে যেতে মানা করেছে।
.
.
.
এখন প্রায় প্রতি রাতেই বর্ষা ওই রুম থেকে আকাশের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। আকাশ যখন রুমে আসে তখন বর্ষা ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। আকাশকে কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় এড়িয়ে যায় নাহয় খারাপ ব্যবহার করে বর্ষার সাথে তাই বর্ষাও কিছু বলেনা আর আকাশকে।

একদিন সকালে তনিমা আসে বাসায়, বর্ষা তনিমাকে খুঁজে খুঁজে গিয়ে পায় আফিফের রুমে। একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। বর্ষার ওদের এই অবস্থায় দেখে মুহুর্তের মাঝে রাগ উঠে যায় আর তনিমাকে টেনে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
‘ কেন করছিস এসব তনিমা?

তনিমা গালে হাত দিয়ে কান্না করছে। এইদিকে আফিফ
‘ ভাবি আমার কথাটা শুনুন
‘ আফিফ তুমি কোন কথা বলবেনা যা বলবার আমি বলবো আর সেটা শুধু তনিমাকে৷

তনিমা অশ্রু নিয়ে
‘ আপু আমি আফিফকে ভালোবাসি।
‘ চুপ কর তনিমা তুই। এই কথা মুখ দিয়ে আর একবারও বের করবি না।

তনিমার হাত ধরে বর্ষা তার রুমে নিয়ে যায়। দুই-বোন চুপ করে বসে আছে তনিমা কান্না করছে নিরবে। তনিমার কান্না দেখে বর্ষার বুক ফেটে যাচ্ছে। ছোট বেলা থেকে ওদের মা নেই তাই মায়ের ভালোবাসা বর্ষা তনিমাকে দিতে চেষ্টা করেছে। কোনদিন দু-বোনের মাঝে কখনো ঝগড়া হয়নি। সব কিছু থেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করছে তনিমাকে, তাহলে আজকে কি ভাবে দিবে বোনকে ভুল পথে চলতে।

বর্ষা তনিমাকে জড়িয়ে ধরতেই তনিমা জোরে শব্দ করে কান্না করে উঠে। বর্ষা দু-হাতে তনিমার চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে
‘ তুই জানিস তো তোর বোন তোর ভালো চায়?

তনিমা কান্না করে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোঝালো।
‘ আমি তোকে বলিনি তনিমা। আমি ভালো নেই আকাশের সাথে। ( চোখ মুছে) কিন্তু ওকে ভালোবাসি বলে ছেড়ে যেতে পারছি না। না ও আমায় ছাড়ছে। ও আমাদের সম্পর্কের প্রথম দিন থেকে কিছু লুকাচ্ছে। আকাশ আমার সাথে হঠাৎ হঠাৎ এমন বিহেভ করে যেন আমি ওর অনেক পুরনো শত্রু। ওর পুরোটা শুধু রহস্যে ঘেরা। হোক বা নাহোক ও আমার থেকে অনেক বড় কিছু লুকাচ্ছে আর আমি সেটার সাথে জড়িত নিপুণভাবে। আমি চাই না যেই ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আমি আটকে গিয়েছি তোর সাথেও এমন হোক। তোকেও এই বাড়িতে এসে এমন সাজা পেতে হয় আমি চাইনা।

তনিমা বিষ্ময় নিয়ে বর্ষার দিকে তাকিয়ে
‘ কি বলছিস আপু? আকাশ ভাইয়া তো তোকে অনেক ভালোবাসে।
‘ সেটা সবাই জানে। আমিও জানি কিন্তু কিছু একটা আছে যা আমি বুঝতে পারছি না। অনেক হয়েছে আজ আমি ওই রুমে যাবোই।
‘কোন রুমে?
‘ কিছু না তুই বুঝবি না। তুই বাসায় যা আমি কালকে বাসায় গিয়ে তোর সাথে কথা বলবো।

অনেক হয়েছে এখন এর সাথে আমার বোন জড়িত হয়ে গেছে আমি আর চুপ করে থাকতে পারবো না। ( মনে মনে)
.
.
.
বর্ষা হাসপাশ করছে আকাশ কখন ঘুমাবে। আকাশ ঘুমাতেই আকাশের ড্রয়ার থেকে ওই রুমের চাবিটা নিয়ে সরাসরি চলে যায় ওই রুমে। রুমটা কেমন ধুলোতে ভরা। মনে হচ্ছে রুমে কেউই প্রবেশ করে না। আকাশ তো রুমে আসে তাহলে পরিষ্কার করে না কেন কে জানে! মস্ত বড় এটা কি? আয়না হবে হয়তো পর্দা দিয়ে ঘেরা। বর্ষা কৌতুল নিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিতেই দেখে বিকট বড় একটা মেয়ের ছবি। কি অপুর্ব দেখতে উনি। বর্ষার চোখ ওই ছবিতেই আটকে যায়। বর্ষার ছবিটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। এতো সুন্দর কাউকে বর্ষা আগে কখনো দেখেনি। তাই কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়। কিন্তু উনি কে? বর্ষা ছবিটার থেকে চোখ তুলে দেখে পাশেই আরেকটা ছোট ছবি একটু কালো পর্দা দিয়ে ঘেরা। ওই পর্দাটা ওঠাতে নিলেই পিছন থেকে
‘ ওটা আমি উঠিয়ে দিচ্ছি।

আকাশের শব্দ শুনে লাফ মেরে ওঠে বর্ষা৷
আকাশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বর্ষার কাছে এসে বর্ষার মুখোমুখি দাঁড়ায়। বর্ষা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। আকাশ বর্ষার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে ডান হাত দিয়ে টান দিয়ে পর্দাটা সরিয়ে ফেলে ওই ছবির উপর থেকে। বর্ষা ওই ছবির দিকে তাকাতেই কেঁপে ওঠে, যেন মাটি সরে যায় পায়ের নিচ থেকে। মনে হচ্ছে আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে বর্ষার উপর………

চলবে……

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে