ফ্লুজি পর্ব-১৫

0
208

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৫]

বাহাররুল হক ডাইনিং স্পেচে আসতেই চমকে গেলেন।আরশাদ একটি চেয়ার দখল করে বসে আছে।তার পাশে দাঁড়িয়ে খুশবু।বাহারুল হকের হতবাক চাহনি দেখে আরশাদ ঠোঁট কুচকে হাসলো।

” আসসালামু আলাইকুম আব্বু ভালো আছেন?”

সালামের জবাব নেওয়ার কথাও যেন ভুলে গেলেন বাহারুল হক।মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে তিনি বলেন,

” তুমি!”

” আজ সকালেই এলাম।”

বাহারুল হক ছুটে গেলেন রান্না ঘরে অনিমাকে ধমক দিয়ে বলেন,

” জামাই এসেছে এই কথা আমাকে জানাওনি কেন?”

” জানালে কি করতেন?নিশ্চয়ই ঝামেলা করতেন তাই তো জানাইনি।”

” দিন দিন কি বিবেক বুদ্ধি লোভ পেয়েছে?ঘরে বাজার সদাই আছে?কি রেঁধেছো?বাড়ির জামাই যা তা দিয়ে আপ্যায়ন করা সাজে না।”

” সেকি কথা!আমি তো ভাবলাম তুমি ছেলেটাকে দেখলেই দা কুড়াল নিয়ে দৌঁড়াবে হঠাৎ তোমার মুখে ভালো কথা!”

” আমার বাড়িতে আসলে কেউ যে আপ্যায়ন ছাড়া যায় না আশা করি সেই কথা ভুলে যাওনি।”

” চিন্তা করতে হবে না।যা রেঁধেছি তোমার জামাইয়ের পছন্দ মতো যাও তুমিও বসো।”

বাহারুল হক গিয়ে বসলেন ডাইনিং টেবিলে।আরশাদ পুনরায় তাকে সালাম জানালো এবার মাথা দুলিয়ে গম্ভীর মুখে সালামের জবাব দিলেন তিনি।ভদ্রতার খাতিরে জানতে চাইলেন,

” তোমার বাবা মা ভালো আছে?”

” জি।তারা আসতে চাইছেন আপনারা অনুমতি দিলে আসবেন।”

” অনুমতি দেওয়ার কী আছে?যখন ইচ্ছে আসবেন তারা এখন আমাদের আত্নীয়।”

” বাবা মা এলে ফাইনাল কথা সারতে চান।অনুষ্ঠানের ব্যপারে তারা আগ্রহী।ড্যাড যেহেতু জব করছেন তার বেশিদিন ছুটি নেই।”

বুকের ভেতরটা কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে নরম হৃদয়টাতে আঘাত করল।কলিজা মুচড়ে গেল বাহারুল হকের।একটাই মেয়ে তার একটাই সুখ আহ্লাদ,আনন্দ জল্পনা কল্পনা।সেই মেয়েকে এত দূরে কিভাবে বিদায় দেবেন তিনি!
মন খারাপকে সঙ্গী না করে বাহারুল হক চট করে বললেন,

” আগামীকাল দুপুরে তোমার পরিবারের দাওয়াত রইল।আমি নিজে ফোন করে বলবো নাম্বার দিও আমাকে।”

” অবশ্যই আব্বু।”

খুশবু তার বাবার দিকে তাকালো।মানুষটা কেমন শান্ত হয়ে সব কথার জবাব দিচ্ছে অথচ কয়েকদিন আগেও ঘরে তান্ডব চালিয়েছেন।বাহারুল হক মেয়ের পানে তাকালেন আদেশ করে বলেন,

” তুমি বসছো না কেন?কখন খাবে।”

খুশবু বসলো তবে ভাত মুখে নিতেই চোখ মুখ কুচকে ফেললে।মেয়ের এমন রিয়েকশন বাহারুল হকের চোখ এড়ালো না।তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

” রান্না ভালো হয়নি?স্বাদ লাগছে না?”

” না না ঠিক আছে।”

খুশবু পুনরায় চোখ কুচকালো।তার ঠোঁটে যে ঘূর্নিঝড় তান্ডব চালিয়েছে সেই তান্ডবে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে ঠোঁট যুগল যার ফলে তরকারি মুখে লাগতেই জ্বলতে শুরু করে। আরশাদ বুঝতে পারে তাই তো বাম হাত কানে নিয়ে ইশারায় খুশবুকে সরি জানায়।
.
সারা বাড়ি হইচইয়ে মুখোরিত।একটি গোলাপি জামদানি শাড়ি জড়িয়ে বসে আছে খুশবু।তার পাশে বসে থাকা মানুষটি সম্পর্কের খাতিরে তার শাশুড়ী।লম্বা ফর্সা স্লিম বডির মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ চোখে চেয়েছিল খুশবু।এতটা বয়সে এসেও এই মানুষটা যতটা ফিট স্ট্রং স্টাইলিশ এই বয়সে এসেও নিজেকে বয়স্ক ভাবেন না তিনি।কে দেখে বলবে এই নারীর এত বড় দুই ছেলে আছে।সাদা একটি শাড়ি পড়ে খোপা করেছেন তিনি।খুশবুর বিমহিত নজর দেখে হাসলেন আফরোজ।

” তুমি আমায় দেখে কি ভাবছো?জ ল্লা দ শাশুড়ী?এসব জ ল্লা দ গিরি করার সময় আমার নেই বুঝলে।আমার ছেলে তিনি তার তল্পিতল্পা নিয়ে আলাদা গুহায় থাকেন।তোমাকেও নিশ্চয়ই সেই গুহার বাসিন্দা বানাবে আমার গুহায় আসার সময় তোমার হবেও না।”

খুশবু চোখে হাসলো।তাদের কথার মাঝে এগিয়ে এলো তার শ্বশুর ইমরান ইহসান।খুশবুকে দেখেই বুকে জড়ালেন তিনি।লম্বা স্টং আরশাদের আদলে ঘেরা মুখখানি তার।সামনা সামনি এত লম্বা লম্বা মানুষের পাশে নিজেকে বিড়াল ছানা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না তার।ইমরান ইহসানের বাদামী চোখ জোড়া চকচক করছে তার খুশিতে যেন মুক্ত ঝরছে।

” অবশেষে তোমাকে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হলো আমার।কেমন আছো মা?”

ইমরান ইহসানের কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসলো খুশবু।হাসি মুখে সব কথার জবাব দিলেও এদের মুখে বাংলা শুনতে তার মোটেও ভালো লাগে না।এরা যেন বাংলা কথার শ্রাদ্ধ করে ছাড়ে।আরশাদ এবং তার বাবা দুজনেই ভাঙা ভাঙা বাংলা বলেন অথচ আরিব ছেলেটার বাংলা বলার ধাঁচ ভিষণ সুন্দর।

আরশাদের সহিত খুশবুর এখনো দেখা হয়নি।আরিব ভাইয়ের ছটফটে ভাবটা বুঝতে পেরে তাকে খুশবুর কক্ষে নিয়ে এলো।ছেলের উপস্থিতি পেয়ে চলে গেলেন আফরোজ।আরিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বলে,

” তোমার সুযোগ করে দিচ্ছি আর আমার বেলায় যত আদেশ উপদেশ বাধা বিপত্তি।”

” এখনো প্যান্টের চেইনটাও লাগাতে পারো না ঠিকঠাক ভাবে এই বয়সে এসেছো প্রেম করতে,হাস্যকর।”

খুশবুর সামনে ভিষণ লজ্জায় পড়লো আরশাদ।ছেলেটা আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল রুমের বাইরে।আরশাদ দরজা হালকা লাগিয়ে বসলো খুশবুর মুখোমুখি,

” সদ্য ফোটা একটি গোলাপি লিলি আমার সামনে বসে।এই ফুটন্ত ফুলকে ছুঁইয়ে দিতেও ভয় লাগে যদি নুইয়ে যায়।”

আরশাদ কথাটি বলেই খুশবুর হাত ছুঁলো।

” না ভাইয়া গোলাপি জার্বেরা ফুলের মতো লাগছে।”

আরশাদ খুশবু দুজনেই অবাক হলো।দরজার দিকে তাকাতে দেখতে পেল আরিব দরজায় মাথা বের করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।আরশাদ উঠে দাঁড়ালো ধমক সুরে বলে,

” আরিব এখানে কি করছো?”

” সবাই খেতে বসেছে ভাবিকে ডাকছে, তোমাকে নয়।আমি ভাবিকে নিয়ে যাই?”

” একবার আসো এখানে দেখো আমি কি করি।”
.

খাবার টেবিলে সবার হই হুল্লোড় চলছে।সবচেয়ে বেশি মজার মানুষ আরশাদের বাবা ইমরান ইহসান এবং আরিব।তারা দুজন মিলে এতটাই আনন্দ করছে যে খুশবুর পরিবারের সাথে যেন আজ নয় বছরের পর বছর এদের পরিচিত।ইমরান ইহসান ছেলেকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করে বলেন,

” আমি চাইতাম আমার ছেলেও একটা বাঙালি বউ ঘরে আনুক।বাঙালি মেয়েদের মতো এতটা সংসারি আর কেউ হয় না।এই যে আমার সহধর্মিণীকে দেখছেন ঘরে বাইরে সবটা সামলে যাচ্ছে।আমাদের বিয়ের গল্প শুনবেন?”

বাহারুল হক আগ্রহী হলেন কিঞ্চিৎ হেসে সম্মতি জানালেন শুনতে চান তিনি।ইমরান ইহসান বিয়ের গল্প শোনাতে কখনো আলসেমি করেননি।তার জীবনের বড় প্রাপ্তি এই প্রাপ্তির কথা শোনাতে কোন আলসেমি নেই।আরশাদ আরিব চুপচাপ দুইভাই চোখাচোখি করলো।জন্মের পর থেকে তারা তাদের মা বাবার সম্পর্কের রসায়ন জানতে জানতে বড় হয়েছে তাই তাদের কাছে এই গল্প মুখস্থ কণ্ঠস্থ।

আরো একধাপ অতীতে ফিরে যাওয়া যাক,বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া আফরোজ তখন কোন বন্ধু হয়নি।ক্যাম্পাসে বেশিরভাগ সময় সে একাই কাটিয়েছে এর মাঝে পরিচয় হয় ক্লিফটন নামের একটি ছেলের সঙ্গে।তারা ক্লাস মিট ছিল বিধায় সম্পর্ক ক্রমশ গাঢ় হয়।ক্লিফটনের বাবা মা সবার সাথেই বেশ সুসম্পর্ক ছিল আফরোজার।ক্লিফটনের বোন গ্লোরিয়া ভীষণ আদর করতো তাকে।সব মিলিয়ে ভালো চলছিল দিনকাল।ক্লিফটনের যেকোন অনুষ্ঠান আনন্দ সুখ দুঃখের ভাগিদার ছিল আফরোজা।মেয়েটাকে সে যত দেখেছে ততই অবাক হয়েছে এই মেয়েটার মাঝে রহস্য খুঁজে পায় সে।মেয়েটা কাছে থাকলে স্বস্তি লাগে অথচ দূরে গেলে হতাশায় ঘিরে ধরে তাকে।

ক্লিফটন তখনো বুঝতে পারেনা আসলেই কি সে আফরোজকে ভালোবাসে?বন্ধুত্বের বন্ধন এভাবে বছরেরপর বছর কেটে যায়।আফরোজের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে।এয়ারপোর্টে মেয়েটার হাত ধরে সেদিন প্রথম ভালোবাসার কথা জানায় ক্লিফটন কিন্তু আফরোজ কোন উত্তর জানায়নি।

সময় কেটে যায় অথচ থমকে যায় ক্লিফটনের জীবন।আফরোজকে ছাড়া তার প্রতিটা মুহূর্ত কঠিন হয়ে পড়ে।সে যেন ছিটকে যায় বাস্তবার দুনিয়া থেকে। একদিন আচমকাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে সে বাংলাদেশে যাবে।পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাগজ পত্র তৈরি করে দেশে আসে।আফরোজের পরিবার তাকে গ্রহণ করে আদর যত্নের ত্রুটি রাখেনি কিন্তু যখনি জানতে পারে সে আফরোজকে বিয়ে কর‍তে চায় তখনি হট্টগোল সৃষ্টি হয়।শুরু হয় তর্কাতর্কি ঝামেলা।

আফরোজের ভাই ক্লিফটনকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে।কিন্তু আফরোজের মনে চলছিল অন্যকিছু এত বছরে তার মনেও ক্লিফটনের জন্য অনুভূতি জন্মেছে।কিন্তু বাঁধা তো একটাই ক্লিফটন খ্রিস্টান ধর্মের ছেলে।আফরোজ তাকে শর্ত জানায় যদি ক্লিফটন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তবেই বিয়ে করবে সে।আশ্চর্যের ব্যপার ভাবনা চিন্তা ছাড়াই ক্লিফটন রাজি হয়।সেদিন রাতেই ক্লিফটন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তার নাম পালটে রাখা হয় ইমরান ইহসান।

তারপরের জীবনটা পালটে গেল দুজনের।ক্লিফটনের মা বাবা কেউ তাদের মেনে নিল না।একটা সময় ক্লিফটন এবং আফরোজের উৎসাহে তারাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।কিন্তু ক্লিফটনের বোন গ্লোরিয়া ছিল বিবাহিত তার বিয়ে হয় অন্য আরেক খ্রিস্টান ধর্মের ছেলের সাথে।সে নিজের ধর্ম পাল্টাতে কিছুতেই রাজি নয়।

ক্লিফটনের পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ নিয়ে আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয় চারদিকে ছড়িয়ে যায় নানান কথা।মানসিক শান্তির লোভে ক্লিফটনের বাবা আমেরিকা ছেড়ে পাড়ি জমান ইতালিতে।তারপরের জীবনটা শুরু হয় সুন্দর সুখময় স্বপ্নময় জীবন।
সেই দিনের ক্লিফটন আজ ইমরান ইহসান তার ঘরে দুই পুত্র আরশাদ ইহসান এবং ইমরান ইহসান।
আফরোজের মতো গুনবতী বুদ্ধিমতি সংসার সামলানো মেয়ে আরশাদের ভাগ্যে আছে তো?নাকি নারীর ছলনায় প্রবল ঝড়ে আচমকা ছিটকে যাবে পরিবারের সুতো।
চলবে….

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৫ বাকি অংশ]

আরশাদ এবং খুশবুর অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।হাতে সময় মাত্র দুইদিন।এই দুইদিন পর ঘরোয়া অনুষ্ঠানে খুশবুকে নেওয়া হবে শ্বশুরবাড়ি।এর একদিন পর খুশবুর রিসিপশন।উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে কারো কোন দ্বিমত না থাকলেও খুশবু জেদ ধরে বসে আছে তাদের বাড়িতে বড় কোন আয়োজন হবে না।কোন হলুদ মেহেদীর অনুষ্ঠান হবে না।মেয়েটার অহেতুক জেদের কারণ খুঁজে পাননা অনিমা।মেয়েটাকে কত করে বোঝানো হলো কিন্তু তার একটাই কথা যা হবে ঘরোয়া হবে এই বাড়িতে আর কোন বড় ধরণের অনুষ্ঠান সে চায় না।

একটা বিয়ে নিয়ে কম ধাক্কায় পড়তে হয়নি বাহারুল হককে।রোহানের সাথে যখন বিয়ের বন্দোবস্ত হলো কোন অংশে ত্রুটি রাখেননি তিনি।একমাত্র মেয়ের বিয়ে কেউ যেন কোন খুঁত ধরতে না পারে সেই জন্য সবটা নিজে সামলেছেন।কিন্তু খুঁত তো হয়েই গেল খুশবুর মিসিং ব্যপারটা এলাকায় পাড়া প্রতিবেশীতে রমরমা হয়ে ছড়িয়েছে।
এসব ভেবে খুশবু বড় কোন অনুষ্ঠান চায় না।কিন্তু আরশাদের এটাই তো প্রথম আয়োজন ছেলের বিয়েতে কোন ত্রুটি রাখতে চাননা আফরোজ এবং ইমরান।

আরশাদ অনেকবার বোঝালো খুশবুকে।অবশেষে প্রতিটা অনুষ্ঠান করতে রাজি হলো কিন্তু সে চায় ঘরোয়া ভাবে শুধু আত্মীয়রাই উপস্থিত থাকবে।আরশাদ তার ফ্লুজির কথা ফেলতে পারে না তাই সেও খুশবুকে সমর্থন জানায়।

শপিং এসে আরশাদের প্রতি ভীষণ বিরক্ত কাজ করছে খুশবুর।এই ছেলেটা শাড়ির দোকানে গিয়ে কাউকে কোন শাড়ি পছন্দ করার সুযোগ দিচ্ছে না,সে যেন একাই একশো।পছন্দ মতো শাড়ি তার ফ্লুজির গায়ে ধরছে আবার প্রশ্ন করছে, ‘এই, পছন্দ হয়েছে তোমার?’ ‘এই রঙটা কি ভালো মানাবে?’ ‘ছবিতে কোন রঙটা ভালো ফুটবে?’
হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে শাড়ি খুঁজে যাচ্ছে আরশাদ।আজকে শাড়ি কেনায় খুশবুরো পাত্তা নেই আরশার একাই একশো।ইমরান ইহসান ছেলের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন।আফরোজ ছেলের এহেন কান্ড দেখে হতাশ।খুশবুর কপালে যে দুঃখ আছে তিনি ইতোমধ্যে তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছেন।ইমরানের দিকে তাকিয়ে আফরোজ বলে,

” এই হাসবে না।তোমার ছেলে তো তোমার থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে।”

” মিও ফিগলিও।মিও ফিগলিও।

অর্থাৎ আমার ছেলে।আমার ছেলে।ইমরানের হাসিতে আজ যেন মুক্ত ঝরছে।

অনিমা অবাক হলেন এই দেশের কালচারের সাথে এসব নিশ্চয়ই যায় না।কনের কেনাকাটায় বর পিছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।যদি প্রশ্ন করা হয় তখন মুখ থেকে যা টুশব্দ আসে এর বাইরে তো মুখে রা নেই।যদিও যুগ এখন আপডেট হয়েছে সবার মান্যতা পাল্টেছে কিন্তু তাতেও আরশাদ সবাইকে ছাড়িয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে।

আরশার একটা শাড়ি কিনে ক্ষান্ত হয়নি।পরপর সে অনেকগুলো শাড়ি কিনেছে,পাতলা জরজেট শাড়ি দেখে মুখ কুচকে যায় খুশবুর।মায়ের দিকে তাকালো করুন দৃষ্টিতে।এসব শাড়ি সে পছন্দ করে না অনিমাও কখনো মেয়েকে এসব শাড়ি পরতে দেননি।পাতলা নেট ও জরজেটের শাড়ি বড্ড দৃষ্টিকটু ঠেকে তার কাছে।অথচ আরশার ঘুরে ফিরে এসব কেন কিনছে?খুশবু আরশাদের কাছে দাঁড়িয়ে স্বল্প স্বরে বলে,

” আমি এসব শাড়ি পড়ি না।”

” বাট হোয়াই?”

” পাতলা মানে ভালোলাগে না।”

” আমার তো লেগেছে।”

খুশবু আরশাদকে বোঝাতে পারলো না।হয়তো বুঝলেও মানতো না।মানলেও একবার পছন্দ যখন করেছে কিনেই ছাড়তো।
.
শাড়ি,জুতা কেনা শেষে সবার ঝোক গেল গহনার দিকে।সবাই গোল্ড কিনতে যাওয়ার জন্য অন্য ফ্লোরে গেল।খুশবু তাদের পেছন পেছন যাচ্ছিলো এমন সময় তাকে ফোন করে ছোট মামি নেহা।মেয়েটা কথায় মন দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ হারিয়ে ফেললো তার দলকে।আরশাদ আরিব অনিমা কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
খুশবু দ্রুত ফোন করলো আরশাদকে দুঃখের বিষয় ফোনে টাকা নেই যার কারণে ফোনে থাকা অপরপাশের ব্যক্তিটি তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সুমিষ্ট স্বরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে।
এত বড় শপিংমলে সে কোথায় খুঁজবে তাদের।খুশবু গোল্ডের দোকান খুঁজতে লাগলো হঠাৎ তার পাশাপাশি কেউ সমান তালে হাটায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে।

” কেমন আছো?”

রোহানকে দেখে মুহূর্তে দু’পা থেমে যায় খুশবুর।মেয়েটার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে মুহূর্তে।

” ভয় পেলে?”

” ভ…ভয় পাব কেন?সরুন সামনে থেকে।”

” বিয়ের শপিং কর‍তে এসেছো?ওপ্সস সরি বিয়ে তো হয়েই গেছে।তোমার বিদেশী বর কোথায়?”

” আপনার সাথে কথা বলার রুচি আমার নেই।”

” শুনো শুনো এত অধৈর্য হচ্ছো কেন?আমার বিয়েতে যেই খেল টা দেখালে…”

” খেল আমি দেখিয়েছি নাকি আপনি দেখিয়েছেন?আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ছিহ!”

” বিয়ের আগে ওসব করাই যায়।এতে এত নাক কুচকানোর কি আছে?আচ্ছা আসল কথায় আসি আমি যখন বর যাত্রী সেজে তোমার বাড়ি গেলাম তখন তুমি নেই।তুমি উধাও।এবারো যদি একই ঘটনা পুনরায় ঘটে!তুমি বউ সেজে বসে রইলে তোমার বরটাই এলো না।”

বুকটা ধক করে উঠলো খুশবুর।মেয়েটা যেন শূন্যে ভাসছে এমন কথা শুনেই তো তার গায়ে কাটা দিচ্ছে।খুশবুর থমকে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে রোহান তার হাত চেপে ধরে।এতটা দুঃসাহস রোহান দেখাবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।দ্রুত নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে সে।

” অসভ্য বেয়াদব কত্তবড় সাহস এই হাত ছাড়।”

” এই হাত আমার ধরার কথা ছিল শুধু আমার।”

” আমি মানুষ জড়ো করবো সবাইকে ডাকবো।”

” তো ডাকো।আই ডোন্ট কেয়ার।”

খুশবু কেঁদে ফেললো নিজের হাত ছাড়াতে চাইলে রোহান তাকে টেনে নিয়ে যায়।আশেপাশে সকলেই অবাক হয়ে দেখছিল তাদের কিন্তু কেউ কোন কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি।রোহান যখন খুশবুর সাথে জোরাজোরি করছিল তখনি রোহানের গালে সশব্দে চড় পড়লো।খুশবুর হাত ছেড়ে ছিটকে দূরে সরলো সে।আরশার এক চড়ে থামলো না ক্রমশ কিল ঘুষি মারতে থাকলো রোহানকে।দাঁতের সাহায্যে ঠোঁট কেটে রোহানের রক্তাক্ত অবস্থা।খুশবু ভয় পেয়ে গেল আরশাদকে টেনে সরিয়ে আনতে সেখানে উপস্থিত হয় সিকিউরিটি গার্ড।কারো সাথে কোন কথা না বলে খুশবুকে নিয়ে সরে যায় আরশাদ।

” ও গালে দুটো চ ড় দিতে পারলে না?”

” আমি ঘাবড়ে গেছিলাম।”

” ঘাবড়ে গেছিলে?তাহলে এখন আমার গালে চড় মা রো।মা*রো মা* রো..”

আরশার খুশবুর হাত টেনে নিজের গাল চড় দিতে শুরু করে।খুশবু ভয় পেয়ে যায় হাত সরিয়ে নিতে গেলে আরশাদ বলে,

” ফ্লুজি এই ফ্লুজি হাত লাল হয়ে গেছে।খুব শক্ত করে ধরেছে তাই না?হাত দুটো ধরার অধিকার আমার তাই না?”

আরশাদের পাগলামিতে খুশবু ফোঁপাতে থাকলো।তার চুপসে যাওয়া চাহনিতে আরশাদ ধমক দিয়ে বলে,

” কি হলো বলো।এই কথা বলছো না কেন?”

” আরশাদ..”

” চলো আমার সাথে।”

খুশবুকে টেনে নিয়ে গেল আরশাদ।চারদিকে ওয়াশরুম খুঁজতে খুঁজতে তার বেহাল দশা।অবশেষে পেয়েও গেল।শুরু হলো তার পাগলামো।
আরশাদ তার ফ্লুজির হাত শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে ঘষে যাচ্ছে।হ্যান্ডওয়াশের বোতলটা শেষ পর্যায়ে তবুও চেপে চেপে পরিমানের তুলনায় বেশি হ্যান্ডওয়াশ খুশবুর হাতে মাখছে আরশাদ।ছেলেটা রাগান্বিত উত্তেজিত অথচ চোখ জুড়ে বিরাজ করছে ভয়।

” আরশাদ.. ”

” চুপ!চুপ জান।কোন কথা নয়।”

আরশাদ তার কাজে আবারো মনোনিবেশ করলো।নখের সাহায্যে চেপে চেপে খুশবুর দু’হাত পরিষ্কার করছে সে।খুশবু দু’গাল অশ্রুপাতে টইটুম্বুর।ব্যথা সইতে না পেরে হাত ঝাকরা দিয়ে সরিয়ে দিতে আরশাদ রেগে ধমক দিল।খুশবু ভয় পেয়ে ফোঁপাতে লাগলো অনুনয় স্বরে বললো,

” আরশার ব্যথা লাগছে।”

” আরেকটু জান।ময়লা ছুঁয়েছে এই হাত।এই হাত পরিষ্কার করা প্রয়োজন।”

আরশাদের এমন আক্রমণাত্নক রূপ খুশবু প্রথম সাক্ষাৎকারে দেখেছিল এতটা হিংস্র আর কখনো হয়নি আরশাদ।
হাত পরিষ্কার শেষে খুশবুর দু’গাল মুখে দিল সে।
আরশাদ আদেশ সুরে বলে

” চলো আমার সাথে।”

” আমি বাড়ি যাব আরশাদ আমার ভালো লাগছে না কিছু।”

” ভালো লাগার কোন দরকার নেই।আমার সাথে এসো।”

খুশবু যেতে চাইলো না তবুও আরশাদ তার হাত টেনে নিয়ে গেল।ছেলেটার মাথায় কি ঘুরছে কে জানে।
.
খুশবুর আতঙ্কিত ফোলা চোখ দেখে অনিমা ভয় পেলেন।দ্রুত খুশবুকে কাছে টেনে বলেন,

“কোথায় ছিলি আম্মু?তুই কেঁদেছিস কেন?”

ইমরান ইহসান আরশাদের পানে তাকালেন।তিনি ভীষণ ভয় পান আরশাদের সাথে আবার কোন ঝামেলা হয়নি তো।সবার প্রশ্নবোধক চাহনি আরশাদ বুঝতে পেরে দায়সারা ভাবে বলে,

” হারিয়ে গেছিলো বলে কান্না করেছিল।”

অনিমা অবাক হলেন খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলেন,

” ফোন করলেই তো হতো।”

” ফোনে টাকা ছিল না আম্মু।”
.
গহনা কিনতে আরশাদ কোন মতামত জানালো না।শাড়ি,জুতার ব্যপারে আরশাদ যতটা আগ্রহ দিয়েছিল গহনার ব্যপারে সে ততটাই এড়িয়ে যাচ্ছে।খুশবুর ভীষণ কান্না পেল আড়ালে বারবার চোখাচোখি করলো আরশাদের সঙ্গে।কিন্তু ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে।ইমরান আরিব এবং আফরোজ বুঝতে পারলেন দুজনের মাঝে জটিল কিছু হয়েছে আর তা না হলে আরশাদ এতটা এড়িয়ে যাবে কেন হঠাৎ?
আরিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে টেনে আনলো আরশাদকে।এবং বাধ্য করলো তার পছন্দ গহনা কিনতে।

সব শপিং শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল।সবাই রাতের ডিনার একসাথে সেরে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি।আরশাদ গাড়ি এনেছে খুশবুর পরিবারকে সে আগে ড্রপ করে দেবে অপরদিকে আরিব উবার নিয়ে চলে যাবে হ্যাঁ এমনটাই কথা হয়েছিল।

কিন্তু সব সিদ্ধান্ত ভেঙে দিলেন ইমরান ইহসান তিনি জানান এখন তিনি খুশবুদের বাড়ি যাবেন গায়ে হলুদের স্টেজ সহ অনন্য সাজসজ্জার ব্যপারে তিনি আইডিয়া দিতে চান।অনিমা বারণ করলেন না বরং প্রচন্ড খুশি হলেন।

আরিব উবার নিয়ে সবাইকে সাথে করে চলে গেল।পড়ে রইল খুশবু আর আরশাদ।তাদের যে একা করে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন ব্যপারটা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো আরশাদ।ঠোঁট বাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে খুশবুকে গাড়িতে উঠার জন্য নির্দেশ দিল।

” আরশাদ আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?এসব যে হবে আমি জানতাম না।”

” আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ফ্লুজি।আমি তো জানি তুমি যদি আমাকে ঠকাও এর পরিনাম কত ভয়াবহ হবে সেটা তুমি নিজেও আঁচ করতে পারো।”

আরশাদ নিরব হুমকি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারলো খুশবু।

” রোহান তোমাকে কি বলছিল?”

রোহানের বলা প্রতিটা কথা খুশবু তাকে জানালো।সবটা শুনে হো হো শব্দে হেসে উঠে সে।এসব কথা যেন পাত্তাই দিল আরশাদ।আরশাদ মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামায় খুশবুর হাত টেনে কাছে এনে বলে,

” তুমি ঠিক আছো মানে সব ঠিক।তুমি ঠিক নেই মানে আমার এক সেকেন্ড লাগবে যুদ্ধের ময়দান বানাতে।”

শেষোক্ত বাক্যটি বলে খুশবুর ঠোঁটে আলতো চুমুখায় আরশাদ।মেয়েটার আতঙ্কিত মুখ দেখে আরশাদ বলে,

” ভয় পাচ্ছো কেন জান?এই আরশাদ ইহসান তোমাকে ছাড়বে না।এবার তুমি ঘৃণার সঙ্গী হও নাকি ভালোবাসার সেটা তোমার ব্যপার।”
.
নিজের কাজ শেষে আরশাদ ফোন করলো রনিকে।ছেলেটাকে খুব সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললো। আরশাদের আদেশ পাওয়া দেরি অথচ রনির কাজে লেগে পড়া দেরি না।আরশাদের আদেশ মোতাবেক রনির কাজটা সম্পূর্ণ করতে লাগলো দুই ঘন্টা।আরশাদ অপেক্ষায় ছিল কখন পরিকল্পনা অনু্যায়ী কাজের ফলাফল পাবে।

কিছু মুহূর্ত পর রনি তাকে একটি ভিডিও পাঠায় যেখানে দেখা যায় হসপিটালের বেডে ভাঙা হাত নিয়ে ছটফট করছে রোহান।ছেলেটার ডান হাত রক্তাক্ত বীভৎস।আরশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।বাদামী চোখ জোড়ার চকচকে ভাবটা আরিবের নজর এড়ালো না।ভাইয়ের হঠাৎ খুশির কারন সে বুঝতে পারলো না।

আরশাদ হাসতে হাসতে চলে যায় বারান্দায়।হাতে তার জুসের গ্লাস।সুনশান আকাশের দিকে তাকিয়ে জুসে চুমুক দিয়ে সে বলে,

” আমি খারাপ ভীষণ খারাপ।তোমার জন্য যতটা খারাপ হওয়া যায় আমি ততটাই খারাপ হবো।তুমি মানো আর না মানো আমি তোমার জন্য সব করতে প্রস্তুত।”

আচমকা কাচ ভাঙার শব্দে আরিব ছুটে আসে বারান্দায় আরশাদের হাতের গ্লাসটি ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাঙা একাংশ আরশাদের হাতের মুঠোয়,তার হাত রক্তাক্ত রঞ্জিত।হাতের দিকে তাকিয়ে আরশাদের কোন ভাবাবেগ নেই।
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে