#প্রেমোত্তাপ
পর্ব: ২৯
কলমে: মম সাহা
শাহবাগের মোড়ে তুমুল জ্যামে আটকে আছে চিত্রার রিকশা। তার মন খারাপ। অথচ আজকে তার সবচেয়ে খুশির দিন হওয়ার কথা ছিল। আজকে তার আনন্দের পথে পান্তরে হৈ হৈ করে ছুটে বেড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। চিন্তার নিবিড় চোখ স্থির। এই চঞ্চল চিত্রার স্থিরতা দেখে বাহার শুধাল,
“তোমার সাথে নিরবতা ভীষণ বেমানান, সেটা কী জানো তুমি?”
চিত্রার গভীর ধ্যান কিঞ্চিৎ ভাঙলো। সে অস্ফুটস্বরে কেবল বলল,
“হুহ্!”
বাহার ভ্রু কুঁচকালো। চিত্রার দিকে চাইল সে নিঃসংকোচে। গভীর ভাবে বলল,
“হয়েছে কী?”
বাহারের আহ্লাদী প্রশ্নে চিত্রার মন খারাপ আরও বাড়লো। মন খারাপের উদাস বাতাস ছুঁয়ে গেল যেন তার আঙিনা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পিঠ টান টান করে বসল। বলল,
“অহি আপা না চলে যাবে বলেছে।”
“কোথায়?”
বাহারের প্রশ্নে চিত্রা চোখ রাখল লোকটার দিকে। চোখে চোখ মিলল। চিত্রার চোখ গুলো ছোটো ছোটো। জ্বলজ্বল করছে দুশ্চিন্তায়। খুব সহজেই কেউ চাইলেই মেয়েটার ভেতরের সকল অনুভূতি পড়তে পারবে। মেয়েটার মন স্বচ্ছ। চোখের ভাষারাও ভাসা ভাসা। বাহার দুই ভ্রু আবার উঁচু করল। চিত্রা হতাশ কণ্ঠে বলল,
“আপার মায়ের কাছে। উনি কয়েকবার এসেছিল আপাকে নিতে কিন্তু আপা যায়নি। কিন্তু আজ আপা বলেছে সে চলে যাবে। এবং কালই যাবে। উনাকেও সে জানিয়ে দিয়েছে এটা। চাঁদনী আপারও কাল ফ্লাইট। আমরাও কাল বিয়ে করব। সবাই কেমন আলাদা আলাদা হয়ে যাব কাল! আমাদের ছাড়া আব্বু, বড়ো আব্বু, ছোটো আব্বু, আম্মু, চাচীরা কীভাবে থাকবে? চেরিটাও কান্না করবে। ভাইজান তো প্রতিদিন রাতে একবার আমাকে না দেখে ঘুমায় না। সে কীভাবে ঘুমাবে? আমাদের ছাড়া বাড়িটা যে আর হাসবে না, বাহার ভাই!”
কথা বলে থামল চিত্রা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ নিয়ন বাতি গুলোর আলো এসে মেয়েটার চোখ-মুখ গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। গোলগাল মুখে হলুদ আভাটা ভীষণ মানিয়েছে। এ যেন মায়ার আলো। আর চিত্রা যেন মায়াকন্যা। বাহার মুগ্ধ চোখে সে মায়াকন্যার চিন্তার ভাষাদের শুনল, জানল। অতঃপর কিছুক্ষণ নিরব থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের দিন পিছিয়ে দিই তবে?”
চিত্রা তৎক্ষণাৎ তাকালো। দৃষ্টি তার তাজ্জব। হড়বড়িয়ে বলল,
“নাহ্।”
চিত্রার না বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল বাহার। তাও বেশ শব্দ করে। নিজের কথায় লজ্জা পেল চিত্রাও। সেকেন্ডে চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি নামাল পথে। মাঝে মাঝে সে এত বোকা কাজ করে ফেলে কেন! চিত্রার লজ্জা যেন বাহারকে ভীষণ আনন্দ দিল। তাই সে এই লজ্জার আবরণ আরেকটু বাড়াতে বলল,
“লজ্জা পেলে?”
প্রশ্নটা করে আবারও হো হো করে উঠল বাহার। চিত্রা মুখ ঢেকে ফেলল দু-হাতের আঁজলে। এ যেন এক মন্ত্রমুগ্ধ সন্ধ্যা। এই যেন এক ভালোবাসার দিন। ব্যস্ত রাস্তা যেন মুগ্ধ চোখে এই প্রেমের কীর্তি দেখল। বহুক্ষণ…. চোখ মেলে।
জ্যাম ছুটল। বাহারের হাসি কমল। নিভে এলো মুগ্ধ দৃশ্য। বাহার আবার আগের ন্যায় গম্ভীর হলো। ভরাট কণ্ঠে বলল,
“কাল এমন একটা দিন, এই দিনে বিয়ে করাটা স্বার্থপরের মতন কাজ হয়ে যাবে না?”
চিত্রা মুখ থেকে হাত সরালো। ক্লান্ত চোখে চাইল আবার। বার কয়েক শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়ে যাবে। আপনারে পাওয়ার জন্য আমি স্বার্থপরও হতে রাজি, বাহার ভাই।”
“এ কেমন ভালোবাসলে, রঙ্গনা? নিজেকে হারিয়ে ফেলতেও ভাবছো না! তুমি যে এমন নও, রঙ্গনা। তবে কেন এত স্বার্থপরতা দেখাচ্ছ? যে বাড়ি এবং বাড়ির সদস্যরা তোমার প্রাণ, তাদের এই দুর্দশার দিনে তাদেরকে ছাড়তেও দু-বার ভাবছো না যে!”
“জানেন বাহার ভাই, আমার কেন জানি মনেহয়, তাদের একবার ছাড়লে আমি দ্বিতীয়বার আবার ফিরে পাব। কিন্তু আপনাকে একবার ছাড়লে চিরতরে হারিয়ে ফেলব।”
“হারিয়ে ফেলার ভয়ে বাঁধতে চাচ্ছ, মেয়ে! তুমি জানো না? যে যেতে চায় তাকে কোনো বাঁধনই রাখতে পারেনা। আর যে থাকতে চায়, তাকে কোনো অবহেলাও তাড়াতে পারেনা। আমি ছাড়তে চাইলে বিয়ে আমায় আটকে রাখতে পারবে? সত্যিই কী বিয়ে আটকে রাখার সুতো? যদি তেমনই হতো তাহলে অহির জন্মদাত্রী কী এত ভালোবাসার পরেও তোমার ছোটো আব্বুকে ছেড়ে যেত? তাদের তো বিয়ের সম্পর্কই ছিল, রঙ্গনা! যে যেতে চায়, তাকে আটকে রাখা যে বড়ো দায়।”
বাহার ভাইয়ের সহজ-সরল কথা গুলো কতক্ষণ অসুরের ন্যায় নৃত্য করল চিত্রার ছোট্টো মগজে। মেয়েটা সইতে পারল না এই ভারী সত্যি কথার তোপ। তার উদাসী চোখ জলে টইটুম্বুর হলো,
“আমি এত জটিলতা বুঝিনা, বাহার ভাই। আমি কেবল এতটুকুই বুঝি, আপনারে না পেলে আমার এই জগৎ বৃথা। এই জনম বৃথা।”
বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। আফসোস নিয়ে বলল,
“করিলে বৃথা জনম, অন্ধ প্রেমে ফেঁসে,
কেউ মরেছে বারে-বারে, প্রচন্ড ভালোবেসে।”
_
ধানমন্ডির এক শুনশান রাস্তায় হাঁটছে চাঁদনী। তার কিছুটা পেছন পেছন হাঁটছে মৃন্ময়। সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ভেতর, বাহির, অন্তর। পথ-ঘাটে গাড়ি আছে বেশ তবে তেমন যানজট নেই। শা শা করে গাড়ি আসছে আর ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। কেউ তাদের হাঁটায় বিরক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, কেউ বাঁধা হচ্ছে না। প্রায় বেশ খানিকটা হাঁটার পর বিরতি নিল মৃন্ময়। পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
“কী বলবেন, ইন্দুবালা? কী বলতে এতদূর ডাকলেন?”
চাঁদনী চাঁদের ন্যায় শীতল হাসল। মিহি স্বরে বলল,
“সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে চলো, চা খেতে-খেতে কথা বলবো।”
মৃন্ময় আর কথা বাড়ালো না। কেবল ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটল। চায়ের দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিল। তারপর নড়বড়ে বেঞ্চটাতে বসলো দু’জনে। আজকে চাঁদনীকে বরাবরের তুলনায় একটু অন্যরকমই লাগছে। প্রায় সময়টাতেই তার মুখে হাসি দেখা গিয়েছে। মৃন্ময় অপলক চোখে কয়েকবার দেখেছেও সেই সুন্দর মুখটি। সেটা অগোচর হয়নি চাঁদনীরও। ব্যস্ত নিবিড় রাস্তায় ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো চাঁদনী। ভেতরে যেন নতুন এক উদ্যমের সৃষ্টি হলো। চাঁদনী সেই উদ্যমকেই সঙ্গী করে সকল জড়তা কাটিয়ে ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“মৃন্ময়, তুমি কী জানো, তুমি কিন্তু ভীষণ সুদর্শন।”
মৃন্ময় মাত্রই চা-টা মুখে নিয়েছিল, কিন্তু আকস্মিক চাঁদনীর এহেন কথায় চা মহাশয় তার নাক-মুখে উঠে গেলো। যার ফলস্বরূপ তুমুল কাঁশির উৎপাত। অথচ বিচলিত হতে দেখা গেল না চাঁদনীকে। সে বেশ আয়েস করেই চায়ে চুমুক দিতে থাকাল। মিনিট পেরুতেই মৃন্ময় স্বাভাবিক হলো। কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এখনো তার ভেতরের হতভম্ব ভাবটা কাটেনি। চাঁদনী দীর্ঘ বিরতির পর আবার বলল,
“তুমি এটাও কী জানো যে তুমি আমার থেকে শতগুণ ভালো মেয়ে ভবিষ্যতে পাবে?”
চাঁদনীর আকস্মিক এমন ধারা প্রশ্নে মৃন্ময় বলার ভাষা হারিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া সে আর কিছুই যেন করতে পারল না। চাঁদনী হাসল মৃন্ময়ের এহেন দশায়। ভাবুক স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে পছন্দ করো এতটুকু অব্দি আমি মেনে নিয়ে ছিলাম। বা বলা যায় এতটুকু অব্দি সব ঠিকই ছিল। তবে ভুল কখন হলো জানো?”
মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকালো, শুধালো, “কখন?”
“যখন তুমি আমাকে পছন্দ করো বলে নিজের বিবেক, বিবেচনা বোধ হারালে। কীভাবে পারলে মৃন্ময়! নিজেকে এতটা ছোটো করতে? তবে আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। তুমি ছোটো মানুষ। ভেবেছিলে ছোটোবেলার খেলনা চাওয়ার বায়না আর মানুষ চাওয়ার বায়না বোধহয় এক। তাই ভুল পথে হলেও সেটা পেতে হবে। কিন্তু মৃন্ময়, সবসময় সবকিছু যে আমাদের মনমর্জি মতন চলে না। কখনো না পেয়েও বাঁচার ক্ষমতা রাখতে হয়। তৃমি কী জানো? কখনো মানুষ হেরে গিয়েও জিতে যায়? তোমার অন্তত মানুষ চাওয়ার খেলায় হেরে যাওয়া উচিত ছিল। এত বড়ো ভুল করা উচিৎ হয়নি তোমার।”
চাঁদনীর কথা থামতেই তড়তড় করে ঘামল মৃন্ময়। অতি উত্তেজনায় বসে না থাকতে পেরে চট করে দাঁড়িয়ে গেল। তোতলানো কণ্ঠে বলল,
“কী, কী বলছেন, ইন্দুবালা!”
চাঁদনীও এবার গা ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চায়ের বিলটা পরিশোধ করতে করতে বলল,
“কালকে আমার ফ্লাইট। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব কালই। তবে দেশ ছাড়ার আগে এত বিদঘুটে একটা সত্য না জানলেও বোধহয় ভালো ছিল। তাই না, মৃন্ময়? নাহয় আমি ভুল করেই ভাবতাম, একটা পাগল ছেলে আমার জ্বর আসবে বলে ছাঁদে ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে ছিল। আর আমাদের ছবি ভাইরাল হওয়াটা কাকতালীয় ছিল। কিন্তু তোমার ভালোবাসার দুর্ভাগ্য মৃন্ময়, আমি শেষ বেলাতে এসে তোমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে আরেকধাপ অপছন্দ করে গেলাম। ভালো থেকো, মৃন্ময়। আর যাকে ভালোবাসবে, তার মন ভেঙো না কখনো। মন ভাঙার যন্ত্রণা মৃত্যুর সমান। জানো?”
মৃন্ময় কথা বলল না। তার মনে হলো পৃথিবী ঘুরছে। এবং সেই ঘুরন্ত পৃথিবীতে চাঁদনী নামক একটি মেয়ে তার থেকে চিরজীবনের মতন দূরে চলে যাচ্ছে।
#চলবে….
#প্রেমোত্তাপ
পর্ব: ২৯ এর বর্ধিতাংশ
কলমে: মম সাহা
নিকোষ আঁধার কালো রাত্রি শোক নামিয়েছে ধরায়। অথচ এই শোককে সুখ করতে ব্যস্ত সওদাগর বাড়ির ছটফটে প্রাণ গুলো। হয়তো তারাও চাচ্ছে তাদের এই বিস্তর বিচ্ছেদের শেষ স্মৃতিটা আনন্দঘন হোক! ড্রয়িংরুমে বসেছে সকলের আড্ডা। যদিও ভেতর ভেতর সকলে ঝিমিয়ে গিয়েছে কঠিন দুঃখে কিন্তু উপর-উপর সকলে এমন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে যেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এমন কেউ বাদ নেই যে এই সওদাগর বাড়ির ড্রয়িং রুমে উপস্থিত নেই। দাদী হতে শুরু করে ছোট্টো চেরিসহ উপস্থিত। দু-চোখ ভোরে সকলেই যেন দেখে নিচ্ছে এই শেষ একত্রিত হওয়ার আনন্দ। এরপর আর কে, কবে একত্রিত হবে কেউ জানেনা। গান হলো, আড্ডা হলো, খাওয়া-দাওয়া হলো ভরপেট। কেউ আহ্লাদে আটখানা হলো, কেউবা সুখের স্মৃতি নিয়ে ঘুমাতে গেল। আজ চিত্রা, চাঁদনী, অহি এই তিনজন একসাথে ঘুমুতে গেল। হয়তো শেষবারের মতন! আর কখনো যদি বালিশ ভাগাভাগি করে ঘুমানো নাহয়!
তিন বোন হাত-মুখ ধুয়ে বসলো বিছানা জুড়ে। সবার ঠোঁটেই কিছুটা কৃত্রিম, কিছুটা অকৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। চাঁদনী তার ছোটো দুই বোনের দিক তাকাল। বিরাট এক শ্বাস ফেলে বলল,
“তোদের ছেড়ে কতটা দূরে চলে যাচ্ছি! আবার কবে আনন্দ ভাগাভাগি করব বল?”
“সবসময় তো আনন্দ ভাগই করলাম আপাই, আজ কী একটু দুঃখ ভাগ করবো? আমার না ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে বুকে। আজ একটু ভাগ করে নিবে দুঃখ? আমি না আর এই ভার বহন করতে পারছি না।”
অহির অপ্রত্যাশিত করুণ আবদারে শিরা উপশিরা কেঁপে উঠল চাঁদনী ও চিত্রার। এই অহি তাদের অপরিচিত। এত ভীষণ অপরিচিত কখনোই লাগেনি তাকে। এই অসহায় অহিকে দেখে ভাষাহারা দু’জন। অহি কাঁদছে। শব্দহীন কান্না। চোখের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে কত সহস্র অশ্রুবিন্দুরা। চাঁদনী, চিত্রা দু’জনই উঠে এলো। জড়িয়ে ধরল বোনকে। যেন ভরসা দিল, তারা আছে। অহিও বিনা সংকোচে মুখ লুকালো বোনদের ভরসাস্থলে। চাঁদনী বরাবরই বুঝদার। তাই সে মুহূর্তেই বুজে ফেলেছে অহির সাথে নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে, নাহয় এমন চাপা স্বভাবের মেয়ে এভাবে তার ব্যাথা প্রকাশ করতো না। অহির শরীর কাঁপছে ক্ষণে ক্ষণে কান্নার দাপটে। তার পিঠ ছুঁয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে চিত্রা। বেশ অনেকক্ষণ, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। কান্নার দাপট কমে এলো অহির। স্তম্ভিত ফিরে পেল সে। তৎক্ষনাৎ সে চাঁদনীর বুক থেকে মাথা তুলল। নিজেকে যথেষ্ট গুছিয়ে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“কিছু হয়নি আপাই, তুমি চলে যাবে তো তাই কষ্ট হচ্ছিল। তোমাকে ভীষণ মিস করব।”
“কথা ঘুরাচ্ছিস?”
চাঁদনীর কোমল প্রশ্নে তপ্ত শ্বাস ফেলল অহি। বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। কিন্ত চাঁদনী নাছোড়বান্দা। আগের ন্যায় অটল নিজের জায়গায়। চিত্রাও এবার মুখ খুলল, ভাবুক স্বরে বলল,
“কী হয়েছে ছোটো আপা? বলো আমাদের।”
অহি নিজেকে সংযত করতে চাইলেও বোনদের আহ্লাদে আর গুছিয়ে উঠতে পারল না। সে এমন নরম, কোমল কখনোই ছিল না। সে বরাবরই শক্ত ধরণের মেয়ে ছিল। হবে নাই-বা কেন? যে শিশুটির ছোটো বেলা কেটে যায় তাচ্ছিল্যে তার শক্ত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। মা পালিয়ে গেছে বাক্যটা নিয়ে সবাই যখন হাসি-তামাশা করত তখন মেয়েটার বয়স কতই বা ছিল? সমাজ এমন বিশ্রী ভাবে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছিল যে মনে হয়েছিল তার মায়ের পালিয়ে যাওয়ার দায়ভার সব তার। এরপর থেকেই ছোটো প্রানটা গুটিয়ে নিল নিজেকে। যদিও মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেওয়া অবনী বেগম তাকে আগলে নিয়েছিল কিন্তু ঐ যে একবার পাথর হওয়ার পর আর কোনোকিছুই ছুঁতে পারল না তাকে। তারপর সেই ছোটোবেলার পর আজ বোধহয় তাকে এমন ভাঙতে দেখা গেল। অহির দুঃখের পাল্লা ভারি হয়। ভেঙে আসা কণ্ঠে বলে,
“আমি নিজে মা ছাড়া থেকেছি, আমি জানি মা ছাড়া থাকার যন্ত্রণা কেমন। সমাজ কতটা ভয়ঙ্কর হয়! অথচ আমিই কি-না আরেকটা বাচ্চার মা ছাড়া থাকার কারণ হতে যাচ্ছিলাম, আপাই!”
অহির হেয়ালি কথায় ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হলো বাকি দু’জনের। চিত্রা বলল,
“এই ছোটো আপা, কী বলছো?”
চাঁদনী বলল, “পাগল হলি?”
অহি দু’হাতের আঁজলে মুখ ঢেকে কাঁদে। অস্ফুটস্বরে বলে, “আপাই, আমার নিজেকে অনেক ছোটো লাগছে জানো? এত ঘৃণা লাগছে নিজের প্রতি!”
চাঁদনী আর চিত্রা ঘাটায় না অহিকে। অহি নিজেই অস্ফুটস্বরে বলতে থাকে,
“হুমুর কথা মনে আছে? রেস্টুরেন্টে আমি আর চিত্রা যে আইসক্রিম নিয়ে ঝামেলা করলাম লোকটার সাথে? মনে আছে?”
চিত্রা ও চাঁদনী দু’জনেই মাথা নাড়ায়। অহি দৃষ্টি রাখে জানালার বাহিরে। হতাশ কণ্ঠে বলে,
“হুমুর পাপার নাম নওশাদ। বেশ ভদ্রলোক। রেস্টুরেন্টের পরেও আমার তাদের সাথে দেখা হয়েছিল অনেকবার। যোগাযোগও গাঢ় হয়। হুমু বাচ্চাটাকে দেখলে না কেমন নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যেত। তাই বোধহয় আমি ওর প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলাম। কিন্তু আমার উচিত হয়নি, আপাই। আমার মোটেও ঝুঁকে পড়া উচিত হয়নি।”
“হয়েছে কি সেটা তো বলবি। তুই কী নওশাদকে পছন্দ করিস?”
চাঁদনীর স্বচ্ছ প্রশ্নে অহি ঘাড় ঘুরিয়ে থাকায়। তার চোখ আবারও অশ্রুতে টলমল করে। চোখ দেখেই বুঝা যায় তার ভেতরটা অমোঘ যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে। চাঁদনীর মায়া হয়। এই যন্ত্রণার ভাষা যে তার বড়ো পরিচিত! সে অহিকে দুহাতে আবারও আগলে ধরে। আদুরে কণ্ঠে বলে,
“তুই ওকে পছন্দ করিস?”
অহি সময় নেয়। ভারী কণ্ঠে বলে,
“আপাই, নওশাদ বিবাহিত। এবং হুমু’র মায়ের সঙ্গে তার বৈবাহিক অবস্থা নাকি বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু আমি তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে নাকি তাদের সংসারটা নষ্ট করে দিয়েছি। বিশ্বাস করো আপাই আমি ভাবতাম নওশাদ হুমুর চাচা হবেন। হুমুর বাবা কখনো হুমুর মায়ের কথা বলেইনি। আমি ভাবতাম হুমুকে এত আদর করে বলে হয়তো সে তার চাচাকে পাপা ডাকে। আমার উচিত হয়নি আপা ভালো করে না জেনে একটা মানুষের সাথে মিশে যাওয়া। সেদিনের আমার জন্মদাত্রীর সাথে আজকের আমার কোনো তফাত রইল না। আমরা দু’জনই একটা বাচ্চার শৈশব নষ্ট করার খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু তুমি তো জানো আপা, আমি এমন খারাপ না। আমি হুমুকে এই যন্ত্রণার মাঝে যেতে দিতে পারিনা। তাই আমি আমার সে-ই মায়ের কাছে চলে যাব যার কাছে আমার কখনো মূল্য ছিল না। আমি চলে গেলেই সবদিক থেকে মঙ্গল। সবদিক থেকে।”
কথাটা বলেই ছুটে চলে গেলো অহি। তার চোখের সামনে ভাসছে পরশুদিনের সেই কঠিন দৃশ্যটুকু। যখন হুমুর মা তার সামনে হাত জোর করে কাঁদছিল, তার সংসার ভিক্ষে চাচ্ছিল! অহির নিজেকে তখন এত বেশি পরিমাণ ছোটো লেগেছিল! শেষমেশ সে কিনা একটা নারীর সংসারের কাল হয়ে দাঁড়াল! এই শহরে থাকলে নওশাদ হয়তো তাকে দেখবে এবং সংসার ভাঙতে চাইবে এরচেয়ে চলে যাওয়াই ভালো তার। সে দূরে চলে গেলে নিশ্চয় নওশাদ থেমে যাবে। অহির বুকের ভেতরটা কেমন ফেঁটে যাচ্ছে। শেষমেশ এত বুদ্ধিমতী মেয়েটাও মানুষ চিনতে ভুল করল! এমন ভাবে ঠকলো!
চিত্রা ও চাঁদনী হতভম্ব। চাঁদনী তো প্রায় বসেই পড়ল বিছানাতে। চারদিকে ভাঙনের সুর গুলো কেমন করুণ স্বরে বেজে উঠল। তার ভেতর একটা প্রশ্নই কেবল প্রতিধ্বনিত হলো, কেন আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি! কেন আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের পাইনা?
উত্তর মেলে না প্রশ্নের। তবে চাঁদনীর চোখে জ্বলজ্বল করে আজ সন্ধ্যা বেলার স্মৃতি। মৃন্ময় তার পা জড়িয়ে কেমন বাচ্চাদের মত কেঁদেছিল! কেমন আকুতি-মিনতি করছিল থেকে যাওয়ার জন্য! অথচ চাঁদনী থাকল না! এই যে, মৃন্ময়ও তো ভুল মানুষকে ভালোবাসলো, যেমন করে চাঁদনী, অহি, আমজাদ সওদাগর কিংবা অবনী বেগম ভালোবেসেছে। ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি যে নিরেট যন্ত্রণা। ভেতরটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে অথচ দেখার কেউ থাকবে না!
#চলবে…..