প্রেম পড়শী পর্ব-০৯

0
725

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

-“তো মিস্টার ওয়াজিহ্ মেজবাহ রঙ্গন, দ্যি গ্রেট ঘাড়ত্যাড়া লোক, এই ভ্যাপসা গরমেও কর্লারওয়ালা ইনফরমাল টিশার্ট পরে ড্রাইভ করতে করতে ফুঁসছ কেন?”

কথাটা বলে মোহ ঠোঁট চেপে হাসি আটকাল। রঙ্গন আচমকা ব্রেক কষল। মোহর দিকে ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“সবই তোমার সুইট, কিউট, জোস অ্যান্ড অভিয়াসলি সো ড্যাম বোল্ড বিহেভিয়ারের কুফল। রাগ লাগলে কামড়, বিরক্ত হলে কামড়, লজ্জা পেলেও কামড়। ভাই, এত কামড়াকামড়ির স্বভাব কেন তোমার?”

মোহ ছোটো-ছোটো চোখে তাকাল। কর্লারের আড়াল হতে তার সকালের সেই কামড়ের দাগটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সকালে রঙ্গনকে থামানোর জন্য ওরকমটা করেছিল। করতেই পারে। স্বাভাবিক! তাই বলে কামড়াকামড়ি বলবে? এটা কেমন ভাষা! কামড়াকামড়ি না বলে একটু সুন্দর করে লাভ বাইট বললেই তো পারে! খারাপ লোক একটা! মোহ ওদিকটা ভাবতে ভাবতেই রঙ্গনের বলা কথাটির শেষ বাক্যে দেওয়া সম্বোধনটা খেয়াল করল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“অবশ্যই আমি তোমার ভাই নই।”

রঙ্গনের তাৎক্ষণিক জবাব,
-“হ্যাঁ তো। ভাই নও, আপু লাগো। আসসালামু আলাইকুম, মোহনা আপু। আপু, কেমন আছ?”
-“আরেকটা কামড়ের জন্য তোমার শরীরটা খুব নিশপিশ করছে, রঙ্গন?”
-“ভীষণ! দাও প্লিজ!”

রঙ্গনের অতিষ্ট কণ্ঠ। মোহ মুখ ঘুরিয়ে বসে বলল,
-“মুড নেই।”

খানিকটা থেমে আবার বলল,
-“জলদি গাড়ি চালাও। নাহলে এ-মাসে তোমার হাফ সেলারি আমি কেটে দেবো। বুঝেছ, মিস্টার ব্যাক্তিগত ড্রাইভার?”
-“কাটবেন না, ম্যাডাম। প্লিজ! কাটলে আমার বউকে নিয়ে রাস্তায় উঠতে হবে। অভুক্ত পিশাচিনী বউ খেতে না পেতে তখন আমাকে কামড়াতে থাকবে। আপনার জাস্ট একটি কর্মকাণ্ডের ওপর আমার ইজ্জত, জান সব নির্ভর করছে। রহম করুন!”

অতি মাত্রার নাটকীয়তা নিয়ে কথাগুলো বলে রঙ্গন গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাথে মিটিমিটি হাসতেও লাগল। মোহর শান্তশিষ্ট মেজাজে চৈত্রের খরা এনে দেওয়ার জন্য এখন তার পৈশাচিক আনন্দ লাগছে। উচ্চস্বরে হো হো করে ভয়ঙ্কর হাসি হাসতে ইচ্ছে করছে। মনুষ্য বলে নিজের ইচ্ছে দমন করল।
মোহ ক্ষোভ প্রকাশ করতে না পেরে ক্রমাগত শ্বাস ফেলতে লাগল। লাইফে এমন একটা জোকার থাকলে আর কী লাগে?

___
হোটেলের দুটো রুম বুক করা ছিল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হলো তাদের। পথিমধ্যেই লাঞ্চ সেরে এসেছে। রঙ্গন মোহকে তার রুমে পৌঁছে দিয়ে বলল,
-“জার্নি হয়েছে, একটা শাওয়ার নাও। তারপর ঝটপটে একটা ঘুম দাও। ভালো লাগবে। আমি মিটিং সেরে সন্ধ্যার পর পর ফিরব।”

রঙ্গন চলে গেলে মোহ আর শাওয়ার নেওয়ার এনার্জি পেল না। তুলতুলে বিছানাতে পোশাক না পালটেই গা এলিয়ে দিলো। ঘুমে তলিয়ে যেতে সময় লাগল কিয়ৎক্ষণ।

টানা দু’ঘণ্টার ঘুমে মোহ একটি অদ্ভুত স্বপ্নের সাক্ষাৎ পেল। ঘুম থেকে যখন জেগে উঠল, পুরো স্বপ্নটা খণ্ডাংশ করে তার মনে পড়তে লাগল। প্রতিটি খণ্ড জোড়া লাগিয়ে একত্রে এ-ই পেল—
একটি ভীষণ সুন্দরী মেয়ে একটি অস্বাভাবিক রকমের বড়ো গাছের নিচে বসে আছে। গাছের পাতা এবং ডালপালা এতই ঘন যে তা হতে সূর্যের রোদ নিচে আসছে না, খানিকটাও না। মেয়েটি মোহ নিজেই। স্বাভাবিক অর্থেই সে ভীষণ রূপসী একজন মেয়ে। তবে স্বপ্নে যেন সেই রূপের সবদিক থেকেই বিস্তার হয়েছে। দেখতে লাগছে ভয়ংকর আগুন সুন্দরী। রোদে মুখটা গৌর লাল দেখায় বলে, সারাটাক্ষণ সে গাছের ছায়ায় থাকে।
একদিন দেখা গেল—সব সময় আগলে রাখা গাছটি খুবই অযত্নে রাখছে তাকে। রোদে তার গা ঝলসে যাচ্ছে। গাছটি নিজের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। মেয়েটি বিরক্ত হয়, মায়ায় জড়ানো আদরের গাছটার এমন দশা সে মানতে পারে না। তৎক্ষণাৎ সে গাছটিকে পরিত্যক্ত করে অন্য গাছের ছায়ায় চলে যায়। অতঃপর অজ্ঞাত কেউ এসে গাছটির গোড়া কেটে দেয়। মেয়েটি তাতে কান্না করার চেষ্টা করল, কিন্তু কাঁদতে পারল না; তার কান্না পেল না। অগত্যা সে হাসতে লাগল। ভয়ংকর সে হাসিতে ভূমি কেঁপে উঠল। আকাশ থেকে আগুন ঝরতে লাগল।
ঠিক সেই মুহূর্তে মোহ স্বপ্ন দেখে বেরিয়ে এলো। দরদর করে ঘামছে সে। ভয় লাগছে সামান্য, তাই চটজলদি উঠে একটা শাওয়ার নিয়ে নেয়।

সন্ধ্যার পর পর, ইন্টারকমে কল দিয়ে একটা কফি আনিয়ে অ্যাটাচড ব্যালকনিতে গিয়ে বসে চাঁদ দেখতে লাগল। তারপর হুট করে মনে পড়ল—আজ ২৩-শে জুলাই। মায়ের কাছে করে বসা এক অভাবনীয় জেদের সূচনাটা আজকের সন্ধ্যেতেই হয়েছিল।

তখন মোহ একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। রঙ্গনের সাথে তার চোখে-চোখে প্রেমের সম্পর্ক, সামান্য হাত ধরা-ধরিও হয় কখনও-সখনও। ভাড়াটিয়ার বিয়েটা তাদের ছাদেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মোহ বরাবরই ভীড়টা ঠিক সহ্য করতে পারে না। তাই রঙ্গন তাকে নিজেদের বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। ওখানটা কোলাহলশূন্য, নিষ্প্রাণ, থমথমে।

রঙ্গনের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের লাগাম ছিল। প্রেমটা মনের সাথে মনের চলত। সামনা-সামনি দুজনেই ভারি স্বাভাবিক। তবে সেদিন মোহ অনেক খুলে মেলেই কথাবার্তা বলছিল। কথাগুলো ছিল শব্দের সাথে নিঃশ্বাসের এলোমেলো হওয়ার খেলা।
রঙ্গন মোহকে দোলনায় বসিয়ে পাশে বসে পড়ে বলল,
-“তোমাকে নিয়ে আমার অনেক চাওয়া।”

মোহ বেশ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যুত্তরে বলে,
-“আমি এই বয়সেই কিছু চাই না। অপেক্ষা করো।”
-“চাইতে ক্ষতি কী?”
-“অনেক ক্ষতি, অনেক ক্ষতি। বুঝবে না তুমি।”
-“বোঝাও।”
-“তুমি প্রাপ্তবয়স্ক, আমি নই। তুমি না আটকালে আমি যে-কোনো ভুল করে বসতে পারি। আমরা দু’জন দু’জনের ফিলিংসটা জানি, বুঝি। তাই আমি শ্যিওর, তুমি আমায় কখনই আটকাবে না। রঙ্গনদা, শোনো!”
-“হু-উম?”
-“তোমাকে নিয়ে আমি কোনো আফসোস চাই না।”

রঙ্গন ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে মোহর মুখোমুখি হয়। দূরত্ব মেটায় প্রথমবারের মতো। আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় বলে,
-“জাস্ট টেক ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড, আই ওয়োন্ট লেট ইউ রিগ্রেট এভার!”

আওয়াজে যেন আফিম ছিল! মোহ মোহাবিষ্ট হয়। রঙ্গন সরে যেতে নিলেও সে নিজ থেকে আঁকড়ে ধরে। ডান হাতটা বুকের বাঁ পাশের টি-শার্টটা মুচড়ে ধরা, আর পুরুষটার ওষ্ঠ তার দাঁতের দংশনে খানিক যন্ত্রণাপূর্ণ। রঙ্গনের অস্থিরতার প্রমাণ তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগেই মিলল। বেশ কয়েক সেকেন্ড পর কামড়ে ধরা ঠোঁটটা ছাড়ল মোহ।

রঙ্গন এলোমেলো শ্বাস ফেলছে। ভাবনাতীত ছিল এমন কিছু। মোহ হাসে, রঙ্গনের চাপদাড়িতে হাত বুলিয়ে তারপর বলে,
-“এগোলাম।”

সেই দিনটার পর তার জীবনটা এদিক-ওদিক হয়েছে পুরো বিপরীতমুখীভাবে। কফির মগটা পাশে রেখে ঠিক সামনের আকাশটায় চোখ রাখল। চাঁদটা ভীষণ সুন্দর!
হুট করেই পেছনে কেউ গেয়ে উঠল,
-“ও চাঁদ, সামলে রাখো জোসনাকে।
এই সবে রাত হয়েছে, এখনই অমন হলে—
মাঝরাতে আকাশটাতে যাবে যে আগুন জ্বলে।
সেই ফাঁকে তুমিও কখন চুরি যাবে।
কাকে পাবে বাঁচাতে তোমারে?”

গান গাওয়া ব্যাক্তিটা যে রঙ্গন আর তার অবস্থানটা ঠিক দু’কদম পেছনে—তা ধরতে পারার জন্য মোহর পেছনে ঘোরার প্রয়োজন পড়ল না। এতটা ধরতে পারলেও, ধরতে পারল না গানের ভেতর গুঁজে দেওয়া উপমাগুলোকে। গানটিতে চাঁদ হচ্ছে মোহ, জোসনা হচ্ছে তার রূপ, রাত বলতে অনুভূতির প্রখরতা আর আকাশ বলতে পুরুষটার বুক বোঝাচ্ছে। নির্বোধ মেয়ে! বুঝল না।

রঙ্গন পিছে থেকে মোহর কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলল,
-“কেমন আছ, মোহিনী?”

মোহ সম্মোহিত হলো। তার জবাবটা ছিল বেশ চমকপ্রদ,
-“যার কাছে স্রষ্টা একজন রঙ্গন দিয়েছেন, তার খারাপ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।”
-“যত্নের মোহিনীকে আর আদরে আদরে রাখতে পারলামই বা কই? একটুতেই তো ছ্যাত করে উঠে কামড়ে দেয়। তাই কম কম আদর করি। আর এতেই যেহেতু এত ভালো আছে, বেশি দিলে তো আকাশে উড়ত। উড়ে উড়ে অন্যের বাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে দেখত—কার বর কাকে, কীভাবে কীভাবে, কতটা আদর করে! ওহ নো! কী সাংঘাতিক ব্যাপার মোহ, ভাবতে পারছ?”

মোহর কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। চরম অসহ্যকর ভঙ্গিমায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“মিস্টার চরম অসহ্য লোক, তোমাকে সহ্য করার জন্য তুমি কি আমায় কোনো স্পেশ্যাল এওয়ার্ড দেবে না-কি আমার মস্তিষ্ককে অকার্যকর বানিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমাকে তা ভেজে দেবো? রাতে ডিনারের সাথে সার্ভ করব? কী বলো?”

রঙ্গন হেসে উঠল। অকস্মাৎ মোহ মলিন হলো, অন্য প্রসঙ্গ টানল,
-“দাদি কল দিয়েছিল। তারা ময়মনসিংহ গেছে। কোনো এক অমানুষ লাইফ সাপোর্টে আছে। আশে-পাশে কান্নার রোল পড়েছে। সচরাচর আমি মানুষদের কান্না সহ্য করতে পারি না, মনের ভেতর সহানুভূতি আসে না, বরঞ্চ বিরক্ত লাগে। তবে আজ ভালো লেগেছে। আমি কল রেকর্ড করে রেখেছি। হুটহাট শুনব। রঙ্গন, কাজটা তোমার, না?”

মিথ্যে বলল না সে,
-“হু-ম..”
-“এভাবে যদি আরও ক’জনের ব্যবস্থা করতে, রঙ্গন! আফসোস! আমি তা চাইতে পারব না তোমার কাছে। নয়তো তারা আমায় কলঙ্কিত সন্তান বলবে। তখন নিজে সামান্য হলেও দোষী হয়ে পড়ব। তুমিই বলো—নিজের দিকে দোষ থাকলে কি অপরের দিকে আঙুল তোলা যায়?”

রঙ্গন চুপ থাকল। মোহ থেমে থেমে শ্বাস ফেলল,
-“এক জীবনে আমাদের কত-শত আফসোস থাকে! কারো একজন মানুষ না হওয়ার আফসোস, কারো পেয়েও হাতছাড়া করার আফসোস! কারো তো আফসোসের পাহাড় জমে। তাদের প্রাপ্তির ঝুলিতে সুন্দর একটা শূন্যের উপস্থিতি সবাইকে আকর্ষিত করে। আল্লাহ আমায় অনেক দিয়েছেন। তারপর নিয়েছেন। আর নিচ্ছেন। আমার সবচেয়ে বড়ো আফসোস কী—জানো, রঙ্গন? আমার সবচেয়ে বড়ো আফসোস হচ্ছে আমার পনেরোটা বছরের ভ্রান্তি। মানুষ অভিনয়ের গুনটা চমৎকারভাবে আরক্ত করতে পারে; একদম তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তুমি করতে পারবে না, কেন না মোহ ধরে নেবে। আমি করলে তুমি টেরই পাবে না। অস্বীকার করা যাবে না, আমি তো তারই সন্তান!”

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে