#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
রাতে মোহকে নিয়ে রঙ্গন ড্রাইভে বের হয়েছে। এর আগেও এখানে অনেকবার আসায় রঙ্গন বেশ ভালোমতো জায়গাটা চেনে। ড্রাইভ করে বেশ নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামাল। আকাশ মেঘলা। ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
মোহ গাড়ি থেকে নেমে এলোমেলো কদমে হাঁটতে লাগল। রঙ্গন নিজেও পিছে পিছে এলো। ঘড়িতে তখন প্রায় বারোটা। মোহ টাইম দেখে মুচকি হাসল। রঙ্গনের দিকে ঘুরে বলল,
-“জীবনের শেষ মুহূর্তটাও এভাবে তোমার সাথে উপভোগ করতে চাই।”
রঙ্গন মাথা চুলকে হাসল,
-“অ্যাজ ইওয়োর উইশ, ম্যাডাম!”
মোহর চোখ দুটো উজ্জ্বল। তার হাসি কমে না। বেশ কিছুটা দূরত্ব একে-অপরের মাঝে স্থির রেখে মোহ বলে উঠল,
-“উইশ মি, রঙ্গন! তোমাকে নিজের নামে লিখে নেওয়ার এই মুহূর্তটায় আমার গোটা দু বছর সম্পন্ন হলো।”
মোহর কথামতো রঙ্গন উইশ করল,
-“হ্যাপি সেকেন্ড ম্যারেজ অ্যানিভারসারি, মোহিনী!”
_____
সেদিন সন্ধ্যায় মোহর এগোনোর সেই এক কদমটার জন্য মোহ তারপর থেকে অস্থির হচ্ছিল। ক্রমেই অস্থিরতা বাড়ছিল। চোখ-মুখে ঝরে পড়ছিল এক বিস্তীর্ণ অন্যায়ের অনুশোচনা। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে সে শেফার কাছে চলে আসে। অবিচল গলায় বলে ওঠে,
-“আম্মু, আব্বুকে ফোন করো। এক্ষুনি আসতে বলো।”
মেয়ের মনের অশান্তি সে খানিকটা আন্দাজ করে, তবে তার উৎস অজানা। মাথায় হাত বুলিয়ে শুধায়,
-“কী হয়েছে?”
মোহ কোনো ভণিতা ছাড়া বলে দেয়,
-“মা, আমি বিয়ে করতে চাই।”
ভীষণ রকমের অবাক হয় শেফা। শক্ত গলায় বলে,
-“এসব কী, মোহ? কাকে? তোমার বয়স সবে ১৭!”
-“বিয়ে পড়িয়ে রাখো। ১৮ হওয়ার পর রেজিস্ট্রি হবে।”
-“মাথা ঠিক আছে? কী বলছ এসব?”
-“আম্মু, আমি তোমার কাছে প্রেম করার অনুমতি চাইছি না, আমি বিয়ে করতে চাইছি।”
-“কিন্তু কেন?”
-“প্রেম অনুভূতিটা খুব সুন্দর, আম্মু। বিয়েটা তার খুঁটি। বিয়ে ছাড়া কারো সাথে জড়ালে কেবল পাপ হয়, প্রেম তখন সুখ না হয়ে অসুখ হয়।”
-“কে সে?”
শেফার থমথমে আওয়াজ। মোহর গলা সামান্য কাঁপল এবার,
-“রঙ্গনদা।”
এখানে গিয়ে শেফার আশ্চর্য হওয়ার মাত্রা আকাশ ছোঁয়। মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসে পড়ে। বাড়িতে দু’জন ছেলে-মেয়ে একত্রে বড়ো হচ্ছে, বিষয়টা তাদের মাথায় রাখা উচিত ছিল। নারী ও পুরুষ হচ্ছে চম্বুকের মতো, একে-অপরকে আকর্ষণ করবেই!
শেফা অনেকক্ষণ পর বলে ওঠে,
-“সম্পর্ক কতদিনের?”
-“হিসেব রাখিনি, আম্মু।”
-“হঠাৎ বিয়ে?”
-“হালালে থাকতে চাইছি।”
-“কোনো ভুল করেছ তোমরা? যে-জন্য এত তাড়া?”
মোহ মাথা নাড়ায়। অবিশ্বাস্য চোখে শেফা তাকিয়ে থাকে, শুধায়,
-“কখন হলো এসব?”
-“আজ সন্ধ্যায়।”
-“মোহ, খুলে বলো! তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। জানতে চাই সবটা।”
-“আজ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিলাম, আম্মু। চুমু খেয়ে ফেলেছি। এখন বিয়ে দাও।”
শেফা মেয়েকে দেখে বললেন,
-“আমি রুমা আপাকে বিষয়টা জানাবনি। রঙ্গন ছেলেটা খারাপ না। বিয়ের প্রস্তাবটা রুমা আপাই একবার দিয়েছিল। তোমরা সম্পর্কে আছ, তিনি কি তা জানেন?”
মোহ দু’দিকে মাথা নাড়ায়,
-“আমরা নিজেরা একে-অপরের কাছেও কখনও স্বীকার করিনি।”
-“এই না বললে, সম্পর্কে আছ?”
-“আছি। রঙ্গনদা জানে আমি তাকে পছন্দ করি, আমি জানি সে আমাকে পছন্দ করে। কেউ একে-অপরের কাছে বিষয়টা এক্সপোজ করিনি।”
-“তবে চুমু?”
-“ওটা ভুল, আম্মু।”
-“তাহলে বিয়ে?”
-“ভুলকে শুদ্ধ করার প্রচেষ্টা।”
শেফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েকে সে কখনও বুঝতেই পারে না। মেয়েটা তার কাছে এত খোলামেলাভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে, তাও সে পড়তে পারে না। শেফা অবশেষে জানায়,
-“ঠিক আছে, আমি কথা বলব।”
-“আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই, আম্মু।”
-“বিয়েটা ছেলে-খেলা না।”
-“এখন যদি আমি নিজের রুমে গিয়ে কিছু একটা করে ফেলি—তবে অবশ্যই তা ছেলে-খেলা হবে।”
-“মোহ, পাগল হয়েছ?”
-“এখনও হইনি, আম্মু। তবে বিয়েটা না হলে সত্যিই হয়ে যাব। সবটা বোঝার মতো বয়স আমার হয়েছে।”
শেফা বলার মতো ভাষা পেল না। মোহ শেফাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আব্বুকে আসতে বলো। ব্যবস্থা করো।”
শেফা মাহফুজকে কল দেয়। মাহফুজ রিসিভ করতেই বিষয়টা পজিটিভ ওয়েতে জানায়, সাথে মোহর জেদের কথাটা বিস্তরভাবে তুলে ধরে। মাহফুজ সাহেব খোলামেলা ধরনের মানুষ, তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা করেন।
তারপরের ঘটনাগুলো এত জলদি হয়েছে, যে রঙ্গন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। ঠিক বারোটার সময় যখন তাকে মোহদের বসার ঘরের সিঙ্গেল সোফাটিতে বসা অবস্থায় কবুল বলতে বলা হয়েছিল, এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে চারবার কবুল বলে ফেলেছিল।
রূশী, জয়তুননেসাসহ উপস্থিত সকলেই হেসে ফেলে।
এরপর মোহ কবুল করল। প্রথম তিনবার কাজির কথামতো। সঙ্গে বলল,
-“তোমাকে আমি স্বামী হিসেবে কবুল করলাম। তোমাকে আমি অনুভূতি হিসেবে কবুল করলাম। তোমাকে আমি অর্ধাঙ্গ হিসেবে কবুল করলাম।”
এরপর মুচকি হেসে রঙ্গনের দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো মোহতে স্থির। মোহ অন্যমনস্কভাবে আরও একবার করল,
-“নিজস্বতাতেও তোমাকে আমি কবুল করে নিলাম।”
______
দুবছর আগের সেই ঘটনাটা ভাবতেই মোহ চনমনে হয়ে উঠল। বৃষ্টি নামবে নামবে। মোহ দৌড়াতে দৌড়াতে ব্রিজের ওপর চলে এলো। রঙ্গন হাসিমুখে প্রিয় স্ত্রীকে দেখছে। হুট করেই তার মাথায় আসে—মোহর গায়ে বৃষ্টি সয় না। খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
সেবার রাগ করে বৃষ্টিতে ভিজেছিল, এরপর তাকে সামলাতে সামলাতে পুরো সপ্তাহ রঙ্গনের নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেছিল।
রঙ্গন ডাকল,
-“মোহ, বৃষ্টি নামবে। চলো ফিরে যাই।”
মোহ পেছাল না, সোজা রাস্তায় হাসিমুখে এগোতে লাগল। আশে-পাশে কোনো ছাওনি নেই, হঠাৎ বৃষ্টি এসে পড়লে এখন ভেজা ছাড়া উপায় থাকবে না। তার ওপর আকাশ খারাপ। বৃষ্টির সম্ভাবনা শতভাগ। মেয়েটা চাইছে কী!
মোহ এগিয়ে গিয়ে ব্রিজে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। গলার আওয়াজ উঁচুতে তুলে রঙ্গনকে বলল,
-“আমার ভালো লাগছে, রঙ্গন।”
-“বৃষ্টি নামবে তো।”
-“নামুক।”
-“ভিজে যাবে গা।”
-“যাক।”
-“জ্বর আসবে।”
-“আসুক।”
-“মনের মাথা খারাপ হবে।”
-“হোক।”
-“সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
-“ক্ষতি নেই।”
হুট করেই বড়ো বড়ো ফোটার বৃষ্টি একটা একটা করে ধরা স্পর্শ করতে লাগল। মোহর ভালোলাগার অনুভূতিনামক প্রজাপতিগুলো বাতাসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। আওয়াজ হচ্ছে জোরদার। ব্রিজের রেলিংয়ে কোমর ঠেকিয়ে মাথা হেলে দিলো পিছে, ধরে রেখে দু’পাশ, সাপোর্ট হিসেবে। মোহতে তো বৃষ্টি একদমই সয় না, রঙ্গন এগিয়ে গেল। জ্যাকেটটা খুলে মাথার ওপর দিয়ে ধরে একদম মোহর ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল।
মুখে বৃষ্টির ছিঁটে আসা বন্ধ হলো, মোহ মুখোমুখি প্রিয় পুরুষের অস্তিত্ব অনুভব করে চোখ খুলল না। ওভাবেই বলল,
-“কী?”
-“তোমায় একটু ছুঁয়ে দিই?”
-“খেয়াল করে দেখো, তোমার একটা হাত আমার কোমর ছুঁয়ে আছে, রঙ্গন।”
-“বুঝতে পারছ না তুমি। এভাবে না, অন্যভাবে।”
-“কোনভাবে?”
-“গভীরভাবে, বাজেভাবে।”
-“রঙ্গন..”
কী আবেগপ্রবণ ডাক! রঙ্গন আর কিছু বলল না, কিচ্ছুটি না। একহাতে জ্যাকেট সামলিয়ে অন্যহাত মোহর কোমরে আরও দৃঢ় করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ঠোঁটের খুব কাছে ঠোঁট রেখে বলল,
-“আশিকী স্টাইলে হয়ে যাক?”
দীর্ঘ সময়ের আশ্লেষের চুম্বন শেষ হলে, মোহ থমকায়। চোখ তুলে রঙ্গনের মুখের দিকে তাকায়। বৃষ্টির ফোটা রঙ্গনের সমগ্র মুখে, চোখ তার বন্ধ। মোহ হাতের তর্জনী দিয়ে রঙ্গনের কপাল, নাক হয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
-“এত ভালোবেসো না, রঙ্গন। এত ভালোবাসা ভালো না।”
-“উম..বাট আই কান্ট স্টপ লাভিং ইয়্যু..”
চলবে..