বাঁধিব তোমায় বিরহ ডোরে পর্ব-০৮

0
270

#বাঁধিব_তোমায়_বিরহ_ডোরে
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_০৮

চৈত্র মাসের সূর্যের রোদ ছড়িয়েছে চারদিকে। জানালা ভেদ করে রোদের কিছু অংশ ইনিয়ার চোখে মুখে পড়ে। ইনিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায় । চোখের পাতা পিটপিট করছে। রোদের তেজ ছড়িয়ে পড়ার কারণে চোখজোড়া ভালো ভাবে খুলতে পারছেনা। এরজন্য ইনিয়া খুব দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়ে। উঠে দেখতে পায় পাশে রাহা ঘুমিয়ে আছে। ইনিয়া মুচকি হাসি দিয়ে বলে সারারাত আম্মুকে জ্বালিয়ে এখন ঘুমানো হচ্ছে। রাহার নাকটা একটু টান দিয়ে বলে পঁচা মেয়ে। বয়সতো বেশি নয় এরপরেও সারারাত শুধু দুষ্টুমি। আম্মুকে একটুও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়না। এমন সময় ইশমাম এক কাপ চা এনে বলে গুড মর্নিং বাবুর আম্মু। এই নেন আপনার চা।

ইনিয়া খুবই অবাক হয়। চোখজোড়া বড়বড় করে ইশমামকে দেখে, এরপরে বলে আপনি আমার জন্য চা বানিয়েছেন?
“ হ্যা আপনার জন্যই তো। ক্যান আমার বানানো চা খাবেন না? ”
“ না এটা অপ্রত্যাশিত ছিলো। ”
“ প্রত্যাশা বলে কিছুই হয়না। আর যার কাছে যত প্রত্যাশা রাখবেন ততই ঠকবেন। তাই প্রত্যাশা ছাড়া যা পাওয়া যায়, তা স্বাভাবিকলি গ্রহণ করতে হয়। আমি কিন্তু অনেক ভালো চা বানাই খেয়ে বলুন কিরকম বানাইছি? ”

ইনিয়া চায়ের কাপে চুমুক দেয়। মুখের মধ্যে দিয়েই বলে আপনি কিভাবে জানলেন? আমি চায়ে কম চিনি খাই!
“ ইশমাম মাথা নিচু করে ফেলে, এরপরে বলে প্রিয়াও চায়ে কম চিনি খেতো! ”

ইনিয়া বুঝতে পারে ইশমাম চা বানিয়েছিলো প্রিয়ার জন্য। তাই ইনিয়া আর কিছু না বলে সুন্দরমতো চা খায়। কারণ আরও কিছু প্রশ্ন করলে ইশমাম কষ্ট পাবে। ইশমাম ইনিয়ার চা খাওয়া দেখে কল্পনায় প্রিয়াকে দেখে। কারণ ইনিয়া যেভাবে চা খাচ্ছে প্রিয়াও ঠিক সেইমভাবে চা খেতো। এভাবে ড্যাবড্যাব করে ইশমাম ইনিয়াকে দেখছে দেখে ইনিয়া প্রশ্ন করে এভাবে কি দেখছেন?
“ আপনাকে!”
“ আমাকে এভাবে দেখার কি আছে? ”
“ ইশমাম ইনিয়ার কথায় বিপাকে পড়ে। চোখের কোণে পানি জমে যায়। কথা ঘোড়ানোর জন্য ইশমাম ইনিয়াকে বলে বাবুকে দেখছি।হয়তো আপনি খেয়াল করেছেন আপনাকে দেখছি। আসলে তা নয়। সারারাত কত কান্না করে মেয়েটা আপনাকে আজকে রাতে বড্ড জ্বালিয়েছে। এখন কিভাবে ঘুমাচ্ছে। একদম নিষ্পাপ ফেরেশতা লাগছে। ”
“ বাচ্চারা ফেরেশতায় হয়। ”
“ আচ্ছা আমি যে বাবুর নাম রাহা রেখেছি। আপনি কিছু মনে করেন নিতো? ”
“ না! মনে করার কি আছে? অনেক সুন্দর নামতো। ”

ইশমাম জানালাটা লাগিয়ে দেয়। এরপরে ইনিয়াকে বলে বাইরে প্রচন্ড চৈত্র্যর রোদ। জানালা ভেদ করে রুমে তাপ দিচ্ছে তাই লাগিয়ে দিলাম। কারণ বাবু ঘুমাচ্ছে। আমি চাইনা বাবুর ঘুমটা ভাঙুক। আপনি আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন। আমি নাস্তা রেডি করে আপনাকে ডাক দিলে খেতে আসিয়েন।

এই কথা শুনে ইনিয়া বলে আজ বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো আমি আপনাদের বাড়িতে। অথচ সব কাজ আপনি একাই করেই যাচ্ছেন আমাকে কিছুই করতে দিচ্ছেন না। এমনিতে আপনি হলেন আমার আশ্রয়দাতা, এভাবে বসে বসে আর খেতে পারছিনা। তার উপর কোনো কাজই করতে দিচ্ছেন না। আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন?

ইশমাম এই কথা শুনে ইনিয়াকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে যতদিন না বাবু বড় হচ্ছে ততদিন আপনার ছুটি নাই। আই মিন ঘরের বাইরে বেড়ানো বন্ধ। এই কথাটা শেষ করে ইশমাম সেখান থেকে চলে যায়।

ইনিয়া ইশমামের ছুটির কথা শুনে ভাবনায় পড়ে গেলো। মনেমনে বললো ওনি এভাবে বললো ক্যান? ওনার কথার কিছুই বুঝলাম নাতো! এরপরে ইনিয়া ভাবলো হয়তো তার বাবুকে সদ্য হারিয়ে যাওয়া মেয়ের মতো পিতৃসেহ্ন করছে রাহাকে। এরজন্য এভাবে বললো। কিছুদিন গেলে ওনি নিজে থেকেই কাজের কথা বলবেন। বসে বসে আর বা কতই খাওয়াবে? হঠাৎ রাহার কান্নার ভাজ পায়। ইনিয়া শুয়ে পড়ে রাহাকে বলে বাবু তোমার ক্ষুধা লাগছে? এইতো আম্মু চলে এসেছে বলে রাহাকে দুধ দেয়। রাহা দুধ খাওয়া শুরু করে। রাহার মুখখানা দেখে জুনায়েদের কথা মনে পড়ে যায়। জুনায়েদের কথা মনে পড়তেই ইনিয়ার চোখ ভিজে যায়। জুনায়েদকে প্রশ্ন করে তোমার যেহেতু নিমুকেই ভালো লাগতো তাহলে আমাকে এতো ক্যানো ভালোবাসলে জুনায়েদ। আমাকে ক্যান মিথ্যা স্বপ্ন দেখাইলা। কি দোষ ছিলো জুনায়েদ আমার? এইযে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন। আমি শিউর এখন রাহাকে দেখলে তুমি আমার কাছে আসতে চাইবে। কিন্তু আমি চাইনা তোমার জীবন দুনৌকার মাঝে বহবান থাকুক। তাইতো আমি চলে এসেছি জুনায়েদ। তুমি যে অনেক বড় অপরাধ করে ফেলছো। ইসলামি বিরোধী কাজ, সেই জায়গায় আমার থাকা শোভা পায়না।

❝ তুমি আজ ভুলেই গেছো,
গাঢ় সবুজ পাতায় বিচ্ছেদের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছো প্রিয়তম !
ইট পাথরের এই শহুরে অলিগলিতে আঙ্গুলে আঙ্গুল রেখে পথ চলাটা,
তুমি কত সহজেই ভুলেই গেছো। অথচ আমার ভুলে থাকা হয়নি !
আমাদের দেয়া অজস্র কথা ছিল, তুমি তা রাখোনি !!
কথা সত্য যে, কেউ কেউ কথা রাখে না, কেউ কেউ ভুলে পড়ে, কেউ ভুলে যায়। কেউ কেউ ভুলে থাকার অভিনয় করে একদিন নক্ষত্রের মতো হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়াটাই নিয়তি।
তীল তীল করে গড়ে উঠা সম্পর্কের সৌধ একদিন হঠাৎ করেই এভাবেই ভেঙ্গে যায়। মায়া মমতায় জড়িয়ে থাকা সম্পর্কে বিচ্ছেদ অবধারিত চলে আসলে আমরা মুষড়ে পড়ি। অনেকের বেঁচে থাকার স্পৃহা চলে যায়। কেউ কেউ ওপারে চলে যায় বিচ্ছেদের কঠিন ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে। অথচ এমন হবার কথা নয়, এমন হবার কথা ছিল না। ❞

কথাগুলো ভাবতেই চোখ দিয়ে অশ্রুকনা গালবেয়ে পড়তে থাকে। রাহা ঘুম যায়। রাহার কপালে চুমু দিয়ে বলে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

____

“ এই তোমার এতবড় সাহস আমার মেয়ের হাত পুড়িয়ে দাও? ”
“ সাহস তো আপনাদের থেকে পাওয়া। মনে নেই অতীতে কি করেছিলেন? ইনিয়ার সঙ্গে। ”

লিমা রহমানের মনে পড়ে যায়। নিমু একদিন ঠিক এভাবেই ইনিয়ার হাত পুড়িয়ে দিয়েছিলো। লিমা রহমান আমতা আমতা করে বলে এই তুমি কি রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে বিয়ে করেছো? ভালোবেসে নয়।

লিমার কথা শুনে জুনায়েদ অট্টহাসি দেয়। এরপরে বলে বাহ! আমার শাশুমা তো দেখি বেশ ব্রিলিয়ান্ট! হ্যা আপনি যা ভাবছেন তাই সত্যি। আর আপনার মেয়েকে ভালোবাসবো এই কথা ভাবলেন কি করে? আমি শুধুমাত্র ইনিয়াকে ভালোবাসি। আপনাদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যার যেমন কর্মফল তার ভাগ্যতে ঠিক দুদিন পরে সেইম জিনিস ঘটে। শুধুমাত্র ফারাক সময়ের অপেক্ষা।
“ আমি তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিব! তোমার এতবড় সাহস হয় কি করে? আমার মেয়ের জীবনের সঙ্গে খেলা? এই খেলা আমি বের করবো। ”

এই কথা শুনে জুনায়েদ ঠোঁটভাজ করে বলে ও তাই বুঝি। তাহলে এই কথাও আমি পুলিশকে বলবো আপনি একজন খুনি মহিলা। ইনিয়ার আম্মুর খুনি। ইনিয়ার বাবার পা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পিছনে আপনি দায়ী।

এই কথাগুলো শুনে লিমা মুখের থুথু দিয়ে গলা ভেজায়। এরপরে বলে তুমি এসব কথা বলছো এগুলা ভিত্তিহীন। পুলিশ চায় প্রমাণ, আর এসব কথা বলছো যে, তুমি প্রমাণ করতে পারবে?

“ অবশ্যই পারবো। ”
“ কিভাবে? ”
“ মি. সর্কেল এখানে আসুন তো? ”
“ মি. সর্কেল কে দেখে ভয় পায় লিমা। এরপরে ডক্টরকে বলে আপনি এখানে? ”

মি. সর্কেল বলে আমাকে এখানে এনেছে জুনায়েদ শেখ।

“ কি ব্যাপার শাশুমা? চিনেন এনাকে? ”
“ হ্যা! চিনবো না ক্যান? ইনিই তো তোমার শশুড়ের পার্সোনাল ডক্টর। এই ডক্টরের পরামর্শে ঔষধ সেবন করে। ”
“ জুনায়েদ মুচকি হাসি দিয়ে বলে ভূল বললেন শাশুমা। এনার পরামর্শে নয়। বরং আপনার পরামর্শে মি. সর্কেল ভূলবাল ঔষধ দেয়। এরজন্য বাবা ঠিক হচ্ছেনা। আর আমি এগুলার এভিডেন্স যত্ন করে রেখেছি। ”
“ কি বলছো তুমি? আমি এসব করতে যাব ক্যান? ”
“ জুনায়েদ মুচকি হাসি দিয়ে রিভলবার পেছন থেকে বের করে মি. সর্কেলকে তাক করে, এরপরে বলে জীবনের মায়া থাকলে সত্যিটা বলেন। ”

“ স্যার! প্লিজ বন্দুক সরান। হ্যা লিমা ম্যাডাম আমাকে বেশি টাকা দিয়ে এরকম কাজ করতে বলেছে। আমি ডক্টর হয়ে এসব করতে রাজি ছিলাম না বলে আমার বউ বাচ্চাকে মারার হুমকি দেয়। পরে এসব করতে আমি বাধ্য হই। ”

জুনায়েদ মুচকি হাসি বলে শাশুমা আপনি যদি চলেন ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়। আমি আগে থেকে বুঝতে পারছি, আপনি এরকম কিছু করছেন হয়তো? তাই বাবার প্রেসক্রিপশন নিয়ে অন্য ডক্টরকে দেখাই। ডক্টর বলেছে বাবাকে যেসকল ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে, এই ঔষধ গুলো আস্তে আস্তে বাবার অঙ্গ প্রতঙ্গ বিকল করে দিবে। এরজন্য সেদিন নিমুকে দিয়ে বাবাকে এই বাড়িতে আনি। আর খুব যত্নের সহিত ঔষধগুলো পাল্টেও দিয়েছি। হয়তো আপনি খেয়াল করেন নি। আর আপনি বিষ প্রয়োগে ইনিয়ার মাকে মেরেছেন তার বড় প্রমান ইনিয়ার বাবা। কারণ ওনি যখন সত্যিটা জানতে পারে তখন আপনি ওনাকে আস্তে আস্তে শেষ করার প্রচেষ্টায় নেমেছেন। কিন্তু একটা কথা কি শাশুমা ওনি কিন্তু এখনো কথা বলতে পারে। এখন বলেন, হবেন পুলিশের শরণাপন্ন। হলে হোন বিপদ কিন্তু আপনার দিকেই ধেয়ে আসবে।

লিমা রহমান ঢোক গিলে আবারও। এরপরে বলে তুমি আসলে কি চাও? কিসের জন্য আমার মেয়ে ও আমার সঙ্গে এরকম করছো?

“ অপমানের প্রতিশোধ। আমি যখন নিমুকে বিয়ে না করে ইনিয়াকে বিয়ে করে ঘরে তুলি আপনি বলেছিলেন আমি ছোটলোক। আর শৈশব অব্দি আমার ইনিয়াকে জ্বালানোর প্রতিশোধ নিতে চাই আমি। আমার শাশুড়ীর সংসারে ঢোকার প্রতিশোধ। এক মেয়েকে মা ইতিম করার প্রতিশোধ। এক বাবাকে পঙ্গু করার প্রতিশোধ। ”

” কিন্তু তুমি যারজন্য এসব করছো, সে তো তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মন বলছে এতদিনে মরেও গেছে। হুদাই মরীচিকার পিছনে না ছুটে আমার নিমুর সঙ্গে সংসার করো। দেখবে তুমিও সুখী আমরাও সুখী। ”

“ জুনায়েদ লিমাকে বলে আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যান। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিনা। আমার ক্লান্ত লাগছে এখন। ”

লিমা রহমান ভয়ে ভয়ে রুম থেকে বের হয়। জুনায়েদের মুখ দিয়ে আবারও রক্ত বের হয়। জুনায়েদ রক্ত দেখে দ্রুত রুমাল দিয়ে মুছে ফেলে।

#চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে