ফুলগুলো ভুল হলো পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
165

#ফুলগুলো_ভুল_হলো – ১৫
শেষ পর্ব

সাউথ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ফেস অফ এশিয়া ফেস্টিভ্যালটি এখন এশিয়া মহাদেশের পপ কালচার ও আর্ট ইন্ডাস্ট্রির কী আইকন হিসেবে পরিচিত । বিশ্বমঞ্চে এশিয়ান মডেল, ফ্যাশন ও বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে উপস্থাপন করতে এই প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যে নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ফেস অফ এশিয়া খেতাব নিয়ে সিউল জয় করে আসলেন বাংলাদেশি মডেল অনামিকা। আজকের বিনোদন পাতায় থাকছে তার এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার। সাথে আছেন রিয়াদ আরেফিন।
‘প্রতিযোগিতার গালা রাউন্ডে নিজের নাম দেখে কেমন লেগেছিল?’
‘আসলে আমি ভাবতেও পারিনি। মোট দেড়শো জন প্রতিযোগী ছিলাম আমরা, বিভিন্ন দেশের। সেরা দশ জনে নিজের নাম যখন দেখলাম বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না। আমার নামের পাশে যখন বাংলাদেশ শব্দটা ভেসে আসলো খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। আমার এই অর্জন দেশের সবার অর্জন।’
‘তারপর যখন সেরাদের কাতারে সেরা হলেন তখন কেমন লাগল? কেমন লাগছে এশিয়ার সেরা নারী মডেল খেতাবধারী হয়ে?’
‘এটা যে কী গৌরবের আর কী আনন্দের এটা আমি বোঝাতে পারব না কাউকে। সেরা মডেল হিসেবে না, আমি যে আমাকে, আমার কাজকে, আমার দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রিপ্রেজেন্ট করতে পেরেছি এটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
‘তো অনামিকা, এরকম বড়ো মঞ্চে জিতে আসার পরে আমরা কবে আপনাকে বড়ো পর্দায় দেখতে পাচ্ছি? চলচ্চিত্রে কবে অভিষেক হচ্ছে আপনার?’
একটুখানি হাসি, ‘না না না। বড়পর্দা না। এখনই না। ওটা স্বপ্নের জায়গা। ওখানে যেতে আরও কিছু প্রস্তুতি দরকার। আর র‍্যাম্পই আমার প্রিয় জায়গা। আপাতত প্রডাক্ট প্রমোশনাল বা ব্রান্ড এম্বাসেডর হয়েই কাজ করতে চাই। এখানেই আমি কম্ফোর্টেবল।’
‘কতগুলো ব্রান্ডের মডেল হয়ে কাজ করেছেন এপর্যন্ত?’
‘আমার চার সংখ্যাটার প্রতি একটু দুর্বলতা আছে। এক সাথে চারটার বেশি কাজ নিতে পারি না। তাই এখন পর্যন্ত চারটা টপ ইন্টারন্যাশনাল ব্র‍্যান্ডের সাথেই চুক্তিবদ্ধ আছি।’
‘এটা বাড়বে না? আর কাজ করতে চান না?’
‘না বাড়বে। বেড়ে আটটা হবে বা ষোলোটা।’ হেসে ওঠেন অনামিকা।
‘কাকে আইডল মানেন?’
‘সাদিয়া ইসলাম মৌ। মৌ আপুকেই দেখে এসেছি ছোটোবেলা থেকে। যখন ভেবেছি মডেল হতে চাই, সেদিন থেকে এই নামটাই শুধু সামনে ছিল।’
‘মডেলিংয়ে পরিবার থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন কে?’
‘কেউ না। ভাইয়া সাথে ছিলেন সবসময়ই, তাকে পাশে পেয়েছি সবকিছুতেই, কিন্তু উৎসাহ বলতে যেটা বোঝায় সেটা কেউই দেননি। খুব কঠিন ছিল আমার এই প্রফেশনে আসাটা।’
‘পরিবারের বিরুদ্ধে এসে ক্যারিয়ার হিসেবে মডেলিংকে বেছে নিলেন কেন? কতোটা নির্ভরযোগ্য এই পেশা?’
‘বর্তমানে নিয়মিত শো করছেন, এমন পেশাদার র‍্যাম্প মডেলের সংখ্যা শতাধিক। একজন প্রথম সারির মডেল মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করেন র‍্যাম্প শো থেকে।
তাছাড়া জনপ্রিয়তা, খ্যাতি, যশ, ভক্ত এগুলোতো আছেই, এসবও খুবই উপভোগ্য।’
‘আর স্ক্যান্ডাল?’
‘স্ক্যান্ডাল তো স্ক্যান্ডালই!’
‘বাংলাদেশের বিনোদন জগতে অনামিকা নামটা পরিচিত হয়ে উঠছে। কিন্তু এই নামটার সাথে সাথেই উঠে আসে আরেকটা সুপরিচিত নাম। বিনোদন সাংবাদিক ও ফ্যাশন ফটোগ্রাফার রাজন মানিক। আপনাকে আর রাজন মানিককে জড়িয়ে মিডিয়াতে বেশ সরগরম গুজব আছে। এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখছেন এশিয়ার সেরা নারী মডেল অনামিকা?’
হেসে হেসে, ‘আপনিই তো বললেন গুজব৷ তো গুজব নিয়ে আমি আর কী বলব?’
‘মানে রাজন মানিক আর আপনার সম্পর্কে, আপনাদেরকে জড়িয়ে যা যা শোনা যায় সবটাই গুজব?’
‘না না। সবটা কেন গুজব হবে। আমার আজকের অনামিকা হওয়ার পেছনে ওনার অনেক অবদান আছে। আমাকে গ্রুমিং করা, পোর্টফোলিও তৈরি করে দেওয়া, আমার লুকচেঞ্জ করা, অনুপ্রেরণা দেওয়া, মোটিভেট করা – তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। আমার মেন্টর উনি!’
‘সেটা তো উনি অন্য অনেক তারকার জন্যই করেন। এর বাইরে আলাদা করে ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই বলছেন?’
‘আমি ওনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। আমার দেখা সেরা মানুষ উনি, আমার সেরা বন্ধু যিনি পাশে থাকলে জীবনটা সুন্দর মনে হয়। এই তো! ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য এগুলোই যথেষ্ট নয় কী?’
‘মডেল অনামিকার ব্যক্তিগত জীবনের ছোটো ছোটো খবরও তার ভক্তদের কাছে অনেক বড় সংবাদ। জানতে চাইছি কোন পোশাকে স্বচ্ছন্দ?’
‘দেশি পোশাকে ফিউশন ভালো লাগে। শাড়ির সাথে ব্লাউজ এবং জুয়েলারি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালো লাগে। ওয়েস্টার্ন অনেক কম্ফোর্টেবল। ক্যাজুয়াল আউটফিট বেশি পছন্দ করি।’
‘কী খেতে পছন্দ করেন? ডায়েট চার্ট?’
‘না না। নির্দিষ্ট কিছু মেনে চলি না। খুব বেশি নিয়ম টিয়ম ভালো লাগে না। ইচ্ছে হলেই বেগুন ভাজা, মৌরলা মাছ, আর গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে ফেলি, পরের বেলায় হয়তো শাক সেদ্ধ। স্পাইসি খাবার পছন্দ করি। আমার মায়ের হাতের রান্না সব খাবার ভালো লাগে। মা খুব ভালো ডেজার্ট করেন কিন্তু খুব অল্প খেতে হয়। আইসক্রিম আর চকলেটকে না করতে পারি না।’
‘হাজার তরুণের স্বপ্নের নায়িকা অনামিকা, বিয়ে করছেন কবে?’
‘হিহিহি। এখনই ভাবছি না এসব নিয়ে। আগামী চার বছর ভাবব না। আগে কিছু কাজ করি।’
‘মিডিয়াতে আরেকটা জোরগুজব আছে যে আপনি বিবাহিতা। এমনকি একজন হাইপ্রাফাইলড কর্পোরেট কর্মকর্তার সাথে আপনার বিয়ের বেশ বড়সড় গুঞ্জন আছে।’
‘দেখুন গুজব তো গুজবই। আমি কী করতে পারি এখানে? আর একজন মডেল বা নায়িকার এরকম স্বামী পরিচয় দেওয়ার লোকের অভাব নেই কিন্তু। আমার আগের সাকসেসফুল হিরোইন বা মডেলদের সবার জীবনেই এরকম উটকো লোক থাকেই। এখানে আমার কিছু বলার নেই।’
‘প্রচুর ভক্ত অনুরাগী এখন অনামিকার। তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।’
‘ছেলে বা মেয়ে সবারই স্বাবলম্বী হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। তবেই নিজেদের হ্যাপি রাখতে পারব আর পরিবার বা কাছের মানুষদেরকেও হ্যাপি করতে পারব। অন্যের উপর নির্ভরশীল হলে নিজের খুশিটা ভাবা যায় না। যার উপর নির্ভরশীল তাকে খুশি করতেই আগ্রহটা থাকে বেশি। তাতে নিজেকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। নিজের মতো বাঁচা যায় না। তাই নিজে নির্ভরশীল হওয়াটা খুব জরুরি। সেটা যেকোনোভাবেই হতে পারে। কেউ ডক্টর হবে, কেউ প্রকৌশল পড়বে, কেউ নাচবে, কেউ শেফ হবে, কেউ প্লেন চালাবে, কেউ বাগানের মালী হবে, কেই রেস্টুরেন্টব্যবসা করবে। এটার সঙ্গে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা উচিত না। আমি ইচ্ছে করলেই এখন আমার ভাইকে গিফট দিতে পারি, প্রেমিককে নিয়ে ডেটে যেতে পারি। আমি সুখি হই, তাদেরকেও সুখি করতে পারি। এটা খুব দরকার।’
‘প্রেমিক কে? তার সাথে আমাদের, আপনাদের ভক্তদের পরিচয় করাবেন না? আড়ালেই রাখবেন তাকে?’
‘অবশ্যই পরিচয় করাব। সময় হলেই সে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে।’
‘আরও অনেকগুলো নাম কিন্তু এসে যায় আড়াল থেকে। অভিনেতা আবরার, মডেল মিনহাজ, বিজ্ঞাপন নির্মাতা রায়হান রহমান, কয়েকজন ইনডাস্ট্রিয়ালিস্টও কিন্তু আছেন এই প্রিন্স চার্মিং লিস্টে!’
‘আবরার ভাই, মিনহাজ ভাই বা রায়হান স্যার, এরা সবাই আমার সহকর্মী। আমরা খুব ভালো বন্ধুও। আর ব্র‍্যান্ড প্রমোশন করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ীর সাথেই আলাপ হয়েছে। সুসম্পর্ক তাদের সাথে বজায় আছে। ব্যস। এখানে কিছু খোঁজাটা উচিত হবে না।’
‘সব সেলিব্রেটিরাই বন্ধুত্ব বলে সম্পর্ক ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন। আপনিও কি সেভাবেই পাশ কাটিয়ে গেলেন?’
‘দেখুন, এখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে তাই বলছি বন্ধু। কাল যে সম্পর্কটা আগাবে না, তা তো বলিনি। সেদিন সম্পর্কের কোনো নতুন নাম এলে সেটাই জানবেন সবাই। এখানে লুকোচুরি বা আড়ালের কোনো ব্যাপার নেই।’
‘অনামিকার স্বপ্ন জানতে চাই। কী করার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে দেশ ও দশের জন্য?’
‘আমাদের দেশে তালাকপ্রাপ্ত নারীরা অনেক বেশি অবহেলিত। স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ যে কারণেই হোক না কেন, দোষের ভাগীদার হয় একমাত্র স্ত্রী। কোনো উৎসবে তাকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না, প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না, অবহেলা, লাঞ্চনা প্রতি পায়ে পায়ে। এদের জন্য একটা শেল্টার হোম করার স্বপ্ন আছে। আমি শুরু করে দিয়েছি কাজটা। গ্রামের বাড়ি থেকে আমার জরী ফুফুকে এনে পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। আরও আরও এরকম অসহায় মেয়েদেরকে আমি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। জানি না পারব কতটুকু, তবে চেষ্টা করব।’
‘অসংখ্য ধন্যবাদ অনামিকা, আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। শুভকামনা আপনার জন্য। শুভকামনা আপনার স্বপ্নপূরণের জন্য।’
‘আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।’

—–_—–

সকাল থেকে বার দশেক অনির দেওয়া সাক্ষাৎকারটা পত্রিকার পাতায় পড়ে ফেলেছেন সাইদা। আর অন্তত দশ মিনিট ধরে গালাগাল করেছেন প্রতিবারই। সীমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশি বলছেন। সীমা আজকাল কানে নেয় না। প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাতে বিন্দুমাত্র থামেন না সাইদা। অনির সাফল্য তার মনে আরও অসন্তোষ তৈরি করেছে। তিনি এক মনে বলে চলেছেন ‘খাল কেটে কুমির এনেছিলাম আমি। আমার ছেলেটাকে পাগল বানিয়ে রেখে দিলো। খায় না, কথা বলে না, ঠিক করে একটা রাত ঘুমায় না আমার ইমরান। আর তুই পরপুরুষ নিয়ে নাচগান করিস! সীমারের ঘরের সীমার! পাষান মেয়েলোক! একটু মায়া-দয়া করতে পারতি। পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি আমরা? রাজি হবি না তো! কীভাবে রাজি হবি! ঘর-সংসার করা মেয়ে তো তুই না! তুই হলি অলক্ষী! ঘর ভাঙা তোর কাজ। ঘর না ভাঙলে তুই উড়বি কীভাবে? ঘর থাকলে তো বেলেল্লাপনা করতে পারবি না। নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছি আমি। নিজের হাতে নিজের সর্বনাশ করেছি ওই অভাগীরে এনে। ঘর ভরিয়ে ফেলেছি সাপের বাচ্চায়।’
সীমা আর চুপ করে থাকতে পারে না, বলে ওঠে ‘শেষ কথাটা কি আমাকে বললেন, আম্মা?’
‘না বাবা, তোমাদেরকে বলিনাই। আমার কপালরে বলেছি। তোমরা সভ্য,ভদ্র ভালো মেয়ে। ন্যাংটা তো আমরা। অজাত কুজাত কোথাকার!’
‘আম্মা সেই অজাত কুজাত কিন্তু আপনাদের জীবন থেকে চলে গেছে। প্রতিদিন তাকে কেন গালমন্দ করেন? অনেকদিন তো হলো। এবার থামেন?’
‘ওরে থামব কীভাবে? ওই কুজাতের মেয়ে আমাকে শান্তিতে চুপ করে থাকতে দিলো কই? কত অনুরোধ করলাম। কত করে বললাম, যা চাইবি তাই দেবো, তবুও আমার ছেলেটার মন ভাঙিস না। শুনল অনুরোধ? এইটুকু থেকে ভালোবাসি, মায়া করি, তার এই প্রতিদান দিলি?’
‘সেই সময় কিন্তু আপনি বলেছিলেন অনিই তাবিজ করেছে বড়ভাইকে। পানিপড়া, চিনিপড়া খাইয়েছে। বড়ো ভাইয়ের টাকার লোভ করেছে। এখন দেখেন, ও নিজেই লাখ টাকা মাসে ইনকাম করে। ওর চারের অসুখ না থাকলে, আরও কাজ করে, আরও লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারত।’
‘আর তুমি কী করলে? তুমি কয় টাকা ইনকাম করলে? আমার ছেলের খাও আর সিসিটিভি হয়ে আমার কথা ওই বাড়ি পাচার করো? তুমিই এইসব বলে অনির কান ভাঙিয়েছ। নইলে মেয়েটা এত অনুরোধেও টলল না! ঘরশত্রু বিভীষণ আমার।’
‘বিভীষন কে সেটা কি জানেন, আম্মা? সে কিন্তু ধর্মযুদ্ধে ধর্মের পক্ষে কাজ করেছিল। আমিও সব বলেছিলাম ঠিক, কিন্তু অনিকে না। আমার আব্বা, আম্মা আর অনির মাকে জানিয়েছিলাম শুধু। অনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছে। আর দেখুন কত ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে! কত নাম হয়েছে। নিজের যোগ্যতায় দেশ বিদেশে ঘুরছে। বাড়ি কিনেছে, গাড়ি কিনেছে।’
‘এসব কি ইমরান ওকে দিতো না?’
‘দিতো হয়তো। তখন বলতেন অনি ওসবের লোভে পড়ে ইমরান ভাইয়ের মাথা খেয়েছে। আপনি সবদিকে চান বলেই আপনার এই অবস্থা। ভালো হয়েছে অনি আসেনি। আর কিছু তো পারতেন না, ওকে কথার হুল ফুঁটিয়ে মেরে ফেলতেন। যেমন পেয়েছেন আমাকে। তাও ইকরাম আর ইমা আপার জন্য সুবিধা করতে পারেন না। ওরা পাশে না থাকলে আমিও অনির মতো চলে যেতাম।’
‘যাও তো, যাও। অলক্ষী বিদায় হোক ঘর থেকে।’
‘না আম্মা, যাব না। এই ঘর যতটুকু আপনার, ততটুকু আমারও। আর আমি বিদায় হলে আপনি আবার আমাকে আনতে পলাশডাঙা হাঁটবেন। পথও ছাড়বেন না, আগাবেনও না, আপনি হলেন সেই টাইপের মানুষ। ওই যাওয়া আসা নাটক করে নিজের সংসারের ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু বলছি, এইবার অনিকে নিয়ে আপনি থামুন।’
সাইদা এবার নরম হয়ে এলেন, কাচুমাচু করে বললেন ‘মা-রে, এইবেলা তালাকটা হয়েই যাবে। অনিকে একটু বোঝাও। আমি প্রাণভরে দোয়া করব তোমার জন্য। মেয়েটা একটু নরম হোক। আমি কোনোদিন মুখে একটা শব্দও কাটব না। তালাকটা না হোক শুধু।’
‘ও শুনবে না, আম্মা। আপনি মিথ্যে আশা করবেন না। ইমরান ভাইও কম ঝামেলার মানুষ না। যেটা মিউচুয়ালি করা যেত সেটা কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। সাংবাদিকরা পিছু নিয়ে থাকে অনির। রমরমা খবর বানিয়ে দিচ্ছে। তাতে লাভ হবে না। অনি শুনবে না। অনি ফিরবে না!’
‘তা শুনবে কেন? বেজাত, বেজন্মারা!’
‘আম্মা! অনি আমার চাচার মেয়ে। আমার সামনেই কী বলছেন এসব!’ সীমার চোখ বিস্ফারিত হয় যেন।

****
‘বাহ অনি! চমৎকার ইন্টারভিউ হয়েছে। দারুণ বলেছ তুমি।’
‘আপনার মনে হচ্ছে এভাবে গুছিয়ে আমি বলতে পারি? কত বার হেসে উলটে পড়েছি। উল্টোপালটা বকেছি। রেগে গিয়েছি। এলোমেলো কথাগুলো রিয়াদ ভাইয়া গুছিয়ে লিখেছেন।’
‘তুমি বেগুন খাও? এলার্জি না?’
‘আরেহ এটা বলতে হয়। যে শুঁটকির গন্ধে বমি করে ভাসিয়ে দেয় তাকেও বলতে হয় ফেভারিট খাবার হচ্ছে শুঁটকি ভর্তা!’
‘আমি ওনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, তিনিও আমাকে স্নেহ করেন। আমার দেখা সেরা মানুষ উনি, আমার সেরা বন্ধু যিনি পাশে থাকলে জীবনটা সুন্দর মনে হয়। এই তো! ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য এগুলোই যথেষ্ট নয় কী?’ পত্রিকা থেকে রিডিং পড়লেন রাজন মানিক। ‘তাহলে অনি, এই তো! এই তো?’
‘হিংসা হচ্ছে? স্বীকার করলাম না বলে?’
‘না। আনন্দ হচ্ছে। অন্তত পাবলিকলি বলছ না এটা
ভেবে। এইটুকু ম্যাচুরিটি এসেছে এটা আনন্দিত করছে আমাকে।’
‘না, এভাবে কেন পাবলিকলি বলব? জোড় বেঁধে, এঙ্গেজমেন্ট রিং দেখিয়ে, বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করব, তবেই না পাবলিক হবে।’
‘আর ইমরান?’
‘উনি আমার চাইতেও বেশি ছেলে মানুষ। আমি অনেক চেষ্টা করেছি বুঝাতে। কিন্তু তিনি বুঝতে নারাজ। এখন তিনি পাঁচ বছর প্রায়শ্চিত্ত করবেন। তারপর তার শাস্তি পুরো হবে। আমার যে পাঁচ বছর গেছে সেই পাঁচবছর সেও কষ্ট করবে। তারপর নাকি তার কাছে ফিরে যেতে হবে আমাকে। পাগল! আমি পাঁচ বছর বসে থাকলে রাজন মানিকের ডেট এক্সপায়ার্ড হয়ে যেতে পারে যেকোনোদিন!’
‘তুমি বিবাহিতা অনি। আমাকে মনে মনে কামনা করাটাও অন্যায়।’
‘আমি আপনাদের মতো বুঝি না এগুলো। কী যেন শব্দটা বলেন আপনারা, কমিটমেন্ট! একটা কাগজের কাছে আমরা কমিটেড না, আমাদের কমিটমেন্ট থাকে সম্পর্কের কাছে। বিয়ে হলে তার বাইরে সম্পর্ক থাকাটা পরকীয়া। বিয়ে না হলে, প্রেমিক-প্রেমিকারা যদি একইসাথে একাধিক রিলেশনে যায় সেটা পরকীয়া নয়? এগুলো কেমন যুক্তি? আমি তো জানতামই না, বিয়েটা আছে! আশ্চর্য! যে সম্পর্কটা আকাশ ফুড়ে নেমেছে তার প্রতি আমার দায়বদ্ধতা নেই কোনো! এভাবে আমাকে গিল্টফিল করাবেন না তো!’
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, ইমরান অথবা ইমরান নয়।’
‘আমি বলেছিলাম রাজন মানিক এবং রাজন মানিক!’ মিষ্টি করে হাসে অনি।
‘তুমি এখনো ছেলে মানুষ, নইলে ন্যাকা সাজো। পাগলামি বন্ধ করো।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে আমি পাগল। আমি ছাগল। আমি বাচ্চা। আমি ন্যাকা। প্রচুর যন্ত্রণা করি আপনাকে। কিন্তু আমি তো বেশিদিন আপনাকে অতিষ্ঠ করব না। আপনার বয়স কত? পঞ্চাশ, ষাট, আশি? আর অল্প কয়েকদিন বাঁচবেন। তারপরই আমার হাত থেকে ছুটি।’
‘আমি মরে গেলে কী করবে?’
‘আরেকটা বিয়ে করে ফেলব।’ সাথে সাথেই জবাব আসে অনির কাছ থেকে।
রাজন মানিক হেসে ফেললেন।
অনি তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিলো ‘না না, একটা হলে হবে না। আরও দুটো করতে হবে। চার পুরো করতে হবে তো! চার পুরো না হলে আমার অস্থির লাগবে!’
আবারও মিষ্টি করে হাসল অনি।
তার চাইতে দ্বিগুণ হেসে হাসিটা ফিরিয়ে দিলেন রাজন মানিক। ‘ইমরানের জন্য এটা লঘু পাপে গুরুদন্ড হয়ে গেল না? ভেবে দেখো, তার দিক থেকে সে কিন্তু ঠিক ছিলো। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবেনি সে। কমিটেড ছিলো এই বিয়েতে। শুধু কমিটমেন্টটা জানায়নি তোমাকে।’
‘হয়তো! তার অন্যায়টা ইচ্ছাকৃত ছিলো না। ভুলই ছিলো। ভুল মাফ করা কঠিন না। চাইলেই মাফ করে দেওয়া যায়। কিন্তু ওইটুকু ভুলের জন্য আমার জীবনে কী কী হয়নি বলুন? আর কী কী হতে পারত না? অন্য সব বাদ দিন। সেজানের সেই রাতের অন্যায় সুযোগ নেওয়াটা ভাবুন। ইমরানের ভুলটা হয়তো ছোটো, কিন্তু পরিণামে আমার ভোগান্তিটা ব্যাপক। কষ্টগুলো ভোলা যায়, অপমানগুলোকে না! আমার কষ্ট, দুঃখ থেকে অপমানটা বেশি হয়েছে। আর এখানে ক্ষমার কোনো ব্যাপার নেই। এটা ভালোবাসা ম্যাটার করে। আমি তাকে ভালোবাসি না। হয়তো একদিন বাসতাম। কিন্তু ভেবে দেখেন একটা কিশোরী মেয়ে, যে পুরুষ বলতে চেনে একজনকেই, তাকেই তো ভালোবাসবে! আজ আর সেসব কিছু কিন্তু মনে পড়ে না আমার, সেখানে আমি কী করতে পারি? আমি তাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসাহীন সম্পর্কে আমি কেন যাব?’
‘তবুও অনি। চেষ্টা করে দেখতে পারো। হয়তো ভালোবাসা হয়ে যেত…ভেঙে ফেলাটা খুব সহজ, চাইলেই ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলা যায়। ধরে রাখাটা কিন্তু খুব কঠিন।’
‘হুম। চেষ্টা করা যায়। হতেও পারে ভালোবাসা। কিন্তু, যদি না হয়? তখন? আর চেষ্টাটা আপনিও তো করতে পারেন, বুড়ো লোকটা। আমাকে ভালোবাসতে চেষ্টাটা আপনি করলেও তো হয়…’
‘এটা ঠিক না অনি। আমি সাপোর্ট করতে পারছি না।’
‘আমার জীবন, কী ঠিক আর কী বেঠিক আমি বুঝব! আপনাকে নাক গলাতে হবে না। উপদেশও লাগবে না আমার।’
‘তো ঠিক আছে, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত ও আমিই নেব। তুমি দূর হও আমার সামনে থেকে। আমার আশেপাশে তোমাকে দেখতে চাই না আমি।’
‘না আপনার জীবনের সিদ্ধান্তও আমার হাতে। আমি বলছি, আপনি আমাকে ভালোবাসেন, ভালোবাসতে বাধ্য আপনি। আমাকে ভালোবাসতেই হবে আপনার। আর আমি জানি, খুব করে অনুভব করি আপনিও ভালোবাসেন আমাকে। শুধু নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে পারেন না। ভালোবাসায় শুধু ভালোবাসার যুদ্ধ থাকতে হয়, ব্যক্তিত্বের না। প্লিজ!’ দুইহাতে রাজনের গলা জড়িয়ে ধরল অনি।
অনির এই সমর্পণ দুহাতে ঠেলে ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব হলো রাজনের জন্য। গাঢ় অন্ধকারে একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। হয়তো বাকী জীবনটাও এভাবেই চলে যেতে পারত। কিন্তু অনি এসেছে ভয়ংকর ঢেউ তোলা আলোর স্রোত হয়ে। ভেসে যাওয়ার ভয়ে কতক্ষণ তিনি মনের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখবেন? আলো তো বাধা মানে না। ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে অনি ঠিক মনের তার ভেতর ঢুকে গেছে!
‘ক্ষতি কী, স্রোতে ভেসে যেতে… হারিয়ে যেতে…অসম বয়সের এই সম্পর্ক হয়তো কিছু কটু কথাই শুনবে। সেসব সামাল দেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা কি তার নেই? লোকে কী বলবে না ভেবে, আলোর এই ডাক শুনলে কী ক্ষতি?’
সমাজের প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত কেউ হয়ে নয়, একবার মাটির মানুষ হয়ে মনে মনে ভাবলেন তিনি!

অনিকে আলিঙ্গনমুক্ত করে দূরে সরাতে সরাতে ওর কানের কাছে ফিসফিস করলেন রাজন মানিক ‘কোর্টে জিতে এসো, অনি। আমি অপেক্ষা করব। বৈধতাতেই আসে স্বস্তি…!’

সমাপ্ত

Afsana Asha

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে