#বাড়িওয়ালার ছেলে
–ফাহিমা ফাইজা
#পর্ব ৩
মেয়েটির পরিচয় জেনে আমি চমকে উঠলাম। মেয়েটি ছিল ইউসুফের স্ত্রী জারা। আমি প্রথমে কোনো কথা বলতে পারলাম না। সে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম,
– আপনি কেন ফোন করেছেন আমাকে?
– প্রয়োজন ছাড়া তো আর ফোন দিতাম না তাই না? প্রয়োজন আছে বলেই তোমার নাম্বার কালেক্ট করলাম আর ফোন দিলাম।
– আমার সাথে আপনার কি প্রয়োজন?
– আছে আছে। তুমি কাল আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
–আপনার সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
– তোমার ইচ্ছামত তো চলবে না তাই না। তুমি আগে আসো তাহলেই বুঝতে পারবে।
বুঝতে পারলাম এই মেয়ের সাথে তর্ক করা আমার চলবে না। আমি নিতান্তই কম কথা বলতে পছন্দ করি। তাই আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “ ঠিকয়াছে। তাহলে কোথায় আর কখন আসতে হবে?”
– তুমি বল। তুমি ব্যাস্ত মানুষ; কলেজ, পড়াশোনা,টিউশনি শেষ করে তোমার যখন সময় হয় এসো।
– কাল তো শুক্রবার।
– ওহ হ্যা। তা ঠিক। যাই হোক তুমিই বল কখন আসতে চাও।
– আচ্ছা বিকালে হলে ভালো হয়।
– ঠিকআছে।
পরের দিন তার কথা মত আমি তার বলা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। যদিও তিনি এখনো আসেননি। রেস্টুরেন্ট টা কলেজ থেকে ভালোই দূরে। এত দূরে কেন ডাকলো বুঝতে পারলাম না। আমি বুঝতে পারলাম আমার হাত পা কাপছে। ভয় হচ্ছে। যদি জারা উলটা পালটা কিছু করে? কি করব আমি তখন? কে বাচাবে আমায়? ভাবতে ভাবতে দেখি শাড়ি আর হাতা কা’টা ব্লাউজ পরে একজন সুন্দরী নারী প্রবেশ করল। আমি তো জারাকে চিনি না, তবুও মনে হলো ইনিই হয়ত জারা। অবশেষে দেখলাম তিনি আমার সামনে এসেই বসলেন।দেখে মনে হয় না যে তার পাচ বছরের ছেলে আছে। আমার থেকে মনে হয় দু-তিন বছরের বড় হবে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি টেবিলে ব্যাগ রাখতে রাখতে বললেন, “ তাহলে তুমিই সেই আয়শা! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক সুন্দরী। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কি দেখে ইউসুফ আমাকে রেখে তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ালো।”
– আপনি আমাকে এখনই প্রথম দেখছেন? তো চিনলেন কিভাবে এটা আমি?.
– আমি আগেই ছবি দেখেছি তোমার আর ইউসুফের। এজন্য চিনলাম। ছবি দেখেই আমার এমনটা মনে হয়েছিল।
আমি বুঝেছিলাম জারা আমাকে অপমান করতে চাইছে। কিন্তু সে যা বলেছে তা ঠিকই বলেছে। আমি নিজেও মাঝে মাঝে তাই ভাবি। ওদের বাসা নাকি এখানেই। বাড়ির বর্ণনা শুনে বুঝলাম ওটা শারমিনদেরই বাসা। শারমিনের সাথে সেদিন কথা হয়েছিল। ইউসুফ বউ বাচ্চা নিয়ে ওদের বাড়িতেই বাসা ভাড়া নিয়েছিল এই মাসের শুরুতে। এজন্যই ও জানতে পেরে আমাকে সব বলে দিয়েছিল। দেখলাম জারাও এসব কথা জানে। ভেবেছিলাম হয়ত অন্য কিছু বলতে এসেছে। কিন্তু সে ওই একই কথাগুলো বলছে যা যা ঘটেছে। আমি মাথা নিচু করে শুধু শুনছি। কি করব নিজেকে এত দোষী মনে হচ্ছে যে কোনো কথাই মুখ থেকে বের হচ্ছে না। জারার মুখের দিকে তাকানোর সাহসও নেই আমার। এক পর্যায়ে সে ইউসুফ আর তার পালিয়ে বিয়ের ঘটনা বলে। তিনি যা বললেন তাতে বুঝতে পারলাম তাদের মা বাবা রাজি ছিলেন না বলে তারা পালাতে বাধ্য হয়েছে। তখন তারা দুজনই কলেজে পড়াশোনা করত। আমার এসব কথা শুনতে একদমই ভালো লাগছিল না। কিন্তু কি আর করব। ভাবলাম জারাকে আমার সরি বলা উচিত কারণ তার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। আর অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়ত আমাকে এখানেই খু’ন করতে ফেলত। কিন্তু সে আমাকে তেমন কোনো কিছুই বলল না। আমি মাথা নিচু করে সরি বলতে যাব তখনই সে নিজে থেকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল।
– আয়শা, আমি ইউসুফ এর পক্ষ থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমি জানি তোমার মনের অবস্থা কেমন।
– এসব কি বলছেন। আমি দোষী। আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন?
– না আয়শা৷ তুমি দোষী না। তুমি আসলে খুব ভালো একটা মেয়ে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়ত ইউসুফ কে এত সহজে ছেড়ে দিত না। কিন্তু তুমি ওর এগেইন্সটে কোনো স্টেপ নেওনি। এমন কি পিছু টানও দাওনি।
জারার কথা শুনে আমি পুরো অবাক হয়ে গেলাম। কি সুন্দর মন, এরমক একটা বউকে ইউসুফ কিভাবে পারল ঠ’কাতে? ওর কি একটুও মন পু’ড়ল না? আমার কথা বাদই দিলাম একটুও ভাবল না তার বউয়ের কথা! যে কিনা তাকে এত ভালোবাসে, তার ফ্যামিলি, তার স্টাটাস, তার সব কিছু ছেড়ে শুধু মাত্র ভালোবাসার জন্য তার কাছে ছুটে এসেছিল। এমনকি নিষ্পাপ বাচ্চাটার কথাও ভাবলো না? হঠাৎই দেখি জারা অঝোরে কাদছে। আমি যাও একটু বলতে চাচ্ছিলাম তার কান্না দেখে আমি আরও ভেঙে পড়ি। সে কান্নারত অবস্থায় বলল,
– অনেক বেশি ভালোবাসতাম ওকে। ও কেন এমন করল আমার সাথে? আমার ছেলেটার কথাও ভাবল না। এমনকি ও তোমার জীবনটাও নষ্ট করেছে। ও একসাথে তিনটা জীবন নষ্ট করেছে।
জারা আর কিছু বলতে পারল না। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে শুধু তার হাতটা ধরে বললাম আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। এছাড়া আমার বলার কিছু নেই।
বলেই আমি ওখান থেকে চলে এলাম। একবারও পিছনে তাকালাম না।
আমি শুধু ভাবছি আমরা মানুষকে যেরকম ভাবি তারা সেরকম হয় না। জারার প্রথম দিকের কথাগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল সে আমাকে অপমান করতে এখানে ডেকেছে। কিন্তু না তার মনে আসলে তেমন কোনো কিছু ছিল না। তাহলে তার মনে কি ছিল? আমাকে সরি বলতেই তার এত প্রচেষ্টা? কিন্তু সে কেন ক্ষমা চাইবে? সে কি করেছে? সেতো কিছু করেনি। তাহলে কোন পাপের মাশুল টানতে হচ্ছে তাকে? তাহলে তার পাপ কি ছিল ভালোবাসা? ভালোবাসা কি পাপ? প্রশ্ন গুলো আমার মাথায় ঘুরতে থাকে। আমি উত্তর পাই না। পাই না কোনো পথ, যে পথে আমি যাব। মনে হতে লাগল এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। আমার মাথায় শুধু জারার কথাগুলো ঘুরতে লাগলো। এসময় আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম। অমনোযোগী থাকার কারণে ভালো করে দেখতেও পেলাম না দু পাশ থেকে গাড়ি আসছে কিনা। হঠাৎই মনে হলো কি যেন আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা মাইক্রোর সাথে আমার এক্সি’ডেন্ট হয়ে যায়। মুহূর্তে আমার চারপাশে মানুষের ভিড় জমে যায়। আর আমি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ি। মনে হয় আর কোনোদিনও চোখ খুলতে পারব না।
.
“আয়শা, একবার চোখ খোলো। প্লিজ আয়শা, আমি আর অনেক ভালো হয়ে যাব। আমি আবার বাবার বাধ্য ছেলে হয়ে যাব। আমার ঘাড়ের ট্যাটুও তুলে ফেলব। তুমি যা বলবে আমি তাই করব। তুমি শুধু চোখ খোলো। প্লিজ,প্লিজ…”
হঠাৎই আমি এসব কথা শুনতে পাই। বুঝতে পারি আদনান কান্না করে এসব কথা বলছে। চোখ খোলার অনেক চেষ্টা করি। আস্তে আস্তে অন্ধকার কে’টে যায়। আর দেখি আদনান আমার হাত ধরে কান্না করছে। আমি অনেক কষ্টে আদনানকে নাম ধরে ডাকি। আমার ডাক শুনে আদনান মাথা উচু করে তাকায়। এই প্রথম আদনানের চেহারা দেখে আমার মায়া হয়। যেন মনে হচ্ছিলো। এ পৃথিবীতে শুধু আদনানই আমার একমাত্র আপনজন। কারণ আমি ভেবেছিলাম আমি হয়ত মা’রা গেছি। আর কখনো চোখ খুলবনা। কিন্তু চোখ খুলেই যখন আদনানকে দেখি তখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। আদনান আমাকে চোখ খুলতে দেখে আল্লাহর কাছে শোকর করতে থাকে। এই প্রথম ওকে শোকর করতে দেখলাম। আমি মুচকি হেসে বলি “ কি আদনান সাহেব,ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন নাকি? ”
– তুমি আসলেই গাধা, রাস্তা দেখেশুনে চলাফেরা করতে পারো না?
– না,পারি না।
– কেন পারো না?
– জানি না।
– দেখ, ফাইজ’লামি করো না। তুমি জানো আমার কি অবস্থা হয়েছিল?
– কি হয়েছিল? আমি ম’রে গেলে আপনার কি?
– আমার কি মানে?
আদনান কথা শেষ করার আগেই আমার কেবিনে শায়লা,রাফা,এশা চলে আসে। বাবা-মা বাড়ি থেকে ছুটে এসেছেন। তাতে বুঝলাম আমার অবস্থা বেশ খার’প ছিল। ওদের দেখে আদনান আমার হাত ছেড়ে দেয়। শায়লা এসে আমার হাত ধরে কান্না করে দেয়। রাফা আর এশাও শোকর করতে থাকে। আমি বললাম,“ শায়লা, আবার মা বাবাকে এসব বলিসনি তো?”
– না,তোর বাবা হার্টের রোগী। আর তো মায়েরও প্রেশার, তাই আর বলিনি।
এরকম আরও অনেক কথা হলো ওদের সাথে। আদনান একবার আমার দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। আমি ওকে ডাক দিয়ে বললাম…
চলবে…