বাড়িওয়ালার ছেলে পর্ব-০৯

0
547

#বাড়িওয়ালার ছেলে
– ফাহিমা ফাইজা
#পর্ব ৯

– তোমার বাবা আমাকে ২ ঘন্টায় চিনে ফেলে আমি কেমন, আর তুমি পুরো ২ বছর সময় নিলে।
আমি বললাম,
– আমি ২ বছর সময় না নিলে তোমাকে আজ এই রূপে দেখতে পেতাম না।
– তা ঠিক বলেছো অবশ্য। আচ্ছা এখন তো বলতে গেলে আমি তোমার ফিয়ন্সে তাই না?
– হুম, কেন?
– না মানে,তুমি যে শাড়িটা ফেরত দিয়েছিলে সেটা খুব শখ করে কিনেছিলাম। যদি পরতে… খুব খুশি হতাম।
– কোন শাড়ি? ও আচ্ছা ওই যে গোলাপী রঙের? সত্যি বলতে আমারো খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু ফেরত দিয়েছিলাম। কারণ তো জানোই..
– হ্যা জানি। এখন তো পরতেই পারো তাই না?
– আচ্ছা ঠিকআছে,যদি তুমি খুশি হও তাহলে অবশ্যই পরব।
– আমার খুশির জন্য পরবে?
– হ্যা, শুধু তোমার জন্য। অনেক ভালো’বাসি যে তাই।
– আমিও ভালো’বাসি অনেক। তাহলে কালই পরবে শাড়িটা?
– হুম, দেখি।
– আচ্ছা,ঠিকআছে। চুড়িগুলোও নিও।আর শোনো, আরেকটা জিনিসও কিনেছি তোমার জন্য।
– কি সেটা?
– এখন বলব না। সারপ্রাইজ থাকবে।
– তাই নাকি!
– হুম। আচ্ছা এখন রাখি তাহলে ঘুমাব। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
– এখন তো দেখছি তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাও।
– হ্যা,পুরোনো অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। যাতে করে বিয়ের পর তোমার ব’কা শোনা না লাগে। আরও ডাক্তার বউ আমার! একটু হেলদি না হলে হয়!
– হা হা হা, ভালো মজা করতে জানো!
– মজা কেন করব, সত্যি বলছি।
– আচ্ছা ঘুমাও তাহলে। গুড নাইট।
– গুড নাইট।

.
সকালে আদনানের বাবা রায়হান আংকেল এসে বিয়ের দিন ঠিক করলেন। যেহেতু আমার পরীক্ষা সামনে তাই পরীক্ষার এক সপ্তাহ পরেই বিয়েটা হবে। আমি কখনো এত খুশি হইনি যতটা এই খবর শুনে হয়েছি। মনে হচ্ছিলো সারাজীবন যার জন্য অপেক্ষা করেছি সে আর কেউ না আমার আদনান। হ্যা হয়ত প্রথম বার ভুল করেছি, কিন্তু শেষবার আমি ভুল করিনি। রবি ঠাকুরের একটা গান আছে না,

“ আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায়।।
বাহির পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয় পানে চাইনি আমার…”

আমার হয়েছিল সেই অবস্থা। আদনান আমার হৃদয়ে লুকিয়ে ছিল, তাকে দেখতে চেয়েও দেখতে পারিনি। কিন্তু এতটুকু তো বলতে পারি তাকে ভালো’বেসে আমি ভুল করিনি। কিন্তু ভয় হচ্ছে যদি আদনান আমার না হয়? যদি কোনো বিপদ আসে, কোনো ঝড় এসে যদি সব ল’ন্ডভ’ন্ড করে দেয় তখন কি করব? সহ্য করতে পারব নাকি পারব না? নাকি আজীবন বিরহ-বেদনায় আমার জীবন অতিবাহিত হবে,চোখের অশ্রুজলে ভাসতে ভাসতে শুধু বলব, আমি একজনকে ভালো’বাসতাম,খুব ভালোব’াসতাম!
ধুর কিসব ভাবছি আমি, আদনান আমারই হবে। ও শুধুই আমার। এতক্ষণ ড্রেসিং টেবিলে বসে বসে এসব চিন্তা করছিলাম। কানের দুলটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় আমার ধ্যান কা’ট’ল। আজ আমার জন্মদিন। আদনানের দেওয়া সেই গোলাপী শাড়িটা পরেছি। আর হাতে ওর দেওয়া চুড়ি। কানের দুলগুলো আমার নিজেরই কেনা। আদনান নাকি কানের দুল চয়েস করতে জানে না। এজন্য শুধু চুড়ি কিনেছিল। মেঝে থেকে দুলটা তুলতে যাব তখনই দরজায় দেখি আদনান দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম,
– কি হয়েছে আদনান?
– হ্যাপি বার্থডে!
– থ্যাংক ইউ!
– তোমাকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। এত রূপ কোথায় এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলে?
– কেন এত দিন কি কু’রূপা ছিলাম?
– তা বলিনি, অন্যসময় তোমাকে দেখলে সম্মান করতে ইচ্ছে করে। মানে মেডিকেল স্টুডেন্ট বলে কথা। কিন্তু আজ..
– আজ কি?

আদনান কোনো কথা না বলে আমার হাত থেকে দুলটা নিয়ে কানে পরিয়ে দেয়। ওর হাতের স্পর্শ পেয়ে আমার সারা শরীর শি’হ’রিত হয়ে ওঠে। আমি আয়না থেকে মুখ সরিয়ে আদনানের দিকে তাকাই। আদনান তখন আমার খুব কাছে, এত কাছে যে ওর নি:শ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছিল। আদনান যখন আমার গালে হাত দিল আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আদনান ফিসফিস করে বলল, “ তোমাকে অনেক ভালো’বাসি আয়শা! ”
– আমিও ভালো’বাসি আদনান!

বলেই আমি ড্রেসিং টেবিলের টুল থেকে উঠে এক দৌড়ে পালাই। আদনান হয়ত লজ্জা পেয়ে নিজের মাথায় নিজেই থা’প্প’ড় দিল।

সাজগোজ শেষ। এখন ছাদে যেতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে। আদনান আর আমি একসাথে ছাদে গেলাম। শায়লা, রাফা,এশা,শারমিন সহ আরও অনেক বন্ধু-বান্ধবীরা এসেছে। শারমিনকে ইউসুফের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল ইউসুফ নাকি কানাডা চলে যাচ্ছে ফ্যামিলিসহ। আমি আর ওর কথা বাড়ালাম না। প্রায় দুই বছর পর এত বড় করে আমার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আদনান সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“ হ্যালো এভ্রিঅন, আজ তোমাদের প্রিয় বান্ধবী আয়শার জন্মদিন। তোমরা বোধ হয় ইতিমধ্যে আমার পরিচয় জেনে গেছো। তা জিজ্ঞেস করছিলাম যে আমাকে কি তোমাদের পছন্দ হয়েছে,মানে আয়শার সাথে কি আমাকে মানাবে?”

সবাই জোরে হেসে দিয়ে বলল, “ হ্যা খুব মানাবে!”

আমি কনুই দিয়ে আদনানকে খো’চা মে’রে বললাম,
“ এটা কোন ধরনের কথা আবার!”
আদনান আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারো বলতে শুরু করল,“ আচ্ছা তোমরা তাহলে কেক কা’টা শুরু কর।”

কেক কা’টার আগে আদনান গিয়ে আমার আব্বুকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। আব্বু ক্লান্ত ছিল তাই ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু আদনান ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসেছে তাকে। আমি তেমন কিছু বললাম না। তো কেক কা’টার পর আমি প্রথমে আব্বুকেই কেক খাওয়ালাম। তারপর শায়লাকে। শায়লা না খেয়ে বলল,“ আরে আদনান ভাইকে আগে খাইয়ে দে। ”
আমি আদনানের দিকে একবার তাকিয়ে শায়লাকে বললাম, “ এত মানুষের সামনে আমার লজ্জা করে!”
আদনানও ইশারা দিয়ে শায়লাকে বোঝালো তার দরকার নেই। মনে হলো আদনান রা’গ করেছে। তাই সবাই যখন কেক খাচ্ছিল আমি আদনানকে এক সাইডে নিয়ে গিয়ে বলি,“ তুমি কি রা’গ করেছো?
– না তো, আমি তোমার উপর রা’গ করতে পারি কখনো বোকা মেয়ে!
– আসলে আমার লজ্জা লাগছিল তাই…
– সমস্যা নাই,বিয়ের পর তো আরও জন্মদিন আসবে তখন খাইয়ে দিও। কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না।
– আচ্ছা,
– আর হ্যা, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে কিন্তু,সবাই চলে যাওয়ার পর তুমি এখানেই থাকবে।
– কি সারপ্রাইজ?
– উফ,সারপ্রাইজ কেউ বলে দেয় নাকি?
– আচ্ছা ঠিকআছে।( জোরে হেসে বললাম )
.
জন্মদিনের পার্টি শেষ হলে আমি ছাদে থেকে গেলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিলাম আর অতীতের কথা ভাবছিলাম। আদনানের উপস্থিতিতে আমার হুশ ফিরল। আদনান আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“হে বন্ধু কী চাও তুমি দিবসের শেষে
মোর দ্বারে এসে।
কী তোমারে দিব আনি।
সন্ধ্যাদীপখানি?
এ-দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের,
স্তব্ধ ভবনের।
তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়?
এ যে হায়
পথের বাতাসে নিবে যায়।
কী মোর শকতি আছে তোমারে যে দিব উপহার।
হোক ফুল, হোক-না গলার হার,
তার ভার
কেনই বা সবে,
একদিন যবে
নিশ্চিত শুকাবে তারা ম্লান ছি’ন্ন হবে।
নিজ হতে তব হাতে যাহা দিব তুলি
তারে তব শি’থিল অঙ্গুলি
যাবে ভুলি–
ধূলিতে খ’সিয়া শেষে হয়ে যাবে ধূলি…”

আদনানের কবিতা আবৃত্তি শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম,
– তারপর?
– তারপরের টুকু ভুলে গেছি। কলেজে থাকতে একবার আবৃত্তি করেছিলাম।
– প্রথমটুকুও তো বলনি।মাঝখান থেকে বলেছো!
– হ্যা,ভুলে গেছি,এজন্য!
– তুমি এত ভালো কবিতা আবৃত্তি কর জানতাম নাতো।
– আমার মা কবিতা খুব পছন্দ করতেন। এজন্য বাবা একটা রুম বই দিয়ে ভর্তি করেছে। বলতে পারো আমাদের বাড়ির লাইব্রেরি ওটা। কিন্তু এখন বইগুলো পড়ার মানুষ নেই। ধূলো জমে গেছে।
– আমি ধূলো মুছে দেব। পুনরায় বইগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনব।
– সত্যি?
– হুম। আমিও খুব পছন্দ করি বই পড়তে।
– যাক ভালোই হলো। আমি ভাই ওইসব বই পড়াতে নেই। আচ্ছা তুমি বোধ হয় খুব ক্লান্ত। যা দেওয়ার জন্য এসেছি তা হলো..

বলতে বলতে আদনান একটা ছোট বাক্স বের করল। মনে হলো আংটির বাক্স। যা ভাবলাম তাই। আদনান বাক্সটি খুললে দেখতে পেলাম একটা আংটি। মনে হচ্ছিলো হিরার। আদনান বলল,
– আগেই বলেছি যাই উপহার দেব, তা আমার ভালো’বাসার সমান হবে না। তবুও তোমার জন্য উ’ম্মাদ এই প্রেমিকের ছোট্ট উপহার গ্রহণ কর।

আদনানের হাস্যজ্বল মুখ মলিন হয়ে গেল যখন দেখল আমার কপোল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আদনান আমার হাত ধরে বলল,
– কি হলো প্রিয়তমা, কাদছো কেন?

আমি বললাম, “ কাদছি না আদনান। আমি শুধু ভাবছি তুমি আমার জন্য কত কিছু করলে,কত ভালো’বাসে আর আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।”
– আরে বোকা মেয়ে,কি বলছো এসব! দেখি হাতটা,আংটিটা পরিয়ে দেই।

আদনান হিরার আংটি আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে হাতে চু’মু খেল। আমি কান্না করা অবস্থায় আদনানকে জড়িয়ে ধরি। আমি অঝরে কান্না করছি। আদনানও কিছু বলছে না। শুধু বলল,
“ যদি কান্না করে তুমি শান্তি পাও,তবে কাদো,আমি বাধা দেব না প্রিয়া। মনের আর হৃদয়ের যত আঘাত আছে সব মুছে ফেল। আমি বাধা দিচ্ছি না। ”

আমিও আর কিছু বললাম না। শুধু শ্রাবণ মেঘের মত বৃষ্টি ঝরাতে লাগলাম।
.
আমার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো। আল্লাহর রহমতে ভালোই হয়েছে। প্রথমে বিয়েটা ঢাকাতে কমিউনিটি সেন্টারে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম না থাক বাড়িতেই করা ভালো হবে। কারণ ওখানে আমার সব স্কুল ফ্রেন্ডরা আছে। আর তাছাড়া….

( চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে