#বন্দিনী
#পর্ব_১
#মেহা_মেহনাজ
‘আমার স্বামী যখন বলল, তার তোমাকে চাই, আমার ভেতর দিয়ে কি ঝড় যাচ্ছিল তখন, তুমি বুঝতে পারছো?’
জোনাকি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে রইলো। যেন সমস্ত অপরাধ ওর একার। যেন সমস্ত লজ্জা শুধুমাত্র ওর। শর্মী ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘কি জাদু করলে ওকে, বলো তো! কেন তোমার জন্য এত উতলা হয়ে উঠেছে ও? কি নেই আমার ভেতর? আমাকে একটু বলো না…আমি নিজের ব্যর্থতা জানতে চাই।’
জোনাকি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, শর্মী কাঁদছে। ভীষণ অসহায়ত্ব ওর কণ্ঠের ভেতর। জোনাকির ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ শর্মীর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠল,
‘আমি তাকে কোনো জাদু করিনি। আমি তাকে পছন্দই করি না। এইখানে আমার কোনো হাত নেই। সব করেছে আমার দুলাভাই। আপনি আমাকে এভাবে দোষারোপ করবেন না। আর কাঁদবেন না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’
‘আমিই তোমাকে ক্ষমা করব না কখনো। যে ছু*রির আঘাত তুমি আমায় দিলে, সেই একই আঘাতে একদিন জর্জরিত হবে তুমিও।’
জোনাকির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শর্মী জোনাকির হাত সরিয়ে দিয়ে ফের বলে উঠল,
‘এসো, আমার সংসারে তোমার স্বাগতম জোনাকি।’
এরপর উঠে চলে গেল। জোনাকির বুক ভেঙে গেল। বাকিটা জীবন কারো সংসার ভঙ্গের কারণ হয়ে থাকতে হবে ওকে!
ঘটনার মূল হোতা ফয়সাল, ওর দুলাভাই। জোনাকিরা দুই বোন। বাবা চলে যাওয়ার পর যেখানে বাকি আত্মীয়রা একপ্রকার মুখ ফিরিয়েই নিলো, সেখানে ফয়সাল ওদের মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়াল। সেই থেকে এই বাড়ির কর্তা হয়ে উঠল সে। সবকিছুর সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সে একাই নেয়। এক সময় সাংসারিক খুটিনাটির সিদ্ধান্ত নিতে নিতে মানুষ গুলোর জীবনের উপরও নিজের প্রভাব খাটাতে লাগল। সে বলল, জোনাকির আর পড়ে কাজ নেই, জোনাকি তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিলো। সে বলল, মায়ের এভাবে বসে বসে খাওয়া উচিত না, তাই মা ঘরেই দর্জির কাজ শুরু করে দিলো। সে বলল, জোনাকিকে ঘরে আর কতদিন রাখবে, এবার বিয়ে দেওয়া উচিত, তখন সবাই তাই মেনে নিলো। কেউ শুনলো না জোনাকি কি চায়! জোনাকির মা ফয়সালকেই পাত্র খোঁজার গুরুদায়িত্ব দিয়ে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই শাওনকে নিয়ে বাড়ি এলো ফয়সাল। পরিচয় দিলো নিজ কলিগ হিসেবে। একই অফিসে কাজ করছে ওরা দুইজন। ভালো ভদ্র ছেলে, চেহারা সুন্দর, স্ত্রীকে ভীষণ মহব্বতে রাখবে। বাড়ির সবাই খুশিমনে মেনে নিলো। জোনাকিও মেনে নিলো। কিন্তু তারপর…
এক গভীর রাতে জোনাকির ফোনে ম্যাসেজ এলো অপরিচিত এক নাম্বার থেকে, সেখানে একটি বাক্যই লেখা, ‘প্লিজ দেখা করতে চাই।’
কে বা কোথায়, কিচ্ছু লেখা নেই আর! জোনাকি সকালে ম্যাসেজটি দেখামাত্র ফোন দিতেই রিসিভ করল ভীষণ মিষ্টি কণ্ঠের এক অধিকারিনী। জোনাকিকে অনুনয় করল, একটিবার দেখা করার জন্য। তাই আজ এই লেক পাড়ে ও এসেছিল এবং এসেই জানতে পারল, শাওন এবং ওর দুলাভাই কতবড় ছল করে ওর জীবন টা ধ্বংস করতে চলেছে…
বাড়ির ফিরতি পথটা ঘোরগ্রস্তের মতো কাটলো ওর। রিকশায় চেপে আজ আর বাতাসে গা ভাসানো হলো না। গাড়ির বিকট হর্ণ গুলোও ওর কর্ণকুহরে ভেসে এলো না আজ। মাথার ভেতর কুটকুট করে কামড়ে খাওয়া রাজ্যের বিষ পোকা নিয়ে ও কখন যে বাসার সামনে পৌঁছে গেল, টেরই পেল না। রিকশা ওয়ালা মামা যখন বললেন, আপা, আইসা পড়ছি, ঠিক তখন জোনাকির চিন্তাধারা হোঁচট খেল। সে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো খানিকক্ষণ। এরপর ভাড়া মিটিয়ে গেইটের ভেতর ঢুকেও দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ঠিক তখনই একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলল, শাওনকে সে বিয়ে করবে না। তাতে যত ঝড় আসার আসুক, কোনো ভাবেই সে শাওনকে বিয়ে করবেই না! জোনাকি মৃদু শ্বাস ফেলে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে চলল।
★
ফয়সাল বাড়িতেই ছিল। সকাল বেলা এসেছে। এখন বেলা সাড়ে এগারোটা প্রায়। জোনাকিকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ফয়সাল ড্রয়িং টেবিল থেকে হাঁক ছাড়লেন,
‘কি রে, কোথায় গিয়েছিলি?’
জোনাকি জড়সড় কণ্ঠে ছোট করে উত্তর করল,
‘এই, একটু বাইরে।’
‘সে তো আমিও জানি। মা’কেও নাকি কিছু বলে যাসনি। সত্যি সত্যি বল, কোথায় গিয়েছিলি? আবার নাগর টাগর বানিয়েছিস নাকি?’
জোনাকি চোখমুখ কুঁচকে তাকাতেই ফয়সাল ফের বলে উঠল,
‘বানালেও ছেড়ে দে ভাই। অনেক কষ্টে একটা যোগ্য পাত্র পেয়েছি তোর জন্য। তোকে মাথায় করে রাখবে। ও, ভালো কথা, শাওন চাচ্ছিল আজ বিকেলে তোকে নিয়ে বেরোতে। কিসব কেনাকাটা করে দেবে নাকি। বেচারা দিন গুণছে। কবে বিয়েটা হবে..’
মা এবার এগিয়ে এলেন। বলতে লাগলেন,
‘কেমন রাজপুত্রের মতো ছেলে। আমার মেয়েটার কপালে এত সুন্দর জামাই থাকবে, আমি ভাবিওনি বাবা। সবই তোমার তৎপরতা। তুমি না থাকলে আমাদের যে কি হতো..’
মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। জোনাকির ভেতরটা জ্বলে গেল। কি আর হতো? এরচেয়ে ভালো হতো অথবা এরচেয়েও খারাপ। মায়ের অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে ফয়সাল এতোটা অধিকার পেয়ে আজ ওর জীবন নিয়ে খেলছে।
ফয়সাল মায়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জোনাকিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘দুপুরের পর পরই আমি আসতে বলি ওকে। তুই তৈরি হয়ে থাকিস জোনাকি।’
‘না গেলে হয় না?’
ফয়সালের আগে মা-ই ধমকালেন।
‘কেন যাবি না?’
‘কারণ মা…’
বলতে গিয়েও জোনাকি থামল। একটা বিষয় ওর মাথায় ঢুকছে না। শর্মীর বলা কথাগুলো কি আসলেই সত্যি? যদি সত্যি হয়, তাহলে এই মেয়ে কেন এত সহজে ওকে মেনে নিচ্ছে? এই মেয়ের তো তুমুল হাঙ্গামা করার কথা! হৈচৈ করবে, দরকার পড়লে থানাপুলিশ করবে। কিন্তু এভাবে ওর সঙ্গে দেখা করতে এসে সবকিছু জানিয়ে বিদায় নেওয়ার মানে কি? শাওন যেরকম হাসিখুশি মানুষ, আচার-আচরণ ভালো, তার পক্ষে আদৌও এমন কিছু করা সম্ভব? না…একটু সময় নিয়ে ঘেটে দেখতে হবে। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, জোনাকির জানতে হবে।
জোনাকিকে হুট করে থেমে কিছু একটা ভাবতে দেখে ফয়সাল এবং মা দু’জনেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। ফয়সাল বলল,
‘কি রে, কি ভাবতে বসলি?’
জোনাকি সম্বিৎ ফিরে পেলো,
‘না, কিছু না। আমি যাবো। উনাকে বলে দাও, দুপুরের লাঞ্চটাও উনার সাথে করব আমি। উনি কি আমাকে নিতে আসবে নাকি আমার যেতে হবে?’
ফয়সাল মহানন্দে বলল,
‘ও-ই তোকে নিতে আসবে। তুই শুধু তৈরি হয়ে থাক। শোন, আজ একটা শাড়ি পড়। শাড়িতে তোকে দারুণ লাগে কিন্তু।’
‘হুঁ।’
জোনাকি নিজের ঘরে চলে গেল। ফয়সাল সঙ্গে সঙ্গে শাওনকে ফোন করল। মা শান্তি পেলেন। কেন যেন জোনাকি শাওনের ব্যাপারে দোনোমোনো। এবার বোধহয় একটু একটু মেনে নিতে শুরু করেছে। মানুক, মেয়েটা খুশি থাকুক, সুখী হউক, আর কিচ্ছুটি চান না উনি…
★
‘কোথায় গিয়েছিলে?’
অসময়ে শাওন বাড়ি থাকবে- আশা করেনি শর্মী। তাই অনেকটা চমকে উঠল ও। থতমত খেলো। পরমুহূর্তে দ্রুতই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘একটু বেরিয়েছিলাম।’
‘কোথায়?’
শাওনের গলার স্বর কঠিন। শর্মী ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। ডান পাশে কোমরের কাছটাতে চেপে ধরল সঙ্গে সঙ্গে, অজান্তেই। সপ্তাহও হয়নি, শাওন সিগারেট চেপে ধরেছিল এখানে। এখনো ঘা শুকোয়নি।
‘বা…বাজারে।’
‘কেন?’
‘পু…পুইশাক কিনতে।’
‘তা কোথায় তোমার শাক?’
‘পা…পাইনি।’
‘পাওনি?’
শর্মী কাচুমাচু ভঙ্গিতে মাথা এদিক ওদিক নাড়লো। শাওন হুট করে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল ওর। তারপর যেখানটায় শর্মীর ঘা, সেখানটায় আস্তে আস্তে হাত নিয়ে খট করে চেপে ধরল। তৎক্ষনাৎ ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল ও। শাওন আরও কাছাকাছি চলে এলো। এত কাছাকাছি যে ওর নিঃশ্বাসের উত্তপ্ত শব্দ শর্মীর কর্ণকুহরে গিয়ে ঢুকছে। শাওন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘আজকের পর থেকে এই ঘরে আর পুইশাক ঢুকবে না। কি বলেছি,মনে থাকবে?’
‘থাকবে…মনে থাকবে।’
ঘাড় কাত করল ও। শাওন হাত টা সরিয়ে নিয়ে শর্মীর গালে একটা টোকা দিয়ে গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে গেল। শর্মীর দু’চোখ বেয়ে বন্যা নামে। শেষমেশ এই ছিল তার কপালে?
(চলবে)