#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
মাহফুজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে। ছেলেটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আম্মা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে দেখতে-শুনতে বেশ ভালো, সরকারি চাকরি করে। ব্যাক্তিত্বও সুন্দর। তবুও আমি বিয়েটা করতে পারছি না। অবশ্যই মাহফুজের জন্য! কোনোমতে বিয়েটা থেকে রক্ষে পাই, ফাজিলটাকে আচ্ছা মজা দেখাব! আমাকে বশ করে রেখেছে! সাহস কত!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১১ আগস্ট, ১৯৯৮
“কাকাতো বোন শিউলি আপুর কাছ থেকে সেদিন জেনেছিলাম, হাতের কোন অংশে ঠিক কীভাবে কতটুকু কাটলে কেবল চামড়া কাটে, রক্ত পড়ে; তবে রগে লাগে না।
শখের বশে শেখা কাজটা, আমার কাজে লেগে গেল। আমার রুমে কোনো ব্লেড বা ছুড়ি জাতীয় কিছু নেই। রান্নাঘর থেকে আনার উপায়ও নেই।
নতুন পেন্সিল শার্পনার থেকে ওটার ব্লেডটা উঠিয়ে নিলাম। তারপর হিসেব মতো হাতে সুন্দরমতো কাটা শুরু করলাম। খুব সাবধানে, যাতে রগে না লেগে যায়। আমি মরতে চাই না, নিজেকে ব্যথা দিয়ে তাদের খানিকটা ভয় দেখাতে চাই।
মাহফুজ! দেখো, তোমাকে পাওয়ার জন্য কতটা করছি! কষ্ট দিয়ো না এরপর, কেমন?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১২ আগস্ট, ১৯৯৮
“বিয়েটা ভেঙে গেছে। আম্মা কথা বলে না আমার সাথে, আব্বাও না। বলতে গেলে বাড়ির আবহাওয়া অতিমাত্রিক ঠান্ডা। আর আমি তা এনজয় করছি। তিনদিন অসুস্থ হয়ে হসপিটালে এডমিট ছিলাম। আজই বাড়ি ফিরলাম। কাল ক্যাম্পাসে গেলে নিশ্চয়ই মাহফুজের চিন্তামাখা মুখটা দেখতে পাব!
মানসম্মানের ভয়ে আম্মা-আব্বা আমার ব্যাপারটা আত্মীয়-বন্ধুদের থেকে লুকিয়ে গেছে। তাই বেচারার কোনো উপায়ই ছিল না আমার সাথে যোগাযোগ করার। কাল দেখা হলে প্রথমে অস্থির হবে, পরে যখন দেখবে—আমি ঠিক আছি, তখন মুখ ফিরিয়ে বলবে,
-‘শুভ্রা, আগামী চারদিন আমার দেখা পাবে না। আমার রাগ নামতে চারদিন লাগবে।’
আমি হেসে ফেলব আনমনে। ইশ! ছেলেটা এত আদুরে! আমি এই আদুরে ছেলেটাতে মরতে রাজি।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১৫ আগস্ট, ১৯৯৮
“পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুভূতি হচ্ছে প্রিয় পুরুষের চোখ নিজেকে রানী হিসেবে দেখা। মাহফুজ আমাকে কত চায়, তা ও কখনও বলেনি আমায়, বলেও না। অথচ ওর প্রতিটি কাজে এই তীব্র চাহিদাটা প্রকাশ পায়।
কাল এক্সাম শেষে মাহফুজের সাথে যখন বউবাজারের সরু রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, মাহফুজ বলে উঠল,
-‘শেফা, কথা আছে কিছু।’
ওর গম্ভীর মুখটা আগেই লক্ষ করেছি। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়নি। আমার ক্ষেত্রে মাহফুজ অনুভূতি প্রকাশে অতি সক্ষম ব্যাক্তি। যখন বলতে ইচ্ছে করবে ওর, ও বলবেই। আর ওর সময়টা হলো তখন।
ওর গম্ভীরতাকে ডিঙিয়ে গিয়ে আমি বললাম,
-‘শুভ্রা ডাকো তিনবার, তবে শুনব।’
মাহফুজ গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
-‘বি সিরিয়াস।’
সিরিয়াস মুখ করে বললাম,
-‘দুইদিনের জীবনে এত কীসের সিরিয়াসনেস?’
মাহফুজের থমথমে চেহারারটার দিকে তাকালাম। তারপর খানিকটা থেমে আবার বললাম,
-‘১৯৯০ সালে নাজিরশাইল চালের কেজি ছিল ১৫ টাকা। এ-বছরে হলো ২১ টাকা। চালের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে তোমার কি মতামত? বসে আলোচনা করব? আসো৷’
মাহফুজ অত্যাধিক শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর হুট করেই করে বসল সবচেয়ে অভাবনীয় কাজটি, আমার সামনে নতমুখী হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আমি ত্বরিতে আশপাশ দেখলাম, সবাই দেখছে। দেখুক! সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আমার মাহফুজের অনাবৃত ব্যবহারটা। ও কাঁপছে থেমে থেমে। তারপর হুট করেই বলে বসে,
-‘তোমাকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন লাগে, শুভ্রা! জীবনটাকে মরুভূমি আর তোমাকে এক ফোঁটা জল লাগে।’
আমি ওর অস্থিরতা বুঝতে পেরেছিলাম। সাত বছর ধরে তো কেবল ওর চেহারাটা দেখছি না, ওর স্বভাবের আদ্যোপান্ত আমার জানা। ছেলেটাকে ওভাবে কাঁপতে দেখেও আমার মজা লাগছে। ওকে কাঁদতে দেখলেও বোধহয় মজা লাগবে। তখন হয়তো বলে বসব,
-‘এই ছেলে! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদো। ঝুঁকে কাঁদলে আমি দেখব কী করে?’
তখন ওর কান্না থেমে যাবে। অভিমান করবে নাকি? কী জানি! কিন্তু এসব বলা যেত না। মিষ্টি হেসে ওর গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,
-‘আমার প্রাণ!’
রানী রানী ফিল পাচ্ছি। উফ!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯
“সুখের দিনগুলো আলোর বেগে এগোয়। বসন্ত পেরোল আরও একটি। আমাদের দু’জনেরই মাস্টার্স শেষ। আমি প্রাইমারিতে একটা জব পেয়ে গেছি। ওদিকে মাহফুজ জব-টব করতে চাইছে না। এই ছেলেকে নিয়ে আমি কী যে করি! এখন ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যাক! আমার সুখের নীড়ের দেখা পাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারছি না।
আজ এতদিন পর ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, অনেক কিছু লিখব। বিগত এক বছরে আমার জীবনে কী কী হয়েছে, সব লিখব। কিন্তু আশ্চর্য! তেমন কোনো পরিবর্তনই আসেনি। মাহফুজের ভালোবাসা আগের মতোই আছে। আমি ওর চোখে এখনও নিজেকে বিশ্বসুন্দরী হিসেবে দেখতে পাই।
মাঝে মাঝে যখন আমি বিভিন্ন আলাপ জুড়ে দিয়ে হাহা-হিহি করি, তখন ঠিক কতটা মুগ্ধতা নিয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি বুঝতে পারি।
আমি কখনও-সখনও খানিকটা কড়া চোখে তাকাতেই ও বলে, আমার রাগকে নাকি খুব ভয় পায়। অথচ আমার রাগ ও দেখেনি, ওকে দেখাইনি। আমি রাগলে উন্মাদ হয়ে যাই, অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি। আর শেষে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করি।
ছোটোবেলায় একবার আম্মা আমার গায়ে হাত তুলেছিল, অকারণে। আমি অনেক বোঝানো সত্ত্বেও আম্মা আমাকে বোঝেনি। চাপিয়ে দিয়েছিল মিথ্যে আরোপ।
আচ্ছা, যেখানে আমার দোষই নেই, সেখানে কেন শাস্তি পাব? এটা এক ধরনের ঘৃণ্য অপমান। আমি নিতে পারিনি। চুলোয় গরম পানি ছিল, তার ওপরে হাত ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। কী সাংঘাতিক কান্ড! আম্মা সামনেই ছিল, তৎক্ষনাৎ আমার হাতটা উঠিয়ে ঠান্ডা পানিতে দেয়। তার আহাজারি এখনও কানে বাজে। অথচ আমি নাকি ছিলাম নির্বিকার। আমার সে রূপ দেখে সবাই মারাত্মক ভয় পেয়েছিল।
মাহফুজ তা জানে না। জানবেও না। ওকে তো ভালোবাসি। ভয় কেন দেখাব?”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
৪ আগস্ট, ২০০০
মোহ এ অবধি পড়ে অবাক হয়ে গেল। তার মাঝের যেই উন্মত্ততার স্বভাবটা, এটা সে তবে তার মায়ের থেকে পেয়েছে! মোহ ডায়েরিটা পড়তে পড়তে এতটাই তলিয়ে গিয়েছিল যে, তার মনে হচ্ছিল এটা সিনিয়র মোহ! এত মিল তাই?
অথচ মোহ নিজের মা’কে এতটা অশান্ত, অস্থির কখনই দেখেনি। তবে কি বিয়ের পর স্বভাবের পরিবর্তন হলো?
ভাবতে ভাবতেই মোহ পেইজ ওলটাল,
“আট বছরে এই প্রথম মাহফুজের কাছ থেকে কোনোরূপ সারপ্রাইজ পেলাম। আর সেটা যে এত বড়ো হবে, তা আমার কল্পনাতীত ছিল। পরিবারসহ আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মাহফুজ। বয়স বেশি হয়ে গেছে বিধায় এখন আর আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে না।
আম্মা প্রায়ই মরা কান্না কাঁদে। বিষয়বস্তু এ-ই—আমার মতো অর্ধবয়স্ক আনম্যারিড মেয়েকে কে বিয়ে করবে? অথচ আমার বয়স সামনের মাসে ২৬ হবে। বেশি হয়েছে কোথায়?
সে যাই হোক, বিয়ের প্রস্তাব যে এসেছে, এই অনেক ছিল আম্মার জন্য। আম্মা রাজি হবে বুঝে গেছিলাম। কিন্তু তবুও মনের ভেতর একটা আশংকা ছিল।
সেই খুঁতখুঁতানি দূর হলো এটা দেখার পর যে—আম্মা পারে না এখনই আমাকে বিয়ে পড়িয়ে উঠিয়ে দেয়!
তার মতে ছেলে দেখতে-শুনতে মাশাআল্লাহ! পরিবার ভালো, শিক্ষিত। সহায়-সম্পত্তি বেশ আছে। এমন পরিবারে আমাকে দিতে যে পারছে, এ-ই যেন আমার সাত কপালের ভাগ্য, বাণীতে আমার সহজসরল আম্মা।
অতঃপর আম্মার জানার পরিসীমা সংকীর্ণ রেখে আগামী মাসের ২৫ তারিখে আমার বিয়ের তারিখ ধার্য্য করা হলো।
বিঃদ্রঃ আম্মার মতে, অবশেষে তার পছন্দেই আমাকে বিয়ে করতে হলো! খোঁটা দিচ্ছে খুব! বলছে, সে-ই তো আমার পছন্দেই বিয়া করলি, তাও এত ঢং করলি ক্যান, বেয়াদব?
আমি ক্ষণে ক্ষণে কেবল হাসছি।
আজ আমার খুশির নেই সীমানা,
আজ আকাশে উড়তে নেই মানা..
আমার মাহফুজ!”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২১ সেপ্টেম্বর, ২০০০
“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! তার নামের তিন কবুল পড়লাম। তার বোনেরা এখন আমাকে তার ঘরে সাজিয়ে বসিয়ে রেখে গেল। একটু পরই ও আসবে। মেয়েরা দু’জায়গায় আটকায়; প্রেমিকের চোখে প্রেম দেখে, স্বামীর চোখে আসঙ্গ দেখে।”
স্বর্ণশেফা হাওলাদার
২৫ অক্টোবর, ২০০০
তারপর ডায়েরইটি খালি। মোহর মনে হলো—এখানেই শেষ। পরক্ষণেই নিজেকে থামাল। না! কোনোকিছুর সমগ্ররূপে শেষ নেই, শেষাংশ ধরে সবেরই আরেক শুরু আছে। মোহ বাকি ডায়েরিগুলো উলোটপালোট করে খুঁজতে লাগল। নাহ, আর ডায়েরি নেই। মোহর ধারণা, শেফার আরেকটা ডায়েরি থাকবে। থাকা অবশ্যম্ভাবী।
তখনই বিছানার ওপর সাইলেন্ট মোডে রিং হতে থাকা ফোনটায় চোখ গেল মোহর। ঘড়িতে বাজে দুপুর তিনটে। সকাল থেকে এসবেই আছে ও। একদমই সময়জ্ঞান ছিল না।
তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করতেই রঙ্গন বলে উঠল,
-“কী ব্যাপার, মিসেস? না কোনো কল, না ম্যাসেজ! ভুলে-টুলে গেলে?”
মোহ বড়ো করে দুটো শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে ফেলে বলল,
-“সম্ভব নয়।”
রঙ্গন হাসে,
-“রুমে কী করছ?”
-“বুঝলে কী করে?”
-“নাফসিন বলল।”
-“ওর সাথে কনট্যাক্ট আছে?”
প্রশ্নটা করেই মোহ বুঝতে ফেলল, সে কতটা নির্বোধের মতো প্রশ্ন করেছে। যোগাযোগ থাকতেই পারে। স্বাভাবিক ব্যাপার!
মোহর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না রঙ্গন, পালটা প্রশ্ন শুধাল,
-“সকাল থেকে খাওনি কেন?”
মোহ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-“ভুলে গেছি খেতে।”
-“আমার ফিরতে দেরি হতে পারে।”
-“তাই কী?”
-“নিজের খেয়াল রাখতে বলেছিলাম।”
-“রাখছিই তো।”
-“রাখছ না। দেখি শুকনো মুখটা! ভিডিয়ো কলে এসো।”
মোহ ক্যামেরা অন করল। রঙ্গন একটা ক্যাফেতে ছিল। মোহ রঙ্গনের মুখের দিকে তাকানোর আগেই চোখ চলে গেল তার ঘাড়ের পাশ কাটিয়ে পেছনের দিকটায়। একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে এসে রঙ্গনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে খুবই উৎকণ্ঠিত গলায় কিছু বলল। ক্ষণিকে ঘটা ঘটনাটিতে মোহ-রঙ্গন, দু’জনেই হকচকিয়ে গেল। রঙ্গন হতবিহ্বল হয়ে ত্বরিতে কল কেটে দিলো। মোহ ফোনটা একই ভঙ্গিমায় ধরে স্থির বসে আছে। মস্তিষ্কশূন্য হয়ে পড়েছে তার। কী হলো এটা?
চলবে..