প্রেমোত্তাপ পর্ব-২২+২৩

0
618

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২২।

আকাশে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ জমছে। ফেব্রুয়ারি শুরু না হতেই এমন ঝড়ের তান্ডব দেখে মনুষ্যজাতি বিভ্রান্ত। পাখিরা ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না, দামী দামী গাড়ি করে অফিস যাওয়া কর্মকর্তাদের ভীড়ও নেই পথেঘাটে। কেবল দেখা যাচ্ছে রিকশাচালকদের। ভিজে টইটম্বুর হয়ে থাকা শার্টের সাথে লেগে আছে তাদের ক্ষুধার্থ জীর্ণশীর্ণ দেহখানি। শরীর দেখলেই বোঝা যায়, অভাবের কাছে বৃষ্টির বাহানা নিছকই হাস্যকর। বৃষ্টি হোক কিংবা খড়া, পেটের দায়ে এই মানুষ গুলোকে বেরুতেই হবে বাহিরে। তাদের যে বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ নেই। তাদের পেট যে ক্ষুধার আহাজারি করতে ব্যস্ত।

চিত্রা তার পড়ার টেবিলে বসে পা ঝুলাচ্ছে। বাহার ভাই মনযোগ দিয়ে পড়তে বসতে বলেছে। পড়াশোনা না করলে বাহার ভাই রাগ করবে। সেই রাগের কথা ভেবেই এত তোড়জোড় করে পড়তে বসা। অথচ তার মন পড়ে আছে বাহিরে। আগে যেমন পড়তে বসলে বনফুলকে ডাকতে ডাকতে পাড়া মাথায় তুলতো, আজও সেই পুরোনো কাজটি করতে ইচ্ছে করছে। অথচ আজ মনে এক রাশ অস্বস্তি। কাজটি করলে বনফুল প্রতিত্তর যদি না করে! তাহলে? তাহলে সে তো ভীষণ লজ্জা পাবে। চিত্রার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে তার ঘরে আবির্ভাব ঘটে ছোট্টো চেরির। গুটি গুটি পায়ে সে তার বুবুর কাছে এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি কণ্ঠে বলে,
“বুবু, তুমি পড়া ফাঁকি দিচ্ছ?”

চেরির আধো কণ্ঠে তার ধ্যান কাটে। চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই বাচ্চাটার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ল। সে চেরির গালটা আলগোছে টেনে দিয়ে বলল,
“পড়া ফাঁকি কই দিচ্ছি?”

“এইযে তুমি পড়ার টেবিলে বসে পা দোলাচ্ছ আর কি যেন ভাবছো! অথচ সব করছো কিন্তু পড়ছো না।”

চেরির দুষ্টুমি ভোরা কণ্ঠে চিত্রা চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“ও বাবা! চেরিসোনা কি বুবুকে পাহারা দিচ্ছে? কে বলেছে তাকে এটা করতে, শুনি?”

“কেন, বাহার ভাই।”

চেরির উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকাল চিত্রা। অবাক স্বরে বলল,
“তুমি ওদের সঙ্গে আবার কথা বলতে গিয়েছিলে? তোমাকে না সবাই না করেছিল। ওদের সাথে যেন কথা না বলো।”

“কী করবো আমি, বুবু? বাহার ভাই এত আদর করে ডাকল, আমি রাগ করে থাকতেই পারলাম না। তার উপর সে লুকিয়ে আমার হাতে ইলিশ মাছও খেয়েছিল আমার রাগ ভাঙ্গাতে।”

“কী! কই আমরা তো জানিনা!”

“আরে, সে তো লুকিয়ে এসেছিল। তোমরা জানবে কীভাবে? বনফুল বুবু আমাকে কেমন কঠিন করে বলল— ‘চেরি তুমি যাও। সওদাগর বাড়ির বাতাস এলেই আমরা দরজা বন্ধ করে রাখি আর সেখানে তো ইলিশ মাছ বহু দূরের কথা।’ তারপর ওদের বাড়ির ঐ নোঙ্গর নামের আপুটা দরজা বন্ধ করে দিল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম অথচ ওদের একটুও মায়া হলো না, জানো বুবু?”

চেরির চোখ আবারও স্মৃতিচারণে টইটুম্বুর হয়ে উঠল। চিত্রা বুঝল বাচ্চাটার কষ্ট, তাইতো আদুরে হাতে কাছে টেনে নিল তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল স্নেহের। চেরি মিহি ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আমাদের আগের বোকা বোকা বনফুল বুবু-ই ভালো ছিল, বুবু। এই বনফুল বুবুকে মোটেও ভালো লাগে না।”

বাচ্চাটার এই সরল সোজা স্বীকারোক্তিতে চোখ ভোরে এলো চিত্রারও। এই গম্ভীর পরিবেশ এড়াতেই সে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
“বনফুল বুবু দেখবে এখনই আমাদের সাথে কথা বলবে। চলো, আমরা আগের মতন সন্ধ্যাবেলা যে কবিতা বলে হাঁক ছাড়তাম, আজ সেটা বলি। দেখবে, তোমার বনফুল বুবু ঘরে থাকতেই পারবে না।”

চিত্রার অপরিপক্ক বুদ্ধিটি পছন্দ হলো চেরিরও। সে হাত তালি দিয়ে উঠল খুশিতে। ঘাড় কাত করে সায় দিল। তারপর দুটো চঞ্চল প্রাণই ছুটে গেল বারান্দায়। বুকে অদম্য সাহস এবং আশা নিয়ে দু’জন আওড়াল বহু পুরোনো সেই ছড়াটি,

“ভুল, ভুল, ভুল জীবনের সবটুকুই ভুল,
তার মাঝে ঠিক, কেবল তুই বনফুল।”

বার কয়েক কবিতাটি আওড়াল। আগে যখন চিত্রা সন্ধ্যাবেলা এই কবিতা বলে হাঁক পারতো, বনফুল দ্রুত লজ্জা মুখে উপস্থিত হতো। লাজুক স্বরে “যাহ্ বাদর” বলতো। অথচ আজ! আজ বার তিনেক ডেকেও সাড়া পেল না। ভেঙে গেল চঞ্চল প্রাণের তুমুল আশা। বুকভার করে উঠলো দু’জনের। তবে চিত্রার ক্ষতটা হলো একটু বেশিই গাঢ়। বন্ধুত্বের অকাল মৃত্যুতে সে চরমভাবে শোকাহত হলো। ভেঙে পড়ল বাজে ভাবে। শেষে আশার বিন্দুও নিঃশেষ হয়ে গেলো। ছোট্টো চেরি হয়তে বড়ো বোনের এই ভেতর ভেঙেচুরে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝল। ছোটে হাতে জড়িয়ে ধরল বোনের হাতটি। স্বান্তনার স্বরে বলল,
“তুমি মন খারাপ করো না, বুবু। বনফুল বুবুই হয়তো ঘুমুচ্ছে। জেগে থাকলে ঠিক উত্তর দিত।”

ছোটো বোনের কোমল স্বরে যেন চিত্রার ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। হাঁটু মুড়ে বসে জড়িয়ে ধরল বোনকেই। আমরা যখন ভীষণ ক্ষত পাই বুকের গভীরে, তখন এমন করেই আমরা মানুষকে আগলে ধরে একটু শান্তি চাই। চেরিও মন খারাপ করে বোনকে জড়িয়ে রাখল। ঠিক এর মাঝেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল। পাশের বিল্ডিং থেকে বহু পরিচিত সেই কণ্ঠ ভেসে এলো,
“যাহ্, বাঁদর।”

যা হওয়ার কথা ছিল না তা আকস্মিক ঘটে যাওয়ায় চেরি আর চিত্রার সহসাই বোধগম্য হলো না সেটা। কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরনে যখন ছড়িয়ে গেলো সেই ধ্বনি তখন তারা বুঝল আজ অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে গেছে। বন্ধুর গুটিয়ে নেওয়া হাত আবার মেলে ধরেছে। আহ্বানে সাড়া দিয়েছে বন্ধু। চিত্রা, চেরি দু’জনই বিস্ফোরিত নয়নে সামনের দোতালা বিল্ডিংটির দিকে চাইল। বনফুল দাঁড়িয়ে আছে। করুণ হাসি ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে। কেমন আধভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
“চলে যাচ্ছিলি নাকি? আর ধৈর্য নেই অপেক্ষার?”

চিত্রা কথা বলতে চাইল কিন্তু অতি আনন্দ যেন তার গলা চেপে বসে আছে, যার জন্য কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছিল না। কেবল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল নোনা অশ্রুর বিন্দু গুলো। চেরি বোনকে উৎসাহ দিল,
“বুবু, তাড়াতাড়ি কথা বলো। পরে যদি বনফুল বুবুই চলে যায় রাগ করে? কথা বলো তাড়াতাড়ি।”

চেরির চোখেও অশ্রু টলমল করছে। চিত্রা তখনই কেঁদে দিল খুব অসহায়ের মতন। অভিযোগ করে বলল,
“আমি ভালো নেই, বনফুল। তুই ক্যান আমারে দূরত্ব দিয়েছিস? আমার কষ্ট হয় ভীষণ।”

বনফুল উত্তরে কিছু বলতে নিয়েও কেন যেন চুপ করে গেল। তার করুণ হাসি মিলিয়ে গেল কিসের এক গম্ভীরতায়! কর্কশ কণ্ঠে কেবল বলল,
“ভালো নেই কে বলেছে? আজকাল তোদের অনেক মানুষ হয়েছে!”

বনফুলের কঠিন কণ্ঠের তোপে ফিকে হয়ে এলো চিত্রা ও চেরির আনন্দ। হুট করে কি হলো মেয়েটার? এই তো ভালো ছিল! চিত্রা অবাক চোখে তার পাশের বারান্দায় তাকাতেই থমকে গেল। নিরু নামের মেয়েটি তুহিন ভাইজানের বারান্দা পরিষ্কার করছে। হয়তো বনফুল এটা দেখেই রেগে গেছে। চিত্রা আগ বাড়িয়ে কিছু বলার আগেই হনহন করে স্থান ত্যাগ করল বনফুল। চিত্রা কেবল অসহায় চোখে দেখল সেটা। তুহিন ভাইজান ও নিরুর উপর তার রাগের পাল্লা আরেকটু বাড়ল। সে দিক-বিদিক শুন্য হয়ে নিজের বারান্দার ফুলের টবটি ছুঁড়ে মারল সেখানে। তুমুল শব্দে টবটি ভেঙেচুরে গেল। এই ভয়ানক শব্দ শুনে চমকে উঠল নিরু। ঘর থেকে ছুটে এলো তুহিন ভাইজান। সেকেন্ডের মাথায় পরিবারের সকলে ভীড় করল তুহিনের বারান্দায়। নিরু নিষ্পলক তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। ডান পায়ে তার খানিক চোটও লেগেছে। তুহিন বিস্মিত ভঙ্গিতে চারপাশে চাইল। বোনের রুদ্রমূর্তির দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি স্থির হলো। অবনী বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন,
“কীভাবে ভাঙল এটা! নিরু? ব্যাথা পাওনি তো, মা?”

মেয়েটার চোখ-মুখ কোমল হয়ে এলো। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“না আন্টি, ব্যাথা পাইনি। টবটা একপাশে রাখতে গিয়ে পড়ে গেছে।”

“এটা তো চিত্রার ফুলের টব। তুহিনের বারান্দায় কী করে এলো?”

প্রশ্নটি করে থামল মুনিয়া বেগম। পাশ ফিরে লাগোয়া বারান্দায় চিত্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে বললেন,
“চিত্রা, চেরি কী করছিস? এখানে আয়।”

চিত্রার শক্ত মুখের আদল ততক্ষণে বদলে অনুশোচনায় পরিণত হয়েছে। রাগের বশে সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে মেয়েটাকে আঘাত করেছে ঠিকই কিন্তু মেয়েটা কেমন তাকে বাঁচিয়ে দিল! অনুশোচনায় মাথা নত করে চিত্রা রুমে চলে গেল। শক্ত হাতে খিল দিল দরজায়। চেরিকেও বের করে দিল ঘর থেকে। তার আর বনফুলের মাঝে আজকে কোনো তফাত নেই। তারা নিজেদের ভালোবাসাকে এত বাড়াবাড়ি রকমের প্রাধান্য দিয়ে আশেপাশের সকল কিছুকে তুচ্ছ করে ফেলেছে। চিত্রার লজ্জায় মাথা নত হলো। আজ সে বড়ো বোকামি করে ফেলেছে। ভালোবাসা কি অন্ধ হতে শেখায়?

_

মধ্যরাতে তারা বিহীন আকাশের চাঁদ দেখতে মগ্ন চিত্রা। হুট করে খেয়াল করল বনফুল তার বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। চালচলনে তার গোপনীয়তা। চিত্রারও সন্দিহান মস্তিষ্ক তার পিছু নিতে বলল। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। এই মধ্যরাতে নির্ভয়ে সে বন্ধুর পিছু ছুটলে। তোয়াক্কা করল না নিজের বিপদের কথা।

#চলবে…

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৩.

রাতের রাস্তা বিদায় হওয়া শীতের কিঞ্চিৎ ঘন কুয়াশা আঁকড়ে ধরে কেমন শুনশান হয়ে আছে! ব্যস্ত শহরের বুক এখন একাকীত্ব জাপ্টে ধরে হাপিত্যেশ করছে। সেই একা শহরের সঙ্গী হলো কিছু সোডিয়ামের আলো। যারা অক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্নিমেষ। সেই শুনশান রাস্তায় খুব দ্রুত পদচারণ করছে বনফুল। তার পেছনেই তাল মিলিয়ে হাঁটছে চিত্রা। সাবধানী পায়ে মেয়েটাকে লক্ষ্য রাখছে। বার বার মন কু ডাকছে। কোন কারণে বনফুল এত রাতে বেরিয়েছে তা খুঁজে পেল না চিত্রা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা পথ এগিয়ে গেল তারা। এলাকা ছেড়ে অনেকটা দূর। ঠান্ডায় চিত্রার গা কেঁপে উঠছো বারংবার। ভেঙে যাওয়া হাতটাও ব্যাথা করছে অতিরিক্ত নড়াচড়ায়। গলা থেকে শুরু করে কান অব্দি তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো অতিরিক্ত ঠান্ডায় টনসিল বেড়ে যাচ্ছে। কিছুটা অসাবধান হতেই সে পথ হারিয়ে ফেলল। কোন রাস্তায় বনফুল গিয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সামনে তিনটি বড়ো রাস্তা ও একটি ছোটো গলি গিয়েছে। বনফুল ঠিক কোন রাস্তায় চলে গেল মুহূর্তের মাঝে চিত্রা ধরতে পারল না। সেকেন্ড খানিক অবচেতন হতেই এমন একটা কাজ হয়ে গেলো। আফসোসে আফসোসে শির-উপশিরায় বিরক্ত ছড়িয়ে পড়ল। তবুও চিত্রা ব্যস্ত হলো। ছুটে গিয়ে ভালো করে প্রতিটা রাস্তা দেখল কিন্তু কোথাও বনফুলের টিকি টুকু খুজে পেল না। একটা ভোঁতা রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পথের ছোটো পাথরের টুকরোতে সশব্দে এক লাথিও মারল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল পথের কোণায়। ঠিক কতক্ষণ বসে রইল সেটা সঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে পা ঝিম মেরে আসতেই উঠে দাঁড়াল। রাত তখন প্রায় নিঃশেষের দিকে। ভোর হতে চলল। মনের মাঝে তীব্র ভয়, বনফুলের কিছু হয়ে যায়নি তো! সেই ভয়টুকু নিয়েই সে বাড়ির পথে রওনা হলো। খুব বেশি বোকামি করে ফেলেছে সে, বনফুলের পেছন পেছন না এসে তাদের বাড়ির লোকদের আগে খবর দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েটার যদি কোনো বিপদ হয়! আরও অকল্যান ভাবনায় চিত্রার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। সে দ্রুতই ছুট লাগাল বাড়ির দিকে।

রাতের আকাশ তখন কুচকুচে আঁধার কাটিয়ে উঠতে শুরু করল। যেমন করে একটি জীবন ভয়ঙ্কর দুঃখ কাটিয়ে উঠে, ঠিক তেমন করে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভাবটি আর আকাশে নেই। হিমেল বাতাসের তীব্রতাও কিছুটা বেড়েছে। বাড়ির সামনে এসেই চিত্রা থমকে গেল। বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে। পাওয়া যাচ্ছে বনফুলের মিহি চেঁচামেচির শব্দও। থমকে গেল চিত্রা। যে মেয়েটার আশায় সে পথের ধারে বসে রইল সে মেয়েটা বাড়িতেই! এটা কীভাবে সম্ভব? নিজের প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর পেল না সে। দিকভ্রান্ত হয়ে বাহার ভাইদের দরজার কাছে এসেই থেমে গেল সে। সংশয়ে আর দরজায় টোকা দেওয়া হলো না। অজানা প্রশ্ন গুলো অজানা রেখেই চিত্রা থেমে গেল। সামলে নিল নিজেকে। এমন সময় কারো বাড়ির ব্যাক্তি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তবুও সে কাল একবার বাহার ভাই ও আন্টিকে সব জানাবে।

_

সকাল হতেই সওদাগর বাড়িতে তুমুল হৈ-চৈ। টেবিলে বসে এক মনে পড়ছিল অহি। অবশেষে সেই হৈ-হল্লাতে অতিষ্ঠ হয়ে সে উঠে গেলো বাহিরে।

ড্রয়িং রুম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির প্রতিটি সদস্য। অবনী বেগমের গালে চড়ের চিহ্ন। চেরি রুমের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে জুবুথুবু বাচ্চাটি। অহি অবাক হলো। যদিও আগে বাড়ির কোনো চিৎকার চেঁচামেচিতে তাকে পাওয়া যেত না কিন্তু আজ সেই প্রচলিত প্রথা মিথ্যে করে দিয়ে সে কথা বলে উঠল৷ তাজ্জব কণ্ঠে বলল,
“কি করছেন?”

আমজাদ সওদাগর মেয়ের পানে চাইলেন। রুক্ষ চোখ জোড়া তার শিথিল হয়ে এলো প্রায়। একবার অবনী বেগম আরেকবার অহির পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
“কিছু না। তুমি ঘরে যাও।”

“কিছু না হলে নিশ্চয় এতো চেঁচামেচি হতো না। তাই বলুন কী করছেন! আপনি বাড়ি ভর্তি মানুষদের সামনে উনার গায়ে হাত তুলছেন? যেখানে আপনার ছয় বর্ষীয়া মেয়েটিও অবস্থানরত আছে। আপনি এমন বিবেকহীন হয়ে গেলেন কীভাবে?”

মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন আমজাদ সওদাগর। থতমত খেলো অবনী বেগমসহ উপস্থিত সকলে। অবশেষে আমজাদ সওদাগর রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
“যার যেটা প্রাপ্য, তাকে সেটা দিতেই হবে।”

“আপনিও তো অনেককিছু প্রাপ্য, কেউ তো সেটা আপনাকে দেয়নি।”

“অহি!”

“চিৎকার করবেন না। আপনার চিৎকারে আমি ভয় পাই না, সেটা নিশ্চয় জানেন?”

আফজাল সওদাগর এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে ডেকে উঠলেন। ভাইকে ধমক দিয়ে বললেন,
“আমজাদ, চিৎকার করিস না। মেয়েটা তো তোদের এসবের জন্যই এত পাথর হয়ে গেছে।”

“ভাইজান, আপনি বলে দেন ওদের, অহিকে ওরা নিতে চাচ্ছে আর অহি ওদের সাথেই যাবে। আর কোনো কথা হবে না। আর কেউ একটা কথা বললে তার দুর্গতি আছে।”

শেষের কথাটা আমজাদ সওদাগর তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই বলল। আজ চুপ নেই অবনী বেগমও। সেও তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল,
“তুমি কী দুর্গতি দেখাবে আমিও দেখবো। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি কারো কাছেই দিব না। ও আমার সন্তান। ওর ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বও আমার। তুমি বললেও আমি সিদ্ধান্ত নিব, না বললেও আমি নিব।”

অবনী বেগমের এই রণমুর্তি অচেনা সকলের। আমজাদ সওদাগরও হতবিহ্বল হলো। তবে প্রশান্তির হাসি অহির ঠোঁটের কোণে। বেশ শান্ত স্বরে অবনী বেগমের উদ্দেশ্যে সে বলল,
“আপনার এই দিনটি দেখার জন্যই আমি এত কাল অপেক্ষা করেছিলাম। যদি আরো আগ থেকে নিজের সংসারে হালটা শক্ত হাতে ধরতেন তাহলে আপনার জীবন আরো সুন্দর কাটতো।”

অহি নিজের কথা শেষ করেই আবার নিজের রুমে চলে গেল। ড্রয়িং রুমের আলোচনাও স্থগিত হলো সেখানে।

_

সাভারের মোর ঘেষে যাওয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। আজ সে কলেজে গিয়েছিল এডমিট কার্ড আনতে। উত্তপ্ত রোদে বাজে অবস্থা মেয়েটির। ঘামে ভিজে চুপচুপে তার শরীর। অসহ্য রকমের বিরক্ত নিয়ে নাক মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে সে অথচ আশেপাশে দেখা নেই রিক্সার। মাথায় উত্তপ্ত রোদ্দুর নিয়ে যখন তার নাজেহাল অবস্থা সেই মুহূর্তে চোখে পড়লো অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্য। পরিচিত দুটি মুখ রিকশায় বসে তার সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। চিত্রার মনে হল যেন কেউ তার হৃদয়ের একটি অংশ টেনে হিঁচড়ে ছিড়ে ফেলছে। আর যাই হোক বাহার ভাইকে সে এই অপরিচিত মেয়েটার সাথে সহ্য করতে পারে না। অথচ সেই দৃশ্যই তাকে দেখতে হয়। বেখেয়ালি বাহার ভাই কেমন করে যেন ওই মেয়েটার খেয়াল হয়ে উঠেছে, ভবঘুরে বাহার ভাই কেমন যেন মেয়েটার মাঝে নির্দিষ্ট একটি গন্তব্য স্থাপন করে ফেলেছে যা চিত্রাকে ভালো থাকতে দেয় না। অসহ্য রকমের এক বুক ব্যথা চিত্রা হাপিত্যেশ করে উঠে। মনে হয় তার সবকিছু ধ্বংস করে দিতে। অসহায় দৃষ্টিতে তার হাতের শপিং ব্যাগটির দিকে তাকায় সে। এই তো কিছুক্ষণ আগেও একটি পাঞ্জাবী পছন্দ হওয়াতে বাহার ভাইয়ের জন্য সেটা কিনে ফেলেছে। কখনো লোকটিকে পাঞ্জাবিতে সে দেখেনি তাইতো একটু দেখতে পাওয়ার কি তৃষ্ণা! অথচ এমন একটি দৃশ্য দেখলো যা চিত্রার সকল মুগ্ধতা মুহূর্তেই নষ্ট করে দিল।

অতি দুঃখে পাঞ্জাবিটি পথের ধারে ছুড়ে মারলো। অতিরিক্ত ভালোবাসা যেন এভাবে অবহেলায় থিতিয়ে আসে।

_

আকাশের বুকে তখন বিষন্ন সন্ধ্যার আগমন। চারপাশে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নীড়ে। ক্লান্ত কৃষাণ ফিরে যাচ্ছে তার গৃহে। ব্যস্ততারও হয়েছে ছুটি। রিক্সার সিটে বসা কপোত-কপোতীরা ফিরে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। এ যেন এক বিচ্ছেদের সন্ধ্যা।

বিল্ডিং-এ, এলাকায় বিদ্যুৎ নেই দেখে প্রায় সকলেই রাস্তায় বেরিয়েছে। আবাসিক এলাকা দেখে এখানে তেমন কোন যানবাহনের চলাচল নেই। কেবল যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাদের গাড়িই এলাকায় প্রবেশ করে। বিভিন্ন বাড়ির সামনেই খোলা জায়গা আছে। সেখানে কোথাও মহিলাদের আড্ডা চলছে, কোথাও বা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি করছে পুরুষ সমাজ। টিনেজার মেয়েগুলো কোথাও রং মিশিয়ে একসাথে বসে খোঁশগল্পে মেতে উঠেছে, কোথাও বা অনেকে ভার্চুয়াল জগতে ডুব মেরেছে। ছেলেগুলো পথে হাঁটছে, কখনো বা বিভিন্ন খেলায় মত্ত হচ্ছে। চারপাশে আড্ডার শোরগোল। এই যেন এক অনন্য পরিবেশ, এইযেন এক সুখের আবহাওয়া। এক মুঠো রাত যেন আঁধারের খামে আনন্দ নিয়ে এসেছে।

সওদাগর বাড়িতে আড্ডার জন্য এসেছেন মৃন্ময়দের বাড়ির সকলে। শাহাদাত, শাহাদাতের নতুন বউ, মৃন্ময়ও এসেছে। বাড়ির সামনে খালি দিকটায় বিশাল আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হইচই চারপাশ জুড়ে। কখনো-বা দারুন কথায় সকলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে কখনো বা ভাবুক সুরে অন্যের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে। অহি আর চেরি সেখানে বসেই নিজেদের মনমতন গল্প-স্বল্প করছে। তার কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। দৃষ্টি তার আকাশে নিবদ্ধ। বেশ অনেকক্ষণ, একটানা তার দাঁড়িয়ে থাকা। চাঁদনী চোখ বন্ধরত অবস্থায় অনুভব করল তার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে খুব নিরবে, নিভৃতে। চাঁদনী নিষ্প্রাণ হাসলো, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“কেমন আছো, মৃন্ময়? আজকাল ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’ গানটা যে গাও না? পড়শিকে বুঝি আজকাল মনে পড়ে না?”

মৃন্ময় চমকালো, ভীষণ অবাক হল। বিস্মিত কন্ঠে শুধালো, “ইন্দুবালা, আপনি আমার সাথে কথা বলছেন নিজে!”

মৃন্ময়ের চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে গেলো স্রোতের বেগে। এই আনন্দ যেন বহু আকাঙ্খিত কিন্তু অপ্রত্যাশিত।

“কথা বলা উচিত নয় বুঝি?”

“সরি, ইন্দুবালা। আমি আপনার এত বড়ো ক্ষতির কারণ হতে চাইনি।”

“সরি বলো না, মৃন্ময়। আমার তোমার উপর আর কোনো রাগ নেই। এই পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমরা না চাইতেও করে ফেলি বা প্রাকৃতিক ভাবে হয়ে যায়। এতে কারো দোষ থাকে না।”

“তাহলে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন যে?”

“নিজেকে সময় দিয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে রাখিনি। তোমার চোখে এইসব যতটা হালকা এবং রঙিন আমার চোখে এটাই ততটা কঠিন এবং ফ্যাকাসে। তোমার চোখের প্রিয়— ফ্যান্টাসি। অথচ আমি আটপৌরে। নিজের পছন্দ, ভালোলাগাকে ভালোবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলো না, মৃন্ময়।”

মৃন্ময় চুপ করে রইল। তার সামনের নারীটির দিকে আজও তার মুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ। অথচ মানুষটার জীবনে বড়ো ক্ষতির কারণও সে।

সকলে যখন আড্ডায় মশগুল, তখন খুব লুকিয়ে বাড়ির গেইটের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে চিত্রা। এত মানুষের মাঝে নিজেকে কেমন যেন লাগছিল। অস্বস্তিতে চারপাশ ভোরে উঠেছিল। তাই শান্তির খুঁজেই বাহিরে আসা। চিত্রার চোখ অনির্দিষ্ট পথের বাঁকে আটকে। আঁধারের মাঝেও তার মেয়েলি সুন্দর নারী স্বত্তাটি জ্বলজ্বল করে উঠছে। মোহভরা দু’টি চোখে যেন কত আহাজারির নামতা গুনতে ব্যস্ত। রঙচটা বাড়িটির দিকে হুট করে তাকাতেই দেখল বাহার বাড়িটি দেখে বেরিয়ে আসছে। হাতে সিগারেটের ছোট্টো জ্বলজ্বল আলো নিখুঁত দেখা যাচ্ছে। বাহারকে দেখতেই দুপুরের দৃশ্য মনে পড়ে গেল তার। মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। মনস্থির করল বাড়ির ভেতর যাওয়ার। তার আগেই বাহারের ডাক ভেসে এলো,
“আজকাল নিয়ম বদলেছে নাকি, রঙ্গনা? ছুঁতে চাওয়া মানুষটাকে ফিরে দেখারও প্রয়োজন বোধ করছো না যে, মেয়ে?”

চিত্রা সরু চোখে তাকাল। নয়নে নয়ন মিলল প্রেমোতৃষ্ণার অঘোষিত দম্পতির। রঙ্গনার চোখে অভিযোগের মৌন ভাষাদের বুঝে নিল যেন প্রেমিক। হাসল তাই কিঞ্চিৎ,
“অভিযোগের ভাষারা এত তীক্ষ্ণ কেন? তবে কী অপরাধটি ভয়ঙ্কর করে ফেলেছি নাকি?”

“না, বাহার ভাই। কোনো অভিযোগ তো নেই।”

সদ্য উঁকি দেওয়া অংশুমালীর মিষ্টি আলো চুম্বন খেয়ে যায় গোলগাল চিত্রার মুখাবয়বে। তা দেখে শক্ত প্রেমিকের বুকেও উঠে ঝড়। সে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। এই দৃষ্টি লজ্জায় ফেলে পুতুলের ন্যায় প্রেমিকাকে। সে মিনমিন করে বলে,
“তাকিয়ে আছেন কেন?”

“এত জ্বালাচ্ছ বলে। এত জ্বালিয়ো না আমায়। পুড়ে যাচ্ছি তো, মেয়ে!”

চিত্রা অবাক হলো, “কোথায় জ্বালাচ্ছি?”

“এই যে জ্যোৎস্না এসে আলিঙ্গন করছে তোমায়। রূপে ঢালছে মুগ্ধতা। আমি কী তা দেখে নিজেকে বেখেয়ালি রাখতে পারি, মেয়ে? আমারও তো লোভ হয়, মিঠে আলিঙ্গনের। তবে কী আর করার? জ্যোৎস্নার মতন যে আমার সাধ্য নেই। অত মূল্যবান শরীরটাকে কী এই দেহ ছুঁতে পারবে বলো? কখনো না। চাঁদকে ছোঁয়ার সাধ্য যে আমার নেই, রঙ্গনা। তাই দূর হতেই তোমায় দেখে যাই। যেদিন বেকারত্বের আকাশে সাফল্যের চন্দ্র মুখ তুলে চাইবে, সেদিন জোছনা হয়ে আমি ঝড়বো। ততদিন অব্দি দূর আকাশের চাঁদ আমার হয়ে থাকবে তো, মেয়ে?”

চিত্রা জবাব দেওয়ার আগেই বাহার হাঁটা শুরু করল, কণ্ঠে তার নিপুণ গান,
“বন্ধুর প্রেমও জ্বালায় অঙ্গ জ্বলে,
জ্বালা, কি দিয়া নিভাই…..

#চলবে…..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে