#ফারাহ
#সূচনাপর্ব
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
“জানেন সজীব ভাই! আমার বড়ো আপা যে বছর বি”ষ পান করে মা”রা গেলো! আমার মা ভীষণ খুশি হয়েছিলো? আচ্ছা মায়েরা কি এমন হয়!”
ফারাহর মুখে আচমকা এমন কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সজীব। আসলেই কি এমন মা দুনিয়ায় আছে? নিজেকেই প্রশ্নটা করে কোনো উত্তর পেলো না সজীব। সে ছোটো ছোটো চাহনীতে বার কয়েক ফারাহকে দেখলো। ফারাহ কথাটা বলেই কোনো ভাবনায় দুনিয়ায় বেখেয়াল হয়ে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে হয়তো! ওর নিরব উপস্থিতি এটাই বুঝাচ্ছে এখন৷ দুজন রাস্তার দুপাশে হাটছে, পিচ ঢালা রাস্তায় দুজনের পায়ের শব্দ ব্যতিত গাছের পাতা নড়ার শব্দ টুকুও নেই। গ্রীষ্মের এই ভরদুপুরে রাস্তায় দুজন মানব-মানবী একা হেটে যাচ্ছে! গ্রামের লোকের চোখে পরলে বিষয়টা নিশ্চিত ভালো চোখে দেখবে না কেউ। খা খা রোদ্দুরের এই সময়টায় সবাই নিজ নিজ বাড়িতে বিশ্রাম করতে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে ২-৪জন লোকজনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। আবার ২-১টা অটোভ্যান ছুটে বাড়ির দিকে ছুটছে। কিন্তু তাদের গন্তব্যস্থলে যাওয়ার মতো কোনো গাড়িই সজীবের নজরে পরলো না। সজীব দ্রুত পা চালিয়ে পথটুকু অতিক্রম করে নিজের বাড়ির দিকে ধাবিত হতে চাইলো।
“আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালাচ্ছেন সজীব ভাই?
সজীবের দ্রুত হাটার গতি থেমে গেলো ফারাহর অদ্ভুদ প্রশ্নে। সে পিছন ফিরে চাইলো। ফারাহর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো। একহাতে লুঙ্গির একপাশ একটু উচু করে ধরে দ্রুত পা চালিয়ে ফারাহ যে পাশ দিয়ে হাটছিলো, সেপাশে এসে ফারাহর মুখোমুখি দাড়ালো। ফারাহর দৃষ্টি রাস্তার পাশ দিয়ে ঢালু ধানক্ষেতে নিবন্ধ। সজীব তার সামনে এসে দাড়িয়েছে বুঝে সে দাড়িয়ে পরলেও দৃষ্টি সজীবের দিকে দেয়নি। সজীব এবার দৃড় কণ্ঠে বললো,
“তোর এসব কি ধরণের হেয়ালি ফারাহ? জেনে বুঝে আমায় কথার জালে আটকাচ্ছিস কেনো?”
“আমার কষ্ট হচ্ছে সজীব ভাই।”
ফারাহ চোখ বন্ধ করে হঠাৎ বৃষ্টির মতো কেঁদে উঠলো। যেনো বিনা মেঘে বৃষ্টি। সজীব এবার পুরোই হকচকিয়ে গেলো। সে ব্যস্ত কণ্ঠে নরম স্বরে বললো,
“ফারাহ? এই পিচ্চি? তুই কাদছিস কেনো? আমি তো তোকে বকা দিইনি? রাগও করিনি? এভাবে রাস্তার মাঝে কাদলে কেউ দেখলে আমায় এসে তো মা”রবে তোকে বিরক্ত করেছি ভেবে।”
“তুমি বড্ড নিষ্ঠুর সজীব ভাই।”
“কি সব আবোল তাবোল বকে চলছিস বলতো! একবার তোর আপার কথা! একবার আমার কথা? বলি শোকে শোকে কি মাথাটা গেছে?”
খানিকটা ধমকেই এবার কথাটা বললো সজীব। ফারাহ সজীবের ধমকে এবার কাদলো না আর। ফিক করে হেসে উঠলো। সজীব আবারও হকচকিয়ে তাকালো ফারাহর দিকে। মেয়েটার হাসিতে মুগ্ধতা আর কান্নায় বিষাদ ছড়িয়ে পরে৷ কিন্তু ফারাহর এরকম পাগলামিতে এখন সজীব মুগ্ধ হওয়ার বদলে বেশ বিরক্ত। সে ফারাহকে ফেলেই হনহনিয়ে হাটা ধরলো বাড়ির দিকে। এক তো ভরদুপুরে কোনো অটো ভ্যান না পেয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার জন্য রাগের শেষ নেই! তারমাঝে ফারাহর পাগলামি! সে নিতো পারলো না। তার দাদী না বললে ফারাহকে সাথে নিয়ে সে বাড়ি ফিরতে হাটা ধরতো না। ফারাহ সম্পর্কে সজীবের ফুফাতো বোন। ফারাহদের গ্রামে এখনও ভালো কোনো কলেজ হয়নি, যেখানে ভালোমতো পড়াশোনা করা যায়! সজীবদের গ্রামের কলেজে পড়তে আসে ফারাহ। আজ ফারাহর নানী, যিনি সজীবের দাদী হোন! তিনি সজীবকে পাঠিয়েছেন ফারাহকে সাথে করে নিয়ে যেনো তাদের বাড়ি আনে। সেটাও কলেজ ছুটির পর নয়, দুপুরের টিফিন টাইমে। দাদীর কথা ফেলতে পারে না সজীব। সেজন্য মাথার উপর খা খা রোদ্দুরের তাপ নিয়েই সে বেরিয়েছিলো ফারাহকে নিয়ে যেতে। কলেজ থেকে তাদের বাড়িটা বেশ খানিকটা দূরেই। গ্রামের উত্তরপাড়ার শেষপ্রান্তে। তবে তাদের গ্রাম ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে যাওয়ার জন্য রয়েছে পিচ ঢালা রাস্তা। সেই রাস্তা ঘেষেই দুজন হেটে বাড়ি ফিরছিলো। তখনই ফারাহ কথাগুলো বলে বসে। সজীব নিজের মনে হেটে যাচ্ছে, ফারাহর দিকে তার নজর নেই৷ ফারাহ যে ওখানেই মাঝরাস্তায় ধপ করে বসে হাটুমুড়ে কাঁদতে শুরু করেছে, সেদিকে সে একটুও নজর দেয়নি। একটুপর কিছুদূর গিয়ে তার হুশ হয়, ফারাহকে পিছনে ফেলে এসেছে। সে ফের পিছন ফিরে তাকিয়ে ফারাহকে দেখে। তাতে তার পিলে চমকে উঠে। এ মেয়ে মাঝরাস্তায় কাদতে বসেছে। সজীব চারপাশে তাকায়। গ্রামের কৃষকরা হাফ জিরিয়ে কাজে ফিরছে ২-১জন করে। তারা ফারাহকে অদ্ভুত চোখে দেখছে। বিষয়টা লক্ষ্য করে সে দ্রুত ফারাহর কাছে গিয়ে বসে। ধমকে জিগাসা করে,
“মাঝরাস্তায় পাগলের মতো কাঁদছিস কেনো? আমায় কি দাদীর বকা খাওয়াবি? যে তার আদরের নাতনীকে আমি কাদিয়ে চোখ মুখ ফুলিয়ে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি?”
“আজ আপার ১ম মৃত্যুবার্ষিকি সজীব ভাই। আমার কষ্ট হচ্ছে।”
২,
সজীব থমকে যায় ফারাহর উত্তরে। মানুষ মা”রা গেলে তার স্মৃতি ব্যতিত কেউ কিছু মনে রাখে না। একান্ত প্রিয় মানুষ ব্যতিত সেই স্মৃতি টুকুও কেউ রাখেনা। সজীবের মনে আছে ফারাহর বোন ফাতিহাকে। কিন্তু তার মৃত্যুবার্ষিকির কথা একটুও মনে নেই! এই তবে কারণ তার দাদীর ফারাহকে বাসায় ডাকার! সজীব ফারাহকে ধরে উঠানোর জন্য হাত বাড়ালো। কিন্তু কিছু একটা মনে হয়ে সে হাত দুটো গুটিয়ে নিলো। সে বললো,
“এভাবে কাদলে তো ফাতিহা ফিরে আসবেনা ফারাহ। বাসায় চল। এরপর মন খুলে কাদিস নামাজ করে রবের দরবারে মোনাজাত ধরে। দোয়া করতে হবে ফাতিহার জন্য। এভাবে কাঁদলে চলবেনা।”
“আ”ত্মহ”ত্যা কারীর যে ইহকাল পরকাল কিছু নেই সজীব ভাই। আমার আপা বেঁচে থাকতেও সুখ পায়নি। এখনও পাচ্ছে না তাইনা?”
সজীব দফায় দফায় বিরক্ত হচ্ছে। বিরক্তির মাত্রা এবার সীমা ছাড়ালো। সে তার ঝাজালো কণ্ঠে বললো,
“রাস্তায় বসে ন্যাকামি কান্না বাদ দিয়ে বাড়ি গিয়ে কাঁদিস চল। তোর জন্য কি এখন আমি কাম কাজ ফেলে রেখে রাস্তায় তোর ম’রা কান্না দেখবো?”
ফারাহ একটু কেঁপে উঠলো সজীবের ধমকে। তবে ভয় পেলো না। সে চট করে দাড়িয়ে সজীবকে ফেলেই তার আগে আগে হাটা ধরলো৷ সজীব ফারাহর এমন অদ্ভুতুরে কাজকর্ম দেখে যারপরনাই হতাশ হলো। এ মেয়েকে বুঝতে পারা এজন্মে সম্ভব হবে না তার পক্ষে। সে নিজেও ফারাহর পিছনে ছুটে হাঁটতে লাগলো।
উঠোনে দাড়িয়ে গাছের আম পাকা আম দেখে দেখে গাছে উঠা এক ছোকরা কে দিয়ে পাড়াচ্ছেন আবিদা বেগম। নাতনী তার আম খেতে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু গাছে তুলে দেওয়া পিচ্ছি ছেলেটা পাকা আমের বদলে আধ পাকা আমগুলোই বেশি পারছিলো। তিনি হাক ডেকে বললেন,
“তোর গাছে থাকা লাগবো না। নাইমা আয় তুই। পাকা আমের বদলে কি সব পাড়তাছোস! এর লাইগা তোরে উঠতে কইছিলাম নাকি!”
“নানী?”
আদিবা বেগম থামতেই নানী ডাক কানে যায় উনার। ঘুরে তাকান উনি। পিছনে ফারাহ দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। সে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদছে, সেটা চোখমুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ফারাহর পিছন পিছনই সজীব আসলো। সে আবার কখন ফারাহ বসে কাদতে লেগে পরে! এই রিস্ক ২য় বার নিতে চায়নি বলে আস্তেধীরে ফারাহর পিছন পিছনই আসছিলো। সজীব ফারাহ আর ওর দাদীকে পাশ কাটিয়ে সোজা বাহির উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বারান্দার একপাশে পেতে রাখা চৌকিতে বসলো৷ ফারাহ তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ দেয় না দেয় দেখা দরকার তো তার! ফারাহর দুচোখের বি”ষ সজীব। সেটা সজীব ভালো মতোই জানে৷ জেদি মেয়ের জেদ অনুসারে কাদতে দেয়নি রাস্তায়! তার বিচার তো নানীর কাছে অবশ্যই দিবে ফারাহ। সজীব চোখ পাকিয়ে ফারাহর দিকেই তাকিয়ে আছে। আদিবা বেগম নাতনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে গালে হাত রাখলেন। বললেন,
“কেমন আছে আমার ফারাহ মনি?”
“নানী? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নানী?”
কথাটা বলেই ফারাহ আদিবাকে জড়িয়ে ধরে । সজীব ফারাহকে তার বিরুদ্ধে নালিশ না করে কাঁদতে দেখে একটু অবাক হয়! তবে বোনের আকস্মিক মৃ'”ত্যূ সেটা আজও ফারাহ মন থেকে মানতে পারেনি? সজীব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বারান্দায় টানানো রশি থেকে গামছাটা নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। গোসল দেওয়া দরকার। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।
এদিকে আদিবা বেগম নাতনীকে সামলাতে ব্যস্ত। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমি জানি আমার নাতনীর আজ কষ্ট হবে, সে কাঁদবে। সেজন্য এনে আনাইলাম। বাড়িতে কাঁদলে তো আমার জ”ল্লাদ বেডি তোরে আগলাইয়া রাখার বদলে আরও মা”রবো। মা না পাথর ওয় পাথর। ”
“পাথরটা তোমারই মেয়ে নানি। কেমনে জন্ম দিছিলা পাথরডারে!”
“খোদায় দিছিলো পেটে। কি করমু ক!”
“নানী! আমি কি আমার বোনের মৃ”ত্যুর’ বিচার কখনও পাবো না?”
“কেমনে পাবি বইন? ওটা যে সবার চোখে আ”ত্মহ’ত্যা।”
“দুনিয়াডা এতো স্বার্থপর ক্যান নানী? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার বুবুরে আইনা দাও না নানী! আমি বুবুরে জড়াইয়া ধইরা রাখমু। কোথাও যাইতে দিমু না।”
আদিবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তার আদরের নাতনী এক অসম্ভব জিনিস আবদার করে বসলো! যেটা পূরণ করা এজন্মে সম্ভব না। ফারাহ নানীকে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
চলবে?