প্রেম পড়শী পর্ব-০২

0
915

#প্রেম_পড়শী
#পর্ব_২ (রংধনু)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

মোহর কান্না থেমেছে। সে থেকে থেকে কাঁপছে। প্রিয় পুরুষের বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে তাকে সবকিছুর বিশদ বিবরণ দিয়েছে। পুরো ঘটনাটা বলা শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ।
সে যে জানত না, ব্যাপারটা তা নয়। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরতেই মায়ের মুখ থেকে অর্ধেক কাহিনি শোনা হয়েছে। তাও চুপচাপ প্রেয়সীর থেকে সবটা আবারও শুনল।

তাকে চুপ থাকতে দেখে মোহ বুকে থেকে মাথা তুলল। আলতোভাবে গালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
-“কথা বলছ না কেন, রঙ্গন?”
-“সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
-“আশ্চর্য! সবাই একই কথা বলছ কেন?”
-“তো কী বলব?”
-“কিচ্ছু বলা লাগবে না। তুমি যাও এখান থেকে। তোমাকে আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

মোহ রঙ্গনের বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইল। রঙ্গন ছাড়ল না। আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল,
-“আমি সব ঠিক করে দেবো। এত চিন্তা কীসের?”

রঙ্গনের সম্মোহনী কথায় এবার মোহ গলে গেল। আবার বলল,
-“আজ আম্মুর ওই ভাই এসেছিল।”
-“কে?”
-“ওই যে!”
-“শিহাব মামা?”

মোহ ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগল। তা দেখে রঙ্গন আন্দাজ করে নিল। কোমলভাবে শুধাল,
-“কী করেছে?”

মোহ কিছু বলল না। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে তার। রঙ্গন জোর দিলো,
-“বলবে কি? তুমি না বললে—জানব কী করে?”

মোহ তাও কিছু বলল না। অধর দংশনে কাঁদতে লাগল। সন্দিহান গলায় শুধাল রঙ্গন,
-“ছুঁয়েছে?”

শব্দ করে কাঁদতে লাগল মোহ। মাথা উপর-নিচ ঝাঁকাল কেবল। রঙ্গন কিছুক্ষণ চুপ থাকল। অতঃপর, মোহর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“আর ছোঁবে না।”

________
মোহকে কেউ শিহাবের সাথে পাঠাতে পারেনি। অগত্যা শিহাবকে আজ রাতে থেকে যেতে হলো। মেয়েটা সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। খুব প্রয়োজনে দাদির সাথে যা না বললেই নয়, তাই বলে। বুঝদার মোহ আজ সারাদিনে যেসব অবুঝ কারবার করেছিল—তা চুকেছে রঙ্গনের সান্নিধ্যেই। আবার সেই আগের মতো নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। নির্লিপ্ত বললে ভুল হবে, হয়েছে গম্ভীর। চেহারায় আশ্চর্যরকমের ম্যাচিউরিটি। আগেও ছিল, এবার যেন আরও বেশি। বড়ো হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন পড়ে না। দু-একটা ধাক্কাই যথেষ্ট।

নাজমাকে কৈফিয়ত দেননি মাহফুজ সাহেব। নাজমা নিজেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পনেরো বছর আগে যখন বিয়ে করেছিল, তখন বিপাকে পড়ে হয়েছিল, অনেকটা দায়ে পড়েই করেছিল। তারপর একসময় ভালোও বেসে ফেলে। এক পুরুষের বুকে দুটো নারী থাকে কি? কত নারী থাকে! কত নারী! একসময় সংসারটাও আপনা-আপনি এসে যায়। কিন্তু মুখ ফুটে নাজমাকে শেফার কথা, কিংবা শেফাকে নাজমার কথা তিনি বলতে পারেননি।

স্বামীর প্রতি যাও খানিকটা অধিকার দেখাত নাজমা, এখন তা-ও ছেড়ে দিয়েছে। আজ দেখা হতেই বলল,
-“মাহফুজ, একবার শুধু বলতেন আমাকে! আমি বিয়ের পরই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতাম। আপনাকে শুধু শুধু দুই নৌকায় পা রেখে চলতে হতো না।”

মাহফুজ সাহেবের উঁচু মাথা কখন যেন নত হয়ে গেল, বুঝতেই পারলেন না। মলিন গলায় বললেন,
-“দুঃখিত আমি। ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই আর। নুরশিন, নাফসিনের জন্য হলেও এ-বাড়িতে থেকে যাও।”

-“কোথায় যাব আর? আমার আর যাওয়ার জায়গা কোথায়? এতদিনের যোগাযোগ ছিন্নতায় আপনার চিন্তায় মরেই যাচ্ছিলাম। এরকমভাবে এর আগে যোগাযোগ বন্ধ করেননি তো, তাই।”

-“আমি রফিককে বলেছিলাম—তোমাদের খেয়াল রাখতে, আমার ব্যস্ততা সম্পর্কে তোমায় জানাতে।”
-“সে খোঁজই নেয়নি আমাদের।”
-“আমি বুঝতে পারিনি।”
-“সে-যাক! আমি এখানে থাকছি—আপনার মেয়ে বোধহয় এতে ভারি অসন্তুষ্ট। রাগ-টাগ করে বাড়ি না ছেড়ে দেয় আবার!”
-“আমার মেয়ের বয়স কম হলেও, অবুঝ না।”
-“কী বুঝবে? বাবার দ্বিতীয় সংসার বুঝবে?”
-“বুঝবে।”
-“আচ্ছা, তাই? তবে থাকলাম আমি.. আমরা। কোন ঘরে থাকব—বলে দিন!”
-“গেস্টরুমে থাকবে।”

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে নাজমা হাত নেড়ে হেসে উঠল,
-“স্বামীর বাড়িতে প্রথম কদম ফেলেই জানতে পারলাম—তার আরও একটা সংসার আছে। তারই বাড়িতে এখন আমাকে গেস্ট রুমে থাকতে হবে। সোনায় বাঁধানো কপাল আমার!”

-“খুব অভিযোগ, না?”
-“না, না! আপনি পর মানুষ! কীসের অভিযোগ?”
-“অভিমান?”
-“এই বাড়িতে আসার আগ অবধি ছিল। আর নেই। হবেও না।”

নাজমা বাচ্চাদের নিয়ে গেস্ট রুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। নাফসিনের ঘুম আসছিল না। একা একা পেটের উপর থেকে মায়ের হাত সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ডিনারের সময় সে মোহকে যে-রুমে ঢুকতে দেখেছিল, ধীরপায়েতে এখন সেই রুমের দিকে এগোল।

মোহ বিছানায় হেলান দিয়ে ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখছিল। অকস্মাৎ দরজা খোলার শব্দে সে চকিতে তাকায়। বাচ্চা একটা মোটাসোটা ছেলে। কোঁকড়াচুল, গোল মুখ, চোখে গোল চশমা আর থুতনিতে টোল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মোহকে দেখে সে এদিক-ওদিক তাকাল। আস্তে-ধীরে বলল,
-“হাই! আমি নাফসিন। তোমার নাম কি আপা?”

মুখ ফিরিয়ে নিল মোহ। অন্যদিকে তাকাল। নাফসিন রুমের ভেতরে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-“সরি! পারমিশন ছাড়াই এসে গেছি।”

মোহ কিছুই বলল না। বাচ্চাটার ওপর নিজের চাপা রাগ ঝাড়ার মানেই হয় না। তাই চুপ রইল। নাফসিন বলল,
-“তখন কত কথা বললে! এখন কথা বলছ না কেন? ব্যাটারি ডাউন?”

এবারও মোহ চুপ। নাফসিন বলল,
-“আচ্ছা, তোমার কথা বলা লাগবে না। আমি কথা বলি, তুমি শোনো। আমি যখন স্কুল শেষে বাসায় ফিরি, তখন আমারও কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুমি স্কুল থেকে এসেছ, তাই-না?”

সরু চোখে তাকিয়ে রইল মোহ। নাফসিন পাশেই বিছানার ওপর উঠে বসল। পা দোলাতে দোলাতে বলল,
-“মা বলল—তুমি আপা। মা আমাকে বলে—নুরকেও আপা ডাকতে। আমি ডাকি না। তুমিই বলো, ওর নাম তো নুর; সবাই নুর ডাকে। আমি ওকে আপা ডাকব কেন?”

কিছুক্ষণ থেমে বলল,
-“আপা, তুমি কি কোনো কারণে রেগে আছ? আমি কোনো ভুল করলে মা আমার সাথে কথা বলে না। আমি কিছু করেছি? কথা বলছ না যে?”

মোহ নাম মনে করার চেষ্টা করল, মনে পড়ল না। অতঃপর বলল,
-“ঘুমাতে যাও।”
-“ইয়াহু! কথা বলেছে আপা!”

মোহ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এ যেন তার পুরো বিপরীতমুখী কেউ। কী চঞ্চল! বাচ্চাটার বয়স কত হবে? উম.. ৬ বা ৭? হবে হয়তো। এইটুকুন বাচ্চা, এত কথা কীভাবে বলতে পারে—মোহর মাথায় আসে না। মোহকে ভাবতে দেখে নাফসিন আবার বলল,

-“আপা, ঘুম আসছে না তো। না ঘুমাই?”
-“নিজের রুমে যাও।”
-“এখানে থাকি?”
-“না।”
-“আপা, এখানেই ঘুমাই?”
-“যাও এখান থেকে।”
-“আচ্ছা, যাচ্ছি।”

নাফসিন যেতে গিয়েও ফিরে এলো। গালে আঙুল রেখে ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
-“এত রাগো কেন তুমি? জানো না—বাচ্চাদের দেখলে কেবল আদর করতে হয়।”

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,
-“এ! বোকো না, বোকো না। বকলে আমার খুব মন খারাপ হয়, আমি যাচ্ছি।”

নাফসিন হাত-পা দোলাতে দোলাতে চলে গেল। মোহ হাতের অ্যালবামটা বিছানায় ফেলে বারান্দায় চলে এলো। দোতলা বাড়িটার পাশাপাশি একটা একই নকশার দোতলা বাড়ি আছে। দুটো বাড়ির মাঝের আয়তা খুবই কম, হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। এখানে দুটো বারান্দা মুখোমুখি। মোহ সেই বারান্দায় চোখ স্থির রাখল। কিছুক্ষণের মাঝেই রঙ্গন এলো। মোহর দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। রঙ্গন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শুধাল,
-“বিশ্বাস করো না?”

মোহ তাকে ছোটো-ছোটো চোখে দেখল। একবার রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অসম্ভব শান্ত গলায় বলল,
-“করি।”
-“তবে এত দুশ্চিন্তা কেন?”
-“এমনি..”
-“আচ্ছা। রুমে যাও। ঘুম দাও।”
-“ঘুম আসছে না।”
-“ক্লান্ত তুমি, বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করো। এমনিই চলে আসবে।”
-“ঠিকাছে।”

মোহ রুমের ভেতর চলে গেল। নিজের পরিবর্তনটা দেখে সে ভারি অবাক হচ্ছে। তার ইচ্ছে নেই মানে হচ্ছে—সে ভুলেও তা করবে না, কেউ করাতেও পারবে না। সেই মোহ এখন দূর্বল। এতটাই দূর্বল যে কেউ জঘন্যহাতে ছুঁয়ে দেওয়ার সাহস পেয়েছে। রাগে-দুঃখে কোমরের সেখানটায় নিজের হাত দ্বারা খামচে ধরল, ঘষতে লাগল। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো করে একটা শাওয়ার নিয়ে রুমে চলে এলো। এবার নিজেকে কিছুটা স্থির লাগছে।
ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে একটা ম্যাসেজ এলো,

“কেবল কল্পনা করো, কল্পকন্যা। দুশ্চিন্তার জন্য রঙ্গন আছে না?
~ওয়াজিহ্ মেজবাহ রঙ্গন!”

মোহ ম্যাসেজটা পড়ে এত কষ্টের মাঝেও মলিন হাসল। উঠে গিয়ে বারান্দার দিকে তাকাল। সেখানটায় আর রঙ্গনকে দেখতে পেল না। বিছানায় বসে সেই ম্যাসেজের রিপ্লাই ম্যাসেজ লিখল,

“মনাকাশটা ঘন-কালো মেঘে ছেয়ে ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল, তবুও অন্ধকার কমছিল না। কী দমবন্ধকর ভয়ঙ্কর! আর এখন কী শান্তি! তুমি আমার গুমোট জীবনের শেষ অধ্যায়, আমার রংধনু।
~মোহনা আফরিন!”

চলবে..
শব্দসংখ্যা: ১৩৪৯

[সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভালোবাসা❤️]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে