বইছে আবার চৈতি হাওয়া পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
669

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৫.

মীরা মোবাইল বের করে সুমনাকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-এই কি সে?
– হ্যাঁ ইনিই তো। তুমি চেনো?
মীরা জবাব দিল না, তবে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন মানুষ হলে হয়তো ও এতটা নিশ্চিন্ত বোধ করতো না। এই মুহূর্তে ও বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সকালে শুভর সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। শুভ ওর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, তাতে অন্তত বিয়ের কথা বলার মতন রুচি ওর হয়নি। আর সবার মত শুভও ওর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সবার মতো সেও বিশ্বাস করেছে, ওর আর আশিকের মধ্যে কোন কিছু চলছে এবং এই কারণেই ও শুভকে বিয়ের জন্য মানা করে দিয়েছিল। মীরা ঠিক করেছিল মরে গেলেও শুভকে বিয়ের কথা বলবে না। কিন্তু বিকেলে যখন মা সৌরভের সঙ্গে বিয়ের কথা বললেন, তখন মীরা ওর সমস্ত আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে শুভকে ফোন করেছিলো। নিজের জন্য নয়, সৌরভের জন্য। মীরা জানে সৌরভ মরে গেলেও বড় চাচার মুখের উপরে কথা বলবে না, কিন্তু সারা জীবন কষ্ট পাবে। মীরা নিজেও কি কষ্ট কম পাবে? সৌরভকে বিয়ে করার কথা ও ভাবতেও পারে না। এমন নয় যে শুভর জন্য ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শুভর আচরণগুলো ওকে অবাক করেনি, তবে সৌরভের সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে ও এতটা কুৎসিত আচরণ করবে, এটা আশা করেনি মীরা। শুভ বলেছে, ও এরকম ছেলেই ডিজার্ভ করে। শুভকে বিয়ে করার কোন যোগ্যতা ওর নেই; আর আশিক শুধু ওকে নিয়ে ফুর্তি করবে, বিয়ে কোনদিন করতে আসবে না। আর সেই আশিক ভাই এখন ওকে বিয়ে করতে এলেন। কি অদ্ভুত! এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য কোন ছেলে হলে মীরা হয়তো বিয়ের জন্য রাজি হতো না। কিন্তু আশিক নিশ্চয়ই ওর অবস্থাটা বুঝতে পারবে। ও তো সবই জানে, তারপরও কেন বিয়ে করতে চাইছে? অপরাধবোধ থেকে?

মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমনাকে বলল,
-বাইরে যা।
-কেন, তোমার কোন সাহায্য লাগবে না?
-কি সাহায্য করবি তুই?
-এমনি, একটু কুচিটা ধরে দিলাম..
-দরকার নেই।
– তবু একটু থাকি। একটু পর তো চলেই যাবে। সুমনার গলা ধরে এলো।
-আচ্ছা থাক।
মীরা বেশি সময় নিল না তৈরি হতে। মাগরিবের নামাজের পর ওকে নিচে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেই বিয়ে পড়ানো হবে। হালিমা বেগমের চাইতে নাসিমাকে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেল। মীরা স্বাভাবিকভাবেই সই করল। কারো দিকে তাকালো না। কবুল বলার সময় একবারের জন্যও ওর গলা কাপলো না।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে বেশি সময় লাগলো না। এজাজ সাহেব খুব করে চাইছিলেন আজকের রাতটা যেন সবাই এখানেই থেকে যায়, কিন্তু আরিফ সাহেব রাজি হলেন না। অনেকটা পথ যেতে হবে। উনি বললেন,
-মেয়েটাকে বাড়িতে একা রেখে এসেছি। তা নাহলে নিশ্চয়ই থাকতাম।

বিদায়ের সময় মীরা একটুও কাদলো না।। ঢাকা থেকে আসার সময় যে ব্যগটা নিয়ে এসেছিল, সেটাই গাড়িতে তুলে দেয়া হলো।

রফিক আরেকটা গাড়ি নিয়ে এসেছ। মারুফ, রফিক আর আরিফ সাহেব ওই গাড়িতেই যাচ্ছেন। আশিক আর মীরা অন্যটাতে। পুরোটা পথ মীরা একটা ঘোরের মধ্যে রইলো। একবারও চোখ তুলে তাকালো না। একটা কথাও বলল না। শেষের দিকে একটু ঝিমুনির মতন এসে গেছিল। গাড়ি যখন থামলো, একটা আলতো ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে ও একটু লজ্জা পেল। আশিকের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। আশিক কিছু বলল না, গাড়ি থেকে নেমে দরজা ধরে দাঁড়ালো। মীরার ঘুম তখনো কাটেনি। বাড়ির ভেতরে ঢুকে ও আশ্চর্য হয়ে গেল। একটু পুরোনো দিনের দোতলা বাড়িটা বেশ সুন্দর আর বড়। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই রোজিনা আর আফসিন ছুটে এলো। আফসিন ওর মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। ওকে না নিয়ে ওর একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একদিকে ভাইয়ের বিয়ের আনন্দ, অন্য দিকে ওকে না নিয়ে যাওয়ার অভিমান। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল নতুন ভাবির আগমন।

ভেতরে ঢুকেই আরিফ সাহেব ঘোষণা দিলেন,
– কোন কিছু আগে থেকে ঠিক করা ছিল না, তাই তোমাদেরকে নিয়ে যেতে পারিনি। রিসেপশনের সময় সবকিছু তোমরাই করবে। এখন নতুন ভাবিকে ঘরে নিয়ে যাও।

মীরাকে আশিকের ঘরে নিয়ে বসানো হল। আফসিন আর রোজিনা ঘরে এসে ওদের কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে গেল, যদিও আরিফ সাহেব বলেছিলেন মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে এসেছে বিরক্ত না করতে। কিন্তু ওদের অতি উৎসাহে ভাটা পড়ল না। মীরার খারাপ লাগছিল না। ওরা দুজনেই ভীষণ আন্তরিক। আফসীনকে ভালো লেগে গেল মীরার। মেয়েটার ব্যক্তিত্ব একেবারেই ওর ভাইয়ের বিপরীত। খুব মায়া কাড়া এবং আদুরে স্বভাবের একটা মেয়ে। মীরার ক্লান্ত লাগছিল না, তবে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাড়িতে, অচেনা একটা ঘরে বসে থাকতে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আরিফ সাহেব এসে ওদের বিদায় দিলেন। মীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিফ সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
-তোমাকে কয়েকটা কথা বলি মা। আমি জানিনা অশিক সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো, তবে এটুকু বলে রাখি, ও খুব চাপা স্বভাবের আর ভীষণ অভিমানী একটা ছেলে। নিজের কষ্ট কখনো কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। ওর আশেপাশে এত বন্ধুবান্ধব থাকলেও ছেলেটা ভেতরে ভেতরে ভীষণ একা। তোমার কাছ থেকে আমার একটাই চাওয়া, চেষ্টা করো ওর বন্ধু হতে।

মীরা মাথা নিচু করেই বলল,
-জি।
আরিফ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন,
– ঠিক আছে মা , তুমি রেস্ট নাও।
আরিফ সাহেব চলে যাবার পর মীরা চারপাশে তাকালো। ঘরটা অনেক সুন্দর এবং বড়। মীরা ব্যাগ থেকে সাধারণ সুতির সালোয়ার কামিজ বের করল। হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে নিল।

মীরার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। ও আশিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুতেই ঘুম ভাবটা কাটছে না। মীরা আস্তে আস্তে বারান্দার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল। এত সুন্দর বারান্দা ও শুধু নাটক সিনেমাতেই দেখেছে। অনেক রকম গাছ রাখা এক পাশে। অন্য পাশে বেতের চেয়ার ছোট টি-টেবিল। মীরা ওর ক্লান্ত শরীর চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বসলো, আর ঠিক তখনই ফোনটা এলো। অচেনা নাম্বার দেখে প্রথমে ও ভাবল ধরবেনা। পরবর্তীতে মনে পরল, বড় চাচা সুমানাকে নতুন ফোন কিনে দিয়েছেন। তাড়াহুড়ায় নাম্বারটা নেয়া হয়নি। হয়তো ওই ফোন করেছে। আসার সময় খুব কাদছিল ও।

মারুফ আর সুমন ছাদে দাড়িয়ে গল্প করছিল। সুমন বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরেই ফিরেছে। ফোনে বিয়ের খবর জানতে পেরে সরাসরি বাসায় চলে এসেছে। আশিক আর রোজিনা খাবার ভর্তি ট্রে নিয়ে ছাদে উঠে দেখল ওরা বেশ হাসাহাসি করছে। আরিফ সাহেব বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করেছেন। কাচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি। আশিক মীরাদের ওখানে খেতে পারেনি, কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ করে ওর মনে হলো তাহলে নিশ্চয়ই মীরারও খিদে পেয়েছে।
ছাদে একটা সিরামিকের টেবিল বানানো। খাবার গুলো টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আশিক রোজিনাকে বলল,
-তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করিস তো ও কিছু খাবে কিনা। লাগলে দিয়ে আসিস।
রোজিনা মাথা নেড়ে চলে গেল। সুমন মারুফের পেটের মধ্যে একটা খোঁচা দিয়ে বলল
-দেখছিস আমাদের ভাইয়ের ভাবীর জন্য কত চিন্তা।
মারুফ এগিয়ে গিয়ে খাবার নিতে নিতে বলল,
-কিসের ভাই? কিসের ভাবি? শোন আশিক মীরা কিন্তু আমার এলাকার ছোট বোন। সেই হিসেবে আমি কিন্তু তোর সম্বন্ধি। একটু রেস্পেক্ট দেখাইস ।

আশিক হাসতে হাসতে বলল,
-আচ্ছা? তুই আমার সম্বন্ধি? তাই না! যা ভাগ তুই আমার শালা। দুলাভাইয়ের প্রতি একটু রেসপেক্ট দেখা।
সুমন গ্লাসে বোরহানি ঢালতে ঢালতে বলল,
– আচ্ছা আচ্ছা, দুলাভাই শালাদের ট্রিট দিচ্ছেন কবে?

খাওয়া-দাওয়ার পর গল্প চলল বেশ কিছুক্ষণ। এক সময় মারুফ আশিকের পিঠ চাপড়ে বলল
-যান দুলাভাই, আমাদের আপা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
আশিক একটু হাসলো। কিছু বলল না। মারুফ আর সুমনকে বিদায় দিয়ে ও আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ঢুকলো। মীরাকে অনেক কিছু বলার আছে। মীরা কি ওর কথা শুনবে? আশিকের খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের আগে একবার জিজ্ঞেস করার, যে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। এখন এসব প্রশ্ন করা অর্থহীন, তবু অনেক কিছু জানার আছে ওর থেকে। অনেক কিছু বলার আছে। আশিক ঘরে ঢুকে দেখল মীরা বিছানার উপর বসে আছে। দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরতেই মীরা তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– খবরদার আমার কাছে আসবেন না। আপনি একটা ভন্ড মিথ্যাবাদী।

চলবে…..

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৬.

আশিক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষটাকে কেমন অচেনা লাগছে। এই ঝকঝকে আলোতে মীরাকে মনে হচ্ছে অন্য কেউ। আশিক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। লজ্জা, অপমান সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল ওর বিস্ময়, এবং কয়েক মুহূর্তেই সেটা পরিণত হলো তীব্র অভিমানে।

আশিক একটা কথাও বলল না। কোন কৈফিয়ত দিল না। কোন কিছু জানতেও চাইল না। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

মীরার সমস্ত শরীর কাঁপছে। চোখ ছল ছল করছে। ও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। সমস্ত শরীর মন তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে আছে। আশিকের অন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়াটা ও দেখল। এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নাটা হঠাৎ করেই বেরিয়ে এল। মিরা দুই হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদলো। আশিকের এই সত্যটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিছুতেই না। এতটা কষ্ট তো ওর তখনও হয়নি যখন শুভ ওকে সন্দেহ করেছে। ওর সঙ্গে এত কুৎসিত আচরণ করেছে। মুখোশ খুলে যাওয়া শুভর বীভৎস চেহারাটা দেখেও অবাক হয়নি ও। আশ্চর্যজনকভাবে সেরকম কষ্টও পায়নি। কিন্তু আশিক এমনটা করতে পারে এটা ওর বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই আশিক? যাকে কিনা ও এতটা বিশ্বাস করে, এতটা শ্রদ্ধা করে? মীরা বিশ্বাস করতে পারছে না। মনের একটা অংশ বলছে আশিক এমনটা করতে পারে না। আর মস্তিষ্কের একটা অংশ বলছে এটাই যৌক্তিক।

মীরা সারারাত ছটফট করল। কিছুতেই ঘুমাতে পারলো না। কান পেতে রইলো কিন্তু পাশের ঘর থেকে কোন শব্দ এলো না। হালকা একটা আলোর রেখা দরজার নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে। ব্যাস অতটুকুই। শেষ রাতের দিকে একটু ঝিমুনীর মতন এলো। মিরা বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সারা ঘর আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ভার হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে মীরা বিছানার উপর উঠে বসলো। চট করে কিছু বুঝতে পারল না। হঠাৎ খেয়াল হলে পাশে তাকিয়ে দেখল লাইব্রেরির দরজাটা খোলা। বিছানা থেকে নেমে উকি দিয়ে দেখলো ঘরে কেউ নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে দশটা বাজে। কি সর্বনাশ! এত বেলা পর্যন্ত ও ঘুমিয়ে আছে? মীরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। বাড়িটা একদম নিরব, শুধু রান্নাঘর থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসছে।

মীরা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, রোজিনা দুপুরের রান্না বসিয়েছে। মীরাকে দেখে একগাল হেসে বলল
– গুড মর্নিং ভাবি। নাস্তা দেই?
মীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-বাকিরা কোথায়?
– আপামনির জরুরী পরীক্ষা আছে তাই ভার্সিটি গেছে। আর খালুজান একটু আগে কোর্টে গেলেন।
মীরা অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল
– আর তোমার ভাইয়া?
– ভাইজান তো সেই সকালেই বাইর হয়ে গেছে। আপনারে নাস্তায় কি দিব?
– সবাই যা খেয়েছে তাই দাও।
– এইখানে সবাই ভিন্ন ভিন্ন জিনিস খায়। আপনি কি খাইবেন বলেন, বানায়া দেই।
– ভিন্ন ভিন্ন মানে?
– আপা দুধ সিরিয়াল খায়। খালুজান পরোটা ভাজি। ভাইজানের ঠিক নাই। কোনদিন খায়, কোন দিন সময় না থাকলে না খাইয়াই বাইর হইয়া যায়।
মীরার অস্বস্তি আরো বাড়ল। ও আস্তে আস্তে বলল
– আজকে কি খেয়ে গেছে?
– না, কিছু বইলাও যায়নি।

মীরার কিছুই ভালো লাগছে না। কিন্তু খিদেও পেয়েছে। কাল কখন খেয়েছিল মনে নেই। রাতে অবশ্য ওরা জানতে চেয়েছিল কিছু খাবে কিনা। মীরার খুব লজ্জা লাগছিল, তাই মানা করে দিয়েছে। মিরা টেবিলে বসে গ্লাসে পানি ঢাললো। রোজিনা কাছে এসে বলল
-পরোটা ভাজি দেই?
– দাও
প্রচন্ড খিদে নিয়েও মিরা বিশেষ একটা খেতে পারল না। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে বারবার গলার কাছটায়। মীরা চা নিয়ে উপরে চলে গেল। হলে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। কালকে আশিকের সঙ্গে যে ব্যবহার করছে তাতে ওর সঙ্গে চোখ মেলাতে ইচ্ছে করছে না। যা শুনেছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে ওর সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। মীরা ঘরে এসে বিছানা পত্র গুছিয়ে রাখল। তারপর আস্তে আস্তে লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেল। এত সুন্দর ঘর ও আগে কখনো দেখেনি। বোঝা যাচ্ছে যে এটা তৈরি করেছে তার রুচিবোধ এবং সৃজনশীলতা যথেষ্ট উন্নত। দেয়াল জোড়া বইয়ের তাক। একপাশে বড় জানালা তার গা ঘেসে একটা বড় ইজি চেয়ার। তার ঠিক পাশেই একটা ছোট্ট টি টেবিল। মিরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল আশিক বোধহয় রাতে এই চেয়ারটাতেই ঘুমিয়েছে। টি টেবিলের উপর একটা নোটপ্যাড রাখা। পাশে একটা কলম পড়ে আছে। কিছু কি লেখা নোটপ্যাডের মধ্যে? এটা কি কাল রাতে লিখেছে আশিক? মীরা নোটপ্যাডটা তুলে নিল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা

“ আঁধারের কাছে নতজানু আমি
শঙ্কিত আজি আলোতে
তিমিরে আমার, ভয় নাই আর
বিব্রত আমি আলোতে”

মীরা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল লেখাটার দিকে। ওর চোখ ভিজে উঠছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে ও কোনমতে কান্নাটা আটকালো।

চলবে…..

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩৭.

আরিফ সাহেব রাতের খাবার খেতে বসে মীরার খোঁজ খবর নিলেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন আশিক বাড়ি ফেরেনি। খাবার টেবিলে বসেই উনি আশিককে ফোন করলেন ও স্বাভাবিকভাবেই কথা বলল। জানালো অনুষ্ঠানের আর কয়েকদিন বাকি আছে এবং কাজের অনেক চাপ, এমতবস্থায় কারো উপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। আরিফ সাহেব কথা বাড়ালেন না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মিরাকে ডেকে পাঠালেন।

মীরা ওড়নার আচল মাথায় তুলে দিয়ে আরিফ সাহেবের ঘরের এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফ সাহেব ওকে দেখে হেসে ফেললেন। তারপর বললেন
– তুমি এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন মা? আমার কাছে আফসিন যেমন, তুমিও তেমনি
– জী বাবা
– আলহামদুলিল্লাহ! এই যে তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকলে, আমাকে বাবাই ভাববে তাহলে আর এত অস্বস্তি বোধ করবে না। আমি জানি তোমার এবং আশিকের বিয়েটা কিরকম পরিস্থিতিতে হয়েছে। তবু তোমাকে একটা কথা বলব। তোমাদের মধ্যে যত কিছুই হোক, বাড়ির বাইরে যেন ছেলেটা রাত না কাটায় এটুকু লক্ষ্য রেখো। মিরা আবারও বলল
-জী বাবা
-ঠিক আছে তুমি যাও
– বাবা একটা কথা বলার ছিল
– হ্যাঁ বলো
– আমি কি আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করতে পারি?
আরিফ সাহেব আবারো হাসলেন। তারপর বললেন
– কেন পারবেনা? তোমাকে তো কেউ পড়াশোনা বন্ধ করতে বলেনি।
– থ্যাংক ইউ বাবা
– ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম

মীরা অনেক রাত পর্যন্ত আশিকের জন্য অপেক্ষা করল, তারপর একটা সময় বুঝতে পারল ও ফিরবে না। মীরা দরজা বন্ধ না করেই ঘুমালো, যেন আশিক ফিরলে ঘরে ঢুকতে পারে। কোন সমস্যা না হয়।

মীরার ঘুম ভাঙলো অনেক সকালে। সারা ঘর বারান্দা খুঁজে ও বুঝতে পারলে আশিক রাতে ফিরেনি। আজ রবিবার সকাল আটটায় ক্লাস আছে। তৈরি হয়ে বের হতে গিয়ে দেখল আফসিন টেবিলে বসে নাস্তা করছে। মীরাকে দেখে বলল
– ভাবী তুমি এত সকালে কই যাও?
– ক্লাসে যাই
– কয়টায় ক্লাস তোমার?
– আটটায়
– আমারও আটটায় ক্লাস। তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে নাও তারপর একসঙ্গে যাই।
– মীরা আপত্তি করলো না, খেতে বসে গেল। যদিও এত সকালে ওর কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। কেমন বমি বমি পায়। রোজিনা জিজ্ঞেস করার পরও তেমন কিছু খেলো না, শুধু একটা কলা নিল, তারপর বলল
-আমি এত সকালে খেতে পারি না। বাড়ি ফিরে খাবো। দুপুরের আগেই চলে আসব। বাবা জিজ্ঞেস করলে বলো।

মীরা বেশ সাধারণ পোশাকেই ক্লাসে এসেছে। ওদের বিয়ের ব্যাপারটা কতজন জানে ওর ধারণা নেই। ক্লাসে ঢুকে ও কারো দিকে তাকালো না, এক পাশে বসে পড়লো। ক্লাস শুরু হবার কিছুক্ষণ পর টুম্পা এসে বসলো ওর পাশে। ক্লাসের মধ্যেই একটা খোঁচা দিয়ে বললো
-কিরে ভালোই তো আছিস।
মীরা জবাব দিল না। হাসলো একটু পাশে তাকিয়ে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে টুম্পার প্রসঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। মেয়েটা ভীষণ মজার। চোখে মুখে কথা বলে। কথার পিঠে কথা বলে ওকে হারানো মুশকিল। সাধারণত বোরিং ক্লাস হলে ওরা কাগজে লিখে লিখে কথা চালাচালি করে। মীরা পাশে তাকিয়ে দেখলো টুম্পা ওর খাতার মধ্যে লিখেছে
-তুই তো ট্রাম কার্ড পেয়ে গেলি রে। কেমন যাচ্ছে আশিক ভাইয়ের সঙ্গে?
মিরা একটু লাল হলো লজ্জায়। কিছু বলল না। কাগজে লিখলে
ফাজিল
টুম্পা আরো কি সব লিখছে। ওর মুখ হাসি হাসি। মীরা পাশে তাকিয়ে মনে করলো এই টুম্পাই ফাস্ট ইয়ারে থাকতে আশিকের প্রেমে পড়েছিল। সে কি উথাল পাথাল প্রেম। ক্লাস শুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েছিল। তবে টুম্পা দমবার পাত্রী নয়। ক্লাসের দু একটা ছেলেকে দিয়ে আশিককে জানানোর চেষ্টা করেছিল।বিশেষ একটা লাভ হয়নি। আশিক তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এরপর টুম্পা একদিন ভয়ঙ্কর একটা কান্ড করেছিল।

ক্লাসের শেষে আশিক অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। চায়ের দোকানটা ডিপার্টমেন্টের পেছনেই। বেশ অনেকখানি খোলা জায়গা পেছনে সেখানেই ছোট একটা চায়ের দোকান। সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা। আশিক ওখানেই বসে ছিল চার পাঁচ জন বন্ধু নিয়ে। টুম্পা হঠাৎ ওখানে হাজির হয়ে বলল
– আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে আশিক ভাই
আশিক একটু অবাক হলো কিন্তু তেমন কিছু প্রকাশ করল না। আস্তে করে বলল
– বল
– আমি আপনাকে ভালোবাসি
আশিকের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। আশেপাশের ছেলে পেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওই করতে লাগলো। টুম্পা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশিক বলল
– আর কিছু বলবে?
– আপনি তো আমার কথার জবাব দিলেন না?
– তুমি তো কোন প্রশ্ন করনি যে আমি জবাব দেবো।
টুম্পার গলা কাঁপছে তবে ও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার মতন মেয়ে নয়। আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মীরা ওর একটা হাত ধরে বলল
– টুম্পা চল এখান থেকে
আশিক একটা হাত তুলে বলল
– ইটস ওকে। টুম্পা তুমি চা খাবে?
টুম্পা একটু সহজ হলো, তারপর বলল
– আমি চা খাই না
– কার্জন হলের সামনে নতুন আইসক্রিমের গাড়ি এসেছে। আইসক্রিম খাবে?
এবার টুম্পার মুখে হাসি ফুটল। বলল
– চলেন
আশেপাশের ছেলেগুলো তখনও মুখ চাওয়াচারি করছে। আশিক উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে দোকানীকে টাকা দিয়ে বললো
– রেখে দাও, বাকিটা পরে হিসাব করে নেব, তারপর টুম্পার কাছে গিয়ে বলল
-চলো
টুম্পা মীরার হাত ছেড়ে দিয়ে আশিকের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো।

সেদিন আশিক টুম্পাকে কি বলেছিল কেউ জানে না। তবে এরপর থেকে টুম্পার মাথা থেকে প্রেমের ভুত নেমে গিয়েছিল। অথচ দুজনের সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে দেখা হলেও আশিক হাসতে হাসতেই বলত
কি খবর টুম্পা, ভালো তো?
টুম্পাও হেসে জবাবে বলত
জি ভাইয়া
মীরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন ওদের মধ্যে কি কথা হয়েছে। টুম্পা এড়িয়ে গেছে। বলেনি কিছু।

তিনটা ক্লাস পরপর হল, কোন গ্যাপ ছাড়াই। মীরা অন্য কারো সঙ্গে আর কথা বলল না। পুরোটা সময় টুম্পার সঙ্গেই থাকলো। শেষ ক্লাসের মাঝখানে মোবাইলে একটা মেসেজ এল আফসিনের কাছ থেকে। ও লিখেছে আর এক ঘন্টা পর ওর সব ক্লাস শেষ হয়ে যাবে। একসঙ্গে ফিরবে কিনা জানতে চাইল।
মীরা জবাবে লিখল একসঙ্গেই যাবে। ক্লাস শেষ করে আর দাঁড়ালো না মীরা। আফসিনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেল। গাড়িতে উঠে দেখলে টুম্পা মেসেজ পাঠিয়েছে।
– শালী! তুই কিছু না বলে চলে গেলি। তোরে হাতের কাছে পাই খালি।

প্রথম রাতের পর আফসিনের সঙ্গে আর কথা হয়নি। পুরো পথ জুড়ে বকবক করল মেয়েটা। আফসিন একটু আহ্লাদী ধরনের। বাবা আর ভাইয়ের খুব আদরের বোঝা যায়। অন্যদিকে মীরা বাড়ির বড় মেয়ে। ওর কাছে সহজেই প্রশ্রয় পেয়ে গেল। ফেরার পথে বলল
– চলো ভাবি আইসক্রিম খাই।
দুজনে আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।

ঘরে ঢুকেই মীরা বুঝতে পারল কেউ একজন ঘরে এসেছিল। যেমনটা সবকিছু রেখে গিয়েছিল সেই মতো আর কিছু নেই। অনেক পরিপাটি গোছানো। মীরার জামা কাপড়ের ব্যাগটা নেই। আলমারি খুলে দেখল আলমারির একটা পাশ খালি। সেখানে ওর ব্যগটা রাখা। মীরা অস্থির পায়ে আবারো পুরো ঘর বারান্দা খুঁজে দেখল। অশিককে কোথাও দেখা গেল না। মিরা ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এল। রোজিনাকে জিজ্ঞেস করল
তোমার ভাইয়া এসেছিল?
রোজিনা জানাল, আশিক এসেছিল গোসল করে ভাত খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। মীরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আশিকের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। এভাবে তো একসঙ্গে থাকা সম্ভব না। আশিক যদি চাইছে না ও এখানে থাকুক সেক্ষেত্রে ও হলে চলে যেতে পারে। ওর কারণে একজন নিজের ঘরেই আসতে পারছে না এই ব্যাপারটা ভালো দেখাচ্ছে না।

মীরা দুপুরেও ঠিকমতো খেতে পারলো না। কোনমতে একটু খাবার মুখে গুঁজে ঘরে চলে গেল। কিছু ভালো লাগছে না। সেদিন আশিকের উপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। ভেবেছিল ওকে দু চার কথা শোনালে হয়তো শান্তি পাবে, কিন্তু কিছুই হলো না। এত অস্থির লাগছ এখন। মীরা আস্তে আস্তে লাইব্রেরীর ভেতর ঢুকলো। এই ঘরটা এত বেশি সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়। মীরা আনমনে চেয়ারটায় বসে পাশে তাকিয়ে চমকে উঠল। নোটপ্যাড এর মধ্যে আরেকটা কবিতা দেখা। এটা কি আজকে লিখে রেখে গেছে ও ?

থাকুক তোমার দখিন হাওয়া
আমার থাকুক ঝড়
তোমার তরে তরুর ছায়া
আমার তেপান্তর

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে