প্রেম পড়শী পর্ব-২১

0
705

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_২১
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

“অন্যসব নারীর মতো আমার হয়তো উচিত ছিল ঘটনাটা ঘটার আগেই লাগাম টেনে নেওয়া, আটকানো। কিন্তু, কার লাগাম টানব? মাহফুজের? যেই পুরুষ নিজেকে শুদ্ধ রাখতে পারে না, সেই পুরুষকে কতটা বেঁধে রাখা যায়?
অথচ সে ভুলেই গেছে, যা আমার তা আমারই; তাতে বিন্দুমাত্র অন্যের ছোঁয়া পেলে আমার আগ্রহ উঠে যায়। মাহফুজকে আমি ভালোবেসেছি। ভালোবাসা ফুরোয় না, মরে যায়। আমার আগ্রহের সাথে ভালোবাসাটাও পুরোপুরি উঠে গিয়েছে। যে অন্যমুখো একবার হয়েই গিয়েছে, তাকে এমুখো করার ইচ্ছেটা আমার নেই। শুধু একটাই চাওয়া থাকে সর্বদা, কোনো মেয়েই যেন কাউকে সর্বস্ব দিয়ে ভালো না বাসে। অপাত্রে পড়ে গেলে, ভালোবাসা মন্দবাসা হয়ে যায়।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৭ জানুয়ারি, ২০১৭

“মেয়েটা নির্লিপ্ত থাকে সবসময়। সবের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ছেলেটাও হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে সারাটাক্ষণ। আমি লক্ষ্য করেছি, দুটো মানুষ হয়েছে একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। মোহ নিরামিষভোজী, মেজবাহর খাবারের পাতে আমিষের ছোঁয়া না হলে চলেই না। মোহ শান্ত, কোমল! মেজবাহ রণচণ্ডী, অশান্ত। মোহ ইন্ট্রোভার্ট, মেজবাহ এক্সট্রোভার্ট। মোহ পড়াশোনায় তুমুল আগ্রহী, মেজবাহ নিজস্ব কার পাওয়ার লোভে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিংটা কম্পলিট করল। মোহর বন্ধু নেই, মেজবাহ যেখানেই যায়—বন্ধু বানিয়ে ফেলে পলক ফেলতেই। মোহ নিম্নস্বরে কথা বলতে পছন্দ করে, হাসে কম। মেজবাহ সবচেয়ে নিচু আওয়াজে কথা বললেও অন্য রুম থেকে শোনা যায়।
এদের মধ্যে কেবল একটা জিনিসই সম্ভব। তা হচ্ছে নেগেটিভ অ্যাট্রাকশন। সবচেয়ে ক্ষতিকর, সবচেয়ে শক্তিশালী। আমি অপেক্ষায় আছি।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

“আজ মাহফুজ সিঙ্গাপুর থেকে ফিরল। ওকে না জিজ্ঞেস করেই, স্বভাববশত ওর ব্যাগ খুলেছিলাম। দেখতে পেলাম কিছু চকোলেট আর কিছু খেলনা আলাদাভাবে রাখা। দ্বিতীয়বার ওদিকে না তাকিয়ে ব্যাগটা আটকিয়ে ফেললাম। আমার জিনিসে ভাগ বসেছে, ১০ বছর হলো। কে বলবে—শেফা হিংসুটে? কে বলবে—শেফা শেয়ার করে না কোনোকিছুই?”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৭ মার্চ, ২০১৭
পুনশ্চঃ বললেও সমস্যা নেই। শেফা আসলেই শেয়ার করে না। সম্পূর্ণ দান করে দেয়।

“মেজবাহ জানাল, ও পারিবারিক ব্যবসায় আসতে চায়। অবাক হলাম প্রায় সকলেই। সঙ্গে খুশিও হলাম ভীষণ। সে নিজ দায়িত্ব বুঝতে শিখছে।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৯ নভেম্বর, ২০১৮

“আজ হুট করে মোহ আমাকে জানায়, সে বিয়ে করতে চায়! মেজবাহকে! এটা হওয়ারই ছিল, এজন্য অবাক হইনি। অবাক হয়েছি ঘটনার আকস্মিকতায়। মেয়েটার মাঝে আমি দৃঢ়তা দেখেছি। কী সুন্দর!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৩ মার্চ, ২০১৯

“সময় বদলায়, অনুভূতিরাও বদলায়। শুধু থেমে থাকে মানুষ। ঠিক সেইখানেই, যেখানে তার অনুভূতিদের হত্যা হয়েছিল। ইশ! সাক্ষী নেই, শাস্তি নেই।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ২০২০

“মাহফুজ রাতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কান্না করে। ক্ষমা চাইতে চায় বোধহয়। ফিসফিসিয়ে মাঝে মাঝে কেঁদে কেঁদে সরি বলে ওঠে। ওর জানামতে আমি রাতে ঘুমের ওষুধ নিয়ে ঘুমাই, তাই এত কিছুতেও জাগি না। ওর জানায় কিঞ্চিৎ ভুল আছে। ঘুমের ওষুধেও আমার ঘুম আসে না। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ আমি বন্ধরত চোখে অনুভব করতে পারি।
মাহফুজ, আমায় যদি তুমি ক্ষণিকের জন্যও ভালোবেসে থাকো, তবে তুমি আমৃত্যু কাঁদবে। তোমার চোখের জল শুকোবে তোমার আত্মার দেহত্যাগের কয়েক ক্ষণ পরে। অভিশাপ নয়, অভিশাপ নয়! এটা ভালোবাসা। ভালোবাসা কাছে আসতে শেখায়, ভালোবাসা এক হতে শেখায়। তেমনই ভালোবাসা নরকসম যন্ত্রণা শেখায়। আমায় ভালোবেসেও এমন অন্যায় করে থাকলে, তুমি সব শিখবে।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২ ডিসেম্বর, ২০২০

“শাশুড়িমা আমাদের সাথে এসে থাকা শুরু করেছে। সে পরিবর্তন লক্ষ করেছে। আমাকে আড়ালে শুধাল,
-‘কী হইছে?’

আমি দোষ লুকোলাম না, বরঞ্চ অনুভূতি লুকিয়ে বলে ফেললাম,
-‘তোমার ছেলেকে তোমার চেয়ে বেশি অবশ্যই আমার বোঝার কথা নয়, মা। বুঝে নাও, কী হয়েছে!’

মা বোঝেনি বোধহয়। বুঝলেও, এটা বোঝেনি—আমি জানি। ভেবেছেন, তার ব্যস্ততার উপকারার্থে মনের ভেতর অভিমান পুষে রেখেছি। আর কিছু নয়। কিন্তু ঘটনা অনেক বড়ো। ঘটনাটা ঘটার সময়সীমা এক যুগ পেরিয়েছে।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৮ ডিসেম্বর, ২০২০

“ইদানিং শরীরটা কেমন যেন করে। আমি খুব করে অনুভব করছি, আমার বেঁচে থাকার সময়গুলো ফুরিয়ে এসেছে। মানুষ মৃত্যুর আগে টের পায়, খেয়াল করে না। আমি খেয়াল করেছি। খেয়াল করেছি—আমার অনেক কাজ বাকি আছে।
ভাবতে বসলাম, কী কী কাজ বাকি আছে। খুঁজতে খুঁজতে একটা কাজই পেলাম, তা হলো মোহর স্থায়ী সুখের ব্যবস্থা করা। মেয়েটার নিজের দুনিয়া বলতে, বাবা-মা-স্বামী আছে। আমি না থাকলে, বাবাকেও যে হারিয়ে ফেলবে না, এর গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না। শেষে মেজবাহ! মেজবাহর সাথে আলোচনা করে বিয়ের আয়োজনের ব্যবস্থা করে ফেলব।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

“মেয়েটার দিকে আজ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কী সুন্দর দেখতে আমার মেয়েটা, মাশাআল্লাহ!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৮ মার্চ, ২০২১

“আজ মেজবাহর সাথে বিয়ে বিষয়ক কথা বলেছি। আমার খুব প্রিয় একটা তারিখ হচ্ছে অক্টোবরের ২১ তারিখটা। অকারণেই প্রিয়। আমি চাই, এই তারিখেই ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। মেজবাহ আমার সাথে একমত। বিষয়টা নিয়ে পরে বিস্তর আলাপ হবে।”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৫ মে, ২০২১

“মাহফুজ, আমি কেন যেন তৃপ্তি পাচ্ছি না। তোমার অনুতপ্ততা আমায় স্বস্তি দিচ্ছে না। আজ কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। আমি তোমায় কত ভালোবেসেছিলাম! কত! মাহফুজ! এ তুমি কী করলে?
যদি জন্মান্তর সম্ভব হতো, আমি পরের জন্মে পুরুষ মানুষ হতে চাইতাম। আমিও দেখিয়ে দিতাম, এক নারীকে কীভাবে ভালোবাসা যায়! আফসোস, তা হবে না!”

স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৭ জুন, ২০২১

এরপরের পৃষ্ঠাগুলো খালি। আর কোনো শব্দ লেখা নেই। তবে আছে হাহাকার। মোহর অন্তরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে দেয়ালে মাথা হেলে দিয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো শুকিয়ে গেছে।

ভোর ছ’টা বাজে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। মোহ উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। এলোমেলো করে রাখা সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল। তারপর এক কাপ কফি হাতে করে বারান্দায় গিয়ে বসল। শেফার শেষ লেখাটা ৭ তারিখের, আর সে মারা গেছে ৯ তারিখেই। ঠিক এ-কারণেই এরপর আর কিছু লিখতে পারেনি।

মোহ এক ধ্যানে বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টির দিকে নিবদ্ধ চোখে পাতায় ভেসে উঠছে সে সময়কার সকল সংঘর্ষ। এত এত ভালোবাসাও মরে যায়! মোহকে যদি কেউ একটা নিয়ম তৈরি করতে দিত, তবে সে ‘ভালো না বাসা’-র নিয়ম তৈরি করত। যে যাকে ভালোবাসে, সে যেন তার হয়ে থেকে যায় আমৃত্যু, নয়তো ভালোবাসা শব্দটা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাক।

_____
ক’টা দিন পেরোল। রঙ্গন দেশে ফিরল বৃহস্পতিবার ভোর ৪ টায়; যেখানে ফেরার কথা পরদিন। সোজা এ বাড়িতে চলে এলো, নাফসিনকে বলে রেখেছিল সবাই ঘুমিয়ে গেলে দরজাটা খুলে রাখতে, নাফসিন খুলে রেখেছে।

রঙ্গন শব্দহীন পায়ে মোহর রুমের সামনে চলে এলো, এক্সট্রা কী দিয়ে দরজা খুলতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ল। সময় নিয়ে দেখল। পুনরায় হাতঘড়িতে সময় দেখল। ৪টা ১৫ বাজে।

দরজার আওয়াজ পেয়ে মোহ আঁচল ঠিক করে পিছে মুড়ল। পরনে লাল সুতির শাড়ি, কৃষ্ণাভ নীল ব্লাউজ। হাঁটু লম্বা চুলগুলো বিনুনি পাঁকানো। প্রসাধনবিহীন ছোটো মুখটায় ঘাম চিকচিক করছে, জ্বলজ্বল করছে সরু নাক, ঠোঁটের কিছুটা নিচে থুতনি সংলগ্ন ভাঁজ, গলা। মাঝ সিঁথি করা, ছোটো-ছোটো চুলগুলো সামনে এলোমেলো অবস্থায়। শ্বেতাঙ্গ স্কন্ধে আঁচড়ের পুরোনো দাগ, যার দায়ী ছিল রঙ্গন! রঙ্গনের চোখের পলক পড়ছে না। কোনো শিল্পীর আঁকা নিঁখুত কোনো প্রতিমার মতো দেখাচ্ছে মোহকে!

রঙ্গনকে ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে যেতে দেখে মোহ অধর বাঁকিয়ে হাসল। বড়োই সামান্য হাসি। সূক্ষ্ম নজরে না দেখলে তা কেউ টের পাবে না। রঙ্গনের সংবিৎশক্তি ফিরল। সে ত্বরিতে বলে উঠল,
-“এই অসময়ে সেজেছ, কেন?”

মোহ আঁচলের শেষাংশ দিয়ে গলার ঘাম মুছে আবারও ক্যানভাসে মন দিলো। রঙ্গন তখন খেয়াল করল মোহর সামনের ক্যানভাসটি। মোহ একটা পেন্সিল স্কেচ আঁকছে। বোঝা যাচ্ছে না কী এঁকেছে! রঙ্গন গভীর দৃষ্টিতে মোহর আঁকা ছবিটি দেখতে পেল। একটা বাচ্চা ছেলের কোলে একটা সদ্যজাত শিশু। ছেলেটি হা করে ছোটো বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আর বাচ্চাটা কাঁদছে। ছেলেটি এতে বিভ্রান্ত নয়, সে হা হয়ে দেখতে ব্যস্ত। রঙ্গন এটুকুই বুঝল।

মোহ ঠিক তখন রঙ্গনের আগের প্রশ্নটির উত্তর দিলো,
-“সাজার আবার সময়-অসময় আছে নাকি? নিজের স্বামীর জন্য মধ্য রাতে ঘুম থেকে উঠেও সাজা যায়! ক্ষণিকেই সাজ নষ্ট হয়ে যাবে জেনেও সাজা যায়।”

শেষ বাক্যটি বলার সময় মোহর ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে হাসি ছড়াল। রঙ্গন হতভম্ব হয়ে উঠল। ভেতরে আসতে আসতে শুধাল,
-“আমি আজ আসব, জানতে?”
-“হ্যাঁ, জানতাম।”
-“কীভাবে?”
-“তোমাকে বলব না।”

মোহ আবার হাসল। মোহ এত হাসে না, অকারণে তো একদমই নয়। আর ঠিক এতেই রঙ্গনের ঘাম ঝরছে। মোহর স্কেচ কম্পলিট। এখন রঙ করা বাকি। পরে রঙ করা যাবে। একপাশে গুছিয়ে রেখে মোহ রঙ্গনকে খাটে বসাল। জানালার পর্দা সব খুলে দিলো। এসি নষ্ট হয়েছে গতদিন, ঠিক করানো হয়নি। তাই ফ্যানটা অন করল। আঁচল দিয়ে রঙ্গনের কপাল মুছে দিতে দিতে বলল,
-“ইশ! কী ঘেমে গেছ!”

রঙ্গন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মোহর দিকে। কিছু বলছে না দেখে মোহ মিটমিটিয়ে হাসল। রঙ্গন অনেকটা সময় চুপ থেকে শুধাল,
-“সত্যিটা বলবে? কী হয়েছে? এত রাতে ঘুমোওনি কেন?”

মোহ রঙ্গনের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
-“তোমাকে কে বলল, আমি আসব? নাফসিন?”
-“না।”
-“তবে?”
-“ঘুমোচ্ছিলাম ৮টা-১টা অবধি। একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। স্বপ্নে দেখলাম, তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে জলদি ফিরে এসেছ। কিন্তু আমি কেন যেন খুশি হলাম না! সারপ্রাইজ দেবে ভালো কথা, জানিয়ে দেওয়া উচিত। যাতে আমি চমকে যাওয়ার অ্যাক্ট করতে পারি! এজন্য উলটো রেগে গেছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর, তাই-না, রঙ্গন?”
-“হুঁ?”

মোহ হেসে উঠল,
-“ভাবলাম, তোমার সারপ্রাইজটা বিফলে দেওয়া যায় না। এপাশ থেকেও সারপ্রাইজড হতে কেমন লাগল?”
-“খুবই ভয়াবহ! ভয় পেয়ে গেছিলাম!”
-“আমিও মজা পেয়েছি।”

মোহ হাসল। হাসির দমকে ছোট্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠল। রঙ্গন শার্টের ওপরের বোতামটা খুলে মোহর কোমরে টান দিয়ে নিজের উরুর ওপর নিয়ে এলো। অস্থির আওয়াজে বলল,
-“ভীষণ জ্বালাচ্ছ! আজ একদম মেরে দেবো।”

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে