#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_৫ (কম্পলিটিং মি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]
প্রথম সম্বোধন! আমি বুঝি, উনি এগোতে চাইছেন। কিন্তু এগোননি। কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। আমার মনের ভেতর ভালোবাসার প্রজাপতি উড়তে লাগলেও, ওনার মনে চলছিল বিষাক্ত কিছু। বুঝে এলে অবশ্যই আমার গা শিরশির করে উঠত। আমি তো বুঝিইনি।
উনি আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও, ওনার বুকের ভেতরে জ্বলছিল তীব্র দাবানল। উনি কখনই আমাকে স্পর্শ করতেন না, ভুলক্রমে যাতে হাতেও না ছোঁয়া লেগে যায়—সেদিকে ছিল তার তীব্র মনোযোগ।
আমার পড়াশোনা চলছিল তখন। উনি আমার সাথে বেশ স্বাভাবিক হয়েছেন। আমি ওনার প্রেমে পড়তে থাকি খুবই ধীরে ধীরে। আস্তে-ধীরে উনিও আমার মায়ায় জড়িয়ে যান।
আমার বুক কাঁপে এখনও এটা ভাবতে—ওনার বুকে একত্রে দুই নারীর বাস ছিল। নারীরা তো শখের পুরুষের ছায়াতেও অন্য নারীর অস্তিত্ব সহ্য করতে পারে না! সেখানে কীভাবে কী..”
বলতে বলতে নাজমা হাঁপিয়ে উঠল। চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
-“উনি যদি একটু সাহস করে আমাকে সত্যিটা বলে দিতেন, তবে ওনাকে এতগুলো বছর, এত কিছু সহ্য করতে হতো না।”
জয়তুননেসা খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-“কী করতা তুমি?”
মলিন হেসে নাজমা বলল,
-“মুক্তি দিয়ে দিতাম।”
-“একা মাইয়া মানুষ, কই যাইতা?”
-“মানুষ জন্মায় একা, মরেও একাই। এখানে দ্বিতীয় মানুষের প্রয়োজন পড়ে না।”
-“পাপ করতা?”
-“আরেক নারীর ব্যক্তিগত পুরুষে দখল বসানো পাপ না?”
-“পুরুষের চার বিয়া করা জায়েজ আছে।”
-“স্ত্রীর অনুমতিতে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে আমার ব্যাপারে জানাননি অবধি।”
নাজমার কথা শুনে হেসে উঠলেন জয়তুননেসা। রসিকতার সাথে বললেন,
-“না জানাইয়াই ভালো করছে। আমার শেফা যতটা ভালা মানুষ আছিল, নিজের জিনিসে তার চাইতেও বেশি অধিকারসূচক আছিল। যদি একবার জানত, ওর জামাই আরেক বিয়া করছে। ও প্রথমে ওর জামাইরে তালাক দিত, তোমারে খুঁইজা একটা খুন করত, তারপর মাইয়াডারে বিষ খাওয়াইত। শেষে নিজে মরত, তা-ও মাফুইজ্যার সামনেই।”
অবাক হলো না নাজমা, মলিন হেসে বলল,
-“তাঁর প্রথম নারীর জায়গাটা পেলে, আমিও হয়তো তাই-ই করতাম।”
-“মানায়া নিতে পারবা না, বউ?”
জয়তুননেসার মুখে এমন সম্বোধনে নাজমার অন্তরটা জুড়িয়ে গেল। সামান্য হেসে বলল,
-“থাকার জন্য যতটা মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন, চেষ্টায় আছি। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে একা সামলে উঠতে পারছি না।”
-“মোহর কথায় কিছু মনে করছ?”
নাজমা তার দিকে তাকাল। জয়তুননেসা বললেন,
-“কিছু মনে কইরো না। মা-বাপের আহ্লাদী আছিল তো, এত ধাক্কা একত্রে নিতে পারতেছে না। সব ঠিক হইয়া যাইব। আমার মোহনারানী কিন্তু খুবই নরম মনের মানুষ। একটু মানায়া নিয়ো।”
-“আমাকে ক্ষমা করবেন, মা। মোহকে দেখলে আমার মায়া অবশ্যই জন্মায়, কিন্তু ওকে আমি নিজের মেয়ে বানাতে পারব না। ওর চোখে আমার প্রতি ঘৃণা দেখলে অন্তরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ওকে দেখলেই মনে পড়ে যায়—আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার দ্বিতীয় নারী; সে আরেকজনকে ছুঁয়ে এসে আমাকে ছুঁয়েছে এবং আমাকে ছুঁয়ে গিয়ে আবার তাকে ছুঁয়েছে।”
-“মনে কিছু নিয়ো না। আল্লাহ সব ঠিক কইরা দিব, দেইখো। বিশ্বাস রাইখো।”
-“সেই বিশ্বাসেই এখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছি। নয়তো পাপ এতক্ষণে হয়ে যেত।”
জয়তুননেসা চুপ হয়ে গেলেন এবার। নাজমা চোখে হাসল।
____
মোহ ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রঙ্গনকে কল লাগাল না। আসলে সে ভুলে গেছে। একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে গেল। বাড়িতে প্রবেশ করেই সে দেখতে পেল—বসার ঘরে জয়তুননেসা বসে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছেন।
মোহ একপলক দেখে ভেতরের দিকে চলে যেতে লাগল। তখনই জয়তুননেসা বলে উঠলেন,
-“কই গেছিলা?”
মোহ পা থামিয়ে ফেলল। দাদির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ভার্সিটিতে।”
-“এতদিন পর ম্যাডাম ফুলটুসির মনে পড়ল—তার লেখাপড়া আছে?”
মোহ নিন্দিত বোধ করল। কপাল কুঁচকে জয়তুননেসাকে বলল,
-“তা বিয়ে করিয়ে দাও, পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিই।”
-“মাইয়ার দেহি বিয়ার খুব সখ!”
-“হ্যাঁ, খুব। দিয়ে ধন্য করো।”
-“দিম না, খাইয়া-দাইয়া পড়বার ব। আমগোর কি ট্যাকা-পয়সা কম নাকি? এই বয়সেই বিয়া দিমু ক্যা?”
-“একটু দাদি-দাদি বিহেভ করলে কি তোমার জাত যাবে, দাদি?”
-“হ, আমি আবার মডার্ন আছি। মাইয়া লেখা-পড়া করব, নিজের পায়ে দাঁড়াইব..”
-“ওয়েট! আমি কি তোমার কুঁজো হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি?”
-“কইতে গেলে তা-ই, খাইতাছস তো আমারই পোলার কামাই।”
মজার ছলে কথাটা বললেন জয়তুননেসা, তবুও মোহর গায়ে লাগল। কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে জয়তুননেসার পাশের এক সিটের সোফায় বসে তাঁর দিকে ঘুরে বলল,
-“তোমার কী মনে হয়—তোমার ছেলে টাকা না দিলে, আমি না খেয়ে মরব, দাদি?”
-“মনে হওয়া না-হওয়ার কী আছে? মাইয়া মানুষ বিয়ার আগ অবধি বাপের দায়িত্বে। বাপের সবকিছু তখন মাইয়ার। তোর বাপের সব তোর। কিন্তু কামাইডা তোর বাপেরই। ট্যাকা না দিলে সত্যিই না খাইয়া মরবি।”
-“তবে দেখা যাক।”
মোহ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল। ভেতরে না ঢুকেই সদর দরজার দিকে যেতে লাগলে, জয়তুননেসা শুধালেন,
-“কী করবি?”
মোহ দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
-“না খেয়ে মরি কি না দেখব।”
-“যাস কই?”
-“রঙ্গনদার বাড়ি।”
-“ক্যান?”
-“ইচ্ছে করছে, তাই।”
-“জওয়ান পুরুষের বাইত্তে এত ঘন ঘন যাওয়া লাগে না, জানোস না?”
-“জওয়ান পুরুষটা যে আমার কী লাগে—তা কি তুমি জানো না?”
-“আমি জানলেও, বাকিরা জানে না।”
-“তুমি জানো, এই যথেষ্ট। বাকিদের জানার প্রয়োজনও নেই।”
-“যাওয়া লাগব না, যাইয়া কী করবি?”
-“ওরে দুষ্ট দাদি আমার! বুঝো না কী করব? খুব উম.. পাচ্ছে। দাদি, আমি যাই?”
জয়তুননেসা মুখ ঘুরিয়ে বসে বললেন,
-“নির্লজ্জ মাইয়ালোক!”
মোহ হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। অনেকদিন পর নিজেকে খানিকটা হালকা হালকা লাগছে। কিছুটা হতবাকও ক্ষণকালের জন্য হয়েছিল সে। চাপা স্বভাবের সে; যতই খোলামেলা হোক, কখনই এভাবে কথা বলে না।
ধীরে ধীরে যেন তার স্বভাবটা রঙ্গনের সাথে এক্সচেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। সে হয়ে যাচ্ছে ওপেন মাইন্ডেড, অ্যান্ড দ্যি গ্রেট সুবিধাবাদী লোকটা হয়ে যাচ্ছে ইন্ট্রোভার্ট। এ-থেকে বোঝা যায়—সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা দুজন বিপরীত স্বভাবের ব্যক্তিদের মাঝে যে-কোনো একজন যদি ভুলক্রমেও খানিকটা পালটে যায়, তবে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটবে; এক্ষেত্রে একজন পালটাতে শুরু করলে, অন্যজনকে স্বভাবের বহির্ভূত কাজ করতে হবে৷ পালটাতে হবে।
এখানে রঙ্গনকে দায়িত্বশীল, ধৈর্যশীল, কর্মনিষ্ঠ, রাগী, নিশ্চুপ, স্থির, শান্ত হতে দেখে মোহ নিজেকে অধৈর্য, দায়িত্বজ্ঞানহীন, চঞ্চল, অশান্ত বানিয়ে ফেলল না-কি মোহকে পালটাতে দেখে রঙ্গনও নিজের খোলস পালটে ফেলল—হু নৌ’জ!
_____
মোহ সিঁড়ি বেয়ে নামতেই, নিচ তলার শারমিন মোহকে দেখে ডাক দিল,
-“মোহনা, শুনে যাও তো!”
মোহ এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“জি, আন্টি। বলুন।”
পাশে আরও দু’জন মহিলা ছিল। মোহকে দেখে কিছু একটা ইঙ্গিত করল। মোহ ব্যাপারটা ধরতে পারল না। তখনই শারমিন বলল,
-“তোমার নতুন আম্মু কি বাসাতেই আছে?”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই চোখ-মুখ শক্ত করে তাকাল মোহ। তীক্ষ্ণ গলায় শুধাল,
-“কীসের আম্মু?”
শারমিন পান-খাওয়া দাঁতে হাসলেন। হেসে হেসে বললেন,
-“শোনো, আম্মু। এসব ঘটনা পাঁচকান হতে সময় লাগে না। খবর কালকেই পাইছি। কিন্তু তোমাদের পারিবারিক ঝামেলার জন্য যাইনি।”
পাশ থেকে একজন মহিলা বললেন,
-“মা মরে নাই এক মাস, তার মধ্যেই বাপের আরেক বউ বাড়িতে আইল। তোমরা কি কাহিনিটা জানবার পারো নাই কোনোভাবেই? এক মাইয়াই তো ছিলা, না? সৎমায়ের অত্যাচার জানো? সহ্য করতে পারবা না।”
আরেকজন বললেন,
-“দেখো, আমরা একই এলাকার। কখনও কোনো সমস্যায় পড়লে আমাদের জানাবা। বাপেও তো এখন তোমারে পাত্তা দিবে না। ওই মহিলা যা বলবে, তাই শুনবে। শোনো আমি বলি কি, একটা বিয়া করে ফেলো। আমার এক ভাতিজা আছে। তোমার দাদির কাছে সম্বন্ধ পাঠাব। এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারলেই এখন শান্তি পাবা।”
মোহ ধরা গলায় বলল,
-“অন্যের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা না বললেই কি নয়?”
-“একই সমাজে থাকি আমরা। ভালো-মন্দ দেখব না?”
-“আমি কি দেখতে বলেছি? মরি-বাঁচি তাতে পুরোটাই আমার পরিবারেরই যাবে আসবে। আপনাদের কিছু হবে না। বড়োজোর দু’বার বলবেন—মেয়েটা ভালো ছিল। খারাপ হলেও বলবেন ভালো ছিল। তাছাড়া কিছুই না।”
-“আগে তো এমনে কথা বলতা না। এত কথা শিখলা কবে? ভালো করছ। এমনেই কঠিন থাকবা। তাইলে সৎমায়ের সংসারে টিকবার পারবা।”
-“সৎমা সৎমা কী লাগিয়েছেন? আশ্চর্য মানুষ তো! খেয়ে-দেয়ে অন্যের ফ্যামিলির বিষয়ে নাক না গলিয়ে কাজ নেই? যতসব আজাইরা লোক!”
-“শিষ্টাচারের কী শ্রী! মুখের ভাষা এমন হলে কপাল তো পুড়বেই। এজন্যই কারো ভালো চাইতে নাই। কথা আমাদেরই শুনতে হয়। ভাবি, চলেন যাইগা! এই মাইয়ার কপালের ঝাঁটার বাড়ি আমি এখনই দেখতে পারতেছি।”
মোহর খুব কান্না পেল। তবুও শক্ত রইল। মনে মনে ফরিয়াদ করে উঠল,
-“রঙ্গন! আই নিড ইয়্যু ব্যাডলি, ইন এভরি সিঙ্গেল মোমেন্ট অব্ মাই লাইফ। আই কান্ট ব্রিদ, আই কান্ট লিভ, আই কান্ট ডু এনিথিং উইদাউট ইয়্যু। আই কান্ট ফরগেট ইয়্যু ফর অ্যা লিটল সেকেন্ড!”
আর একটা বাক্য ব্যয় না করেই মোহ দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান ঘটাল। পাশের বাড়ির সদরের বড়ো গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে, ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। কল লাগাল রঙ্গনকে। রিসিভ হতে সময় নিল না।
রঙ্গন শুধাল,
-“হ্যালো, মোহ! তুমি কোথায়?”
জবাব দিতে গিয়ে মোহ খানিকটা ইতস্তত বোধ করল। হালকা কেশে নিয়ে বলল,
-“আমি ক্যাম্পাসে নেই, তুমি কি ওখানেই?”
-“হ্যাঁ। তুমি কোথায় আছ?”
-“আমি শ্বশুরের ভিটেতে।”
-“কী?”
-“বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ লাগবে?”
-“একটু সময় লাগবে।”
-“শোনো।”
-“হু-উম?”
থেমে থেমে অনেকটা ভেবে-চিন্তেই মোহ বলল,
-“অনেক অনেক পরে বুঝতে পারলাম—আ’ম নাথিং উইদাউট ইয়্যু।”
রঙ্গন মুচকি হেসে বলল,
-“অ্যান্ড ইয়্যু কম্পলিট মি।”
চলবে..