#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
মসজিদ থেকে ফিরে বারান্দায় খবরের কাগজ মেলে বসে আছেন মাহফুজ সাহেব। আজ অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই বাড়িতেই থাকবেন। দৃষ্টি খবরের কাগজের ওপর হলেও, মন তার খবরের কাগজে নেই। তিনি ভেবেই চলেছেন। কী থেকে কী করলেন ছোট্ট এই জীবনটায়, তার হিসেব মেলাচ্ছেন। দু’বার প্রেমে পড়া অন্যায় নয়, তবে একই সময়ে দুই নারীর সাথে অন্যায় করে যাওয়াটা পাপ।
বিষয়টা সে ধরতে পেরেছেন উত্তেজিত হয়ে নাজমাকে বিয়ে করে ফেলার পর পর। নাজমার প্রতি তাঁর সূক্ষ্ম অনুভূতি তৈরি হয়েছিল সেই হসপিটালের দিনগুলোতেই। নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রেখেছিলেন। তারপর সেই বিয়েটা! শেফার প্রতি অন্যায়।
শ্বাসে টান উঠল তাঁর। প্রলম্বিত ক’টা শ্বাস ফেললেন। বুকে চিনচিনে ব্যথার আভাস। ডান হাতটা দিয়ে বুকের বাঁ-পাশটা ডলে গেলেন। সে একজন ঘৃণিত স্বামী, একজন অসহায় বাবা। তার দু’জন সহধর্মিণীই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একজনের অভিমানটা বেশি ছিল, সে তার সাথে থাকার চেয়ে মৃত্যুকে ভালো মনে করেছে। আর অন্যজন এত বেশি চেনা থেকে হুট করেই অচেনা হয়ে উঠেছে। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তাঁর হৃদয়।
সকালে যখন ছাদে হাঁটাহাঁটি করছিলেন মাহফুজ সাহেব, ও-বাড়ির ছাদের দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিল মোহ। মাহফুজ সাহেব মেয়ের দিকে কেমন জড়ানো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। মোহর চোখ যখন এদিকটায় এলো, সে নির্বিকারভাবে উঠে চলে গেল। অনিমেষ চেয়ে দেখলেন মাহফুজ সাহেব! এত প্রিয় মেয়ে তাঁর! এত আদরের, এত যত্নের! ভালোবাসায় ভাগ পড়লে, আহ্লাদগুলোও আকাশে উড়াল দেয়; ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে থাকে দমবন্ধকর শখ ফেলে।
মাহফুজ সাহেব ডায়েরিটা বের করলেন। একটা নীল-রঙা বলপেন নিয়ে ডায়েরির মাঝ বরাবর কাগজ খুলে, সেখানে এলোমেলো দাগাতে লাগলেন। নীল রঙ! বিষের রঙ! বেদনার রঙ, যন্ত্রণার রঙ!
একটুখানি লেখা শুরু করলেন—
-“শেফা! আমার শুভ্রাণী!
আমাদের প্রণয়ের দিনের কথা মনে আছে? মনে আছে—সেবার রিমুর সাথে ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিলাম বলে তুমি আমাকে ক্যাম্পাসের মাঝখানে কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছিলে! মনে নেই, শুভ্রা?
আমার সামান্যর থেকেও সামান্য ভুলের কোনো ক্ষমা তোমার কাছে ছিল না, শাস্তি আমাকে পেতে হতোই। এবার তো জীবদ্দশার সবচেয়ে বড়ো অন্যায়টা করে ফেললাম। শাস্তি দিলে না? কেন দিলে না? এত উদার হলে কেন? তুমি তো এমন ছিলে না!”
মাহফুজ সাহেব আরেকটা লাল কলম নিলেন। পুরো লেখাটা এক দাগে কেটে দিলেন। সামান্য হেসে নিচের দিকে নীল কলমে আবারও লেখা শুরু করলেন,
-“আমার সবচেয়ে বড়ো শাস্তি হচ্ছে ঘুম-ভাঙা চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে, অভ্যাসবশত অসার হয়ে যাওয়া শরীরকে আঁকড়ে ধরে টের পাওয়া—আমার শুভ্রা আমাকে নিঃশ্বাস থমকে যাওয়া মুহূর্ত উপহারে দিতে খানিকটাও কার্পণ্য করেনি। তুমি দারুণভাবে শাস্তিটা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছ।”
মাহফুজ সাহেব উদ্ভ্রান্তের মতো হাসলেন। এরপরের পৃষ্ঠায় গিয়ে কালো কলম দিয়ে লিখলেন,
-“প্রিয় নাজ,
তুমি আমার অত্যাধিক প্রিয় একজন মানুষ। আমি কীভাবে তোমাতে জড়িয়েছি, ট্রাস্ট মি আমি জানি না। আমার উচিত হয়নি। ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। নাজের রংধনুর মতো উজ্জ্বল জীবনে ঘন কালো মেঘের আনাগোনার রাস্তা তৈরি করে দেওয়ার জন্য তার শিকদার সাহেব অত্যন্ত দুঃখিত!
ইতি
মাহফুজ শিকদার!”
শেষ লাইনের ‘দুঃখিত’ শব্দের আগের বিশেষণ কেটে নিচে নোট দিলেন,
-“পুনশ্চ: আমাকে প্রলুব্ধ করার জন্য আমি খানিকটা কম দুঃখিত। দোষ অতি সামান্য হলেও, তোমার কিন্তু ছিল! অস্বীকার কোরো না, লক্ষ্মীটি!”
তারপর ক্ষণিকের স্থবিরতা। অন্য আরেক পেইজে আবার লিখলেন,
-“মামনি মোহনা,
আব্বু লাভস ইউ। আমার সব শান্তির কবর তো তখনই হলো, যখন তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে। আব্বুকে ক্ষমা করা যায় না, সোনাই?”
ঝড়োয়া বাতাসে এলোমেলোভাবে মাহফুজ সাহেবের কানে এসে আছড়ে পড়ল,
-“তুমি শাস্তিরও অযোগ্য!”
মাহফুজ সাহেব দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে অস্থির চিত্তে লাল কলম দিয়ে সব কাটতে লাগলেন। নিঃশ্বাসের গতিবেগ থেমে থেমে বাড়ছে।
______
রুমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেশে উঠল। মোহ ত্বরিতে উঠে বসে এদিক ওদিক তাকায়। রঙ্গন ক্যাবলামো করে হাসে। রুমা শাসানো দৃষ্টি রঙ্গনের পানে নিক্ষেপ করে দরজা আটকে বের হয়ে গেল সেখান থেকে। তার সেই দৃষ্টির অর্থ এ-ই—লক করতে ভুলে গেছ কেন? ওটাও কি আমি মনে করিয়ে দেবো? কী লজ্জা, কী লজ্জা!
মোহ এবার সোজা রঙ্গনের দিকে তাকাল। রঙ্গনকে হাসতে দেখে সে নিজেও হেসে উঠল। হাত খোঁপা করে উঠতে উঠতে বলল,
-“আম্মাজান কেন এসেছিলেন, দেখে আসি। থাকো।”
রঙ্গন কিছু বলল না, তার মিটিমিটি হাসি দেখে মোহ কিছু একটা ধরতে পারল। কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
-“ইইই না!”
রঙ্গন বিছানায় হাঁটুর ওপর ভর করে এক কদম এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“কী না, মোহ সোনা?”
মোহ ভাঁজ করে রাখা হাঁটু দাঁড়া নরম বিছানায় ভর করে পেছাতে পেছাতে বলল,
-“একদম না।”
মোহর পিঠ দেয়ালে ঠেকল। রঙ্গন হেসে বলল,
-“দূরে দূরে যাও কেন? কাছে এসো!”
-“না।”
-“আদর আদর পাচ্ছে। আসো না!”
-“আসব না।”
রঙ্গন মোহর পেটে সুরসুরি দিতে লাগল, ছুঁয়ে দিতে লাগল স্নিগ্ধ রমনীর শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর বাঁক। মোহ আওয়াজ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে এরকম করতে মানা করতে লাগল। মোহর খোঁপা খুলে গেছে, চুলের অবস্থা এলোথেলো। মোহকে এ-অবস্থায় দেখে রঙ্গনের হাসি হুট করেই নিভে গেল। বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করে উঠল। মুগ্ধ হয়ে প্রিয় নারীর হাসি দেখতে লাগল। চোখের তারায় উন্মত্ততা বিরাজমান, অবিচলভাবে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে চুলগুলো খুবই আলতো ভঙ্গিমায় কানের পিঠে গুঁজে দিলো। রঙ্গনকে স্থির চিত্তে অস্থিরতা প্রকাশ করতে দেখে মোহর হাসি থমকে গেল। রঙ্গনের এক হাত মোহর গলায়, সে হাতের বৃদ্ধাঙ্গল ক্রমাগত গালে স্লাইড করে যাচ্ছে। অন্য হাতটি মোহর কোমর ছুঁয়েছে। মোহ রঙ্গনের সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারছে না। শ্বাস ফেলতেও ভুলে যাচ্ছে।
_______
নুরশীন আর নাফসিনের স্কুল ট্রান্সফার করা হয়েছে। পাশেরই একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। নুরশীন আজ মেয়েলি সমস্যায় অসুস্থ অনুভব করায় স্কুলে যায়নি। নাফসিনও আজ না যাওয়ার বায়না ধরে রুমে বসে আছে। নাজমা কিছু বলেনি আর।
নুরশীন পড়তে বসেছে। নাফসিন তার পেছন দিয়ে ঘুরঘুর করছে। পড়ার সময় আশেপাশে কেউ ঘুরতে থাকলে, সে খুব বিরক্ত হয়। এতক্ষণে বিরক্তির সীমা তার তুঙ্গে উঠে গেল। খট করে বইটা বন্ধ করে পিছে ঘুরে বলল,
-“নাফসিন, তুমি কিছু বলবে?”
নাফসিন গোল চশমাটা ঠিক করে বলল,
-“ইয়েস।”
-“বলো।”
-“আপা এত রাগ করে কেন?”
-“কে আপা?”
-“উম.. কী যেন নাম! ওহ্! মোহ আপা।”
নুরশীন আশ্চর্য হয়, পুরোপুরিভাবে নাফসিনের দিকে ঘুরে শুধায়,
-“কী করেছেন উনি? মেরেছেন?”
-“না।”
-“বকেছেন?”
-“না।”
-“কী করেছেন?”
-“কিছু করেনি! আপা আমার সাথে কথা বলে না কেন বলো তো, নুর? আমার ভালো লাগে না।”
নাফসিনকে কড়া শব্দে ক’টা কথা বলতে ইচ্ছে করল নুরশীনের। নিজের ইচ্ছে ভেতরে দমিয়ে রেখে বলল,
-“তুমি ওনার সাথে কথা বলতে গেছ কেন?”
-“আমার ওকে ভালো লাগে।”
কী পরিষ্কার করে বলে দিলো নিজের ভালো লাগাটা। নুরশীন অবাক না হয়ে পারে না। বিস্মিত হয়ে শুধায়,
-“ভালো লাগে? তাহলে ওনাকে ভয় পাও কেন?”
-“কারণ আপা কথা বলে না। যারা কথা বলে আমাদের সাথে—তারা বকলে রাগ লাগে, আদর করলে কাছের লাগে। আপা তো কিছুই করে না। তাই আমার ভয় লাগে।”
ইন্ট্রোভার্ট মানুষের নিশ্চুপতা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এই বাচ্চা ছেলেটা ধারণা করে নিল, অথচ বড়োরা কেউ টের পেল না। তারা জানলই না—সামনে কী অপেক্ষা করছে। সে তো শেফারই মেয়ে! মাহফুজ সাহেব কি কিছু ভুলে বসলেন?
____
সকালে নাশতা করেই মোহ এ-বাড়িতে চলে এলো নিজের প্যাকিং করতে। খানিকক্ষণ পরই বেরোবে। নিজের রুমে প্রবেশের আগে মাহফুজ সাহেবের রুম ক্রস করে এগোতে হয়। দরজা খোলা। মাহফুজ সাহেব মেয়েকে দেখে ডাকতে চাইলেন। আওয়াজ বের হলো না। অন্যমনস্কভাবেই মাথাটা নত হয়ে এলো।
নাজমা তখন গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছিল। মুখোমুখি হলো মোহর। মোহ নাজমার দিকে তাকাল না। সরু রাস্তাটা দিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নাজমা নিজের ভেতরটায় ব্যথিত অনুভব করল। কোমল স্বরে বলল,
-“মোহ! তাই-না?”
একদম নাজমার পাশাপাশি তার অবস্থান, দু’জন একে অন্যের বিপরীতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোহর পা থেমে গেল। দৃঢ় ও অবিচল গলায় বলল,
-“মোহনা।”
নাজমা খানিকটা হাসল। ডানে তাকিয়ে মোহর মুখের একপাশটায় চোখ রেখে বলল,
-“মোহনা! আমার প্রতি তোমার খুব রাগ, না?”
মোহ হেসে ফেলল। নাজমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত। দৃষ্টি সোজা বরাবর স্থির রেখে বলল,
-“অস্বাভাবিক বটে! কিন্তু রাগ নেই।”
-“থাকা উচিত ছিল।”
-“আপনি আমার রাগ করার মতো কেউ নন।”
-“তবে মুখ ফিরিয়ে রেখেছ কেন?”
-“আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করে না।”
নাজমার অন্তরের ভেতরটা নড়ে উঠল। প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
-“সেম টু মি, মোহনা।”
মোহ তাচ্ছিল্যের সাথে ফের হাসল,
-“সমস্যা নেই। আর বেশিদিন সতিনের মেয়ের চেহারা দেখতে হবে না। সংসারটা আপনার একার হবে।”
-“প্ল্যান কী তোমার?”
-“আপনাকে বলতে ইচ্ছুক নই।”
-“তুমি আমায় হেয় করছ।”
-“সয়ে নিন।”
মোহ থামল। হাসি নেমে গেছে তার, চোখ চিকচিক করছে। অভ্যন্তরটা জ্বলে যাচ্ছে। স্বকীয় ব্যবহারকে সামলাতে এক হাত দিয়ে নিজের অন্য হাত খামচে ধরে বলল,
-“আপনি একজন পুরুষের দ্বিতীয় নারী আর আপনার অবস্থান আপনারই পুরুষের প্রথম নারীর বাড়িতে। এলাকার মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না।”
-“কম বলছে না; আমি শুনেছি, শুনছি।”
-“গ্রেট!”
-“মোহনা, আমি তোমাদের ব্যাপারে জানতাম না।”
-“এক্সপ্লেইন করলে আমার লাইফটা আগের মতো হয়ে যাবে না।”
-“নিজের দিকটা বলার সুযোগটাও পাব না?”
-“না। আমার আপনাদের কারো ওপর কোনো প্রকারের রাগ কিংবা অভিযোগ নেই।”
-“তুমি ভারি অদ্ভুত, মোহনা।”
-“আমি অপ্রকৃতিস্থ। আস্তে আস্তে টের পাবেন।”
মোহ চলে গেল। নাজমা খেয়াল করতে ভুলল না—মোহ একটা বারের জন্যও তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। নাজমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। বুকে দহন হচ্ছে। বোঝাপড়া প্রয়োজন। বাড়ির প্রকৃতি খুবই শান্ত। একটা ঝড়ের প্রয়োজন।
চলবে..