প্রেমোত্তাপ পর্ব-২৬+২৭

0
611

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৬.

বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে অনবরত। কতগুলো ব্যাকুল প্রাণ পথ চেয়ে বসে আছে, এই বুঝি বাড়ির অবুঝ, বেখেয়ালি মেয়েটা ফিরবে। বোনের প্রাণও আকুল হয়ে অবশেষে গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ছাউনির নিচে দাঁড়িয়েছে তবুও এই দানবীয় বৃষ্টির ছাঁট তাকে আংশিক ভিজিয়ে জুবুথুবু করে দিতে সক্ষম। চাঁদনীর শরীর কাঁপছে মৃদুমন্দ বাতাসে। তবুও তার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা। যেন পণ করেছে, বোনকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। চাঁদনীর ছাউনির নিচেই এলাকার একটি পরিবারের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন মহিলা, একটি মেয়ে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আছে। চাঁদনীকে দেখেই তাদের ফিসফিসানি শুরু হয়েছে যা এখনো থামা-থামির নাম নেই। চাঁদনী বুজছে, এখানের আলোচনার বিষয়বস্তু সে, তবুও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বলুক, যার যা ইচ্ছে।

এর মাঝেই কোথা থেকে যেন মৃন্ময়কে ছুটে আসতে দেখা গেল। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো সে চাঁদনীর দিকে। কাছে এসেই হড়বড়িয়ে বলল,
“পেয়েছেন চিত্রাকে?”

চাঁদনী অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে তাকাল। মহিলা গুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। একজন তো মুখ ফসকেই বলে ফেলল,
“ছোটো মেয়েটাকেও বুঝি পাওয়া যাচ্ছে না? বাপরে! সওদাগর বাড়ির মেয়েদের তো ভালোই গুণ আছে!”

চাঁদনী যে ভয়টা পেয়েছে সেটাই হলো। তার নামে মানুষ যা ইচ্ছে তা বলুক তার কিছু আসে যায় না কিন্তু তার বোনের নামে কেউ কিছু বললেই তার সহ্য হয় না যে! মৃন্ময় মহিলার কথায় ভ্রু কুঁচকালো,
“একটা মেয়েরে পাওয়া যাচ্ছে না, আর আপনি গুণ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন! গুণ হিসেব করলে কত মানুষের গুণই বের হবে!”

মহিলাও কম না। মৃন্ময়ের কথার ইঙ্গিত বুঝে আক্রোশের স্বরে বলল,
“কিন্তু যত মানুষের যত গুণই বের হোক, সওদাগর বাড়ির মেয়েদের কেউ পিছে ফেলতে পারবে না। কেন? তুমি কী গুণের খবর রাখোনি? পুরো দুনিয়ার মানুষই তো জানে।”

“না, আন্টি, আমার তো খাওয়া দাওয়ার পরেও অনেক কাজ থাকে তাই কার কি গুণ তা আর খোঁজ করার সময় পাই না। আর অন্যদিকে আপনাদের খাওয়া দাওয়ার পর সময় কাটে অলস তাই আপনারা গসিপ করার জন্য টপিক খুঁজে বেড়ান। এটাও আপনাদের কাজ, আমি সে কাজকে অসম্মান করছি না। যার যেমন যোগ্যতা, সে তো তেমন কাজই করবে তাই না!”

চাঁদনীর মুখের অদৃশ্য হাসিটা এখন দৃশ্যমান হয়েছে। খুব নিরবে তা ছড়িয়ে গিয়েছে পুরো মুখ জুড়ে। তন্মধ্যেই অদম্য বৃষ্টির ছাঁট ভেদ করে দু’জন মানব-মানবীকে আসতে দেখা যাচ্ছে। লম্বা, ছিমছাম গোছের ঝাঁকড়া চুল বিশিষ্ট মানুষটি যে বাহার ভাই তা আর বোধগম্য হতে বাকি নেই চাঁদনীর। তবে বাহার ভাইয়ের পিছরের গুটিশুটি মেরে ছোটো-ছোটো পায়ে এগিয়ে আসা মেয়েটিকে চাঁদনী গাঢ় দৃষ্টিতে দেখল। যখন দেখল মেয়েটি আর কেউ না, তাদের আহ্লাদী চিত্রা, ঠিক সেই মুহূর্তেই চাঁদনী ছাউনি থেকে বেরিয়ে গেল। তার যেন আর তর সইছে না বোনকে ছুঁয়ে দিতে চাওয়ার ইচ্ছে। চাঁদনী ছাউনি ছেড়ে বেরুতেই মৃন্ময় ছাতা মেলে ধরল চাঁদনীর উপর। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“ভিজে যাবেন তো, ইন্দুবালা।”

“একটা কথা শুনেছ, মৃন্ময়? ‘যার বৃষ্টি পছন্দ, তার ছাতা হইও না’। শুনেছিলে? আমার ছাতার প্রয়োজন নেই মৃন্ময়। এ জীবনে যারাই ছাতা হয়েছে, তাদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে আমরা। তারপর যখন তুমুল বৃষ্টি হয়, তখন সেই ছাতারা আমাদের মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে যায়। আমরা তখন হয়ে যাই একা, নিঃসঙ্গ। একসময় যেহেতু একা হতেই হবে, তবে আজই বা কেন সঙ্গীর বিলাসিতা করব বলো?”

চাঁদনীর কথায় বিস্মিত মৃন্ময় শুধাল, “আপনি রেগে আছেন আমার উপর, ইন্দুবালা?”

“মৃন্ময়, তুমি ছোটো এখনো অনেক। ছেলেমানুষী ভরা। তাই তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। কিন্তু একটা কথা বলি শোনো— যেই কুকুরকে তুমি ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে আনো, সে-ই কুকুরকে আর সবাই লা থি দিলেও তোমার কিন্তু লা থি দেওয়ার অধিকার নেই। তুমি হয়তো সেই প্রাণীটার বুকে, পেটে, কিংবা শরীরের একটা বাহ্যিক অংশে লাথি দিবে, অথচ সেই লাথিটা গিয়ে লাগবে প্রাণীটির বিশ্বাসে, ভরসায়, অন্তরে। তখন সে চাইলেও আর মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবে না। আর সব ভেঙো, বিশ্বাস ভেঙো না। কেমন?”

চাঁদনীর কথায় কেমন যে বিমূঢ় দেখাল মৃন্ময়কে। সে যে আর কিছু বলার ভাষা পেল না। আবার হয়তো পেল কিন্তু বলার সাহস হলো না। কিন্তু চাঁদনী বলল,
“আজ সোমবার। আর তিনদিন পর শুক্রবার। সেদিন সকালে আমার সাথে একটু দেখা করো। তোমাকে কিছু বলার আছে।”

মৃন্ময় প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হলো বাহার-চিত্রা। বাহার ভাইয়ের মুখ বরাবরের মতন গম্ভীর, দৃঢ়। শীতে কাঁপছে চিত্রা। চাঁদনী ছুটে গেল, আগলে ধরল বোনকে। শাসনের স্বরে বলল,
“দু’দিন পর পর যে এমন নিরুদ্দেশ হচ্ছিস, কাহিনী কী তোর? কী চাচ্ছিস? সবাই টেনশনে মরে যাক? এত ছন্নছাড়া কবে হলি? কিছুই পরোয়া করছিস না যেন আজকাল!”

চিত্রা নিশ্চুপ, স্তব্ধ। বাহার ভাই যে তাকে বিয়ে করবে রাজি হয়েছে, সে সেটা তখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না। উত্তর দিল বাহার ভাই,
“বড়োলোকের মেয়েদের ঐ একটু মতিভ্রম হবেই, চাঁদ। তাছাড়া তোমাদের নুরুল সওদাগর যেভাবে সবাইকে নাচান, তাকেও নাচানোর জন্য তো কাউকে প্রয়োজন। তাই আর কেউ না, তার নিজের সন্তানই সেই দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে।”

বাহারের গা-ছাড়া কণ্ঠে ড্যাবড্যাব করে তাকাল চিত্রা। চাঁদনী আলগা হাসল। শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল বোনকে। চুপ রইল মৃন্ময়। যেন জমে গিয়েছে সে! বোনের সাথে আলাপ-আলোচনার পর্ব শেষ হতেই তারা যখন পা বাড়াল বাড়ির দিকে, ঠিক তখন ছাউনির নিচ থেকে সেই আগের মহিলা ঠাট্টা করে বলল,
“সওদাগর বাড়ির এই গল্প তো সিনেমাকেও হার মানাবে। কী রঙ-তামাশা এদের!”

“তবুও তো সওদাগর বাড়ির মেয়েদের বউ করার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন বাড়ির বাহিরে। আপনাদের দেখলে তো বেহায়াও লজ্জায় দেশ ছাড়বে।”

বাহার ভাইয়ের এক কথা যেন তীরের বেগে সব সমালোচনার নামতা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। মহিলাটা গোলগোল আঁখিদুটি নিয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রাদের দিকে অনেকক্ষণ। ঠিক যতক্ষণ বাহার ভাইয়ের দৃঢ় ছায়াটি দেখা যাচ্ছিল সোডিয়ামের আলোয়, ততক্ষণ।

_

বৃষ্টিতে ভিজছে কদম, ভিজছে জুঁইয়ের আঙ্গিনা। সওদাগর বাড়ির সামনে ভিজছে প্রায় পরিবারের সকলে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মধ্যমনি চিত্রা। আজকে চিত্রার গালে সজোরে চড়টা তার বাবা বসায়নি, বসিয়েছেন তার মা মুনিয়া বেগম। মায়ের কপালের রগ গুলো কেমন নীল হয়ে ফুলে আছে। মুনিয়া বেগম সচারাচর রাগেন না, কিন্তু যখন রাগেন তখন আর তার হুঁশ থাকে না। যেমন আজ করলেন।

চিত্রা চড় খেয়ে মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মায়ের জায়গায় বাবা হলে বোধকরি তার এত করুণ দৃষ্টি হতো না, আর তার অনুভূতিও এত বিস্মিত হতো না।

“তুমি বাড়িতে আসবে না। যেহেতু এত রাত অব্দি বাহিরে থাকতে পেরেছো, তার মানে তোমার বাহিরে থাকার জায়গা অবশ্যই আছে। এত মানুষকে না জ্বালিয়ে তুমি বরং বাহিরেই থেকে যাও আজীবন। যাও।”

বাহার, নোঙর, বনফুলও দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সদর দরজা জুড়ে। চিত্রা মাথা করে রাখল। মুনিয়া বেগম যখন আরেকটু রেগে এগিয়ে আসলো, তাকে থামালো তুহিন। আগলে দাঁড়াল বোনকে। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“মা, ও বড়ো হয়েছে। কি করছো! আশেপাশের মানুষ খারাপ বলবে।”

“খারাপ বলার আর কি বাকি রেখেছে মানুষ? বাড়ি বয়ে এসে মেয়ের গুণগান করে যায়। আমার কি সৌভাগ্য! এসব গুণগান চুপ করে শুনতে হয়। মানুষকে বলার সুযোগ দিলে তো মানুষ বলবেই। সুযোগ ও তৈরি করেছে। মানুষ তাই খারাপ বলছে।”

মুনিয়া বেগমের কথার পরপরই চিত্রার দাদির কন্ঠ পাওয়া গেল। মহিলা বাড়ির রোয়াক থেকেই চেঁচিয়ে বলছে,
“এখন বকছো কেন? খারাপ যেহেতু তোমরা করেছ, এখন ভুগো। এত না মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকতে, তাহলে আজ শাসন করছ কেন? অনেক হয়েছে, মেয়ের ডানা বেশি বেড়ে গেছে। এবার ছাটতে হবে। নুরু, নুরু……..

মহিলা এবার ডাকলেন নিজের ছেলেকে। কণ্ঠ আগের মতই গগনচুম্বী রেখে বললেন,
“তোর মেয়েকে আর ঘরে রাখা যাবে না। জলদিই বিয়ের ব্যবস্থা কর। পরীক্ষা শেষ হতেই বিদায় করে দিবি। একজন তো সম্মান খেয়েছেই, বাকিটা ও খাওয়ার আগেই বিদায় করে দে। মানুষকে তো পরে মুখ দেখাতে পারব না।”

“এমনেও বা আর কতদিনই মুখ দেখাতে পারবেন, বলেন তো দাদী? দুই পা-ই কবরে চলে গেছে। কবে যেন আপনার প্রাণ পাখিও উড়াল দিবে। এরপর আপনার মুখ কেউ-ই দেখবে না এমনেতেও। তাছাড়া আপনার যেই মুখ, মনেহয় যেন বাংলা ছবির ভিলেন রিনা খান। সেটা দেখলে মানুষের অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায়। এরচেয়ে বরং আপনি মুখ না দেখালে উপকার হবে।”

বাহারের তীক্ষ্ণ ঠাট্টায় জ্বলে উঠল দাদী। আপন বেগে অসন্তোষ স্বরে বলল,
“অসভ্য কোথাকার।”

“কোথাকার অসভ্য জানেন না? এই তো, আপনাদের সভ্য বাড়ির বরাবর বাড়িটার অসভ্য আমি।”

মুহূর্তেই গমগমে পরিবেশের মুখে মিটমিট হাসি ফুটল। সকলেই চাপা হাসি ধরে রাখতে পারলেও ফিক করে হেসে দিল চেরি। তার দেখাদেখি সশব্দে হেসে দিল চিত্রা। পরপরই অহি, চাঁদনীসহ বাড়ির বাকি সদস্যও হাসল। কেবল থমথমে রইল নুরুল সওদাগর আর মুনিয়া বেগম। আফজাল সওদাগর আজ বাড়িতে নেই। স্ত্রীর সাথে স্ত্রীর বাপের বাড়িতে গিয়েছে বিধায় আজ ঘটনা এতদূর অব্দি গেল।

মুনিয়া বেগম মেয়ের দিকে রুষ্ট দৃষ্টি ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। পর পর এক এক করে সবাই-ই ভেতরে গেল। বাহিরে রইল গুটি কয়েকজন। তার মাঝে নুরুল সওদাগরও আছেন। মোটামুটি জায়গা খালি হতেই সে দরাজ গলায় বাহারকে ডাকলেন,
“শোনো, বাহার….”

নুরুল সওদাগরের ডাকে থমকে গেল যেন উপস্থিত সকলের শ্বাস-প্রশ্বাস। নুরুল সওদাগর এ অব্দি বাহার ভাইয়ের কখনো নাম নেননি। তুহিন বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল তার ভেতরের মতিগতি। চাঁদনী আর অহিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অবাক না হওয়া বাহার ভাইও আজ অবাক হলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জবাব দিল,
“জি! আমায় ডাকলেন?”

“তুমি ছাড়া কী এখানে কেউ আছে? নেই। তাই তোমাকেই ডাকলাম। চিত্রাকে তুমি পড়াতে আসছো না কেন? পারিবারিক সমস্যার জের ধরে তোমার একটা স্টুডেন্টের ক্ষতি তুমি করতে পারো না। অন্তত এ ব্যাপারে তোমাকে দায়িত্বশীল ভেবেছিলাম।”

নুরুল সওদাগরের এহেন কথায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সকলে। কিন্তু তা আর বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব হলো না। কথা শেষ করেই নুরুল সওদাগর বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। বাহিরে রেখে গেলেন কতগুলো অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি। বাহার কতক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে দেখল। কি মনে করে যেন হাসলো মনে মনে। অতঃপর তুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমার বোনকে মেডিসিন দিও। মতিভ্রমের বসে না আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসে থাকে। তার তো কোনো খবর থাকেনা৷ তার জন্য কত মানুষের পৃথিবী থমকে থাকে।”

শেষের বাক্যটা ধীরেই বলল যেন। তুহিন হয়তো ঠিক বুঝতেও পারল না। তবে প্রেমিকের মন জানে, তার সকল সুখ অষ্টাদশীতে আবদ্ধ যে!

বিরাট সমস্যার রাতটি গাঢ় হয়ে এসেছে। রাত বেড়েছে নিজস্ব গতিতে সাথে বেড়েছে মুশলধারা বৃষ্টির পরিমাণ। চিত্রার শীতে শরীর কাঁপছে। হুট করে সে অনুভব করল গল গল করে তার নাক দিয়ে কিছু পড়ছে। সে নাক চেপে ধরে তরল পদার্থটার দিকে তাকাতেই ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় চিকচিক করে উঠল তার হাতের লাল টকটকে রক্ত গুলো।

#চলবে…..

#প্রেমোত্তাপ
কলমে: মম সাহা

পর্ব: ২৭

কাক ডাকছে কর্কশ কণ্ঠে। তবে বোধহয় সেই কর্কশ কণ্ঠ তেতো না, কেমন এক বিরহী সুর তার! আজকে অবশ্য আকাশের মন ভালো। চারপাশে শুভ্র শুভ্র মেঘগুচ্ছ ভেসে বেড়াচ্ছে। দিনটি বুধবারের প্রাণোচ্ছল দিন। সূর্য তার গন্তব্যে ফিরে যাওয়া আরম্ভ করেছে সবে। তবুও আজ সন্ধ্যার আকাশ উজ্জ্বল। চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে তার বিরাট বারান্দায়। অদ্ভুত ভাবে কেবল সে না, আজ যেন সবারই কেমন ছুটি! অহিও আজ বইয়ে ডুবে না থেকে জানালার কোল ঘেঁষে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে দূর আকাশে। এমন অনিয়ম সচারাচর চোখে পড়ে না। অহি বইয়ের মাঝে না তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে আকাশ দেখছে এটা বিষ্ময়কর ব্যাপার। চাঁদনী আপা বসে আছে তার বিছানায়। তবে মাথাটা হেলান দেওয়ানো আছে জানালার সাথে। তার চোখ দু’টি বন্ধ। সকলের এই নিস্তব্ধতার জন্য প্রকৃতপক্ষে একজনকেই দায়ী করা যায়। সে হলো- বাহার ভাই। লোকটার গানের কণ্ঠ ভেসে আসছে বহু কাছ থেকে। ছন্নছাড়া লাইন গুলো,
“আমি তোমায় ভালোবাসি,
জগতে হইয়াছি দোষী…….”

গানের লাইনগুলো যেন খু্ব বিশেষ ভাবে প্রতিটি নিখুঁত ভাবে ভালোবাসতে পারা মানুষদের সাথে জড়িত। যারা প্রকৃতপক্ষে ভালোবেসে কেবল প্রতিদানে পেয়েছে কলঙ্ক। লোকে বলেছে ছি ছি! ভালোবেসেছ! যেন মহা পাপ কিছু করে ফেলেছে। অথচ দিনশেষে এমন ছি ছি মাখা মিছে কলঙ্ক কুড়িয়েও যারা ভালোবাসার মানুষদের পায়নি বা পায়না, এই গানের লাইন গুলো যেন তাদের জন্যই দরদী হয়ে কাঁদে। বনফুল অন্যান্য সময় এত মনোযোগ দিয়ে তার ভাইয়ের গান শুনেনা, অথচ আজ শুনছে৷ তার মনে হচ্ছে ভাই যেন তাকেই গাইছে আরও করুণ ভাবে, নিঃস্ব করে! বনফুল নিবিড়ে হেঁটে তার মায়ের রুমের কোণায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে তুহিনের রুম দেখতে পাওয়া যায় খুব সহজ ভাবে। বনফুলের বেহায়া চোখ খুব গোপনে সেই রুমের দিকে চাইল। ফাঁকা রুমেও যেন সে নিজের ভালোবাসার অস্তিত্ব খুঁজে পেল। বুকের ভেতর তুমুল আ ন্দো ল ন। তার অবুঝ মন প্রশ্ন তুলল- আচ্ছা, আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে পাই না কেন? যাদের ছাড়া আমাদের চলেই না, তারা কেন আমাদের ভালোবাসে না? মন তো প্রশ্ন করে নিরব হয়ে যায় কিন্তু অশান্তিতে ভুগে উত্তর না পাওয়া বনফুল। এই কেন-র উত্তর আদৌও মিলবে! সে শূন্য চোখে তুহিনের রুম দেখে নির্নিমেষ। একমাত্র লোকটাকে পাবে বলে ভদ্র বনফুলও ভদ্রতা ভুলে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। কিন্তু কোনো লাভ কী আদৌও হলো! দিনশেষে সমাজের ছি ছি ছাড়া আর কী পেল সে!

বাহারের গান থামতেই পরিবেশ ভয়ঙ্কর রকমের নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। যেন বিষাদের এই বোবা গল্প শান্তি চায়। চিত্রা বারান্দা দিয়ে চাইল। অগোছালো বাহার ভাইয়ের হাতে তখন জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে উর্ধ্বে। চিত্রা ডাকতে গিয়েও ডাকল না তাকে। কেন যেন এই কথা না বলা ক্ষণটি তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যেমন পছন্দ হয়েছিল সেই বছর কয়েক আগে কিশোরী চোখে দেখা প্রথম কোনো ছন্নছাড়া পুরুষকে।

এই মোহগ্রস্ত নিরব সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চাঁদনীর ফোন বেজে উঠলো। ঘোর কাটাল চাঁদনীর। চোখ মেলল সে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা অপরিচিত নাম্বারটির দিকে তাকালো। ফোনটা বাজতে বাজতে প্রায় থামার পূর্ব মুহূর্তে চাঁদনী ফোনটা রিসিভ করল। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পক্ষ থেকে একটি গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চাঁদ বলছো?”

চাঁদনী থমকানো, মনে মনে কিছুটা হোঁচটও খেলো বোধ হয়। কিন্তু খুব দ্রুতই আবার নিজেকে সংযত করে নিল। আধো কণ্ঠে বললো,
“শাহাদাত, তুমি!”
শাহাদাত হাসলো। বলল, “এখনো কণ্ঠ চেনো তবে! ভুলোনি?”

“ভুলে যাওয়ার কথা তো আমি কখনো উচ্চারণ করিনি, তাই চিনি। সেটা তো তুমি করেছিলে। তাই তুমি ভুলে গিয়েছো কারণে অকারণে৷”

শাহাদাত হতাশার একটি শ্বাস ফেললো বোধ হয়। বলল,
“এখনো অভিযোগ, অভিমান পুষে রেখেছো!”

“সেই অধিকার তো তুমি কেড়ে নিয়েছ, রাখব কীভাবে? বাদ দাও সেসব কথা। তা হুট করে কল দিয়েছ কেন?”

“চাঁদ……” ডাক দিয়েই থামল শাহাদাত। কণ্ঠটা কী কাঁপছে লোকটার! মনে হলো যেন সে কান্না গিলে নেওয়ার ছোট্টো চেষ্টাটুকু করল বড়ো গোপনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! চাঁদনী যে মানুষটাকে আগাগোড়া চিনতো একসময়। যার হাসির কণ্ঠ, কান্নার কণ্ঠ, চাঁদনীর মুখস্থ, তার আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা চাঁদনী ধরতে পারবে না? চাঁদনী সময় দিলো মানুষটাকে। শাহাদাত সামলে নিল নিজেকে। কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“চাঁদ, আমি জানি, তুমি কখনো আমাকে অভিশাপ দাওনি। কিন্তু তবুও, তোমার মন ভাঙার মতন পাপের শাস্তি বিধাতা আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে যতটা আমি আঘাত করেছি, তার শাস্তি যে ভোগ করতেই হবে।”

এবার চাঁদনী কিঞ্চিৎ অবাক হলো। বিষ্ময় ধরে রেখেই শুধাল,
“কী হয়েছে, শাহাদাত?”

“আমার স্ত্রী’র তিনমাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে তার। এমনকি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাও।”

চাঁদনী যেন ভুল শুনল। দূর আকাশে তখন হাসল সন্ধ্যার নক্ষত্র। প্রকৃতির খেল বুঝা যে বড়ো দায়!

প্রতিদিনের মতন আজ অভ্যস্ত নিয়মে সন্ধ্যা হলো না। গত কয়েক মাসের গতানুগতিক নিয়ম পাল্টে যেন এই অপরাহ্ন এক বুক হাসি নিয়ে এলো। মন খারাপ উড়িয়ে নিয়ে যাবার এই সন্ধ্যা। চিত্রা যখন নিশ্চুপ চোখে আকাশ দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রাস্তা থেকে সরু কন্ঠে ডাক এলো,
“চিতাবাঘ, নিচে আয়। এলাকার মোড়ে ঝালমুড়ি মামা এসেছে। বোম্বাই মরিচ আছে। দ্রুত আয়।”

চিত্রার গভীর ধ্যানে ভাঁটা পরল। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বনফুল তাকে স্বেচ্ছায় ডাকছে! বনফুল? চিত্রা নিচু করে পথের দিকে চাইল। ভেসে উঠলো বনফুলের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। যেন পুরনো সেই বনফুল যার সরলতায় মুগ্ধ হতো পৃথিবীর সকল উপমা। যেন গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলো মুহূর্তেই চাপা পড়ে গেল বনফুলের নিখুঁত হাসির নিচে। চিত্রাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বনফুল আবার ডাকলো,
“আসবি? না আমি চলে যাব?”

চিত্রা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। কোনমতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘরের বাহিরে। পেছন থেকে বার করে ডাকলেন মুনিয়া বেগম কিন্তু মেয়েটার যেন উত্তর দেওয়ার সময় নেই। কেবল হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“মা, বনফুল ডাকছে আমায়। হাত বাড়িয়ে ডাকছে আমার বন্ধুত্ব। আমায় তুমি পিছু ডেকো না, ম। আমার যে পিছু ডাক শোনার সময় নেই।”

মুনিয়া বেগম প্রথমে ধমকাতে গেলেও বনফুলের নাম শুনে থেমে গেল। আর কেউ না জানলেও মায়ের মন তো জানে, মেয়েটা বড়ো বন্ধু ভক্ত। এই কয়েক মাস তো দেখেছে সে মেয়েটা কেমন গুমড়ে গুমড়ে মরত। আজ যেহেতু বাঁচতে চাচ্ছে তাহলে বাঁচুক না! ক্ষতি কী? পিছন থেকে মায়ের ডাক শুনতে না পেরে মনে মনে হাসলো চিত্রা। তার যে কি ভীষণ আনন্দ হচ্ছে! আজকাল যেন পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে এসেছে। চারপাশে কেমন আনন্দ আর আনন্দ! কিন্তু ভয় হলো এই আনন্দ কতদিন টিকবে!

চিত্রা নিচে নেমে আরও অবাক হলো। কেবল বনফুল না, বাহার ভাইও দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে। যদিও লোকটার চেহারায় তেমন ভাবাবেগ নেই। চিত্রাকে দেখেই বনফুল হেসে এগিয়ে এলো, আবেশে জড়িয়ে ধরল চিত্রার বাহু। উৎফুল্ল বদনে বলল,
“তাড়াতাড়ি চল। ভাইয়া ঝালমুড়ি মামাকে ডেকে এনে দাঁড় করিয়েছে। আয়।”

চিত্রা অবাক চোখে বাহার ভাইয়ের দিকে তাকাতেই মানুষটার অগোছালো হাসি চোখে পড়ল। চোখে ইশারা করে যেন লোকটা বলল,
“আমি আছি।”

চিত্রার অন্তর আত্মা যেন শীতল হয়ে এলো। একজন ‘আমি আছি’ বলা লোকের অভাবে কত মানুষ মারা যায় আফসোস নিয়ে! অথচ চিত্রার আর সেই আফসোস রইল না। ঠিক সেই মুহূর্তে চিত্রার সকল আনন্দকে ভয়ে পরিণত করে আমতে দেখা গেল তুহিন ভাইজানকে। সাথে তার প্রেমিকা নিরু। চিত্রা বীত চোখে বনফুলের হাতটার দিকে তাকাল। যে হাতটা জড়িয়ে আছে চিত্রার বাহু। চিত্রা অপেক্ষা করল, এই বুঝি বাঁধন আবারও ঢিলে হলো!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে