প্রেম পড়শী পর্ব-০১

0
1411

#প্রেম_পড়শী
#সূচনা_পর্ব (ক্ষিপ্ততা)
#লেখনীতে_ নবনীতা_শেখ

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত]

মা মারা যাওয়ার শোক কাটতে না-কাটতেই বাড়ির অন্দরে প্রবেশ হলো বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, সাথে তার দুই সন্তান। বাবা ও মায়ের ছিল প্রেমের বিয়ে। এলাকাতে প্রচলিত আছে—মাহফুজ সাহেব বউ-পাগল মানুষ একজন। তার দ্বারা এমন কিছু ভাবনাতীত ব্যাপার বই কি! মোহ শোকে আছে না কি শকে আছে—কেউ-ই বুঝতে পারছে না। খানিকক্ষণ পর পর বিরবির করছে,
-“আমার আব্বুকে ফাঁসানো হচ্ছে। আম্মু থাকতে সম্ভব ছিল না বলে, এখন করছে! বুঝতে পারছি আমি।”

মোহ স্তব্ধ বনে গিয়েছে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মাসখানেক আগেই শেফার মৃত্যু হলো, অথচ এই স্বল্পসময়ের ব্যবধানে তার ঘরে অবস্থান করছে প্রিয় স্বামীর আরেকটি বউ। মোহর সবকিছুর অসহ্য ঠেকছে। উঠে চলে গেল দাদির ঘরে।

জয়তুননেসা তাকাতেই মোহ মেঝেতে, তার পায়ের কাছে বসে পড়ল। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে শুধাল,
-“এসব কী হচ্ছে, দাদি? ওই মহিলাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিয়েছ কেন?”

জয়তুননেসা আঁড়চোখে তাকিয়ে বললেন,
-“তয় কি ওমনে বাইরে ফালায় রাখুম?”
-“ওরা বাইরের মানুষ, দাদি। বাইরেই ওদের জায়গা।”
-“ওরা তোর-আমার কিছু না লাগলেও, তোর বাপের মানুষ।”
-“তাই বলে, আমার মায়ের ঘরে থাকতে দেবে?”
-“ওইডা তোর বাপের ঘর।”
-“ওরা আমার আব্বুর কেউ না। তুমি বুঝতে পারছ না কেন, দাদি? ওরা আমার আব্বুকে ফাঁসাতে চায়। ওরা কেউ ভালো না। ওই মহিলাকে চলে যেতে বলো, দাদি। প্লিজ!”

কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গিয়েছে মোহর। শেষবারের মতো আবার শুধাল,
-“আব্বু কখন আসবে, দাদি? আমার আর কিছু ভালো লাগতেছে না। আব্বুকে আসতে বলো না! কখন আসবে?”
-“কামে গেছে, কাম ফুরাইলেই আসব।”

মোহ উঠে নিজের রুমে চলে গেল।

_____
জানালার পর্দা ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে নাজমা। ভেতরে, খাটের উপর বসে আছে—নুরশীন আর নাফসিন। নুরশীন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী, আর নাফসিন প্রথম।
নাজমা এখন কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। আগে মাহফুজ কখনই এতদিন নাগালের বাইরে ছিলেন না। একা দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলাটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বলেই, ঠিকানা অনেক খুঁজে-টুজে এ-বাড়িতে পা রেখেছে। মোহ যেমনটা তার ব্যাপারে জানত না, সে নিজেও নিজেকে দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে জানত না। মাহফুজ বলেছিলেন—তাঁর পরিবার বিয়েটা মানবে না, এজন্য আলাদা থাকতে হবে। পরিবার বলতে কেবল মাহফুজের বাবা-মাকেই নাজমা বুঝেছিল। তাই আর সে নিজে শ্বশুর-ভিটেয় পা রাখার আর্জি জানায়নি। মাহফুজের কাছে তার কোনো আশা না থাকলেও কিছু অধিকারবোধ ছিল, ভালোবাসা ছিল, সংসার ছিল। এসবের পরও সে স্বাভাবিক রয়েছে—বাচ্চাদুটোর মুখের দিকে চেয়ে; আপাতত থাকার জায়গা প্রয়োজন।

নাফসিন নরম স্বরে নাজমাকে বলে উঠল,
-“মা, খুদা পাচ্ছে।”

নাজমার বুকের ভেতরটা ছলকে উঠল। আঁচলের শেষাংশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে চোখের কার্ণিশ মুছে নিল। মুখে হাসির রেশ টেন বলল,
-“এই তো, আব্বু। আরেকটু অপেক্ষা করো। বাবা এলেই খেতে দেবো।”
-“বাবা কখন আসবে, মা?”
-“চলে আসবে।”
-“আমার খুব খুদা পাচ্ছে। খু–ব।”

ঠোঁট উলটে বসে রইল নাফসিন। নুরশীন নাজমার দিকে তাকাল। তার চোখের চাহনি ভীষণ তীক্ষ্ণ। গলায় কাঠিন্য এনে বলল,
-“মা, ওই মেয়েটা কে ছিল?”
-“কোনটা?”
-“আমাদের দেখে চিৎকার-চেচামেচি করল, সে।”

নাজমা কী বলবে—ভাবছে। খানিকক্ষণ ভেবে জবাবে বলল,
-“তোদের আপা লাগে।”
-“আপা? বাবার মেয়ে?”
-“হ্যাঁ।”
-“তোমার মেয়ে না?”
-“না।”
-“তার মা কে?”
-“জানি না।”
-“মা..”
-“আর কোনো প্রশ্ন কোরো না, নুর। আমার মাথা ঠিক নেই।”

______
নিজের রুমের দক্ষিণের দেয়ালে টানানো মা-বাবার সাথে তার ছোটো বেলার ছবির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে মোহ অভিযোগের পসরা সাজাচ্ছিল,
-“এসব কী হলো, আম্মু? এটা তো চাইনি! আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আম্মু!”

তখনই কটিদেশ বরাবর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে তার সমগ্র গা শিরশির করে উঠল। সরে যাওয়ার আগেই হাতটা আরও জোরে ডেবে বসল। মোহর খুব কান্না পেল। ভয়ে পুরো শরীর শিথিল হয়ে এলো। কোনোমতে সরে গেল সেখান থেকে। পিছে ঘুরতেই শিহাবকে দেখতে পেয়ে কান্নাগুলো ভুলে গেল। রাগে-দুঃখে শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মা নেই! কেন নেই? এখন যে তাকেই সবচেয়ে বেশি দরকার!

মোহকে ঘেন্নায় মুখ সরিয়ে নিতে দেখে শিহাব খুবই অশালীনভাবে হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
-“মামা এসে গেছি না? এখন আমার মোহনারানীর এত কষ্ট পেতে হবে না। এখানে থাকা লাগবে না। চলো, মামা বাড়িতে নিয়ে যাব।”

মোহর হাত ধরতে গেলেই, মোহ ছ্যাত করে উঠল। আরও দূরে গিয়ে বলল,
-“তোমার সাথে যাব না আমি। কোত্থাও যাবে না। চলে যাও এখান থেকে।”
-“তা বললে তো হয় না, মামনি। মামা কি তোমাকে কম আদর করি? আসো। আমার কাছে আসো।”

মোহ কাছে যায় না। পেছোতে পেছোতে বারান্দার ঢুকে যায়। রেলিংয়ের সাথে আটকে পড়তেই থমকে দাঁড়ায়। শিহাব সাবধান করল,
-“পড়ে যাবে তো। এদিকে এসো।”
-“যাব না। যাব না।”
-“কেন আসবে না?”

মোহ কিছু বলে না। শিহাব আরেক কদম এগোনোর আগেই রুমের ভেতর মাহফুজ সাহেবের আগমন ঘটল। শিহাবকে দেখে বলল,
-“তুমি এখানে?”

ভদ্রতার খোলসে নিজেকে আবৃত করে নিল শিহাব,
-“হ্যাঁ, দুলাভাই। আপার যাওয়ার পর মামনি খুব মনমরা হয়ে ছিল। কান্না-টান্না করছিল। তাই ভাবলাম—নিয়ে যাই। ক’দিন আমার বাড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”

কিন্তু পরিস্থিতি এখন প্রতিকূলে। হুট করে কী হয়ে গেল, মাহফুজ সাহেব নিজেও বুঝতে পারছেন না। মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারছেন না। শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তুমি নিচে গিয়ে বোসো। মোহর সাথে কিছু কথা বলে আসছি আমি।”

শিহাব চলে গেল। মোহ এবার খানিকটা শান্ত হলো। বাবাকে দেখে এগিয়ে গেল। মাহফুজ সাহেবের বুকে মাথা রেখে বলল,
-“আব্বু, জাস্ট একটাবার বলো সব মিথ্যে! সব মিথ্যে! বলো না। আমি তো তোমায় সব থেকে বেশি বুঝি। তবে তোমার চোখ দেখে আজ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কেন?”

মাহফুজ সাহেব শুধু মোহর মাথায় হাত রাখলেন। কিছু বলতে পারলেন না। মোহ আবার শুধাল,
-“বলছ না কেন? আব্বু? আব্বু বলো—সব মিথ্যে!”

তিনি বলতে পারলেন না—সব সত্যি। কেবল বললেন,
-“আজ থেকে ওরা তোমার সাথে থাকবে। খারাপ ব্যবহার কোরো না।”

মোহ ছিটকে সরে গেল। অশ্রুসজল নয়নে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আম্মু থাকলে আমার দুনিয়াটা আগের মতোই সুন্দর থাকত। আমিই অভাগী!”

মাহফুজ সাহেব মলিন চোখে কেবল মোহর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের প্রচণ্ডরকমের শান্ত-স্থির স্বভাবের মেয়েটার চোখ-মুখের অস্থিরতা তার বুকের অন্তঃস্তলে রক্তক্ষরণ করছে। মেয়েটা বুঝতেই পারল না।

______
রাতে ছাদে বসে বসে অশ্রুবিলাস করছিল মোহ। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে ফেলার মতো অবস্থা। তার বাবার হুট করেই পালটে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না। রাতে না খেলে যেই বাবা অস্থির হয়ে যেত, আগে-পিছে ঘুরে-ফিরে ক্লান্ত হতো, তবুও নিজ হাতে খাইয়েই ছাড়ত—সেই বাবা আজ তার এমন দমবন্ধকর কান্নাতে কিছু বলল না। রাতে যখন নাজমারাও একত্রে খেতে বসেছিল, মোহ ডাইনিং থেকে উঠে গিয়েছিল। তার বাবা তাকে একবার খেতেও বলল না! খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের ঝুলি খুলল সে।

এমন সময় মোহ নিজের সান্নিধ্যে একটা ছায়া পায়। পিছে না তাকিয়েও বুঝে ফেলে—সে কে। কান্নার গতি আরও বাড়ল। কঠিন পুরুষের বুক নরম হলো। সামনে এগিয়ে এসে নিজে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মোহকে টেনে নিয়ে বক্ষে আটকাল। কানের পিঠে চুল গুঁজে দিতে দিতে বলল,
-“কী হয়েছে?”

মোহ ফুঁপিয়ে উঠল,
-“আমার সব গেছে গো, সব গেছে। তুমি যেয়ো না।”

মোহর সাধের পুরুষ দু’হাতে তার মুখ আঁজলা করে ধরল। চোখের স্থির ও গভীর দৃষ্টি সোজা বুকের অভ্যন্তরে গিয়ে পৌঁছাল। আকস্মিক অনুভূতিরা মেয়েটাকে বোঝাল,
-“আমি তোমার।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে