#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
চরম ঠান্ডায় কাহিল মোহ, গলার আওয়াজও বসে গেছে। একটা বাক্য বলতে গেলে ৩-বার করে হাঁচি দিচ্ছে। ওদিকে আওয়াজও হচ্ছে ভেঙে ভেঙে। রঙ্গন সেই তখন থেকেই চোখ কটমট করে তাকাচ্ছে; চোখ যেন বলছে,
-“তোকে আজ খাচ্ছি, দাঁড়া!”
মোহ খাটের ওপর আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে। কোলের ওপর টিস্যু বক্স। নাক টেনে বলল,
-“সব বৃষ্টির দোষ..”
ভাঙা ভাঙা কথা, বলতে বলতে আবার হাঁচি। পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলল,
-“ওভাবে তাকাও কেন?”
রঙ্গন সামনের সোফাটিতে ঠিক করে বসল। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“বৃষ্টি থামেনি কিন্তু এখনও। আরেকটু ভিজবে?”
কথাগুলো মোহর কানে এসে বিঁধল অন্যরকমভাবে, ‘বৃষ্টি থামেনি। বৃষ্টিবিলাস না? আয়, আজ তোর জন্মের সাধ মেটাব।’
মোহ আরেকবার হাঁচি দিয়ে বলল,
-“উম..”
-“কী উম?”
-“ভিজব।”
-“সিরিয়াসলি, মোহ?”
-“ইয়েস!”
রঙ্গন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল,
-“তোমার ওই তুলতুলে সাদা গালদুটোতে আমার হাতের কাজ শুরু হওয়ার আগে মেডিসিনগুলো চুপচাপ গিলে ঘুম দাও।”
মোহ সরু চোখে তাকায়। রঙ্গন এসে মেডিসিনগুলো মোহর হাতে ধরিয়ে দিলো। গ্লাসে পানি ভরে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“ড্রিংক ইট।”
মোহ মুখ বানিয়ে ভারি ঢঙ করে বলল,
-“রঙ্গন, জান, শোনো!”
-“লাভ নেই। গেলো।”
-“আরে, একটা কথাই তো! বলি, শোনো।”
-“সে ফাস্ট!”
-“তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, রাইট?”
-“হুম, তো?”
-“তুমি আমার অর্ধাঙ্গী, হু?”
রঙ্গন বুকে হাত গুঁজে টান টান হয়ে দাঁড়াল,
-“হুম, এরপর?”
-“তো তুমি আমার সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, জ্বালা-পোড়া—সব। তাই-না?”
রঙ্গন চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
-“এক্সাক্টলি কী বলতে চাইছ, বলো তো! তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”
মোহ দাঁত কেলিয়ে বলল,
-“ওষুধগুলো অনেক বড়ো বড়ো। আসো, রঙ্গন। আমরা ভাগাভাগি করে খাই।”
রঙ্গনের চোয়াল ঝুলে পড়ার অতিক্রম। সে পালটা কিছু বলতে গেলে মোহ বলে ওঠে,
-“সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারলে, ওষুধও পারব। আসো, বর। কাছে আসো।”
রঙ্গন ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে আটকে ফেলল। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-“আমরা এখন ক’নম্বর ফ্লোরে আছি, সোনা?”
-“উম.. ফোর্থ..”
-“এখন বারান্দা থেকে যদি তোমার ছোট্ট শরীরটাকে আমি ফেলে দিই। তোমার ভালো লাগবে, তাই-না?”
-“উফ, রঙ্গন! ওরম করো কেন?”
-“খাও।”
মোহ চোখ-মুখ কুঁচকে ওষুধ গিলল। কোঁচকানো অবস্থাতেই বলল,
-“কিস মি!”
-“জি, না। আপনি ঘুমাবেন।”
-“খারাপ লোক!”
-“জানি।”
-“অভিশাপ দিই কয়টা?”
রঙ্গন আঁড়চোখে তাকাল। মোহ বলে উঠল,
-“অসহ্য পুরুষ, শোনো! তুমি বউ পাবে না।”
-“একটাকেই সামলাতে পারি না, আবার আরেকটা?”
আওয়াজ বড্ড নিচু ছিল, মোহ আবছা আবছা শুনল। বিষয়টা পরিষ্কার করার প্রয়োজনার্থে বলে উঠল,
-“কী বললে?”
-“ঘুমাও।”
মোহ আর কিছু না বলে শুয়ে পড়ল। রঙ্গন নিজের রুমে গেল না। ল্যাপটপটা বের করে ওখানে বসেই কাজ করতে লাগল। ভোর হতে আর ৩-ঘন্টা বাকি। এই ৩-ঘন্টা কাজ করে রুমে গিয়ে ঘুমাবে।
মোহর ঠান্ডার সাথে সাথে জ্বরও এসেছিল। ওষুধের জোরে জ্বরটা নেমে গেলেও ঠান্ডা এত সহজে নামল না। সারাদিন তাই রুমবন্দী হয়ে থাকতে হলো। সন্ধ্যা অবধি ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। এরপর আর রুমে মন টেকে না। রঙ্গনের কাছে চলে এলো। সারাক্ষণ রঙ্গনের আগে-পিছে ঘুরে রঙ্গনকে জ্বালাতে লাগল। বেচারা লোকটা! সে বউই পেয়েছে এমন!
হুট করেই তার রোড-সাইডে দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাওয়ার লোভ জাগল। রঙ্গনকে তা বলায়, সে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় তাকাল, যেন মহা অন্যায় আবদার করে ফেলেছে মোহ। রঙ্গনের একটাই কথা, এই ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে আইস্ক্রিম কে খায়? তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজিয়ে লাগিয়ে নিয়েছে সর্দি!
মোহ যুক্তি ছুঁড়ে দেয়,
-“দেখো মশাই, ঠান্ডা লাগা অবস্থায় ঠান্ডাজাতীয় খাবার খেলে ঠান্ডায়-ঠান্ডায় কাটাকাটি হবে। বুঝেছ? বোঝোনি? আমাকে আইস্ক্রিম খাওয়াও, তাহলেই বুঝবে।”
রঙ্গন চোখ কটমট করে তাকায়, সেই সঙ্গে হয় হতাশ। মেয়েটা কম জ্বালায় না তাকে! এত এত জ্বালানোটাও তার খারাপ লাগে না। একমাত্র বউ তার। বায়নাগুলো পূরণ না করলে কেমন দেখায় না?
আইস্ক্রিম পার্লারে নিয়ে যেতে রাজি হলো। কল্পরাজ্যের ঢঙ্গী রাজকন্যা মোহিনীর ইচ্ছে হচ্ছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আইস্ক্রিম খাওয়ার! অগত্যা রঙ্গন হার-সূচক শ্বাস ফেলে বলল,
-“তৈরি হয়ে নাও। এতে যদি ঠান্ডা না কমে উলটো বাড়ে না? তোমাকে আমি বাড়ি গিয়ে সারারাত সাতনোহারায় চোবাব।”
মোহ হেহে করে হেসে বলল,
-“সাঁতার পারি না গো, বাবুর আব্বু।”
রঙ্গন হতবিহ্বল নেত্রে তাকিয়ে বলল,
-“কার বাবু?”
-“তোমার-আমার।”
-“তা কবে ডাউনলোড হলো?”
-“কিছু একটা করো। আই প্রমিস, দশ মাসের মাথায় এনে দেবো।”
রঙ্গন মেয়েটার ইললজিকাল কথাবার্তাগুলো উপভোগ করে খুব। যেহেতু জবাব দিতে পারে না; তাই চুপচাপ মোহ যা বলে, বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
রাস্তার ধারে আইস্ক্রিম খাচ্ছিল মোহ, রঙ্গন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল। দুটো ছেলেকে খেয়াল করল, মোহর দিকে ভুলেভালে দু’বার তাকিয়েছে। রঙ্গনের জিনিসটা মোটেও পছন্দ হলো না। তবুও চুপ রইল। কিন্তু একইভাবে তৃতীয়বার যখন এদিকটায় চোখ ফেলে, পকেটে হাত গুঁজে রঙ্গন এগিয়ে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ায়।
ছেলে দুটো রঙ্গনকে দেখে অপ্রস্তুত হাসে। রঙ্গন নিজেও হাসে। হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
-“রিজার্ভড জিনিস। চোখ যেন আর না পড়ে!”
হাসির সাথে দেওয়া হুমকিটা ছেলেদুটোর গায়ে লাগে। তাদের চোখ ছোটো-ছোটো হয়ে আসে। কেউ এভাবে কীভাবে বলতে পারে? বড়োজোর জানাতে পারে—ওটা তার ওয়াইফ! হুমকিটা গায়ে খুব করে লাগল। এক কদম এগিয়ে গিয়ে ওদের একজন রঙ্গনের মুখোমুখি হলো। কেউই হাসি ছাড়ছে না ঠোঁট থেকে।
ছেলেটাও মুচকি হেসে বলল,
-“কী করবা?”
রঙ্গন ছেলেটার কর্লারটা ঠিক করতে করতে বলল,
-“দুনিয়া দেখার অবস্থা রাখব না।”
-“পাওয়ার?”
-“বাপের টাকা ছাড়াই নিজেরে বানাইছি। ক্ষমতার জোর বুঝে নে। তোদের উড়ায়া দিতে দুই মিনিটও লাগব না।”
রঙ্গনের ভাষার সাথে সাথে গলার টোনেরও পরিবর্তন হলো। ছেলে দু’টো খানিকটা ভড়কে পেল। সামান্য কেশে প্রস্থান ঘটাল। রঙ্গন আবারও ফিরে গেল মোহর কাছে। মোহ আইস্ক্রিম শেষ হতে না হতে এক কাপ চা-ও নিয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
-“এত হেসে হেসে কথা বলার কী আছে? চেনা কেউ?”
রঙ্গনের হাসি এখনও কমেনি। মোহর গালে তর্জনী স্লাইড করতে করতে বলল,
-“খুব চেনা।”
-“রঙ্গন, তুমি ওদের শাসাচ্ছিলে কেন? আমি বিষয়টা খেয়াল করেছি।”
-“খেয়াল করেছ?”
-“হু।”
-“কী বলেছি, তা খেয়াল করোনি?”
-“করলে কি আর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম?”
রঙ্গনের হাসি নিভে যায়। শক্ত গলায় বলে,
-“এত সুন্দর হতে কে বলেছে তোমায়? আমি ক’জনকে আর শাসাব?”
মোহ হাসি চেপে রাখার তাগিদে এদিক-ওদিক তাকায়। রঙ্গন হতাশ হয়। মেয়েটা সব কিছুতেই মজা নেয়। তাই আফসোসের সুরে বলল,
-“মোহিনী, তোমার গায়ের আবরনী হিসেবে যদি থাকতে পারতাম!”
-“তবে কী হতো?”
-“শুভ্রাঙ্গী মোহর গায়ের পোশাকের ন্যায় সজ্জিত শ্যামপুরুষটা তাকে সব কিছু থেকে হেফাজতে রাখতে পারত!”
মোহ হাসে। তার চোখ হাসে। এরকম আরও অসংখ্য মুহূর্ত তারা কাটিয়েছে। পুরো তিনটি দিন ছিল স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর।
_______
মোহ বাড়ি ফেরে গুনে গুনে তিনদিন পর। এই তিনদিনে সে রঙ্গনকে আরও নতুনভাবে জেনেছে। ছেলেটা মাত্রাতিরিক্ত অধিকারসূচক বই কি!
বাড়ি ফেরার পর সন্ধ্যায় বাগানের পেছনের দিকটায় মোহর সাথে সরাসরি মাহফুজ সাহেবের দেখা হয়ে গেল। মোহ এড়িয়ে যাওয়ার তাগিদে প্রস্থান ঘটাতে চাইল। মাহফুজ সাহেব আটকাতে চাইলেন। একবার এক্সপ্লেইন করতে চাইলেন। কিন্তু কী এক্সপ্লেইন করবেন? তিনি অবশ্যই ভুল করেছেন। মেয়েটার মুখোমুখি হওয়াটা তার জন্য খুবই দুঃসহ!
মোহ কথা বলে না তার সাথে। আজও তাই। মাহফুজ সাহেব একদৃষ্টিতে মেয়ের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখ ছলছল করছে তাঁর। মোহ ঠিক তখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানেই থেমে গেল। পিছে ঘুরল না। সামান্য হেসে আবারও চলে গেল।
মাহফুজ সাহেব অস্থিরতায় ভুগছেন। রাতে লাইব্রেরি রুমে বসে আবারও ডায়েরি লিখতে লাগলেন। অনেক অনেক কথা লিখলেন। তারপর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। কতগুলো দিন পর ঘুমোতে পারছেন!
নাফসিন মোহর ফেরার পর থেকে ননস্টপ কাঁদতেই আছে। তার আপা তার সাথে কথা বলে না, তার নুর তার সাথে খেলে না, তার বাবাও তার সাথে আগের মতো খুনসুটি করে না। তার রুটিনমাফিক লাইফটার মাঝে হুটহাট পাওয়া পরিবর্তনগুলো সে ধরতে পারছে। আর এই পরিবর্তনগুলো ভীষণ রকমের জঘন্য। তার ভালোই লাগছে না।
মোহ নিজের রুমে এসে হুট করেই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কেমন যেন লাগছে! একটু আগে নিজেকে যেমনটা মুক্ত আকাশের পাখির মতো লাগছিল, এখন ঠিক তেমনই খাঁচাবন্দী লাগছে। সে ঘুমোনোর চেষ্টা করল। অথচ ঘুম পাচ্ছে না। নিঃশ্বাসের বেগ বাড়ছে। কান্না কান্না পাচ্ছে। নিজের মনকে বার বার স্বান্তনার বাণী শোনাচ্ছে—মোহ! ইয়্যু আর অ্যা স্ট্রং লেডি! ডোন্ট ক্রাই!
মোহ কল দেয় রঙ্গনকে। রঙ্গন রিসিভ করতেই মোহ বলল,
-“ঘুম পাড়িয়ে দাও।”
মোহর ছেলেমানুষী কথা শুনে রঙ্গন হাসে,
-“কীভাবে?”
মোহ গাল ফুলিয়ে বলে,
-“জানি না।”
রঙ্গন নরম গলায় বলে,
-“মন খারাপ?”
-“বুঝতে পারছি না।”
-“আমি বোঝার চেষ্টা করব?”
-“করো।”
-“আচ্ছা, শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে?”
-“হচ্ছে।”
-“বুকে ব্যথা করছে? সূক্ষ্ম ব্যথা?”
-“করছে।”
-“কাউকে আঁকড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে? কোনো কারণ ছাড়াই?”
-“হ্যাঁ।”
-“শ্বাসের ঘনত্ব বাড়ছে?”
-“হুঁ..”
-“অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে?”
-“হয়তো!”
-“বুঝলাম।”
-“কী বুঝলে, রঙ্গন?”
-“তোমার একটা রঙ্গন চাই; নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার জন্য, সব ব্যথাগুলোকে শুষে দেওয়ার জন্য।”
চলবে..