#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
-“একটা থাপ্পড় মেরে হ্যাঁ/হুঁ ছুটিয়ে দেবো। সকালে দরজা খুলছিলে না বলে কলিজা শুকিয়ে গেছিল আমার। এক্সট্রা কি দিয়ে ভেতরে এসে দেখি মেডিসিন গিলে মরার মতো ঘুমাচ্ছ। একেবারে মেরে দিই?”
মোহ মলিন চোখে রঙ্গনকে দেখল। রঙ্গনের বুকের বাঁ-পাশটায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল,
-“এইখানটায় আমি ছাড়া অন্য কেউ, আই সোয়্যার, আমি তোমাকে মেরে দেবো।”
রঙ্গন নির্নিমেষ চোখে মোহকে অবলোকন করল। মেয়েটার মাঝের তেজটা বেড়েই চলেছে, যেখানে কালকের ঘটনায় তার নেতিয়ে পড়ার কথা! মেয়ে মানুষ অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। তারা সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে জানে, ঠিক তেমনই মিনিটের ব্যবধানে মানিয়ে নিতেও জানে।
রঙ্গনের ইচ্ছে হলো, মোহর বাবার ব্যাপারে সবটা মোহকে জানাতে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে দমিয়ে ফেলল। এ-বিষয়টাকে এখানেই ক্লোজ করে দেওয়াই ভালো।
মোহ উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। ফিরে রঙ্গনকে বেডশিট গোছাতে দেখল। মোহ পাশকাটিয়ে ডাইনিংয়ে চলে এলো। আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়িটা। মোহর ফুপি ও কাকারাও এসেছে। মোহকে দেখে ক’জন এগিয়ে এলো। বিভিন্নভাবে স্বান্তনা দিতে লাগল। মোহর সেগুলোর খুব একটা প্রয়োজন পড়ছে না। সে কিচেন থেকে খাবার বেড়ে এনে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে খেতে লাগল।
মোহর এরূপ আচরণে বাকিরা মুখ কুঁচকে বিভিন্ন কথা-বার্তা বানাতে লাগল। অনেকে তো এ-ও বলছে—বাপের সম্পত্তি যেন পরের পক্ষের বাচ্চারা না পায়, এজন্য সব লিখে নিয়ে বাপকে মেরে দিয়েছে মোহ নিজেই। কী স্টুপিড কথা-বার্তা!
মোহ আপন তালে খাওয়া শেষ করল। হাত ধুয়ে আবার রুমে ফিরে যেতে গেলে, তার কাকি আটকে ফেলে। চতুর চোখে তাকিয়ে বলে,
-“মোহনা, কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”
মোহ তার দিকে তাকাল, নিজ স্বভাবে আবৃত থেকেই বলল,
-“বলুন।”
-“আমার সাথে চলো।”
রেনু মোহর হাত ধরে তাকে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে এলো। এখানে লোক সমাগম নেই। রেনু আশপাশটা দেখে মোহকে শুধাল,
-“নাজমা আসার পর আমরা যেদিন এসেছিলাম, সেদিন কি তোমাকে সাবধান করিনি?”
মোহর মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথাটা। নাজমা এ-বাড়িতে আসার পরই কাকা-কাকিরা এসেছিল। রেনু মোহকে অনেক বুঝিয়েছে। সব কিছু মেনে নিতে অবশ্য বলেনি, কিন্তু কারো সাথে কোনো ঝামেলা করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। মোহ এমনিতেও কোনো ঝামেলা করত না।
রেনু আবার বলল,
-“ভাইয়ার মারা যাওয়ার পেছনে কোনোভাবে তোমার হাত তো নেই, মোহনা?”
মোহর হাত একেবারেই নেই বললে ভুল হবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে মাহফুজ সাহেবের মৃত্যু হয়েছে। আর সেই মানসিক চাপটার ৮০-শতাংশ মোহর দেওয়া।
মোহ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
-“তা কেন মনে হলো?”
-“কারণ তোমার বাবা খুব ফিট একজন মানুষ ছিলেন। এভাবে অকালে চলে যাওয়ার মানেই নেই!”
মোহ হাসতে লাগল,
-“আমার আম্মুকেও তো এত জলদি হারানোর কোনো মানে ছিল না। তবুও হারালাম। তবে কি আমার বলা উচিত—আম্মুর মৃত্যুটাও রহস্য। আচ্ছা, আপনার সাথে পেঁচিয়ে লাভ নেই। খুলেই বলি। আমার কি ভাবা উচিত—আম্মুকে খুন করা হয়েছে? আমার আব্বু খুন করেছে?”
-“তোমার আব্বু-আম্মুর মাঝের বন্ডিংটা তুমি জানো, মোহনা। তারা একে-অপরকে সামান্য আঘাত দিয়েও কোনো কথা বলতে জানে না।”
-“আমার আব্বুকে আমি এতকাল নিজের একার আব্বু জানতাম। শেষমেষ তো ঠিকই দেখলাম—তাকে ডাকার জন্য আরও দু’জন আছে।”
-“মৃত মানুষের প্রতি এত অভিযোগ?”
-“ঠিক অভিযোগ না। চাপা ক্ষোভ। আরও একশ মরন মরলেও, এই ক্ষোভগুলো যাবে না, কাকিমা।”
-“মানুষটা আর নেই, রাগটা কমাও!”
-“মানুষটা আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। যতদিন মনে থাকবে, ততদিন রাগগুলো নামবে না। এদিকে তাকে ভোলাটাও অসম্ভব।”
রেনু গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
-“রাগটা তবে ভেতরে ভেতরেই দেখাও। বাইরে খানিকটা মূর্ছা যাওয়ার অভিনয় করো। বাইরের মানুষের সামনে কেন নিজের রাগ প্রকাশ করবে? এরা তোমার মনের ব্যথা বুঝবে না। তুমি যা দেখাবে, এরা তাই দেখবে। এরা তোমার দেখানোর ওপর ভর করে মনগড়া কাহিনি বানাবে।”
মোহ সরু চোখে তাকায়। রেনু আবার বলে,
-“তুমি কি জানো—এরা তোমাকে খুনি বানিয়ে দিচ্ছে? তুমি তোমার বাবার মৃত্যুতে কাঁদোনি বলে, এরা তোমাকে তারই মৃত্যুর দায়ী বানাচ্ছে। তোমাকে একা নয়। নাজমাকেও এরা ছাড়ছে না। আমি জানি—ভাইয়ার মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছে। কিন্তু এরা ভাবছে, তোমাদের পারিবারিক কূটকৌশলে লোকটার মৃত্যু হয়েছে। কতটা হীন ভাবনা, ভাবতে পারছ?”
মোহ থেকে থেকে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলে,
-“পারছি।”
-“এজন্য বলছি—স্বাভাবিক আচরণ করো।”
-“আমি কি অস্বাভাবিক আচরণ করছি?”
-“অবশ্যই। এখন তোমার উচিত কান্না করা। সেটাই স্বাভাবিক। আর তুমি তা করছ না।”
-“আমার কান্না না পেলে কী করব?”
-“নাটক করবে। নাটক করে কাঁদবে। মেয়েরা অভিনয়ে নিঁখুত হয়।”
-“পারব না, দুঃখিত! এতে যার যা ইচ্ছা ভাবনা হয়, ভাবুক।”
রেনু থেমে যায়। মোহর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“মোহনা, আমি তোমায় বিয়ে করাতে চাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আম্মার সাথে এই নিয়ে কথা বলব। তোমার কী মতামত?”
মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“এ-নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাদের।”
-“কেন? পছন্দ করা আছে?”
-“আছে।”
-“কে?”
-“সময়মতো আয়োজন সমেত জানিয়ে দেওয়া হবে।”
-“অপেক্ষায় রইলাম।”
______
মাহফুজ সাহেবের মৃত্যুর পরের সাতদিনের স্তব্ধতা কাঁপিয়ে তুলল পুরো কলোনি। চারপাশে নানান গুঞ্জন! বলা যায়, আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে এই বাড়ির ঘটনাগুলো। পান থেকে চুন খসলেও তা নিয়ে হয় বিস্তর বৈঠকী গল্প।
একটা মিটিং হ্যান্ডেলের জন্য মাহফুজ সাহেবের দেশের বাহিরে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর স্থানে সময়মতো রঙ্গন চলে যাবে। সপ্তাহখানেক পর ফিরবে। সব প্যাকিং শেষে রঙ্গন এ-বাড়িতে এসে মোহর রুমে গেল। এ-কয়দিন বাড়িতে মানুষ ভর্তি হওয়ায় মোহর কাছ ঘেঁষাটাও কষ্টসাধ্য ছিল।
মোহ কাউচে নিজের পুরোনো ডাকবাক্সটা নিয়ে বসে ছিল। অসংখ্য রঙ-বেরঙের চিঠি আর চিরকুট সেন্টার টেবিলে এলোথেলোভাবে ফেলে রাখা। মোহ একটা একটা করে দেখছে। পুরোনো স্মৃতি অন্তরে শান্তির হাওয়া সৃষ্টি করে, অতীত থেকে তৈরি সেই হাওয়া বর্তমানের অস্তিত্বশীল অগ্নিকে বাড়িয়ে দেয়। মোহর অবস্থা অনেকটা তেমনই।
রঙ্গন রুমে এসে দরজা আটকে দিলো। মোহর সামনের টেবিলের কাগজগুলো একপাশে সরিয়ে সেখানে বসে পড়ল। মোহ শুধিয়ে উঠল,
-“হঠাৎ এলে?”
রঙ্গনের ঠোঁটের আগায় এনে রাখা জবাবটা সে দিলো,
-“আমাদের প্ল্যান করে কিছু হয়নি।”
মোহ দু’দিকে মাথা নাড়ায়,
-“তা বটে!”
-“মোহ, তুমি তো জানোই আমাকে সিঙ্গাপুর যেতে হবে।”
-“হুম..”
-“সন্ধ্যার পর ফ্লাইট।”
-“ওহ! একটু পরই তো বেরোবে তবে!”
মোহর দায়সারা কথাবার্তা রঙ্গনের আজ ভালো লাগছে না। রঙ্গন হ্যাঁচকা টানে মোহকে নিজের উরুর ওপর এনে বসাল। এক হাত কোমরে স্থির ও অন্য হাত ক্রমাগত মোহর গাল ও গলার সন্ধিক্ষণে স্লাইড করে যাচ্ছে। মোহ নিজের ভার রাখতে রঙ্গনের কাঁধের কাছের টিশার্টটি আঁকড়ে ধরেছে। রঙ্গন ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল,
-“তোমাকে না ছুঁয়ে থাকতে পারি না, তোমার কি আমার থাকা না-থাকাতে কিছু আসছে-যাচ্ছে না?”
মোহ হিমায়িত চোখে তাকিয়ে রয়। তাতে রঙ্গন আরও খানিকটা জোর প্রয়োগ করে দূরত্বটা মিটিয়ে নেয়। মোহ বলে উঠে,
-“সামাজিক স্বীকৃতি হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান চাই।”
রঙ্গন হতাশ হয়ে বলে,
-“তোমার বাবা মারা গেছে ক’দিন আগেই। এখন সম্ভব নয়, সোনা।”
-“কেন সম্ভব নয়?”
এই প্রশ্নটা করার মতো অবুঝ মোহ নয়। রঙ্গন তা জানে। আর প্রশ্নটা থেকে পাওয়া উত্তরে প্রেক্ষিতে যে মোহ ধারালো কিছু একটা বলবে—তারও আন্দাজ রঙ্গনের আছে।
রঙ্গন মোহর সমগ্র মুখে চোখ বুলিয়ে বলল,
-“তোমার অনুভূতি সম্পর্কে কেবল তোমার কাছের মানুষরাই বুঝবে। সমাজ মজা নিতে এক চুল ছাড়ও দেবে না।”
-“সেই সমাজের তোয়াক্কা আমি করি না, যেই সমাজ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে না অথচ বিপদে ঠেলে দিতে দু’বার ভাবে বা। সেই সমাজকে এই মোহ তোয়াক্কা করে না, যেই সমাজ মোহনার চাঞ্চল্যকে মোহর নিশ্চুপতায় পরিণত করতে চেয়েছিল..খানিকটা সাফল্য পেয়েছেও!”
কথাগুলো কতটা গভীর ছিল তা আপাতদৃষ্টিতে খেয়াল করে বোঝার উপায় নেই। রঙ্গন চাক্ষুষ বান্দা, সদাজাগ্রত চোখে তাকিয়ে রইল। মোহ তা খেয়াল করে হেসে ওঠে। যেই হাসিতে প্রাণ নেই, নিঃসন্দেহে সেই হাসি ভয়ঙ্কর; মৃত হাসি মৃত মানুষ অপেক্ষা অধিক ভয়ঙ্কর।
রঙ্গনের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। সে মোহর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“তোমাকে ছাড়া আমি এক দণ্ড স্বস্তিও পাই না। মোহ, আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার।”
মোহ নরম গলায় মিনমিনে আওয়াজে বলল,
-“হু..”
রঙ্গন একই ভঙ্গিতে ফের বলল,
-“টেক কেয়ার অব্ ইওয়োর হার্ট, মাই লাভ!”
চলবে..