#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৪
–বাবা আমি গ্রামের বাড়ি যেতে চাই।
নির্লিপ্ত গলায় বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডান হাতের ব্যাগটা ফ্লোরে রাখতে রাখতে বলে উঠলাম আমি।বাবা টি টেবিলের উপর পত্রিকাটা রেখে আমার দিকে তাকালেন।সকাল সকাল এমন কথা শুনে বাবা কিছুটা অবাক হয়েই বলে উঠলেন,,,
–হঠাৎ!আমাকে বললি না যে? এখনি যাবি নাকি?তোর ব্যাগ গুছিয়েও ফেলেছিস?
–হ্যাঁ।আজ এক্ষুনি যাবো।কমলা আন্টিকে বলে দিয়েছি ফোন দিয়ে।তুমি কি আমাকে দিয়ে আসবে? না দিয়ে আসলেও সমস্যা নেই।একা চলে যেতে পারবো।এখন থেকে একা পথ চলাটাও শিখে নিতে হবে।(আমি)
–মা চল তোকে দিয়ে আসবো।তুই যা বলবি তাই ই হবে।(বাবা)
–এই কথাটা আগে বুঝলে আরো ভালো হতো।(আমি)
বাবা নিজের রুমে চলে গেলো কোনো প্রকার জবাব না দিয়েই। তার বলারই বা বাকি আছে কি।ইদানিং আমি কোনো কিছু বললে বা চাইলে বাবা সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দেয়।কিন্তু এখন হ্যাঁ বলে আর লাভ কি?বিয়ের সময় ভাইয়ার তত একটা সম্মতি ছিল না।আমার বিয়ের পরে কি করেছে জানি না তবে ডিভোর্স এর পর থেকে ভাইয়া বাবার সাথে কথাই বলে না।আমাকে সপ্তাহে ১-২ বার কল দেয়।আগে প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নিতো।শুনেছি ভাইয়ার নাকি প্রমোশন হয়েছে হয়তোবা তাই ব্যস্ত ইদানিং।
বাসায় তালা দিয়ে বাবা আর আমি বাস স্টেশনের দিকে চললাম। সাদুকে একবার কল দিয়েছিলাম। ওর ফোনটা বন্ধ পাই।কাউন্টার থেকে দুই সিটের টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। ১৫ মিনিটের অপেক্ষাকে বিদায় দিয়ে বাস তার নির্দিষ্ট গতিতে চলতে লাগলো। বাসে জানালার পাশের সিটে বসেছি আমি। মাথাটা একটু বা দিকে এলিয়ে দিলাম।
পৃথিবীতে নানান রোগের নানান ঔষধ তৈরি করা যায় কিন্তু স্মৃতি, অনুভুতি,যন্ত্রণা দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়ার কোনো ঔষধ তৈরি করা যায় না কেন?যদি এমন কোনো ঔষধ পৃথিবীতে থাকতো তাহলে যেকোনো কিছুর মূল্যেই আমি তা ক্রয়ের চেষ্টা করতাম।কারণ ওই লোকটাকে এই পর্যন্ত যতবারই দেখেছি ততবারই অতীত এসে আমাকে কষ্ট দিয়ে যায়।ওই লোকটাকে সামনে দেখলে কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়।
কালকে সকালে তাকে দেখে বুঝতে বাকি ছিল না যে সে পাশের বিল্ডিংয়ে উঠেছে।কিন্তু আমার জানা মতে তো তার নিজের বাড়ি আছে। কিন্তু তাও সে ভাড়া বাড়িতে কি করছে?আমার সাথেও কেমন আচরণ করছিল।যাইহোক, তার লাইফ তার ইচ্ছে। সে আকাশে, বাতাসে, পানিতে যেখানে খুশি সেখানে থাকুক আমার কি?আমি শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই। অনেক দূরে। যেই লোক সামান্য দুধ নিতে ডিরেক্ট বাসায় এসে পরে সে কয়দিন পরে আদা রসুন নিতেও বাসায় এসে পরতে পারবে।এখন থেকে তার সঙ্গে হয়তোবা বার বার দেখা হয়ে যাবে।যা আমি চাই না।তার সামনে যেনো পরতে না হয় তাইতো আজ গ্রামের বাড়ি যাওয়া।
চোখে হালকা ঘুম এসে পরেছিল।বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম চলে যেতেই দেখি বাসটা কিছুটা গ্রামের দিকে এসে পড়েছে। গ্রাম বললে আসলে ভুল হবে।কারণ পিচঢালা রাস্তার কোল ঘেষে চারপাশে অনেক বড় আর মোটা মোটা গাছ।এরপর দৃষ্টি যতটুকু যায় তাতে ফসলের মাঠ দেখা যাচ্ছে। সবশেষে ছোট ছোট ঘড় চোখে পরছে।নাকে একটা মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতোই পরিবেশটা।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার বাস জার্নি করে বাস থকে নামলাম বাবা আর আমি।সময় টা এখন আসর আর মাগরিবের মাঝামাঝি। এখান থেকে একটা অটোতে করে ২০-২৫মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিলেই আমাদের গন্তব্য “দাদু বাড়ি”পৌঁছে যাবো।
দাদু বাড়ি এসেছি আজ দু’দিন হলো।এখানে এসে কিছুটা ভালোই লাগছে।দাদু বাড়ি আর নানু বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। এখানে একটা বাজার রয়েছে। বাজারের একপ্রান্তে দাদু বাড়ি আর আরেক প্রান্তে নানু বাড়ি।আমার আপন কোনো কাজিন নেই তবে দাদু আর নানু বাড়িতে আশেপাশে আমার সমবয়সী কয়েকজন মেয়ে আছে। ওদের সাথে একটুআধটু ভাব আছে।
দুপুর এর দিকে জাম মাখিয়ে খাচ্ছিলাম।সাথে সুমনা আপু ছিল,আঁখি ছিল, সুমাইয়া ছিল।সুমনা আপু এখানেই একটা ডিগ্রি কলেজে পড়ে।আঁখি আর সুমাইয়া আমার ক্লাসে পড়ে। ওরা সবাই ই দূর সম্পর্কের আত্মীয়।ওই গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি বাড়ি যেমন থাকে ওদের বেলাতেও তেমনই আরকি।এমন সময় সাদুর কল আসে।ওর সাথে প্রায় ১ ঘন্টার মতো কথা বলে আমার ফোন টা কে ঘুমাতে পাঠাই।এই দুই দিন আমি কি কি করলাম।আর সাদু কি কি করলো এইসব নিয়েই কথা বলে কেটে দেই। ফোন রাখার পরে বুঝতে পারি যে আসলে পুরো ১ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে।সাদুকে গ্রামে এসেই জায়ফের গাজীপুর আসার কথা, আমাদের বাসায় আসার কথা বলেছিলাম।
সাদুর সাথে কথা বলে সুমনা আপুদের সঙ্গে একসাথে পুকুরে গোসল করতে আসি।সুমনা আপুরা সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করছে।আমি বসে বসে ওদের জন্য রেফারির চাকরি করছি। ছোট থেকে বেশির ভাগ সময়টা গাজীপুর থাকা হয়েছে বলে সাঁতার টা শিখে ওঠা হয়নি।গোসলের পাট চুকিয়ে, খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিকেল বেলা নানু বাড়ি এসেছি। আজকে এখানেই থাকবো আবার ২-৩ দিন পরে দাদু বাড়ি যাবো।
নানুদের বাড়িতে নানা নানু আর মামা মামি থাকে।এই বাড়িতে বাচ্চা পার্টি বেশি।এখন কেবল রাত ৮টা বাজে। বাচ্চা পার্টি এতক্ষনে ঘুমিয়ে সমুদ্রের তলদেশে চলে গেছে। নানু বাড়ি এই এক সমস্যা, গ্রামে ওরা ৯-১০ টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর বাচ্চা গুলো আরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। আমার তো ১১ টা ১২ টার আগে ঘুমই আসে না।তাই একা একা আমার রুমেই বসে থাকতে হয়।
বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় গাছগাছালি আর মাটির ভিজে গন্ধের সাথে হালকা ঠান্ডা পরিবেশটা এখন ভালোই লাগছে। জানালার পাশে একা একা অনেক সময়ই হলো বসে আছি।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বার টা অবশ্য আননোন।কারণ বাবা,ভাইয়া, সাদু ওদের নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার আমার ফোনে নেই। ২ বার ফোনটা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৫-৬ মিনিটের মাথায় আবার বেজে উঠলো। একটু বিরক্তি হয়েই কল টা রিসিভ করলাম।সালাম দেয়ার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,,,
–জুইঁ আমি সাদমান।তোমাকে এতোবার কল করে বিরক্ত করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
–না না।আমি বিরক্ত হইনি।আসলে নাম্বার টা অপরিচিত বলে আমি পিক করছিলাম না।(আমি)
–ওহ।আচ্ছা শোনো, তোমার সাথে কি সাদিয়ার কথা হয়েছে আজকে বা কালকে?(সাদমান)
–হ্যাঁ।আজকেও তো কথা বললাম আমরা।(আমি)
–আসলে ও আমার নাম্বার টা ব্লক করে রেখেছে মনে হয়।তুমি কি একটু ওকে বলে আমার সাথে ওর যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে? (সাদমান)
আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম,,,
— ও আপনাকে ব্লক করে রাখবে কেন?(আমি)
–না মানে,আসলে।আমি ওকে প্রপোজ করেছি ২-৩ দিন আগে।ওকে একটা বই আর চকলেট দিয়েছিলাম।ও চকলেট টা নিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়।এরপর থেকে ওকে কল করলেই ব্যস্ত বলছে।(সাদমান)
তার কথা শুনে চাপা হাসিটা আর রাখতে না পেরে ফিক করে হেসেই ফেললাম। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম হাসাটা উচিৎ হয়নি।বেচারা এসেছে তার সমস্যা নিয়ে।আর আমি বেআক্কলের মতো হাসছি। হাসি থামিয়ে বললাম,,,
— ভাইয়া সরি! সরি!সরি!আপনি মনে করেন না কিছু। সাদু কেমন তা তো জানেনই আপনি।প্রেম করার মতো মেয়েতো আর ও নয়।আমি ওর সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। (আমি)
–আচ্ছা তাহলে ওর সাথে একটু কথা বলো।আর ওকে বলো আমি ওকে প্রেম করতে বলছিনা আমার সাথে। আমি শুধু আমার মনের কথা ওকে প্রকাশ করেছি।এখন ওর মনে কি আমি শুধু তাই ই জানতে চাই।(সাদমান)
–জ্বি ভাইয়া ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি। রাখছি তাহলে।(আমি)
সাদমান ভাইর কল টা কেটে সাদু কে কল দিলাম দুই বার রিং হতেই রিসিভ করলো।
–এতোই যখন তোর আমারে মনে পরে তাইলে গ্রামে গেলি কেন?(সাদু)
–তোর এতই যখন সাদমান ভাইরে অপছন্দ তাইলে তার চকলেট খালি কেন?আমারে দিলেই পারতি।(আমি)
–ওই ব্যাডা তোরে কল দিসিলো তাই না?(সাদু)
–তুই নাকি নাম্বার ব্লকে রাখছোস?(আমি)
–হ।শোন তোরে সিক্রেট একটা কথা কই।ওই ব্যাডারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইয়া দেখতে হইবো।যদি আমার কাছে পাশ করে তাইলে তো ভালোই আর পাশ না করলে আরো ভালো।(সাদু)
–তোরে তো আর এখনি প্রেম ট্রেম করতে হইতাছে না।ব্লক টা অন্তত খোল।(আমি)
–আচ্ছা দেখতাছি।ওই তুই গাজীপুরে আসবি কবে?(সাদু)
–যদি আর কোনো দিন না আসি?(আমি)
–মানে?আসবি না কেন? ওই শয়তান ব্যাডার জন্যে?
–হ্যাঁ।আমি তার সামনে পরতে চাই না।তাকে আমি দেখতে চাই না।(আমি)
–বাসা পাল্টে ফেল।তাইলেই কিচ্ছা খতম।(সাদু)
–বাসা কে খুজবো।তুই?মালপত্র কে টানবো।তুই?ভাইয়া নাকি সামনে মাসে আসবে।তাই ভেবেছি এই কয়েকদিন গ্রামে থাকবো।ভাইয়াকে বলেছি এসব।তাই ভাইয়াও বলেছে বাংলাদেশে এসে নতুন বাসা নিয়ে তারপর আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে যাবে।(আমি)
–আচ্ছা বোইন আমারে একটু কতো ওই ব্যাডা চায় টা কি?(সাদু)
–যাইয়া তারেই জিজ্ঞেস কর।ফোন রাখ আমি ঘুমাবো।(আমি)
সাদু কল টা কাটার সাথে সাথে আবার ফোন বেজে উঠলো।সেভ করা না বলে খেয়াল না করে সাদমান ভাই ভেবেই রিসিভ করে বললাম,,,
–নিন আপনার রাস্তা এখন ক্লিয়ার।এবার একটু মন ভরে আমাকে ট্রিট দেন।(আমি)
–নিজের রাস্তা নিজে ক্লিয়ার করে আবার নিজেই ট্রিট চাচ্ছো।
অন্যরকমের ভয়েস শুনে তাড়াতাড়ি করে নাম্বার টা চেক করে দেখলাম এটা সাদমান ভাইর নাম্বার না।হঠাৎ মনে হলো কন্ঠ টা জায়েফ এর মতো।ফোনটা আবার কানে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,,
–কে আপনি?
–জানালা দিয়ে সোজা তাকাও।আমাকে স্ব শরীরেই দেখতে পাবে।
মনে মনে যা ভাবছি যদি তাই হয় তাহলে আমি কি করব?আস্তে আস্তে জানালার পর্দা সরিয়েই মনে হলো আমার পৃথিবী শুদ্ধ আমি চরকির ন্যায় ঘুরছি।জানালা দিয়ে তাকালেই বাড়ির উঠোন দেখা যায়।২৫-৩০ কদমের উঠোন টা পাড় হলেই বাড়ির গেট দেখা যায়।গেট টা এখনো খোলা আর গেট এর বাইরেই পাকা রাস্তায় জায়েফ কে দেখা যাচ্ছে।তার পিছনে তার সাদা রঙ এর গাড়ি টাও দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলা বাইরে লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় এখানে। তাই লাইটের ফকফকা আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কালো জিন্সের সাথে সাদা টি-শার্ট পড়ে একহাতে একটা জ্যাকেট নিয়ে আরেক হাতে ফোনটা কানে ধরে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখার সাথে সাথে ফোন হাতেই আমাকে ইশারা করলো।তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখে কেনো যেনো খুব রাগ লাগছে। তখন উনি আবার ফোনট কানে নিয়ে বলে উঠলেন,,,
–জুইঁফুল একটা বার বের হবে?যাস্ট দেখে চলে যাবো।
তার এমন কথায় মনে হলো আমার রাগে পুরো শরীর রিরি করে উঠলো।মনে মনে ভেবে নিলাম তার সাথে আজকে বোঝাপড়াটা শেষ করতে হবে।কয়কদিন ধরেই কেমন যেনো করে আসছে উনি।আজকে আমাকে দেখতেও চাইছে।উনি সত্যি সত্যি ই কি চায় আজ জানতে হবে।
ওনার ফোনটা কেটে গায়ে ওড়না টা ভালো করে পেচিয়ে উঠোনের লাইটটা অফ করে উঠোনটা অন্ধকার করে নিলাম। কেউ যেন না দেখে আর দেখলেও যেন চিন্তে না পারে।একট ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে তা গ্রামে দৃষ্টিকটু দেখায়।জায়েফকে মামা মামি,নানা নানু চিনলেও তো আর অন্য মানুষরা চেনে না।আমাদের সম্পর্কের কথা তো আর জানে না।তাই তো এই ব্যবস্থা করা। মোবাইলের আলোতেই বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে।
চলবে……