#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৯
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
“বন্ধুত্বের ৩ বছর, প্রণয়ের ৬ বছর, পরিণয়ের ৩ বছর শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত (মা হওয়া) ৩য় বর্ষ চলছে। মোটে ১৫ বছর। একটা মানুষের মনে স্থায়িত্ব করে নেওয়ার জন্য ১৫ বছর কি যথেষ্ট নয়? নাকি একজনের মন থেকে উঠে যাওয়ার জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট? আমার কলিজা কাঁপে ইদানিং। আশ্চর্য! মাহফুজের চোখ এখন আর আমায় খোঁজে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ নভেম্বর, ২০০৬
“রফিক জানাল, মাহফুজ তাদের কোনো এক ম্যানেজারের মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। ভালো কথা, নিতেই পারে। কিন্তু মেয়েটিকে সে অন্য নজরে দেখা শুরু করেছে। আর এই বিষয়টা অত্যন্ত জঘন্য। আমি পদে পদে মাহফুজকে সাবধান করছি। ও খেয়াল করছে না।
কাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পর ওকে বললাম,
-‘মাহফুজ, পৃথিবীর সবচেয়ে নরম জিনিস কোনটা জানো?’
মাহফুজ না ভেবে জবাব দিলো,
-‘পানি।’
হেসে দিয়ে বললাম,
-‘ভালো জানো। আরও কিছুটা শোনো। পৃথিবীর সবচেয়ে নাজুক জিনিস হচ্ছে মেয়ে মানুষের মন। একইভাবে সবচেয়ে শক্তও মেয়ে মনই। বুঝেছ?’
-‘হঠাৎ?’
আমি আরও খানিকটা হেসে বললাম,
-‘মেয়ে-হৃদয় এতটাই শক্ত, একবার সেখান থেকে বের হয়ে গেলে পৃথিবীর কারোর সাধ্য নেই সেখানে প্রবেশ করানোর।’
মাহফুজ কী বুঝল, কে জানে?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৩০ এপ্রিল, ২০০৭
“পুরুষ মানুষকে সবটা দিয়ে ভালোবাসা উচিত না। তারা ছেড়ে যায়। তারা হারিয়ে যায়, আমাদের হারিয়ে দেয়। আমি তাকে হারিয়েছি, তবে হেরে যাইনি। আমার মনে কিছুটা ভালোবাসা নিজের জন্য ছিল। মাহফুজ, তুমি কেন মন থেকে সরে যাচ্ছ? এটা তো চাইনি। আমি তো তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমার চোখ কেন অন্যকে চায়?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৩ মে, ২০০৭
“মাহফুজ ভুলে গেছে, আমি চোখ পড়তে জানি। ভার্সিটি লাইফে একদিন ও আমাকে মিথ্যে বলতে গিয়েছিল, প্রথমবারের মতো। বন্ধুদের সাথে মিলে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রাত থেকেছিল। সে-রাতে সবাই শখের ড্রিংকস করেছিল। এজন্য সকালে ক্যাম্পাসে আসতে দেরি করেছে, প্রথম দুটো ক্লাস মিসও গেছে।
এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
-‘সরি, আসলে সকালে আব্বা-আম্মার জন্য দেরি..’
আমি ওকে বাকিটা বলতেই দিইনি। তার আগেই বলে উঠি,
-‘আমাকে মিথ্যে বললে তোমারই লস।’
তারপর ও ভীষণ রকমের অনুতপ্ত হয়ে রাতের ঘটনা জানায়। আমি রিয়্যাক্ট করিনি মোটেও। হেসে বলেছিলাম,
-‘নেক্সট টাইম দু’জন মিলে খাব, ওকে?’
তারপর থেকে মাহফুজ আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকোয়নি। আর এখন? পাকা অভিনেতা হয়ে গেছে। আচ্ছা, ওর বলা প্রতি ১০টি বাক্যের মাঝে যে এখন ৭টা মিথ্যে থাকে, ও কি বুঝতে পারছে না—আমি টের পাই?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৩০ আগস্ট, ২০০৭
“সে ধীরে ধীরে আমার মন থেকে পুরোপুরি উঠে গেল। আমার সংসারে ভাগ হলো। আমার ভালোবাসায় ভাগ হলো। বড়ো সাধের স্বামী তো! মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারছি না।
আমার ইদানিং আর নিজেকে সহ্য হচ্ছে না। কেমন নারী আমি? যে নারী নিজের স্বামীকেই ধরে রাখতে পারলাম না! আমার মাহফুজ আমার মাহফুজ করে যে কত গলাবাজি করলাম, এগুলো গেল কই?
আমি এর শেষ দেখতে চাই। আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিক।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৮ জুলাই, ২০০৮
“ইদানিং আর আগের মতো হাসি না, আগের মতো রাগি না। আমার স্বভাব পালটে যাচ্ছে। প্রিয় পুরুষের শরীর থেকে পাচ্ছি অন্য নারীর স্মেল। বুকের ভেতর যে কী চলে! কাকে বোঝাই?
মেজবাহ আমাকে প্রায়ই বলে উঠে,
-‘মামনি, তুমি পালটাইতেছ।’
আমি কিছু বলতে পারি না। সামান্য হেসে উঠতি বয়সী বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিই। ছেলেটা ক্লাস টেনে, মেয়েটাও এবার ক্লাস টু-তে। বাচ্চাগুলোকে আঁকড়ে ধরেই আছি আমি। নতুন করে নিজেকে ভালোবাসা শুরু করেছি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২২ জুন, ২০০৯
“নিজেকে সহ্য হয় না। জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তে এসে এত বড়ো ভুল করে ফেললাম? আমি ভালোবাসা চিনতে ভুল করিনি। মাহফুজ অবশ্যই আমাকে ভালোবাসত। তবে এত জলদি তা মিটল কেন? আমি ধরে রাখতে ব্যর্থ! মাহফুজ, তুমি দোটানায় হাঁসফাঁস করতে করতে মরে যাও। প্রাণ ফিরেও দুই পাশে টান খাও। আমি বাকিটা জীবন তোমার চোখে অনুতাপের জ্বলন্ত অগ্নি দেখতে চাই।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
০৭ আগস্ট, ২০১০
“মাহফুজকে আমার জীবনের গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে থেকে বের করেছি, তার চতুর্থ বর্ষপূর্তি। মেজবাহ ইন্টারমিডিয়েটে, আর আমার মেয়েটা ক্লাস ফোরে। ছেলেটা বড়ো হওয়ার সাথে সাথে অসীম জেদি, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তেমনই মেয়েটা নাজুক, নির্বিকার। কী অমিল! এদিকে আমি ভেবে পাই না, আমার সোনাই যেন আমারই অনুরূপ! দেখতে গ্রহণ লাগা চন্দ্রের মতন সুন্দর।
শিহাব কীভাবে যে মেয়েটাতে নজর দিলো, ভাবতেই ঘেন্না পাচ্ছে আমার। আজ কাকাইয়ের বর্ষপূর্তিতে ওবাড়িতে ছানা-পোনা নিয়ে গেছিলাম। মেজবাহ দেখল—শিহাব কীভাবে আমার মেয়েকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিল। ছেলেটা এমনিই রগচটা। তার ওপর যা দেখল, তাতে আর সইতে পারেনি। ওর এত আদরের পুতুলে এরকম কুনজর অবশ্যই সহ্য করার মতো না। তাই মোহকে আড়ালে রেখে এসে রুমবন্দী করে বেধড়ক পেটাতে লাগল শিহাবকে। বাচ্চাবয়সী ছেলের কাছে এমন মার খেয়ে শিহাব যন্ত্রণায় নিজের ঘরে পড়ে কাতরাচ্ছিল। আমি গিয়ে আটকাই। তারপর মেজবাহর কাছে সব শুনি। শেষে গিয়ে ওকে আবার আটকাই। কসম দিয়ে ওকে রুম থেকে বের করি।
মেজবাহ আমার জন্য সেদিন শিহাবের জান নিতে পারেনি। নয়তো খুন হতো! শেষে মেজবাহ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যায়।
তারপর আমি শিহাবের হাত-পা বেঁধে ফেলি। মুখটাও আটকে দিই, যাতে আওয়াজ না বের হয়। এরপর বাকিরাত বিরতিহীনভাবে বেল্ট দিয়ে মারতে থাকি। জানোয়ারের বাচ্চার সাহস অনেক হয়ে গেছিল। লজ্জা থাকলে আর এই সাহসটা ওর হবে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১১
“তার মেয়ে হলো! এতদিন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, এখন আমার মেয়েরও হলো। আম্মুজান, আল্লাহ তোমাকে এই সত্যিটার সাথে পরিচয় না করাক। এত সাহস তো তোমার নেই, সোনাই। আমি মেনে নিতে পারলেও, তুমি হয়ে উঠবে বিধ্বংসী, অপ্রকৃতস্থ। আমারই তো রক্ত। এসব গুন তোমার জন্য অবশ্যম্ভাবী।
আমি মেজবাহর চোখে তোমার জন্য অগাধ আদর দেখেছি। কিন্তু আমি তা বলব না তোমায়। তোমাদের কোনো সিদ্ধান্তই আমি নেব না। এই দেখো! তোমার বাবার চোখেও আমি নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম। অতঃপর ভালোবাসা আমায় ভালো থাকতে দিলো না। আমি চাই না, তোমার বেলায় তা হোক।
মেজবাহ রাজনীতিতে ঝুঁকছে। বিষয়টা ভালো লাগছে না আমার। ও যে-রকম মানুষ, রক্তারক্তি বাঁধিয়ে ফেলবে প্রতি ওয়াক্তে। প্লাসে-মাইনাসে যেমন আকর্ষণ হয়, মেজবাহ আর পলিটিক্স যেন তেমনই কিছু। রক্ত ঝরবে আরও। আমি তা চাইছি না। অবশ্য যা চেয়েছি, তা পেলামই বা কই?
মেজবাহকে আজ গিয়ে বলে উঠলাম,
-“দুটো একসাথে পাবে না।”
মেজবাহ অবাক হয়ে শুধায়,
-“কোনটা?”
আমি শান্ত গলায় বলি,
-“প্যাশনটাকে ছাড়ো, মেয়ে দেবো। নয়তো না।”
আমাদের শাশুড়ি-জামাইয়ের মাঝে কথা-বার্তা তখনই শেষ হয়। মেজবাহকে মোহর কমনীয়তা বোঝানোর পর সে পলিটিক্স ছেড়েছে। তবুও আমি জানি, সে সবটা ছাড়েনি। ততদিনে রাজনীতি ওর রক্তে। প্রকাশ্যে না পারুক, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে চলেছে, নেড়ে যাবে। যাক, সেটুকুতে দোষ নেই। আমার মেয়েটা ভালো থাকলেই হলো।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৬ জুলাই, ২০১১
“পৃথিবীর সবচেয়ে লোমহর্ষক মুহূর্ত হচ্ছে সাধের পুরুষকে বাস্তব জীবনে অভিনেতা হয়ে উঠতে দেখা। আশ্চর্য! ওর এত সুন্দর অভিনয় দেখে আমার গা শিউরে ওঠে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ২০১১
“মাহফুজ অভিনয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে। তবুও কি আমার থেকে লুকোতে পারবে? ওকে চেনার ১৯ বছর তো হলো!
আমার ঘুম হারাম হয়েছে আরও ৪ বছর আগে। ও টের পায়নি। যে পুরুষের হৃদয়ে একাধিক নারী স্থান পায়, সে পুরুষ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রাণীর আওতাধীন। আমি তার বহিঃপ্রকাশ করিনি। তবে ইদানিং একটা জিনিস খুব খেয়াল করছি। মাহফুজ রাতে ঘুমোতে পারে না। যখনই চোখ খুলে ওর দিকে তাকাই, ওর সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টিকে দেখতে পাই। আনন্দে আমার বুকটা ভরে ওঠে। ও টান খাচ্ছে।
মাঝে মাঝে খুব বলতে ইচ্ছে করে,
-‘মাহফুজ, শোনো! তুমি তো ভুল করোনি, করেছ অন্যায়। এই অন্যায়টা না করলেই হতো না? আমি কেন তোমার জন্য যথেষ্ট ছিলাম না?’
আবার ইচ্ছে হয়, বুকে গিয়ে কেঁদে উঠি, অভিযোগগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে উঠি,
-‘কিংবা আমাকে বলেই দেখতে! হাসিমুখে তোমাকে ছেড়ে যেতাম। তখন না হয় আরেকজনে জড়াতে! তোমার শরীর থেকে ভেসে আসা অন্য নারীর স্মেল আমার শরীরে দহন ঘটায়। প্রতিটা লোমকূপ ঘৃণায় তোমাকে শাপ দিয়ে বসতে চায়। আমাদের সেই দিনগুলোর জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিতে পারছি না। ভালোবাসায় যেহেতু ভাগই বসানোর ছিল, তবে শুরুতে কেন আমাকে প্রেম শেখালে?’
আমি কিছুই বলতে পারি না। ওর দিকে তাকিয়ে থাকি শুধু। মানসপটে ভেসে উঠে ভবিতব্য—ওর শান্তির দিনগুলো ক্ষণিকের। ইশ! যদি আমার একার থাকতে, তবে জানতে সুখময় দিনগুলো চিরস্থায়ী।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ অক্টোবর, ২০১১
“ভালোবাসাকে এখন আমার মন্দবাসা ডাকতে ইচ্ছে হয়। শালার ভালোই থাকতে দিলো না!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ মার্চ, ২০১২