ফুলগুলো ভুল হলো পর্ব-০৮

0
154

#ফুলগুলো_ভুল_হলো – ৮

একটা সিনেমার মহরৎ অনুষ্ঠান। আলোকিত স্টেজে নায়ক, নায়িকা, পরিচালক, প্রযোজকরা কেক কাটছে। সহপ্রযোজক লোকটা নায়িকার পাশ থেকে সরছে না। কেক কেটে নায়িকার বুকের উপর দিয়ে হাত উড়িয়ে নায়কের মুখে দিলো। নায়িকা একটু বিব্রত। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেই কেক নিয়ে ওই লোকটাকে খাইয়ে দিলো। ঘনঘন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ছে। টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, সিনে ম্যাগাজিন সাংবাদিকেরা বাইট নিতে ব্যস্ত।
মঞ্চের নিচের দিকে ভীড়টা অন্য ধরনের। ব্যুফে ডিনারের আয়োজন অতিথিদের জন্য। সফেদ টেবিল রানারে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সবাই প্লেট ভরে ভরে খাবার নিয়ে খেতে ব্যস্ত। অনি এখানে ক্যামেরাম্যান সেজানের সাথে এসেছে। একজন নির্মাতার সাথে কথা বলিয়ে দেবে সেজান। বিজ্ঞাপনচিত্রে মেইন লিডের জন্য। ফটোশুটের পরে অনেক রকম অফার পেয়েছে অনি, কিন্তু একটাও মেইন রোল পায়নি। সবাই বলেছে অনির এক্টিং স্কিল ভালো না। ভালো হাইট আর ফিগার নিয়ে শুধু র‍্যাম্পেই হাঁটা যায়৷ মেইন্সট্রিম মিডিয়ায় আসা যায় না।
বেশ কতগুলো ফ্যাশন শোতে অংশ নিয়েছে অনি। লাইমলাইট পেয়েছে, শোস্টপার হিসেবেও ক্যাটওয়াক করেছে লাক্সের ফ্যাশন উইক রানওয়েতে। এখন কমার্শিয়ালে একটা ব্রেক চাই ওর। হন্যে হয়ে আছে। রাজন মানিকের সাথে সম্পর্ক ভালো হলেও, তার কাছ থেকে এক্সট্রা কোনো বেনিফিট পাওয়া যাবে না, সেটা বুঝে গিয়েছে অনি, যখন সারাদিন অসুস্থ মানুষটাকে সেবা করেও সিনেম্যাগাজিনের কাভারে ওর ছবি আসেনি! তাই সেজানকে ধরেছে ও। সেজান, রাজন মানিকের সাথেই কাজ করত। স্টিল ফটোগ্রাফিতে বেশ নাম। তারকাপাড়ায় জানাশোনাও ভালো। সিনেমাটোগ্রাফিতেও নাম করে ফেলেছে। বেশ কয়েকটা ভালো কাজ ইতিমধ্যেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে।
এখানে আজকে সেজানের ইনভাইটেশন আছে। নায়িকার ক্লোজআপ নিতে ব্যস্ত অনেকক্ষণ। সবাইই ব্যস্ত। হয় নায়িকাকে নিয়ে, নইলে খাবার নিয়ে। অনি একা একা বোর হচ্ছে। মহরৎ শেষে সংবাদ সম্মেলন। বেশ অনেকটা সময়। ও দুটো স্প্রিং রোল, একটা ক্র‍্যাবভাজা, একটুখানি চাউমিন আর একটা বাটিতে থাই স্যুপ নিয়ে বসল। সবাই কোল্ড ড্রিংকস নিচ্ছে, ও নিলো না। এখানে ডায়েট কোক নেই, দেখেছে ও। ও অবাক হয়ে খেয়াল করেছে শোবিজের লোকেরা একেবারেই ডায়েটসচেতন না, খাবার যাই হোক হামলে পড়ে, অথচ এদেরই ফিটনেস ধরে রাখা উচিত সবচেয়ে বেশি।

স্যুপ মুখে দিয়ে ইমরানকে মনে পড়ল ওর, প্রথমবার স্যুপ খেয়েছিল ইমরানের সাথে। কেমন একটা বাজে গন্ধ লেগেছিল নাকে, আর মনটাও ভালো ছিলো না তখন। ইমরানের কথা খুব একটা মনে পড়ে না এখন আর ওর, মাঝে মাঝে বিশেষ কোনো সময়ে, সময়ের তুলনা করে। এখন যেমন স্যুপে চুমুক দিয়ে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা মনে পড়ল!
এখন স্যুপ বেশ ভালো লাগে, থাই স্বাদেরটা সবচেয়ে মজা লাগে। কিন্তু এখন আবার ভালো লাগছে না। মাথায় টেনশন কাজ করছে। এত মানুষ চারিদিকে, এত এত তারকা। এই তারকাদের কারো চোখে কি ও পড়ে না? এমন হাইটের বাঙালি মেয়ে, ঘুরে একবার তো তাকানো উচিত। অনির খুব করে মনে হয় কোনো একদিন অমিতাভ রেজা চলে আসবে, অনিকে তার কোনো বিজ্ঞাপনে কাস্টিং করতে, নইলে মালেক আফসারী কোনো এক অনুষ্ঠানে ওকে দেখেই পছন্দ করে ফেলবে তার আপকামিং সিনেমার হিরোইন হিসেবে। শাকিব খানেরও তো কখনো মনে হতে পারে, অনির সাথে তার একটা হিটজুটি হবে৷ বা আফরান নিশো, তার কোনো নাটকে অনিকে নেওয়ার জন্য পরিচালককে অনুরোধ করবে। স্যুপের বাটিতে টুকটাক নাড়াচাড়া করতে করতে স্বপ্ন দেখছিল অনি।
কাজ শেষে সেজান এলো, একা একাই। কাউকে সাথে নিয়ে এলো না। অনি দ্বিধায় পড়ল ‘সেজান ভাই, আপনি একা?’
‘একা কই? তুমি তো আছ?’
‘না, সেটা বলিনি।’
‘তো, কী বলেছ? ক্র‍্যাবটা কেমন? বেশ না? টেন্ডার?’
‘ভালো।’
‘তুমি ক্র‍্যাব খাচ্ছ, দেখতে ভালো লাগছে।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে, সচরাচর মেয়েরা আরেকটু সময় নেয়, তুমি অনেক এডভান্স।’
‘ক্র‍্যাব খাচ্ছি বলে এডভান্স?’
‘ক্রেজি শোনাচ্ছে? আসলেই তাই। চিংড়ি যতটা আদর করে রান্নাঘরে ঢোকাই আমরা, জাতভাই হয়েও কাঁকড়া ঠিক ততটাই দূরে। কাঁকড়া খাওয়াটা একটা ট্যাবু এখনো। তুমি অনেক তাড়াতাড়ি এটা ভেঙেছ। বাকীগুলোও উতরে যাবে।’
‘আমি সব পারব, সেজান ভাই। আপনি শুধু একটু রাস্তাটা দেখিয়ে দেন। আজকে বলেছিলেন না, একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন?’
‘কে? মুনিম ভাই? হ্যাঁ বলেছিলাম তো! এইমাত্র এলো আর চলেও গেল। ব্যস্ত মানুষ তো!’
খাবারগুলো বিস্বাদ লাগল অনির কাছে। ‘আমি খুব আশা করেছিলাম সেজান ভাই।’
‘এভাবে কী হয় অনি রাণি? আশা তো কতজনই কতকিছুরই করে। সব আশায় কি ফল ধরে? অপেক্ষা করতে হয়। সাধনা করতে হয়। ধৈর্য রাখো।’
‘আর কত ধৈর্য রাখব বলেন? ছয় মাস হয়ে গেছে আমি র‍্যামপে হাঁটছি, এখনো একটাও কাজ পেলাম না। আমি পর্দায় আসতে চাই, সেজান ভাই, প্লিজ!’
‘অনি, তুমি অনেককিছু বোঝো না, অস্থির হও শুধু। হবে আস্তে আস্তে। মানুষ ছয় বছর ঘুরেও একটা চান্স পায় না। আচ্ছা যাও, সামনের সপ্তাহে আমি অরণ্য স্যারের অফিসে যাবো, ওনাকে নিয়ে একটা ফটোফিচার করতে, তখন তোমার কথা বলব।’
‘সত্যি? থ্যাঙ্কিউ সেজান ভাই।’
‘আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি এটা কি জানো?’ ফিসফিস করে বলে সেজান।
‘জানি।’
‘কচু জানো!’ হাসে সেজান।
অনিরও ভালো লাগে সেজানকে। খুব গুরুত্ব দেয় ওকে। ফটোশুটের পরে প্রথম র‍্যাম্পে হেঁটেছিল সেজানের রেফারেন্সে। লাক্স সামার উইকলির মতো বড় শোয়ে। সেই শোটার স্পেশাল কয়েকটা ছবি ও তুলে দিয়েছিল। ডানদিক থেকে কপালে ফোকাস করলে অনির ছবিগুলো খুব আবেদনময়ী হয়, এটা ওই আবিস্কার করেছে।
শোয়ের আগেপরে দুজন একসাথে থাকে, মনে হয় কাপল। অনিকে নিয়ে বেশ পজেসিভও দেখা যায় সেজানকে। রাতে ট্যাক্সি ডেকে নিজেই পৌঁছে দেয় অনিকে। অনির নিরাপত্তার জন্য ভালো হলেও সুমনার অগ্নিদৃষ্টির সামনে ভষ্ম হতে যথেষ্ট এটা। আর একবার দুবার না প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা এটা। নিত্যদিনই সুমনা গজগজ করেন, রেগে যান একেবারে ‘রাত কয়টা বাজে, অনি? ভদ্রলোকের মেয়েরা এইসময় বাড়ি ফেরে?’

*****

উবারে করে ফেরার সময় আজকে ফেরার রাস্তা দেখে বুঝল ওরা বাসায় যাচ্ছে না। অনি সেজানকে জিজ্ঞাসা করল ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘কেন? আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে?’
‘না, তা না। জানতে চাইছি। আর দেরি হলে মা ভীষণ বকে তো!’
‘শিল্পিদের ঘর সংসার থাকতে নেই এইজন্য। এখন তুমি যদি নায়িকা হয়ে যাও, ধরো ইদের আগে আগে। ইদে মুক্তি পাবে যে ছবি তিন শিফটেও সেটার কাজ শেষ করতে পারো নি। লেট নাইট শিফটেও কাজ করতে হবে, তখন? তখন যদি মা বকার ভয় করো তবে শোবিজে আসাই উচিত হয়নি তোমার।’ একটু যেন রেগে যায় সেজান। নাকি পার্টিশেষে এলকোহলের প্রভাব?
উবারের গাড়ি এসে থামে সেজানের বাসার সামনে।
অনি একটু যেন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এখানে কেন সেজান ভাই?’
‘অনি, অনেক কিছুই বোঝো না তুমি। কম দিন হয়নি কাজ করছ। এমন ন্যাকা ন্যাকা কথা কেন বলো?’
‘মানে?’
‘আই নিড আ মোমেন্ট, আই ওয়ান্ট টু ফিল ইউ!’
সেজানের চোখ নরম হয়ে এসেছে, কন্ঠে আকুতি।
অনি শক্ত হয়ে যায়। ‘না।’
‘না মানে কি? অনি আই লাভ ইউ! প্লিজ।’
ভাড়ার গাড়িটা বেরিয়ে গেল হুশ করে। এগারোটা বাজে ঘড়ির কাঁটায়। অনির ভয় করতে লাগল।
‘অনি, অনি, প্লিজ, আজকের রাতটা শুধু প্লিজ! আই নিড ইউ!’ আড়ষ্ট হয়ে আসা অনির হাত ধরে টানল সেজান ‘প্লিজ, অনি সিন কোরো না, আবাসিক এলাকা।’
অনি আরও শক্ত হয়ে যায়।
সেজান রেগে যায় এবার। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে ‘ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবেই কাজ হয় অনি। কাজ পেতে এটাই করতে হবে তোমাকে। আজকে আমার সাথে শুতে হবে কালকে কোনো প্রডিউসারের সাথে। আর যদি টেন্ডার চিকপিক হও তো ইটস নট ইওর প্লেস বেইবি। তুমি ঘরে বসে সীতা-সাবিত্রি নইলে শাবানা আপার সিনেমা দেখবে আর চোখের পানি ফেলবে। ক্যামেরাম্যান হচ্ছে এই ইন্ডাস্ট্রির ভগবান। সে চাইলে তোমার ক্যারিয়ার তৈরি করে দিতে পারে নইলে ছুঁড়ে আছাড় মারতে পারে। এমনও হতে পারে, তোমার আমার টিম একটা দারুণ ক্লিক করল, আমরা একের পর এক কাজ সাইন করতে লাগলাম!’ আবারও মিনতি করে সেজান ‘প্লিজ অনি, চলো? লাভ ইউ, জান!’
অনির চোখে পানি এলো না। শুধু ফোঁপাতে থাকল অপমানে। ধপ করে বসে পড়ল গ্যারেজের মেঝেতে। ওর মনে পড়ল পরশ কথা নিয়েছিল ওর কাছ থেকে, কখনো লোভ করবে না!
বিড়বিড় করে বলল ও ‘অসম্ভব!’
‘এখন চলো। অরণ্য স্যারের অফিসে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাব আমি। প্লিজ!’
অনি পিছু হটতে শুরু করে। বেরিয়ে আসতে চায়। সেজান গলা উঁচু করে ‘কোথাও কাজ পাবে না তুমি, কোথাও যেন কাজ না পাও, সেই ব্যবস্থাই করব আমি। অনি ভুল করছ তুমি।’
দৌড়ে বেরিয়ে আসে অনি।

রাত অনেক। মানুষের চলাচল আছে তবুও নিরাপত্তার অভাব। মানুষের কাছ থেকেই তো ভয়। মানুষের বেশে, মুখোশের আড়ালে কে আছে চেনা বড় দায়।
সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরতে দেরিই হলো ওর। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই সুমনার রোষের মুখে পড়ল, ‘রাত কয়টা বাজে অনি? এসব আর কতদিন চলবে?’
‘নতুন কথা বলো, মা।’ অনিকে ক্লান্ত দেখায়।
‘এইগুলো কেমন জামাকাপড়? এইগুলো পরে রাতবিরাতে পুরুষ মানুষের সাথে বাড়ি ফিরলে ছিঃছিৎকার পড়ে যাবে না?’ অনি একটা লো কাট গাউন পরা। এতেই সুমনা ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন। অন্য সময় র‍্যাম্পে হাঁটার ড্রেসগুলো তো ডিজাইনারকে ফিরিয়ে দিয়েই আসতে হয়, স্পনসর করা জামা সেগুলো৷ আজ তো পার্টি ছিলো। পার্টির জামা নিজের কেনা। তাই ওগুলো কাউকে দিয়ে আসার দরকার হয় না।
‘মা, আমি শাওয়ার নেবো প্লিজ!’ অনি পাত্তা দেয় না সুমনার কথা বা রাগ কোনোটাকেই।
অনির পথ আটকান সুমনা। আজ এর দফারফা হতেই হবে। ‘খবরদার তুই আমার ঘরে ঢুকবি না। নিজে তো নষ্ট হইছিস, ছোটোটারেও নষ্ট করবি?’ এরপর ছেলেকে ডাকলেন চিৎকার করে, ‘পরশ, এদিকে আয়।’
পরশের ঘুম আসছিল না, ও অনির ফেরার অপেক্ষা করছিল। বারবার ফোনে ট্রাই করে পাচ্ছিল না। নিজেও অনিকে বকুনি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সুমনা ওকে দেখেই চিৎকার করলেন, ‘আজকে এই মেয়ে প্রতিজ্ঞা করবে, ও আর এইসব করবে না, নইলে আমি ওকে এই ঘরে ঢুকতে দেব না।’ বলেই দুই হাত দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে ব্যারিকেড দিলেন।
‘অনেক রাত হইছে, মা।’ পরশের কথায় সুমনা আরও জ্বলে উঠলেন ‘হ্যাঁ, এতরাতে কারা বাড়ি ফেরে জানো? আমি ওকে ঘরে ঢুকতে দেবো না। ও ঢুকলে আমি বেরিয়ে যাব।’
‘আহ মা, এখন মানুষ শুনছে না?’
‘শুনুক। শুনতে কেউ বাকি নেই আর।’
এই বাকবিতন্ডা নেওয়ার মতো মানসিকতা অনির আর নেই, সেজানের সাথে ঘটা ঘটনাটার পরে আরো নেই। ধৈর্যচ্যুতি ঘটল ওর, ‘মা, তুমি থামবা? কাল সকালেই চলে যাবো আমি।’
‘আহ অনি? তুই ও তো কথা বাড়াচ্ছিস!’ পরশের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমনা বললেন, ‘কাল সকাল আবার কী, এখন বের হবি তুই?’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুমনা বসে পড়লেন মেঝেতে। হাই প্রেশার আছে তার। সিচুয়েশন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে কীনা ভেবে পরশ তাড়াতাড়ি বলল ‘ঠিকই তো অনি, তোকে সবরকম সাপোর্ট দিই, তাও তুই কথা শুনিস না। তোর জন্য আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না। বেরো তুই ঘর থেকে?’ মা কে সামলাতে গিয়ে অনির কোথায় আঘাত করল পরশ, তা ও বুঝল না।
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলো অনি, এখন খেই হারালো। পরশও ওকে ভুল বুঝল?
গুটি গুটি পায়ে ও নেমে গেল রাস্তায়।
সুমনাকে ঠান্ডা করে পরশ অনিকে খুঁজতে বেরোলো। ও ভেবেছিলো হয়তো ছাদে বা নিচে গ্যারেজে বসে থাকবে। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলেই ডেকে নিয়ে আসবে। কিন্তু অনি কোথাও নেই। রাস্তার মাথায় গিয়ে পরশ ক্রমাগত ফোন দিতে থাকল। অনির ফোন সুইচড অফ আসছে। পরশের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো! অভিমানী অনি কোথায়, কী বিপদ ঘটিয়ে দিলো আবার!
রাত তিনটের সময় টালমাটাল পায়ে রাজন মানিকের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল অনিকে। টুক টুক করে নক করল। রাজন মানিক তখনো কাজ করছেন। রাত জেগে কাজ করা তার নেশা, দিনে পড়ে পড়ে ঘুমোন। দরজা খুলতেই অনি কাতর হয়ে বলল ‘আমাকে থাকতে দেবেন এখানে, প্লিজ?’

*****
তিন বছর পরের এক দিন

‘হ্যালো রোজবাড!’
‘আপনার কি ভুল হচ্ছে কোথাও?’
‘কোথায়? একটা কথাও তো এখনো বলিনি। ভুল কোথায় হলো?’
‘হুম! ঐ একটা কথাই ভুল বলেছেন, মনে হচ্ছে না? ইটস নট আ রোজবাড নাউ, ইটস আ ব্লুমিং ফ্লাওয়ার উইথ অল ইটস বিউটি স্প্রেডিং!’ দুই হাত মাথার দুপাশে দুলিয়ে চোখ নাচায় অনি।

নিচের ঠোঁটটা উপরে তুলে মাথা নাড়ালেন রাজন মানিক। ‘রাইট। রাইট ইউ আর৷ একইসাথে এপিয়ারেন্সএও চেঞ্জ আসছে। এটিটিউড চেঞ্জ হয়ে গেছে। জেসচার বদলে গেছে। এমনকি ভাষাও!’
‘এটা স্ক্রিপ্ট থেকে মেরে দিয়েছি, হাহাহা।’ জোরে হাসল অনি। আশাপাশের মানুষজন তাকালো। লোকের এটেনশন কীভাবে নিতে হয় সেটাও এখন ভালোমতোই জানে অনি।
‘তো! কী শুনছি এসব? সত্যি?’
‘আপনি কী শুনেছেন বা শুনছেন, সেটা সত্যি নাকি মিথ্যা আমি কী করে বলব?’ লাস্যময়ী হাসল অনি।
‘তাও ঠিক। তোমার বুদ্ধিতে আমি চমৎকৃত!’
অনি হাসল শুধু, উত্তর করল না।

রাজন মানিক বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন ‘আবরার এর সাথে নাকি তোমাকে দেখা যাচ্ছে? অনেকেই ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছে তোমাদেরকে। বেশ কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু।’
‘যারা বলছে তারা জানে, তারাই ভালো বলতে পারবে। এখন তারা কী দেখেছে, তাদের চোখ জানে। তাদের চোখের দেখাটা আমি কীভাবে দেখি বলুন?’
‘রাইট। এবসলিউটলি রাইট ইউ আর!’ ঠোঁট চেপে থাম্বস দেখালেন রাজন মানিক। তারপর আরো দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘কিন্তু, কথাগুলো আমার কানে এসেছে মানে, কিছু একটা ব্যাপারে আছে। সেটা কি তুমি অস্বীকার করতে চাও?’
‘না। একদম না। কে বলেছে আমি অস্বীকার করছি?’
‘এসব কেন করছ অনি? তোমার একটা সুন্দর পরিবার আছে। তারা তোমাকে ভালোবাসে।’
‘আমিও তো একজনকে ভালোবাসতে চেয়েছি। সে আমাকে কেন ফিরিয়ে দেয়?’
‘তুমি অনেক ছোটো অনি। বুঝতে চেষ্টা করো!’
‘অনেক বুঝি আমি এখন। এটাও বুঝি, পুরো ইন্ডাস্ট্রি জুড়েই কাস্টিং কাউচ মাথা উঁচু করে আছে। এখানে টিকতে গেলে আমাকে কমপ্রোমাইজ করতেই হবে। কাজ পেতে গেলে লোকের মনোরঞ্জন করতে হবে।’
‘কে বলে এগুলো? যেকোনো কাজ একমপ্লিশ করার জন্য শুধুমাত্র দুটো পদ্ধতি আছে। একটা সঠিক আর একটা ভুল। সঠিক যে রাস্তাটা সেটাতে হাঁটতে গেলে লাগে পরিশ্রম, ধৈর্য আর অধ্যবসায়। আর ভুল রাস্তাটা শর্টকাট, যেটা অলস আর অকর্মণ্যদের জন্য, তারাই সুবিধা খুঁজে বেড়ায় আর তাই এইসব দুর্নীতিবাজদের দেখাও তাদের সাথেই মেলে। বহু লোক আছে শোবিজে, ইনফ্যাক্ট তারাই সংখ্যাতে বেশি যারা মেধা আর পরিশ্রম দিয়েই সাফল্যের চূড়ায় উঠে গেছে। আর আবরারের অনেক বদনাম ইন্ড্রাস্টিতে, জানো তুমি?’
‘তো? তার বদনাম সেটা সে জানবে, সে বুঝবে। আমি জেনে কী করব?’ রাজন মানিকের বাকি কথাগুলো কোনোটাই ধর্তব্যর ভেতর নিলো না অনি।
‘যার তার সাথে শুয়ে এভাবে কাজ নেবে?’ ক্ষেপে গেছেন রাজন মানিক।
‘শুয়েই যখন কাজ পেতে হবে, তো আপনার কোরিওগ্রাফার সেজান কেন, আমি আবরারের সাথেই শোবো। আফটার অল, টপ হিরো এখন!
‘তুমি বুঝছ না অনি!’ অসহিষ্ণু হলেন রাজন মানিক
‘আপনিও তো বুঝছেন না!’
‘আবার সেই কথা! আমি তোমার থেকে কত বড় অনি!
‘কেয়া কারু রাম, মুঝে বুঢঢা মিল গ্যায়া!’ মাথা চাপড়ে হেঁয়ালি করে অনি।
‘তুমি ভুল করছ। অনেক পস্তাতে হবে। প্লিজ, ফিরে যাও।
‘ভুল। আমি জানি সব ভুল। ফুলগুলো সব ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে যায়, ভুল হয়েই থাকে। কিন্তু ফেরার পথ তো নেই। পথ আছে কীনা খোঁজার ইচ্ছেও নেই।’ উদাস হয় অনি, তারপর গ্লাসের লেমোনেড নেড়ে চুমুক দেয় একটু একটু করে বারচারেক। আস্তে করে বলে ‘আপনি চাইলেই পথ তৈরি করে দিতে পারেন। সেই পথেই ফিরব আমি। তবে আমার সাথে আপনারকেও হাঁটতে হবে আমার হাতটা ধরে। ধরবেন, আমার হাতটা?’ হাতটা বাড়িয়ে দেয় অনি।

রাজন মানিক হাতটা ধরলেন না। ‘পরশ বারবার আসে আর তুমি ফিরিয়ে দাও। ছায়ার মতো তোমার সাথে থাকে সবসময়। এমন ভাই হয় না, অনি। স্বার্থের এই পৃথিবীটাতে এমন ছায়া পাওয়া খুব শক্ত, অসম্ভবই এখন। আর সেই কোন তিন বছর আগে মুখ ফসকে কী না কি একটা কথা বলার অপরাধে সে খুবই অনুতপ্ত।’
অনি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়, ‘আজ অনুতাপ করে লাভ নেই, স্যার। সেদিন তাদেরকে আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো। তারা আমাকে গলাধাক্কা দিয়েছে। বারবার, বারবার তারা আমাকে নিয়ে খেলবে, আমাকে নিয়ে ছেলেখেলা করবে, এমন তো হয় না।’
‘ওরা কীভাবে জানবে, সেদিন কী হয়েছিল?’
‘জানার দরকার পড়ে না। জানতে হয় না সবকিছু। কখনো কখনো কিছু না জেনেও শুধু সাপোর্ট করে যেতে হয়। যেমন আপনি সাপোর্ট হয়েছিলেন সেদিন রাতে। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিয়েছিলেন আমার সামনে।’
‘তুমি আমার কেউ ছিলে না অনি, তোমার জন্য কোনো দায়িত্ববোধ ছিলো না, আমার জন্য সহজ ছিল, একটা অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া।’
‘ওয়েট ওয়েট, তখন কেউ ছিলাম না, এখন বুঝি কেউ?’ দুষ্টু হাসি অনির চোখ আর ঠোঁটজুড়ে।
রাজন মানিক অনির কথায় বিভ্রান্ত হলেন না, ‘তিনটে বছর চলে গেছে মাঝখান দিয়ে।
‘হ্যাঁ। তো?’
‘এখন তো ফ্যামিলির কাছে ফিরে যাও।’
‘আমি না আপনাকে আর নিতে পারছি না। যাস্ট নিতে পারছি না। তিনটে বছর একটা বড় কাজ পেলাম না। অথচ আপনি লোকটা একবার কাভারে এনে ফেললেই, আমার আর কষ্ট করে আবরারের টায়ার্ডনেস দূর করতে যেতে হয় না।’
‘আমি তো প্রফেশনের সাথে কম্প্রোমাইজ করব না, অনি। তা তো তুমি জানো।’
‘হ্যাঁ জানি। জানি বলেই নিজের উপায় নিজে খুঁজি। আপনার ফেভার চাইছি না। একেবারেই ভুলে গেছি সেটা, বিশ্বাস করেন। কিন্তু আপনাকে আমার চাই। এই জন্মেই চাই। কাভার ফাভার সব ভুলে যাব, শুধু রাজন মানিক লোকটাকে দিয়ে দিন আমাকে।
‘একদিন খুব পাগলামি মনে হবে এসব!
‘পাগলামি করেছিলাম ভেবে খুব একচোট হাসব! প্লিজ!’
‘অনি? অনেক কথা হয়েছে। তুমি জেদি ঘোড়ার মতো ঘাড় ফুলিয়ে বসে আছো। বেশ, তুমি চুলোয় যাও, তোমার মা, ভাই গোল্লায় যাক। আমি আর কোনো উপদেশ দিতে আসব না। আমার উপদেশের তুমি থোড়াই কেয়ার করো!
‘শুধু আপনাকেই তো কেয়ার করি, মেরে জান!’ বলতে বলতে অনির মোবাইলে মেসেজ নোটিফিকেশন বাজল টুং করে। মেসেজটা দেখে অনি হেসে উঠল।
রাজন জিজ্ঞেস করলেন ‘কী ব্যাপার হাসছ যে?’
‘আমার মনে হচ্ছে আজকের মতো আমাদের আলোচনা পর্ব সমাপ্ত হইয়াছে। আমাকে এখন উঠতে হবে। নায়ক সাহেব গাড়ি পাঠাচ্ছে। গাজিপুর শুটিং লোকেশনে তার নাকি খুব একা একা লাগছে!’ চোখ টিপে দেয় অনি।

অনি চলে যাওয়ার পর পুরো সন্ধ্যেটা ওখানেই কাটিয়ে দেন রাজন মানিক, যতক্ষণ না রেস্তোরার ওয়েটাররা এসে, বিনীতভাবে উঠে যেতে অনুরোধ করে বলল, তাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে।

*****

অনি আবরারের কাছে যায় না। সোজা নিজের বাসায় চলে আসে। বিছানার উপর শরীরটা ছেড়ে দেয়। চার সংখ্যাটাকে অনি নিজে যেমন ছাড়তে পারে না, চার নিজেও অনিকে ঘিরে রাখে। অনির এইটুকু জীবনে পুরুষও চারজন, সে লম্পট হয়েই আসুক বা প্রেমিক হতে। ইমরান পেয়েছিল অনির অধিকার, কিন্তু সে অনিকে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিলো। তারপর সেজান, হয়তো লোকটা খুব তাড়াহুড়ো না করলে অনির জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ হতে পারত। অনেকগুলো ভালো মূহুর্ত আছে দুজনের, যা এখন শুধুই তিক্ত স্মৃতি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি দ্বিগুণ বয়সী রাজন মানিক মানুষটাকে তীব্রভাবে চায় অনি। সে যতবার ফিরিয়ে দেয়, প্রত্যাখ্যান করে, অনি ততবার ফিরে যায়। কারণ তার প্রত্যাখ্যানে অপমান নেই, অপারগতা আছে শুধু। লোকটা ভালোবাসায় ভয় পায়, ভালোবাসতে ভয় পায়, অনির ছেলেমানুষীকে ভয় পায়। অনির পাশে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে থেকে যেতে চায়। আর চতুর্থজন আবরার!
শোয়া থেকে উঠে বসে আঙুলগুলো চারবার করে মটকে নিলো ও তারপর হাসল। চোখের সামনে টিভি পর্দার মতো ভেসে আসলো দৃশ্যগুলো। অনি নামের সতেরো বছরের মেয়েটা রাজন মানিকের বুকে আছড়ে পড়েছে নিজের সবটুকু আবেগ নিয়ে।
‘ছিঃ অনি, সামনে পুরো জীবনটা আছে, পাগলামি করে না।
‘পাগলামি করব, আপনি সামলে নেবেন আমাকে।’
‘এভাবে হয় না। এটা ভালোবাসা না।
‘তবে কী?
‘তোমাকে সেদিন আশ্রয় দিয়েছিলাম বলে তোমার কৃতজ্ঞতাবোধ আমার প্রতি, যেটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল হচ্ছে তোমার।
‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি ভুল করছি?
‘অনি, তোমার ভাই বারবার আসছে তোমাকে নিতে। তুমি চলে যাও?’ কঠিন হয় রাজন মানিকের গলা
‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। যাব না। যাব না। যাব না! ওদের কাছে ফিরে গেলে সবার আগে আপনাকেই ছাড়তে হবে আমাকে। সেই শর্তই সামনে রাখবে ওরা। আমার মন কোনোদিন বুঝবে না, আমি জানি।’
‘খুব বেশি নিচে নেমো না, অনি। আমাকে কোনো প্রলোভনেই ভুলিয়ে তুমি আমার ম্যাগাজিনের কাভারে আসতে পারবে না। আমার অনেক দোষ আছে, কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ে সিডিউস করবে আর আমি তার আঙুলে নাচব বা নাচাবো এমন দোষ নেই।’
স্মৃতির পুরোনো পথ হেঁটে বর্তমানে ফেরে অনি। বিছানা থেকে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে নামে।
‘তুমি দেখো, রাজন মানিক। বুড়ো লোকটা। আমি অতটাই নামব, যেখান থেকে টেনে তোলা যায়। আর আমাকে টেনে তুলতে হলে তোমাকে হাতটা বাড়াতেই হবে।’ আপনমনে হাসে অনি। আবার পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। খুব আবেগের মূহুর্তে একদিন নিজের গায়ের টিশার্টটা খুলে ফেলেছিলেন রাজন মানিক। বিস্ফারিত চোখে অনি দেখেছিল একটা পোড়া মাংসের শরীর। পৃথিবীর কুৎসিততম দৃশ্য। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছিল ও। অনির মাথায় বিলি কাটতে কাটতে রাজন মানিক বলেছিলেন ‘বাড়িতে হিটারে রান্না হতো। কত বয়স আমার, দশ এগারো হবে। সকালের কাজ শেষ করে মা ঘরে গিয়ে শুয়েছে। হিটারের তার খুলতে ভুলে গেছে। আমি আমার ছোটো ফুটবল নিয়ে খেলছি একা একা। একটা লাথি দিয়েছি বলে। একটু জোরেই মনে হয়। বলটা চলে গেছে হিটারের কাছে। বলটা ড্রিম্বলিং করতে গিয়ে হাত পড়ল হিটারের তারে। কোথাও একটা লিকেজ ছিলো, শক লাগল। হাই ভোল্টেজ ইলেক্ট্রিসিটি ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো গনগনে হিটারের উপর। আমি চিৎকার করতে পেরেছিলাম কীনা মনে নেই আমার। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। তিনমাস হাসপাতালে ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরলাম, একটা পোড়া শরীর নিয়ে, বিভৎস দেহ নিয়ে।’
একটু থেমে রাজন মানিক ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন করিডোরের সাদামাটা ফ্রেমগুলোর সামনে। ফ্রেমের ছবিগুলোর মেয়েটির মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন ‘আমরা প্রেম করেছিলাম। ভালোবাসা হয়েছিল কীনা জানি না। প্রেম করেছিলাম। আমি তখন চাকরি করি। ফার্মাসিউটিক্যালসে। বেশ ভালো স্যালারি। বাড়ি থেকে বিয়েটা মেনে নিলো। ঘটা করে বিয়ে হলো আমাদের। রাতের খুব অন্তরঙ্গ মূহুর্তে, আমার পিঠে হাত দিয়ে আঁতকে উঠল ও। তারপর সারারাত কাঁদল। ওর মনে হচ্ছিল ও প্রতারিত হয়েছে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইনসিডেন্টটা ওকে আমি জানাইনি। হ্যাঁ। কথাটাতে কোনো ভুল ছিলাম না। আমি লুকিয়েছিলাম, জেনেবুঝে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম সত্যটাকে। ভয় হতো, ওকে যদি না পাই! কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম কই? তিনটে দিন অবিশ্রান্ত কাঁদল ও। তারপর বৌভাত অনুষ্ঠানের পর ফিরানিতে চলে গেল। আমারও মনে হোলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এতটা অপরাধবোধ আর গ্লানি আর নিতে পারছিলাম না। ষোলোদিনের মাথায় ডিভোর্স লেটার এলো। তার তিনমাস পরে খবর পেলাম আবার বিয়ে করেছে ও। শখ করে ক্যামেরা কেনা ছিলো, শখেই ছবি তুলতাম। শুধুমাত্র ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।’

অনি সেদিন হুহু করে কেঁদেছিল। আজও কাঁদছে। একটা মানুষ, যার জীবনটা একেবারে অনির মতো। অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ। অপূর্ণতাগুলো প্রেমে ভরপুর করে দিতে চায় ও। বয়স মানে না, সমাজ মানে না, প্রতিবন্ধকতাগুলোকেও আমলে নেয় না। কী হয়, সব বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেয় একটা জীবন যদি বাঁচা যায়!
কতবার ফেরাবে ওকে রাজন মানিক? কান্না ভুলে হাসে অনি। তারপর ঘুরে ঘুরে নাচে আর গান ধরে –

“যখন এসেছিলে, যখন এসেছিল
অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপার
চাঁদ ওঠে নি
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিল
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম
অনুভবে জেনেছিলেম
হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলে
অনুভবে জেনেছিলেম
প্রাণে তোমার পরশখানি বেজেছিল গানের তার
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে
তুমি গেলে যখন একলা চলে, চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে
চাঁদ উঠেছে
তুমি গেলে যখন
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার
পড়ে আছে মালা তোমার
তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার
পড়ে আছে মালা তোমার
বুঝেছিলেম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে
অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে
চাঁদ ওঠে নি
যখন এসেছিলে, যখন এসেছিলে

চলবে
Afsana Asha

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে