#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
“অয়স্কান্ত না-কি প্রাণ?
কিংবা অভ্রান্ত? আর সহসা অধিকার!
কী বলে ডাকি তোমায়? তোমায় বরং আমি আমার ‘নিজস্বতা’ বলেই ডাকি, কেমন?
অসংবেদনশীল নিজস্বতা,
বিশেষণটির জন্য তোমার খারাপ লাগলে, আমি খানিকটাও বিচলিত হব না। তোমার খারাপ লাগা অবশ্যম্ভাবী। কেননা তুমি থমকেছ আমার মতন পাষণ্ডীর প্রমত্ততায়। কেননা আমি নিষ্ঠুর, আমি উগ্র, আমি ক্রূরমতি, আমি অকরুণ, আমি যন্ত্রণাপদ, আমি হৃদহীনা।
আর?
আমি অসুখ, আমি সঁজীবনী,
আমি বিচ্ছেদ, আমি আসঙ্গী।
আমি অবিনাশী, আমিই বিনাশিনী।
মধ্যাস্থে আমি কদর্য। অথচ, তুমি আমার হীন হৃদয়ের এক ভারি দুঃসাহস।
তুমি আমার ত্রপিত কায়ার দুর্বিনীত কৃতি..
তুমি আমার ত্রপিত কায়ার বেহায়াপনা, ঔদ্ধত্য, আস্পর্ধা, চপলতা, ধৃষ্টতা।
আমি অভিশঙ্কী। অন্যথায় ধ্রুব, অবধারণীয়।
আমি তত্রাচ, স্বল্পোক্তিপ্রবণীয়। আমি অধিষ্ঠিত, অস্তিত্বশীল।
তুমি অতীতকে আঁকড়ে থাকা সম্মুখে দণ্ডায়মান কাল; তমসাচ্ছন্ন, ক্ষীণালোকীয়। আমি বিদ্যমান, ঘটমান; অঁজিষ্ণুর ন্যায় নিশিত।
তুমি সুহৃৎ। আমি দ্বীষৎ, আমি মৃত্যু।
তুমি স্থির। আমি তোমার স্থিরত্বের মাঝের বিস্তর চঁচলতা, অধীরতা।
উপসংহারে আমি তোমার নিষিদ্ধতা, আমি তোমার নিজস্বতা। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে তুমি খানিকটা।
আর আমি দুযতি,
উদ্দীপ্ত আগুনের শিখার মাঝেও স্থির নীলত্বের ছায়া বিদ্যমান। ওটা তুমি।
ইতি
তোমার প্রতিমুখ!
২২/১১/২০১৯ (মঙ্গলবার)”
রঙ্গনের যাওয়ার পর মোহ ডাকবাক্সের চিঠিগুলো নিয়ে বসেছিল। এই চিঠিটা ছিল রঙ্গনকে দেওয়া তার অষ্টম চিঠি। রঙ্গন এটা হাতে হাতে পেয়েছিল। মোহ সেদিন চিঠিটা রঙ্গনের মুখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-“বাবুসাহেব, চিঠি এসেছে। পড়তে চান?”
রঙ্গন ততদিনে অসন্দিগ্ধ—চিঠি পেতে হলে, তাকে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। তাই অজ্ঞতা না দেখিয়ে মাথা উপর-নিচে নেড়ে বলল,
-“বিনিময়ে কী চাই?”
মোহ ভাবলেশহীন জবাব দেয়,
-“গাড়ি চালানো শেখাতে হবে।”
রঙ্গন চকিতে বলে ওঠে,
-“তুমি আন্ডার এইটিন..”
মোহ নির্বিকার,
-“তো? জীবনে শখ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই নাকি?”
-“তা কখন বললাম?”
-“তবে আটকাচ্ছ কেন?”
-“তোমার সেফটির প্রসঙ্গ এলে, আমি যে-কোনো কিছুতে ফুলস্টপ টেনে দিতে পারি।”
মোহ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তো তোমাকে কে বলল—ড্রাইভিং শেখা খুবই আনসিকিউরড কিছু?”
রঙ্গন পালটা শুধায়,
-“কথার প্যাঁচে না ফেলে একদম শেষ মাথায় গিয়ে ঝেড়ে কাশো।”
মোহ সত্যি সত্যি খানিকটা কেশে বলল,
-“শিখিয়ে রাখো, এখন হুটহাট গাড়ি নিয়ে বেরোব না।”
-“তোমাকে বিশ্বাস করব বলছ?”
-“আমি শত ভুল করলেও, আমাকে অবিশ্বাস করার তোমার কোনো ওয়ে নেই, রঙ্গনদা। একচ্যুয়ালি তুমি পারবেও না।”
রঙ্গন হেরে গিয়ে অবশেষে বলল,
-“ওকে, শেখাব। এবার চিঠিটা দাও।”
মোহ চিঠিটা আলগোছে খানিকটা দূরে সরিয়ে বলল,
-“আমার শেখা হয়ে গেলেই পাবে। হাতে হাতে কাজ হবে। হু?”
তারপর আর এই চিঠিটা রঙ্গনকে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি বারান্দা বলে, একে-অপরকে অজস্র চিঠি, চিরকুট ছোঁড়া হতো সময়ে-অসময়ে। মোহ সে-সবই এই ডাক বাক্সে রেখে দিয়েছিল। ক’টা চিঠি তার নিজের লেখা, যা রঙ্গনের হাতে যায়নি এখনও। এই চিঠিটাও সেরকম একটা। মোহ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।
বারান্দায় গিয়ে গলার আওয়াজটা খানিক উঁচুতে তুলে ডাকল,
-“র-ঙ্গ-ন!”
রঙ্গন বেরোবে বেরোবে মুহূর্তে মোহর আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় ফিরে আসে। মোহ চিঠিটি হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়, তা সামনের বারান্দাটিতে পড়া মাত্র মোহ বলে ওঠে,
-“উড়ো চিঠি, তাকে বলে দিয়ো। প্রেম নোঙরের নাবিক বানানোতে ড্রাইভিং না শেখানোর ক্ষমা মঞ্জুর হলো। অবশেষে তার দ্বার গোড়ায় তার সম্মানীটা পাঠালাম। চার বছর পুরোনো চিঠি কিন্তু! ফিরতি চিঠি তৈরির সংকল্প যেন পড়া মাত্র গাঁথা হয়!”
রঙ্গন চিঠিটা নিয়ে নিল। মোহ ঘুরে রুমের ভেতর চলে এলো। রঙ্গন চলে গেল ঘন্টার মাঝেই। মোহ চিঠিগুলো গুছিয়ে ফের বাক্সবন্দী করে কেবিনেটে তুলে রাখল। কাউচে বসল। সেন্টার টেবিল থেকে পানির বোতল নিল। অর্ধেকটা খেয়ে জায়গামতো রেখে গা এলিয়ে দিলো। গরম লাগছে, এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। অন্তস্তলের অস্থিরতা মোহ অনুভব করতে পারছে।
ভাবপ্রবণতারা রাজত্ব চালাচ্ছে সর্বক্ষণে, সর্বাঙ্গে। কানের কাছ দিয়ে এগোতে থাকা অগ্নিসখেরা গুন-গুন করছে,
-“রঙ্গন নেই, রঙ্গন নেই..”
মোহ অস্থিরতা ক্রমে বাড়তে থাকে। সে হাঁসফাঁস করতে লাগে। হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।
থরথর করে কাঁপতে লাগে। হাত-পা কাঁপছে, বুকের ভেতরটা কাঁপছে। দমবন্ধকর লাগছে। এতদিন রঙ্গনের পাশে থেকে আর নিজেকে সময় দিতে পারেনি। অতিমাত্রায় ফর্সা হওয়ায়, কাঁদলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দৃঢ়; তাই কাঁদেনি।
আজ মোহর নিজেকে সময় দিতে ইচ্ছে করছে, কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আস্তে-ধীরে ফোঁপাতে লাগে। কান্নারা যখন আওয়াজ তুলতে লাগল, মোহ কামড়ে ধরল নিজের হাত। পুরো শরীর থমকে থমকে উঠছে। মোহ থামে না। মনে মনে বিলাপ করতে লাগে,
-“আব্বু, আ-ব্বু! আম্মু! আব্বু-আম্মু! কই? তোমরা কই? আমি কী দোষ করেছিলাম? এতটা অসহায় কেন লাগে? আল্লাহ! মরে যাচ্ছি!”
বিশ্বাসের পর্দা যখন হুট করেই ছিঁড়ে যায়—অনুভূতিরা তখন হোঁচট খায়, আবেগ গা ঝেড়ে পালায়। এতদিন সেই নির্বিকারত্ব নিয়ে মোহ এগোলেও, এখন আর পারল না। হয়ে উঠল বাঁধভাঙা।
কাঁদতে কাঁদতে মোহ ফ্লোরেই পড়ে রইল, একসময় ঘুমিয়েই গেল। তখন বাজে বিকেল চারটে।
______
রঙ্গন পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে মোহকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করল, তখন এ-দেশে রাত দুইটা। মোহ ঘুমিয়ে। মেঝেতে ফোন ভাইব্রেট করছে। মোহ ঘুমের মাঝেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। মাথাটা প্রচণ্ড ভার হয়ে আছে। শীত শীত লাগছে। এদিকে এসির টেম্পারেচার বাড়ানো, ফ্লোরে সমগ্র গা, বাইরে বৃষ্টি; আবহাওয়াও হীম। এমনিই অল্পতে সর্দি বাঁধানোর এক চমৎকার গুন মোহনা আফরিনের আছেই। তার ওপর এ তো, নিজেকে অসুস্থ করার জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন।
দু’বার রিং হতেই মোহ সচকিত হলো। মাথা সামান্য উঁচিয়ে ফোন খুঁজল। পেল বিছানা ঘেঁষে। ডিস্প্লেতে চকচক করছে সাধের পুরুষটি, “নিজস্বতা!”
পাশে একটা অগ্নির ইমোজি। মোহ সবসময় রঙ্গনকে বলত,
-“তোমাকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা লাগে রঙ্গন, মাঝে সাঝে! তুমি খানিকটা ছুঁলেই আমার দেহে দহন ঘটে। আমি মোহিনী, অগ্নিকন্যা। আগুনে আগুন লাগে না, আমি বরঞ্চ ঠিকই থাকি। তবে তোমাকে ছাই বানিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।”
রঙ্গন তাতে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মোহর থেকে দূরত্ব বাড়ায়। মেয়েটার চোখে জ্বলজ্বল করে কামনার আগুন। রঙ্গন তা হতে নিজেকে খানিক সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রিয় নারীর এহেন চাহনি উপেক্ষা করা কোনো সাধারণ পুরুষের সাধ্যে নেই। এদিকে রঙ্গন অসাধারণ। সে শুষ্ক চুমুতেই মনের চাহিদা মেটাত। দেহেরটার সময় হয়নি এখনও।
চতুর্থ রিং হতে গেলে মোহ কল রিসিভ করল। আধ-ভাঙা আওয়াজে বলে উঠল,
-“উম, পৌঁছেছ?”
রঙ্গন প্রশস্ত হেসে বলল,
-“ফ্রেশ হয়েই কল দিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে, না? ওয়াজিহ্ মেজবাহ খুব সরি, ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার উঠে মুখ ধুয়ে কফি বানিয়ে আনো, খানিকটা কথা বলি।”
মোহ নিজের আওয়াজটা ঠিক করতে পারছে না। গলায় উশখুশ করছে। সামান্য গলা ঝেড়ে বলল,
-“উম, ওকে।”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো রঙ্গনের আতংকিত আওয়াজ,
-“মোহ, তুমি ঠিকাছ?”
-“ঠিকাছি।”
-“তবে আওয়াজ এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?”
-“হুম।”
-“হঠাৎ? মোহ?”
-“কিছু না, রঙ্গন। তেমন কিছু না।”
-“কিছু না বলছ? এদিকে তো কথাই বলতে পারছ না! কী মারাত্মক অবস্থা!”
মোহ হাসে সামান্য। রঙ্গন গম্ভীরমুখে বলে উঠল তখন,
-“মোহ, তুমি কেঁদেছ?”
মোহ অস্বীকার করতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। এই ছেলেটা তাকে এত বোঝে কেন? দুনিয়ার সবার কাছ থেকে মোহ নিজেকে লুকোতে পারলেও, দু’জনের কাছে কখনই পারেনি। শেফা আর রঙ্গন। মোহ মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা হেলে দিলো। কলটা স্পিকারে রেখে এক হাতে সামনে ধরে রাখল।
রঙ্গন ফের বলল,
-“মোহ!”
মোহ মলিনমুখে শুধায়,
-“হু-উম?”
-“কেঁদেছ?”
-“জিজ্ঞেস কোরো না। তোমাকে মিথ্যে বলতে কষ্ট লাগবে।”
রঙ্গন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। ইচ্ছে করল সব ছেড়েছুড়ে এখনই ফিরতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই বলল,
-“আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে এসো।”
-“ঠিকাছে।”
-“মোহ, শোনো!”
-“কী?”
-“তুমি খোলসে আবৃত থেকো না, অন্তত আমার সামনে। আমি তোমাকে ততটুকুই বুঝতে পারি, যতটুকু তুমি বুঝতে দাও। এর বাইরে খানিকটাও আমার সাধ্যে নেই।”
মোহ হাসে। অশ্রবণীয় কিছু কথা মোহ মনে মনে আওড়ায়,
-“রঙ্গন, একটা মানুষকে পুরোপুরি বোঝা যায় না। আর মোহকে বোঝা কোনো মানুষের সাধ্য না। মোহকে বুঝে গেলে, পৃথিবীতে ‘ভালোবাসি’ শব্দের ব্যবহার খুব কমে যেত। এত বড়ো অন্যায় মিছে অনুভূতিরা মানতে পারত না। তাই মোহ ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কিছু।”
চলবে..