বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৮.
লাইব্রেরীতে ঢুকে শুভ থমকে গেল। মীরা আশিক আর মারুফ একটা কম্পিউটার টেবিলে বসে কাজ করছে। আশিকই মূলত কাজটা করছে মীরা পাশ থেকে দেখিয়ে দিচ্ছে। শুভর মেজাজটা এমনিতেই খারাপ ছিল আরো খারাপ হয়ে গেল। অসংখ্যবার ফোন দেওয়ার পরে ও মীরা ফোন ধরেনি। ক্যাম্পাসেও এড়িয়ে গেছে। শুভ কষ্ট করে মাথা ঠান্ডা রেখে এগিয়ে গেল। না, আর কোন ভুল করা যাবে না। একবার মাথা গরম করে ভুল করে ফেলেছে। আগে হলে ও এত বিচলিত হতো না। মীরা আর কদিন রাগ করে থাকতো, কদিন পর ঠিকই ওর কাছে আসত আবার। কিন্তু এখন কেন যেন মনে হচ্ছে এই জিনিসটা দীর্ঘায়িত হলেই ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে। সে ক্ষেত্রে মীরা ওর চোখের সামনে আশিকের সঙ্গে….। না, আর ভাবতে পারছে না। যে করেই হোক এটা ঠিক করতে হবে। শুভ এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো, তারপর বলল
-মীরা তোমার সঙ্গে কথা আছে। একটু আসবে
মীরা অন্যদিকে তাকিয়েই বলল
-আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি
শুভ খুব নরম গলায় বলল
-তাহলে কাজ শেষ করো, আমি বাইরে অপেক্ষা করি
– কাজ শেষ করে আমি টিউশনিতে যাব অপেক্ষা করার দরকার নেই
শুভ ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়লে ও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। বলল
– প্লিজ মীরা
মীরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আশিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-মিরা, যেটুকু আছে আমরা করে ফেলতে পারবো। তুমি যাও।
বাধ্য হয়ে মিরাকে উঠতে হলো। আশিক তাকিয়ে আছে। শুভ আর মীরা
হেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। মীরা শুভর দিকে তাকাচ্ছে না, অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। আশিক একটু হাসলো। মেয়েটা বোধহয় রেগে গেলে তার দিকে তাকায় না। আশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো কাজে মনোযোগী হল। অনুষ্ঠানের আর বেশি বাকি নেই। কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে
শুভর অনেকটা সময় লাগলো মীরাকে ম্যানেজ করতে; তবে শেষ পর্যন্ত সফল হল। অনেক করে বুঝিয়ে বলল যে , ও খুব ইনসিকিউরড ফিল করছিল। মিরাকে এখানে একা ফেলে যাবার কথা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না। এই মুহূর্তে বাসায় কথা বলা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই জোর করছিল বিয়ের জন্য। ভেবেছিল হয়তো পরিবারের দোহাই দিলে মীরা রাজি হবে , তাই ওসব বলেছিল। ওর পরিবার সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য করার কোন ইচ্ছাই ওর ছিল না। যা বলেছে তার জন্য অনেক বার করে ক্ষমা চাইলো।
শুভ ওর দাদা বাড়িতে থাকে। ওদের যৌথ পরিবার চাচা চাচি এবং চাচাতো ভাই বোনদের সঙ্গে। শুধুমাত্র ওর বাবা-মা দেশের বাইর থাকে। সামনে ওর চাচাতো বোনের বিয়ে, সেই উপলক্ষে শুভর বাবা মা দেশে আসছে। শুভ প্রতিশ্রুতি দিল, এবার বাবা-মা দেশে ফিরে এলে মিরাকে ওদের সঙ্গে দেখা করবে। মীরা যেভাবে চায় সেভাবেই বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
কৌশল করে শুভ আশিকের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল, যেন ওদের দুজনকে নিয়ে ওর মনে কোন সন্দেহের উদ্রেকই হয়নি। সময় লাগলেও শেষমেষ মীরা মেনে নিল। যেহেতু ওর নিজের বাড়ি থেকেও বিয়ের কোন চাপ নেই, বড় চাচা সৌরভের বিয়েটা মেনে নিয়েছেন ,কাজেই আপাতত বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
কয়েকটা দিন এভাবেই চলল। মীরা সবটা মেনে নিয়েছে। সবকিছু আবার আগের মতন হয়ে গেলেও কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে। ওদের সম্পর্কে যেটুকু বা গভীরতা ছিল সেটাও আর খুঁজে পেল না মীরা। সম্পর্কটা কেমন ভাসা ভাসা, শরতের মেঘের মতন। এই আছে তো এই নেই। অবশ্য আপাতত এত কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই মীরারা। টিউশনি জুয়েলারির অর্ডার ,অনুষ্ঠানের কাজ এসব নিয়েই মহাব্যস্ত হয়ে আছে। আশিকের কথা মতো মীরা ওদের কাছে কিছু এডভান্স দাবি করেছে। ওরাও খুব সহজভাবে মেনে নিয়েছে। দুই হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে। মীরা সমস্ত জিনিসপত্র কিনে সেটগুলো রেডি করে ফেলেছে; কিন্তু সমস্যা বেধেছে অন্য জায়গায়। ওরা কিছুতেই পিক করতে চাইছে না, বলছে ডেলিভারি করতে। উত্তরার একটা ঠিকানা পাঠিয়েছে। মীরা বুঝতে পারছে না কি করে ওখানে যাবে।
এবার বইমেলা বেশ জমজমাট ভাবে হচ্ছে। মীরার খুব ইচ্ছা ছিল যাবার; কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যে আছে , তাই আর সময় করে উঠতে পারছে না। সবমিলিয়ে দম ফেলার সময় নেই।
স্টেজ ডেকোরেশনের সমস্ত ব্যানার প্রিন্ট হয়ে চলে এসেছে। আশিকের অফিসে রাখা আছে। আজকে পাঁচটার সময় মিটিং। সবকিছু ফাইনাল করে ফেলতে হবে। মীরার ক্লাস ছিল না। তিনটার সময় সাধারণত ও টিউশনতে যায়। একবারে পড়ানো শেষ করে আশিকের অফিসে যাবে ঠিক করল। পড়ানো শেষ করতে করতে সাড়ে চারটার বেশি বেজে গেল। মিরা ঝটপট রিক্সা নিয়ে আশিকের অফিসে চলে গেল। ভেবেছিল পৌছে দেখবে সবাই চলে এসেছে। কিন্তু ওখানে পৌঁছে কাউকেই দেখতে পেল না। সেদিনকার মতই সদর দরজা খোলা। মীরা ভেতরে ঢুকেও কাউকে খুঁজে পেল না। ছাদ বারান্দা থেকে শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই সবাই ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। মীরা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। ওই তো, আশিক ভাইকে দেখা যাচ্ছে। আর কেউ তো নেই। একাই হেঁটে হেঁটে রিহার্সেল করছে। নিশ্চয়ই এই কবিতাটাই আবৃত্তি করবে প্রোগ্রামের দিন। মীরা ভিতরে গেল না , পাছে ওকে দেখে আশিক ভাই থেমে যায়। ওখানেই দেয়ালের সঙ্গে সেটে দাঁড়িয়ে রইল। কি অদ্ভুত সুন্দর আবৃত্তি করে করে আশিক ভাই। ইচ্ছে করে সারাদিন ধরে শুনতে।
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে রাজা আছে
ইচ্ছে আছে, শুধু তুমি অন্য ঘরে।
চলবে……
বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৯.
মেঘের গর্জন শুনে আশিক আকাশের দিকে তাকালো। সন্ধ্যা নামতে এখনো দেরি আছে, কিন্তু আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। কি অদ্ভুত! একটু আগেও ঝলমলে রোদ ছিল। এখন মনে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি নামবে। হঠাৎই দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা ওর মুখের উপর এসে পড়ল। আশিক দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে চমকে তাকিয়ে বলল
তুমি কখন এলে মীরা?
মীরা একটু লজ্জা পেয়ে বলল
-এইত কিছুক্ষন। আপনি রিহার্সাল করছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি। এই কবিতাটাই করবেন প্রগ্রামের দিন?
-আরে ধুর! একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেউ এই কবিতা পড়ে?
– সুন্দর হচ্ছিল খুব
– থ্যাঙ্ক ইউ
বাইরে মেঘের গাজন শুরু হল সেইসংগে পাল্লা দিয়ে ঝড়ো হাওয়া। পুরানো দিনের জানালার কপাটগুলো শব্দ করে আছড়ে পড়তে লাগলো। আশিক জানালা বন্ধ করে ঘরের আলো জেলে দিল। তারপর চিন্তিত মুখে বলল
-রাসেল আর মারুফের আসার কথা, ব্যনার আর স্পিকারগুলো নিয়ে। এই রকম অবস্থা থাকলে তো জিনিসগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর একটু থেমে বলল
-মীরা তুমি বস, আমি আসছি। আশিক পাশের ঘরে গিয়ে মারুফকে ফোন করে জানতে পারলো যে, ও ডেকরেটরের ওখানে আটকা পরেছে। রাসেলকেও ফোন দিল কিন্তু ও ধরলো না। আশিক ফিরে এসে মীরাকে কোথাও দেখতে পেল না। রান্নাঘরে উকি দিয়ে দেখল , ও কি যেন সব তৈরি করছে , আশিক কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইল। ওকে দেখতে ভালো লাগছে। কি সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাজ করছে, মনে হচ্ছে যেন এটা ওরই রান্নাঘর। আশিকের হঠাৎই মনে হল ,আচ্ছা , মীরার আর ওর যদি একটা সংসার হত তাহলে কেমন হতো? এই রকম ঝুম বৃষ্টির দিনে মিরা চা আর পিয়াজু বানাত, তারপর দুজন গল্প করতে করতে রাত ভোর করে দিত। নিজের ভাবনায় আশিক নিজেই বিরক্ত হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে বলল
– তুমি কিছু খুঁজছো মিরা?
– হ্যাঁ একটা বড় বাটি খুজছিলাম
– ওপরের তাকে আছে দেখো
আশিক আর কিছু জানতে চাইলো না, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেল।
মীরা কেটলিতে চায়ের জন্য জল চাপিয়েছে। ইলেকট্রিক কেটলিগুলো দু-মিনিটের মধ্যেই জল ফুটিয়ে ফেলে। মীরা ব্যাগ থেকে চানাচুর বের করে বাটিতে ঢাললো। আসার আগে স্টার থেকে কিনেছে। সাধারণত মীরা টুকটাক খাবার রাখে নিজের রুমে। কখনো ক্লাস করতে দেরী হলে বা ল্যাব থাকলে ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা খায়।
আজ চা পাতা খুঁজতে গিয়ে তাকের মধ্যে এক প্যাকেট মুড়ি খুঁজে পেয়েছে, তাই মনে হল একটু মুড়ি মাখাতে। বাড়িতে থাকতে বিকেলবেলার নাস্তা বানানোর দায়িত্বটা ছিল মীরার। কোনদিন পিয়াজু, কোনদিন মুড়ি মাখা বা চটপটি-ফুচকা, আলুর বড়া আরো কত কি বানাত। সন্ধ্যে হলে সৌরভ ভাই আর বড় চাচা বাড়ি ফিরলে সবাই একসঙ্গে খেত। কি মিষ্টি ছিল সেই দিনগুলো। আজ কেন যেন বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। পেছনের উঠোনে এইরকম বৃষ্টিতে ওরা তিন বোন একসঙ্গে ভিজতো। মা খুব রেগে যেতেন।
একটু সরিষার তেল থাকলে খুব ভালো হতো , সঙ্গে কাঁচা মরিচ, পেয়াজ আর ধনেপাতা তার একটুখানি টমেটো। যাক, কি আর করা। শুধু মুড়ি চানাচুরই খেতে হবে। মীরা যত্ন করে দুটো বাটিতে মুড়ি মাখা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল আশিক পাশের ঘরে ফোনে কথা বলছে। মুড়ি নেতিয়ে যাবে বলে মীরা তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে চা করতে চলে গেল।আশিক কথা শেষ করে ঘরে এসে শুনলো মিরা তখনও রান্নাঘরে ঠুনঠান করে কিছু করে যাচ্ছে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে ও হতভম্ব হয়ে গেল। ওখান থেকেই গলা উচিয়ে বলল
-মিরা, এটা কি তুমি বানিয়েছ?
– জি আশিক ভাই, আপনি শুরু করেন , আমি চা নিয়ে আসছি
মীরা চা নিয়ে ফিরে এসেছে, ততক্ষণে আশিক খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মীরা চেয়ারে বসে চায়ের কাপ টেনে নিল। আশিক খুব আগ্রহ করে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে অসম্ভব ক্ষুধার্ত। মীরা আস্তে আস্তে বলল
– আপনি কি সকাল থেকে এখানেই?
– হ্যাঁ কাজগুলো শেষ করছিলাম
– কিছু খেয়েছেন সকাল থেকে?
– না কিছু খাওয়া হয়নি, ভেবেছিলাম কিছু অর্ডার দেব, পরে ভুলে গেছি।
মীরার একটু খারাপ লাগলো। এমন কাজ পাগল হয় মানুষ। মিরা ওর বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল
-আপনি এটাও খেয়ে নিন
– না না, আর লাগবে না। তুমি খাও
-আরও আছে। আমি খেয়ে নেব। আপনি নিন, আমি চা নিয়ে আসছি
মীরা চা আনতে উঠে গেল। আশিক কিছুক্ষণ ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। এরকম বৃষ্টির দিনে মা এসব ভাজা-ভুজি খুব করতেন। আশিক খুব ভালবাসত খেতে, এখনো ভালবাসে, তবে এখন আর কেউ এত যত্ন করে খাওয়ায় না। মীরা চা নিয়ে ফিরে এসেছে। আশিক খেতে খেতেই বলল
-তুমি যখন এখানেই আছো তখন এসো তোমার কাজটা শেষ করে ফেলি। একটা কাজ অন্তত হোক
-আচ্ছা
খাওয়া শেষ করে দুজনেই ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাইরে তখনও ঝড়ের তীব্রতা একইভাবেই চলছে, কিন্তু দুজনেই কাজে এমন ডুবে ছিল যে কেউ খেয়াল করল না। কাজ শেষ করতে করতে আটটা বেজে গেল। আশিক তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলে কপালে দুই পাশ চেপে ধরে বলল
-যাক তোমার কাজটা অন্তত শেষ হল, তোমার আর না আসলেও চলবে।
হঠাৎই জানালার কাজ ভাঙার শব্দে দুজনে সম্বিত ফিরে পেল। পুরনো জানালার কাচ ঝড়ের দাপটে ভেঙ্গে পড়েছে। আশিক চিন্তিত মুখে উঠে গেল। ঘড়ি দেখে বলল
-তোমার ফেরার ব্যবস্থা করা উচিত। রাত বাড়ছে। দাঁড়াও, আমি বাসায় ফোন দিয়ে দেখি গাড়ির কি অবস্থা।
বাড়িতে ফোন দিয়ে জানা গেল গাড়ির কার্বুরেটরে জল ঢুকে অবস্থা খারাপ। গ্যারেজে নিতে হয়েছে। আশিক চিন্তিত কন্ঠে আবারো বলল
-চলো আমিই তোমাকে দিয়ে আসছি। হলে যাবে তো?
-হলে অথবা শ্যামলী যেটা সুবিধা হয়
দরজা খুলতেই প্রচন্ড ঝড়ের দাপটে দরজা আবারো আছড়ে পড়ল। সেইসঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল একগাদা ভেজা পাতা আর খানিকটা বৃষ্টির জল। আশিক তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। পাশের বারান্দা থেকে দেখল আশেপাশে রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির বেগ ও বাড়ছে। কিছুক্ষণ উবারের জন্য চেষ্টা করল কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না। নেটওয়ার্কের অবস্থাও ভালো না। মীরাকে বলল
-তোমার ফোনের কি অবস্থা, দেখতো
মীরা ফোন বের করে দেখল যথারীতি ওর ফোনে কোন চার্জ নেই। আশিক মারুফকে ফোন করে দেখল ও বাসায় চলে গেছে। রাসেলকে আবার ফোন করে জানা গেল ও কাছাকাছিই আছে।
রাসেলের বাসা মোহাম্মদপুর, এই মুহূর্তে ধানমন্ডির একটা দোকানে অপেক্ষা করছে ও। ঝড় একটু কমলে বাসায় ফিরবে। আশিক জানতে চাইল
-তুই ফেরার পথে আমার এখান থেকে মীরাকে নিয়ে শ্যামলী পৌঁছে দিয়ে, বাড়ি যেতে পারবি?
– মীরা কোথা থেকে এলো?
– ওতো বিকাল থেকেই ছিল।
– বলিস কি?
তাহলে তো ভালোই টাইম কাটাইতেছো মামু। শেষের কথাটা আর আশিককে বলল না, বরং জানালো মিরাকে পিক করে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
মীরা পুরোটাই শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। এখন আসলে আর কোন অপশন নেই। আশিক চকিতে একবার মীরার দিকে তাকালো। ওর মুখ কালো হয়ে আছে। আশিক টের পায় রাসেলের সাথে ও ঠিক কমফোর্ট ফিল করে না। কিন্তু এখন বিপদ বলে কথা। আশেপাশে কোন রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে বের হলে একেবারেই ভিজে যাবে।
ঝড় থামতে থামতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। রাসেল দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়েছে। মেজাজ খারাপ লাগছে। রিক্সার প্লাস্টিকের পর্দায় ফুটা। ভিজে একসা হয়ে যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালা কিছুতেই ৩২ নাম্বার যেতে চাইছে না। মোহাম্মদপুর যাওয়ার জন্য অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে, এখন যদি আবার তাকে বলতে হয় শ্যামলী যেতে হবে এই ব্যাটা না আবার বেঁকে বসে। তবে মিরাকে হাতের নাগালে পাওয়া যাবে এটা বেশ হয়েছে। এত দেমাগ আজকে কোথায় যায় দেখবে। রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখে যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ওর মনে হল আশিক নিজেও তো দিয়ে আসতে পারতো, ওকে এখানে আনবার কি দরকার ছিল? আশিক সব সময় ওর সঙ্গে এরকম করে। ওকে কি ভাবে? নিজের চামচা? শালার কপাল সবসময়ই ওর সঙ্গে থাকে। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করে তারপরেও শালার ফাস্ট ক্লাস ওই পায়, আর রাসেল কোনোমতে পাস করে যায়। শুধু তাই নয় সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে টুম্পা নামের একটা মেয়েকে খুব মনে ধরেছিল। কেমন ছটফটে শালিক পাখির মতন। চোখে মুখে কথা বলে। রেশমাকে বলেছিল একটু সেট করে দিতে কিন্তু রেশমা এসে জানিয়েছে ওই মেয়ে নাকি আশিকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শালার আশিক ওই মেয়ের সঙ্গেও প্রেম করলো না। মাঝখান থেকে ওর জিনিসটা ঘেটে গেল। শুধু কি তাই? সেদিন তো কলারো চেপে ধরেছিল, ওই শালী মীরার জন্য। আজ শিক্ষা দেওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ পাওয়া গেছে। রাসেল দরজার হাতল ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে নিচে নেমে রিক্সা করে বাড়ি চলে গেল। রিক্সায় উঠে ফোনটাও সুইচ অফ করে দিল।
মনে মনে বলল আমার কলারে হাত দিছিলি না, কালকে সকাল হইলে টের পাবি।
চলবে…….
বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৩০.
-তোমার কি ভয় করছে মীরা?
-ভয়? না ভয় করছে না। একা থাকলে হয়তো ভয় লাগতো।
আশিক একটু অবাক হলো। মেয়েটা কি বোকা, নাকি ওকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে?
রাত প্রায় এগারোটার উপর বাজে। রাসেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আগেই কথা হয়েছে, এতক্ষণে ওর চলে আসা উচিত ছিল। কি জানি কি হয়েছে? মীরা আরেকপ্রস্থ চা বানিয়ে এনেছে। টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
– আমি বোধহয় আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
আশিক চায়ের কাপ টেনে নিল, তারপর আয়েশ করে চুমুক দিয়ে বলল,
– ঝামেলা তো আমার হযনি মীরা, ঝামেলায় তো তুমি পড়লে। আমি তো মজা করে চা খাচ্ছি।
– আপনি বাড়ি ফিরবেন না?
– না। মাঝে মাঝে বেশি রাত হয়ে গেলে আমি এখানেই থেকে যাই।
– এখানে?
– হ্যাঁ। ভেতরের রুমে একটা সোফা কাম বেড আছে। কদিন আগেই এনেছি। এখানে…
আশিক কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই বিকট শব্দ করে জেনারেটর বার্স্ট করে পুরো এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেল। অন্ধকারের ঘনত্ব দেখে মনে হচ্ছে শুধু এই এলাকা না, আশেপাশের কোথায়ও আলোর কোন চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে শুধু বিদ্যুৎ চমকের ঝলকানিতে ঘরের মধ্যে এক চিলতে আরো ঝলকে উঠছে। গাঢ় অন্ধকারে মীরার অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ছে। এই রূপে মীরাকে দেখলে কেন যেন ভীষণ কাছের, ভীষণ আপন মনে হয়। এমনভাবেই ওকে প্রথমবার দেখেছিল আশিক। সেই থেকে মনের মধ্যে কেমন একটা অদ্ভুত যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছে ওর সঙ্গে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানির নীল আলো এসে পড়ছে ওর চুলের উপর। একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা, মীরা যদি এখন ওর মনের কথা টের পেত, তাহলে নিশ্চয়ই ওর ভয় করতো। এরকম অন্ধকারে ওর সঙ্গে বসে থাকতে পারতো না।
মীরার জবাব শুনে আশিক অবাক হলো। মেয়েটা বোকা না ওকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে বোঝা যাচ্ছে না; তবে আশিক নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ও একবার মনে মনে বলল আমাকে এত বিশ্বাস করোনা মীরা; আমি একটা রক্ত মাংসের মানুষ। আমার মধ্যেও অনেক কামনা বাসনা আছে। হয়তো আমার ভেতরেও কোথাও একটা পশু লুকিয়ে আছে।
আশিক আচমকা উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
– রাসেল মনে হয় আর আসতে পারবেনা। বৃষ্টি থেমে গেছে। চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ ধরে ও মিথ্যা করেই বলছিল যে ওর ভয় করছে না। আসলে ওর ভীষণ ভয় করছিল। এখানে এইরকম অন্ধকারে আশিকের সঙ্গে বসে আছে এই জন্য নয়, বরং এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে ওকে রাসেলের সঙ্গে এতটা পথ যেতে হবে এই কথা ভেবে।
আশিক ভেতরের রুম থেকে টর্চ নিয়ে এলো। মীরা ঝটপট ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। দরজার লক খুলে আশিক হতভম্ব হয়ে গেল। দরজা আটকে গেছে, কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। এর আগে যখন দরজা খুলেছিল, প্রচন্ড হাওয়ায় দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় হয়তো আটকে গেছে। পুরনো দিনের দরজা। এটা এখন কি করে খুলবে বুঝতে পারছে না। কয়েকবার হ্যাচকা টান মারলো, লাভ হলো না। এরকম হলে তো খুব ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে যাবে। মীরাকে পৌঁছে দেয়াটা জরুরী। আশিক রাসেলকে এর মধ্যে চার বার ফোন দিয়েছে। প্রথমবার ধরেনি, এরপর থেকে সুইচ অফ দেখাচ্ছে; হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গেছে। রাত প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। এর চেয়ে দেরি করাটা আর সমিচীন হবে না। মীরা এগিয়ে এসে বলল,
-কি হয়েছে?
আশিককে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। ও জবাব দিল না। আবার দরজা ধরে হ্যাচকা টান মারলো।
– দরজা আটকে গেছে আশিক ভাই?
– তাই তো মনে হচ্ছে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো।
মীরার চেষ্টা করার খুব একটা আগ্রহ ছিলনা; আশিক যদি পারছে না তাহলে ও আর কি করবে। তবুও মীরা একবার দরজা ধরে টানলো। বোঝা যাচ্ছে খুব শক্ত হয়ে আটকে গেছে। আশিক চিন্তিত মুখে বলল,
– এটা তো ভালো হলো না।
পাশে তাকিয়ে মীরাকে আর দেখতে পেল না। মীরা আবার আগের চেয়ারে গিয়ে বসেছে। আশিক বাড়িতে ফোন করে ওর বাবাকে জানালো। আরিফ সাহেব জানালেন, হয়তো পুরনো দিনের দরজা বলে আটকে গেছে। চিন্তা না করতে। সকাল হলে দারোয়ানকে পাঠিয়ে দেবেন। বাইরে থেকে চেষ্টা করলেই খুলে যাবে। আশিক নিশ্চিন্ত হতে পারল না। চেষ্টা চালিয়েই যেতে লাগলো। আরো অনেকক্ষণ টানাটানি করে হতাশ হয়ে একবার মীরার দিকে তাকাল। মীরা বলল,
– বাদ দেন আশিক ভাই। আর তো কয়েক ঘন্টা। আপনি বসেন। আপনার চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল। এখন আর গরম করাও যাবে না।
আশিক বসলো না, বিরস মুখে ভেতরের ঘরে চলে গেল। তারপর মোমবাতি এনে জ্বালিয়ে টেবিলে রাখল। চেয়ারে বসে একটা বই খুলল। যে ক ঘন্টা আছে, নিজের মনোযোগ একটু সরিয়ে রাখতে হবে।
মীরাকে বিশেষ একটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে ভাঙা জানালা দিয়ে ঝড়ো বাতাস আসছিল বলে ওর শীত করছিল। বুঝতে পেরেই কিনা ও জানে না, আশিক ওকে একটা চাদর এনে দিয়েছে। এখন ও সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে, আরাম করে পা তুলে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। যদিও চা ঠান্ডা হয়ে গেছে; একবার গরম করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এই অন্ধকারে চা গরম করা সম্ভব না। বিরক্ত লাগছে। সময় কাটছে না। সামনে তাকিয়ে দেখল আশিক বই পড়ছে। মীরা একটু আগ্রহ নিয়ে বলল,
-কি পড়ছেন আশিক ভাই?
– কবিতা।
– একটু জোরে পড়েন আমিও শুনি, তাহলে একটু সময় কাটবে।
আশিক আর উচ্চবাচ্য করল না। পড়া শুরু করল
প্রিয় আকাশি,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পয়েছি। খামের উপর নাম ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি তোমার হাতের লেখা;
ঠিকানা পেলে কিভাবে লেখনি; কতদিন পর ঢাকার চিঠি;
তাও তোমার লেখা, ভাবতে পারো আমার অবস্থা??
গতকাল প্যারিসে ঝরেছিলো এ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তুষারপাত।
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি; এই প্রথম আমি অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ। তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর বদলে যাওয়ার সংবাদ; তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছো – রাত্রির ঢাকা এখন নিয়নের স্নিগধতা ছেড়ে নিয়েছে উতকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন কালের সাক্ষী,
শীতের বইমেলা পরিণত হয়েছে মিনাবাজারে,
টি এস সি’র চত্বরে যেন উপ্তপ্ত বৈরুত।
বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্বৃতি এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছো;
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও
বদলে যেতে দেখলাম কত সুদুর ইতিহাস-
বালির বাধের মতন ভেসে গেল বার্লিন প্রাচীর …
ইংলিস চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন;
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে,
ক্ষিদে পেলেই ছিড়ে ছিড়ে খাও,
স্বাধীনতা মানেই যেন উদর পুর্তি …
তুমি লিখেছ – “তোমাকে ভুলে গেছি কিনা?”
প্রিয় আকাশি,
আমি জেনে গেছি-
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা
আশিক একটু থামলো, তারপর মনে মনে বলল আসলেই সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা। বিশেষত যাকে ভুলে থাকতে চায়, সে যদি এই ভাবে চোখের সামনে বসে থাকে। ও চোখ তুলে তাকালো এবং হেসে ফেলল। হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মীরা। কপাল বেয়ে চূর্ণ চূর্ণ চুলগুলো ঝুলে পড়েছে মুখের উপর। কি অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ওকে। আশিক আনমনে বলল,
“তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।”
চলবে………