#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
রাতের খাবার সেড়ে সবাই নিজেদের রুমে চলে যাওয়ার পরপরই নাফসিন মোহর রুমে এলো। সে ফোঁপাচ্ছে। মোহ কপাল কুঁচকে তাকাল। বাচ্চাটাকে সে এর আগে কাঁদতে দেখেনি।
মোহ তবুও কিছু বলল না, একটা বই বের করে তাতে মুখ ডোবাল। নাফসিন এগিয়ে এসে বলে,
-“আপা, আমাকে জিজ্ঞেস করো—কেন কাঁদছি?”
মোহ জিজ্ঞেস করে না। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কেবল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নাফসিন নিজ থেকেই বলা শুরু করে,
-“তুমি এতদিন কই ছিলে, আপা? আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।”
মোহ জিজ্ঞেস করে,
-“মিস করেছ?”
-“হু, হু।”
-“কেন?”
-“জানি না।”
-“কেন জানো না?”
-“তা-ও জানি না।”
-“জানো কী?”
-“তোমাকে মিস করেছি।”
মোহ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে জানায়,
-“ভালো কথা। এতে কান্নার কী আছে? কাঁদছ কেন?”
-“জানি না।”
-“তুমি ছিচকাঁদুনে?”
নাক টেনে নাফসিন জবাব দেয়,
-“নাহহ!”
-“তবে?”
-“আপা, আমাকে ভালোবাসো তুমি?”
মোহ কিছুক্ষণ অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। নরম গলায় শুধায়,
-“ভালোবাসা অর্থ কী?”
-“জানি না, সবাই যা বলে তাই।”
-“ভালোবাসা মানে কী বোঝো, নাফসিন?”
নাফসিন তাকিয়ে থাকে। মোহ তাড়া দেয়,
-“বলো।”
নাফসিন না ভেবে পরমুহূর্তেই বলে,
-“আদর বুঝি। আম্মু, আব্বু, নুর, দাদুন, মেজবা ভাইয়া, রূশীপু, রফিক চাচু আরও অনেক্কে আমাকে আদর করে। কারণ তারা আমাকে ভালোবাসে। তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো না?”
-“তোমাকে ভালোবাসার মানুষের তো অভাব নেই, তাইনা?”
-“হু।”
-“তবে আমারটা না পেলে খুব একটা সমস্যা হবে না।”
নাফসিন টেনে টেনে বলল,
-“নায়ায়ায়া! আমার তোমার ভালোবাসা লাগবে।”
-“কেন লাগবে?”
-“জানি না।”
-“জানো না?”
-“উঁহু।”
-“আচ্ছা, খোঁজ লাগাও। জানার পর আমাকে জানিয়ো। তখন ভালোবাসব।”
নাফসিন অসহায় চোখে তাকায়। এখন কোত্থেকে জানবে? নুরশীনকে জিজ্ঞেস করলে হাজারটা প্রশ্ন করবে, তারপর মোহর কথা জানতে পারলে বকে দেবে। মা এসব বলবে না, দাদুনকে জিজ্ঞেস করা যায়! এক নিমিষেই নাফসিনের মলিন চেহারা উজ্জ্বল হলো।
দৌড়ে জয়তুননেসার কাছে যায়। জয়তুননেসা পান চিবাচ্ছেন। নাফসিনকে দেখে আঁড়চোখে তাকিয়ে শুধান,
-“কী?”
নাফসিন দাঁত কেলিয়ে হাসে,
-“দাদুন, ভালোবাসা কী?”
আশ্চর্য ভঙ্গিমায় জয়তুননেসা জানার তাগিদ দেখান,
-“হঠাৎ ক্যান?”
-“উহহু! বলো না!”
-“কঠিন শব্দ! বড়ো হইলে একাই বুঝবা।”
-“এখন বোঝাও!”
-“বুঝবা না কইলাম!”
-“বুঝব, তুমি বোঝাও।”
জয়তুননেসা সন্দেহবাতিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অবশেষে নাতির অত জোরে বলতে লাগেন,
-“ভালোবাসা হইলো ভালো লাগা আর ভালো থাকার সমন্বয়। আমরা মানুষ কিছু মানুষকে খুব পছন্দ করি, তাদেরকে আমাদের ভালো লাগে। আবার কিছু মানুষের কাছে আমরা ভালো থাকি। সবার কাছে দুইটা জিনিসই পাওন যায় না। যাদের কাছে পাওন যায়, আমরা তাদের ভালোবাসি। বুঝছ?”
-“ওকে!”
নাফসিন এটুকু বলেই ফের ছুটল মোহর ঘরে। জয়তুননেসা দৃষ্টি ফিরিয়ে স্বীয় কর্মে মত্ত হন।
মোহ বইয়ে ডুবে ছিল, এমন টাইমে নাফসিন আবার আসে। এতক্ষণ দাদুনের বলা প্রতিটা কথা আওড়াতে আওড়াতে আসছিল, প্রায় মুখস্ত বলা চলে। মোহর সামনে এসেই উগলাবে তা। সেই হিসেবেই এগিয়ে এলো।
মোহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হুবহু একই বাক্য রিপিট করল। দাঁড়ি-কমাটাও বাদ পড়েনি। মোহ চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
-“কার কাছ গিয়ে এই মুখস্ত বিদ্যাটা কাজে লাগালে?”
নাফসিন হেসে হেসে দাদুনের নাম নেয়। মোহ শুধায়,
-“সমন্বয় অর্থ কী?”
নাফসিন জানে না এর অর্থ। মোহ নেক্সট কুয়েশ্চন করে,
-“ভালো থাকা কী?”
এর উত্তর নাফসিনের জানা। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল,
-“আমি জানি, কিন্তু এক্সপ্লেইন করতে পারছি না।”
-“করতে হবে। চেষ্টা করো।”
-“আব্.. দরকারের সব পেয়ে যাওয়া?”
-“দরকার কী?”
-“যা লাগবে।”
-“কী লাগবে, নাফসিন?”
-“ভালোবাসা লাগবে।”
-“পাচ্ছ?”
-“পাচ্ছি।”
-“যদি সব পেয়েই যাও, তবে আমাকে কী জন্য দরকার?”
জবাবে নাফসিনের মাথা আউলিয়ে গেল। তার ছোট্ট মস্তিষ্কে এত বড়ো বড়ো কথা ধরছে না। মোহর দিকে সে চোখ পিটপিট করে তাকায়। মোহ শান্ত স্বরে বলে,
-“তোমার দাদুনের দেওয়া ভালোবাসার সঙ্গাটা রিপিট করো তো!”
নাফসিন পুরোটা আবার বলে। মোহ শুনে নিয়ে ধীরে সুস্থে বলল,
-“তোমার মুখস্ত বিদ্যা ভালো। গো এহেড!”
নাফসিন চুপ হয়ে আছে। মোহ একটা ডাউট শুধায়,
-“দাদুনের মতে ভালোবাসা হচ্ছে ভালো লাগা আর ভালো থাকার কম্বিনেশন। এতে তুমি একমত?”
না বুঝেই নাফসিন ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ওপর-নিচ নাড়ল। মোহ তাতে বলল,
-“আমার কাছে তুমি ভালো থাকছ না, আমাকে ভালো লাগার মতোও কোনো কারণ নেই। ভালোবাসাটা তবে কেন বললে?”
নাফসিন জানে না। তার মুখ মলিন হলো। কান্না পেল। ঠোঁট উলটে ফোঁপাতে লাগল। মোহ ওর কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো করে বলল,
-“তুমি খুব আদুরে। কিন্তু আমার তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না। খুব সেলফিশ আমি। তুমি না চাইতেও ভাগ বসিয়েছ। আ’ম সরি, আই কান্ট লাভ ইউ!”
ঠোঁট উলটিয়ে নাফসিন বলল,
-“কী করেছি, আপা?”
মোহ বইটা বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে চোখের চশমা খুলতে খুলতে বলল,
-“বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তিটা তাদের জন্য কম পড়ে গেলে, বাচ্চাদের ওপর এসে পড়ে। তুমি বাচ্চা মানুষ, মিছে মায়ায় জড়িয়ো না। রাত হয়েছে, রুমে গিয়ে ঘুমাও।”
প্রথমে নরম করে বললেও, শেষে এসে মোহর গলা শক্ত হয়ে আসে। নাফসিন রুম থেকে চলে যায়। মোহ সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
-“বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তিটা তাদের জন্য কম পড়ে গেলে, বাচ্চাদের ওপর এসে পড়ে। তুমি কিছু করোনি, নাফসিন! আবার না করেও অনেক কিছু করেছ। তোমার বাবা-মায়ের অসহায় চেহারা দেখে মজা পাচ্ছি। দেখতে থাকি। আর হ্যাঁ! তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু নয়। তারা মরে গেলেও আমি তোমায় আপন করতে পারব না। নাফসিন! আই কান্ট লাভ ইউ। সরি!”
____
সকালের দিকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রঙ্গন আর মোহ একে-অপরের সাথে কথা বলছে। রঙ্গন মোহকে আশ্বাস দিচ্ছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মোহর সেই এক কথা, ‘ধৈর্য বরাবরই নেই।’
রঙ্গন অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
-“হুট করে কীভাবে কী করব?”
-“তুমি খোঁজ লাগাও, তাতেই হয়।”
-“লাগিয়েছি। বর্তমানের সব কথাই জানতে পেরেছি, কিন্তু অতীতটা জানা যায়নি।”
-“কেন যায়নি? কীভাবে খোঁজ লাগিয়েছ?”
-“অধৈর্য হয়ো না।”
একাদশবারের মতো মোহ আবারও বলল,
-“ধৈর্যটাই তো আমার নেই, রঙ্গন!”
অবশেষে রঙ্গন বলে,
-“আমি আছি তো!”
-“তুমি থাকলেই চলছে না, রঙ্গন। সে কেন আরেকটা বিয়ে করল, কেন লুকিয়ে রাখল! আমার আব্বু তো এমন ছিল না, সে কেন পালটাল? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার চাই। আমি স্বস্তি পাচ্ছি না, বুঝতে পারছ না কেন?”
-“বুঝতে পারছি।”
-“পারছ? তবে উত্তর এনে দিচ্ছ না কেন?”
মোহর কণ্ঠে প্রচণ্ডরকমের অধৈর্যতা, উগ্রতা। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে রয়েছে অসহায়ত্ব। রঙ্গনের খুব মায়া লাগল। বলতে পারল না,
-‘মোহিনী, উত্তর আমার কাছে আছে। কিন্তু আমি তোমায় বলতে পারব না। তুমি বিশ্বাস হারাবে। কেবল ওই এক পুরুষের ওপর থেকে নয়, সমগ্র পুরুষজাতির ওপর থেকে। বিশ্বাস করো লক্ষ্মীটি, রঙ্গন তোমার অবিশ্বাস্য দৃষ্টিকে খুব ভয় পায়।’
রঙ্গনের পরক্ষণে মনে হলো—বিয়ে করে সে মোহকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। এখানে আর আনবে না। মোহ সহ্য করতে পারবে না এসব, যতই শক্ত সে দেখাক না কেন!
মোহ নড়বড়ে, বড়ো নাজুক হয়।
মোহ অনুভূতির সুউচ্চ শৃঙ্গের চুড়ায় রয়।
মোহ ক্ষণিকের, তবে তাতে প্রেমের অবক্ষয়।
মোহর অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রঙ্গন তা দেখে বলে উঠল,
-“এ-বাড়িতে এসো, মোহ। নাকি আমি আসব?”
-“আসছি।”
মোহ পিছে ঘোরার আগেই তার দাদির চিৎকার শুনতে পায়। চোখ-মুখ কুঁচকে আসে। পরমুহূর্তেই সেই চিৎকারের ব্যাখ্যাটা পেয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে রুমের খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসা আওয়াজটা অনুসরণ করে তাকায়। এদিকে কিছু না দেখা না গেলে রঙ্গনের পানে তাকায়। আওয়াজটা রঙ্গন শুনে মোহর আগেই বুঝে উঠেছে এবং তৎক্ষনাৎ ছুট লাগিয়েছে, জলদিই এবাড়িতে চলে আসবে।
মোহর পৃথিবীটা তৃতীয়বারের মতো কেঁপে উঠল। প্রথমবার যখন মায়ের লাশ তার সামনে রাখা হলো, দ্বিতীয়বার যখন অন্দরে সৎমায়ের পা পড়ল, তৃতীয়বার যখন সে পুরোদস্তুরভাবে এতিম হলো।
মোহর পা ভেঙে এলো। ওখানটাতেই বসে পড়ল। এলোমেলো বাতাসেরাও শোক তুলে মোহর সাথে তাল মিলিয়ে শুধিয়ে উঠছে,
-“আমার অনেক প্রশ্ন ছিল। উত্তর না দিয়ে যেয়ো না, যেয়ো না।”
চলবে..