#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
মেয়েটা তখনই ছেড়ে দাঁড়াল রঙ্গনকে। পিছে ঘুরে তুশিকে দেখতে পেয়ে রঙ্গনের চোখ-মুখ বিকৃত হলো। ভেতর থেকে অসহনীয় একটা নিঃশ্বাসের সাথে অশ্রবণীয় কিছু আওয়াজে ভেসে এলো,
-“আল্লাহ! রক্ষা করো!”
সে কথা তুশির শোনা হলো না। সে ভীষণ রকমের উত্তেজিত হয়ে বলল,
-“মেজবাহ, তুমি এখানে? আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে নোটিস করছিলাম। ফাইনালি যখন চিনতে পারলাম, তখন তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না! কত বছর পর দেখা! দেখো কান্ড! আমি খুশির ঠেলায় বকবক করে যাচ্ছি। আর তুমি তো আরও দুই ধাপ ওপরে। এত খুশি হয়েছ যে, একটা শব্দও বলছ না!”
রঙ্গন অপ্রস্তুত হলো। সে জানে তুশি কিছুটা গায়ে পড়া টাইপের মেয়ে। তবুও এ মুহূর্তে এসে কিছু বলতে পারছে না। তুশি তার ভার্সিটির এক বড়ো ভাইয়ের আদরের বোন ছিল আর ওদেরই ক্যাম্পাসে পড়ত। তখন থেকেই রঙ্গনকে তুশি পছন্দ করত। এদিকে রঙ্গনের তখন মোহর সাথে গোপনে প্রেম চলে, তাই সে এসবে জড়ায়নি। এতে তুশির মনটা ভেঙে যায়। তারপর একদিন বিয়ে করে এখানে সেটেল হয়ে যায়।
রঙ্গন অনেকটা ভেবে তুশিকে বলল,
-“হাজব্যান্ড কোথায়?”
তুশি জানাল,
-“ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসবে। এসো, বসি এদিকটায়।”
এ-ই বলে রঙ্গনের হাত ধরতে নিল। রঙ্গন নিজেকে ধরার সুযোগ দিলো না, একটু সরে এসে বলল,
-“দিলে তো আমার সংসারে ঝামেলা বাঁধিয়ে!”
-“ওমা! আমি কী করলাম?”
-“তোমাকে কতবার বলেছি, এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরবে না! আমি অতটাও ফ্রেন্ডলি নই। তাছাড়া আমার বউ কলে ছিল। দেখে কী যে মনে করল!”
চোখ পিটপিট করে তিশা বলল,
-“আব্.. আচ্ছা সরি! অত চেতছ কেন? বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম দেখে। শুধু শুধু বকছ!”
-“বকছি?”
অবাক হয় রঙ্গন। তা দেখে তুশি হেসে ফেলে বলে,
-“একসময়ের ভালোবাসা ছিলে তুমি আমার। তাই একটু-আধটু বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলাম। মাইন্ড কোরো না। আসো, বসে এক কাপ কফি খাই।”
-“না, এখন না। মোহ কী না কী ভেবে বসে আছে! ওর ডাউট ক্লিয়ার করি আগে।”
____
রঙ্গন মোহকে টানা কল দিয়েই যাচ্ছে। মোহ রিসিভ করছে না। কল দিতে দিতে গাড়িতে করে হোটেলে ব্যাক করল। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে। এমন সময় মোহ কল কেটে দিয়ে ভিডিয়ো কল দিলো।
রঙ্গন রিসিভ করতেই স্ক্রিনে মোহকে দেখতে পেল। জাম রঙা একটা সুতির থ্রি-পিস পরে আছে। ওড়না অবহেলায় পড়ে আছে বিছানার অন্য প্রান্তে। চুলগুলো উঁচুতে কাটা দিয়ে বাঁধা। কোলের ওপর কুশন, আর কুশনের ওপর প্লেট। মোহ ফোনটা সামনে রেখে বলল,
-“সরি, ডাইনিংয়ে ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারিনি।”
রঙ্গন সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-“সত্যি?”
-“মিথ্যে বলছি না।”
-“শোনো, মোহ! ওই মেয়েটা আসলে..”
-“কিছু বলা লাগবে না।”
অবাক হয় রঙ্গন,
-“কেন?”
-“কারণ তোমায় আমি বিশ্বাস করি।”
এই এক কথা! রঙ্গনের বুকের ওপর থেকে পাথর সরাতে এই এক কথাই যথেষ্ট ছিল। রঙ্গন হেসে বলল,
-“এত বোঝো কেন?”
-“কীজানি!”
খেতে খেতে মোহ জবাব দিলো। রঙ্গন সামান্য মাথা দুলিয়ে বলল,
-“তবুও তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে চাই। নিজের শান্তির জন্য।”
-“বলো।”
-“ও আমাকে পছন্দ করে।”
-“আচ্ছা।”
-“জ্বলছে না?”
-“না।”
-“কেন?”
-“কারণ তুমি তো আমারই। সবভাবে আমার।”
-“এত বিশ্বাস?”
-“সেটা তুমিও জানো—তুমি এক নারীতে আসক্ত না থাকলে, তোমার এমন অবস্থা করব যে তুমি বাকি জীবন কোনো নারীর দিকেই চোখ তুলে তাকাতে পারব না।”
রঙ্গন হেসে দিলো। গলার টাই আলগা করে ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“আই মিস ইউ!”
মোহর খাওয়া শেষ। পানির গ্লাস খালি করে বলল,
-“কবে ফিরবে?”
-“নেক্স্ট ফ্রাইডে।”
-“আচ্ছা।”
আর কিছুক্ষণ কথা বলে মোহ ফোন রেখে দিলো। এরপর প্লেট কিচেনে রেখে মায়ের রুমে চলে এলো। কাবার্ডের সবকিছু খুঁজল। কোথাও কিছু পাচ্ছে না। ড্রয়ারগুলোর চাবি কোথায়, তা-ও জানা নেই। সাইডবক্সগুলোর ভেতর খুঁজতে লাগল। সেখানে চাবি পেল অনেকগুলো। এগুলো কাবার্ডের ড্রয়ারেরই চাবি। তবে সবগুলো ড্রয়ার খুললেও, কিছুই পেল না। ফিরে চলে গেল।
রাত আড়াইটা বাজে, অথচ মোহর চোখে ঘুম নেই। কানের মাঝে কিছু কথা বাজছে!
-“সত্যের দুইটা দিক থাকে। একটা প্রকাশিত সত্য, অন্যটি লুকায়িত সত্য। কল্পনা করো কিছুটা এরূপভাবে—যেরূপভাবে তুমি কখনও কল্পনাও করতে পারতে না।”
অনেকবার ভাবল মোহ কথাটা। তারপর উঠে গেল। পুনরায় শেফার রুমে এলো। বেড সাইড বক্সের নিচ দিয়ে খুঁজল। সোফার কুশনের ভেতর থেকে শুরু করে, ড্রেসিংটেবিলের পিছনে। শেষে আবার কাবার্ডের সামনে এলো। ড্রয়ারগুলো পুনরায় খুলল। এবার আলগা ড্রয়ারগুলো বের করে ফ্লোরে রাখল। সব যখন এলোমেলো করে শেষ হলো, তখন মোহর চোখ গেল এক ড্রয়ারের খাঁজের ওপরের দিকের কিছু একটা। মোহ হাতাহাতি করে বুঝল, এটা আরও এক ড্রয়ার। আর এটায় চাবি না, লাগবে পিন। ৪ ডিজিটের একটা পিন। মোহ ফার্স্টে দিলো ৪৪৪৪, এটা শেফার প্রিয় সংখ্যা। খুলল না। মোহর বার্থ ইয়ার দিলো, ২০০২। এতেও খুলল না। সবার বার্থ ইয়ার দেওয়া শেষে ১৯৯২ থেকে ক্রমানুযায়ী পিন দিতে লাগল। আর তা খুলল ২০০৮ সেট করার পর। বেরিয়ে এলো কিছু কাগজসহ একটা ডায়েরি।
মোহর হাত কাঁপছে। সে ডায়েরিটা নিয়ে পুরো রুম তাড়াহুড়োর মাঝে গুছিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর ডায়েরি খুলল। প্রথম পাতাগুলোতে বৈবাহিক জীবন নিয়ে লেখা, মোহর জন্ম নিয়ে লেখা। মোহ আধো আধো বুলিতে কীভাবে ডাকে, কী করে! এসবই।
“আমার সোনাই কথা বলতে শিখেছে। কী মিষ্টি করে আম্মাহ ডাকে! তার চেয়েও মিষ্টি করে ডাকে মেজুবা! আর মেজবাহ তো সারাদিন পড়াশোনা ছেড়ে সোনাইকে নিয়ে ব্যস্ত। কাল কথার ছলে রুমা আপা বলে উঠল,
-‘আমার ছেলে তাহলে নিজের জন্য মেয়ে নিজেই পছন্দ করে রেখেছে! নিজ হাতে বড়ো করে তুলছে! এলেম আছে বলতে হবে!’
আপার কথা শুনে মুচকি হাসলাম। বিষয়টা ধরতে পেরে বললাম,
-‘ওরা বড়ো হোক, আপা। ওদেরটা ওরাই বুঝে নেবে। আমাদের উচিত হবে না এখনই ওদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদি তোমার ছেলে কিংবা আমার মেয়েটা অন্য কাউকে পছন্দ করে বসে?’
আমার কথায় আপা সায় দেয়। তবে দু’জনকে একত্রে আমার খুব ভালো লাগে। আমি খুব চাইব, ওরা এভাবেই থাকুক।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬
“আমার ডায়েরিতে ইদানিং মেয়ের চেয়ে বেশি ছেলেটা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বাচ্চা ছেলে! বয়স মাত্র ১৩ বছর। আর স্কুলে কি-না নিজের আলাদা গ্যাং বানিয়ে নিয়েছে! কী সাংঘাতিক! সেই গ্যাং নিয়ে ক্লাসের সবাইকে জুলুমের ওপর রাখে। কাল গার্জিয়ান মিটিং হলো। মেজবাহ এসে আমাকে বলে,
-‘মামনি, একটু কষ্ট কইরা আমার কলেজ থেইকা ঘুইরা আইসো। আবহাওয়া ভালো লাগব। সাথে মামার ঝালমুড়িটা হেব্বি! একবার খালি যাইয়া কইবা—তুমি ওয়াজিহ্ মেজবাহর লোক। আনলিমিটেড ফ্রি পাইবা! নামের একটা জোর আছে, বুঝছ?’
আমি কড়া চোখে তাকিয়ে বলি,
-‘মেজবাহ! শুদ্ধ বলবে। এসব কী ভাষা?’
মেজবাহ মুখ কুঁচকে বলে,
-‘আমি কি তোমার লগে সিরিয়াস আলাপ পারতাছি? যেমনে কইতাছি, কইবার দেও। এডিতে যেই শান্তি আছে, অন্যডিতে পাইবা?’
আমি শ্বাস ছাড়ি থেকে থেকে। ছেলেটা একদম অসম্ভব! দুই পরিবারের কেউ অশুদ্ধ বলি না, অথচ এটা? তারপরই খেয়াল হলো, ও আমাকে ওর স্কুলে ঘুরতে যেতে বলেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল, বন্ধুরা এসে গেছে ওর।
আমি বুঝেছি, আবারও স্কুলে কিছু একটা ঘটিয়েছে আর গার্জিয়ান ডেকেছে। ওর বাবা-মা বিষয়টা জানে না, জানলে বকবে-মারবে; যেগুলো ও সহ্য করবে না। বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাসায় গিয়ে থাকবে। এজন্য এসব আমিই হ্যান্ডেল করি।
ও রোজ কিছু না কিছু করবে, আর সপ্তাহ শেষে আমি যাব। এখন প্রিন্সিপাল ওকে শোধরানোর বিভিন্ন উপদেশ দেওয়াও বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আমি যাই, তিনি প্রোগ্রেস রিপোর্ট হাতে তুলে দেন। নাহ, সবেতেই ভালো মার্ক্স! এক্সামের সব সাবজেক্টের সাথে মারপিট, চুলোচুলি সবেতেই প্লাস এসেছে। অতঃপর প্রিন্সিপাল ম্যাম আর আমি দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বিষয়টা এখন অতিমাত্রায় স্বাভাবিক। কবে যেন টিসি ধরিয়ে দেয়, সেটাও অস্বাভাবিক নয়।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ মার্চ, ২০০৬
“আজ মাহফুজকে কত করে বললাম, মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাব! সে নাকি ব্যস্ত, অফিসে ঢেড় কাজ! কাজেরে গুলি মারি। এত কাজ কেন করবে? প্রচুর মন খারাপ হলেও, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম আমি। আজ-কাল এসব যেন দুধ-ভাতের মতোই সাধারণ। মাহফুজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইদানিং আমার দিকে অকারণে তাকায় না। মুগ্ধতা কমে এসেছে বোধহয়। কবে যেন মিটে যায়! দীর্ঘশ্বাস আসে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৬ মার্চ, ২০০৬
“বন্ধুত্বের ৩ বছর, প্রণয়ের ৬ বছর, পরিণয়ের ৩ বছর শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত (মা হওয়া) ৩য় বর্ষ পেরোল। মোটে ১৫ বছর। একটা মানুষের মনে স্থায়িত্ব করে নেওয়ার জন্য ১৫ বছর কি যথেষ্ট নয়? নাকি একজনের মন থেকে উঠে যাওয়ার জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট? আমার কলিজা কাঁপে ইদানিং। আশ্চর্য! মাহফুজের চোখ এখন আর আমায় খোঁজে না।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ নভেম্বর, ২০০৬
চলবে..