প্রেমোত্তাপ পর্ব-২০+২১

0
612

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২০.

ধরায় তখন প্রহর চলছে অপরাহ্নের সমাপ্তির প্রহর। ব্যস্ত শহরে ঝুপ করে নেমে এসেছে ক্লান্তি। কেউ রিকশার টুংটাং শব্দে খুঁজে নিচ্ছে অবকাশের ভাবনা। আঁধার আকাশে আধো আধো কুয়াশারা হামাগুড়ি দিচ্ছে। হিমেল সমীর জনজীবনে দিয়েছে প্রশান্তি। কেবল শান্তি নেই চিত্রার দেহে, মনে। কেবিনের এক কোণায় বসে সে এই অশান্তির জীবনের হিসেব মেলাচ্ছে। মেলাতে মেলাতে ফলাফল বের হলো, অদ্ভুত জীবন, অচেনা দুঃখ। চিত্রার চোখের কার্নিশ ঘেঁষে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল সেই অপ্রত্যাশিত, নিষ্ঠুর, অপ্রিয় দৃশ্যটি। বাহার ভাই কারো ভরসার কাঁধ হয়েছে, এটা চিত্রা মানতে পারছে না। অবশ্য মানতে না পারারই কথা। যে মানুষ সর্বদা ছিল ছন্নছাড়া, বেখেয়ালি— সে মানুষ হুট করে কারো খেয়াল রাখার কারণ হয়ে যাবে সেটা চিত্রা কীভাবেই বা মানবে? উন্মাদ হলো সে, দ্রুত গতিতে মায়ের ফোন থেকে কল লাগাল কাঙ্খিত সেই নাম্বারটিতে। রিং হলো, চিত্রা তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় ছটফট করতে লাগল। তার তৃষ্ণাকে চির যৌবনা রেখে অপর পাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করল না। অবহেলায় মূর্ছা গেলো ফুলের ন্যায় চিত্রা। চোখ তার ঘোলাটে হয়ে এলো। দৃষ্টি এলোমেলো। চারপাশে হাতড়ে একটি ভরসার কাঁধ খুঁজল কিন্তু পেল না। পাবেই বা কীভাবে? তার ভরসার কাঁধ আজ অন্যের আশ্রয় হয়েছে যে! এই চরম সত্যি মানতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি। চোখের সামনে বখাটে, ভবঘুরে এক পাগলাটে পুরুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। যাকে ভালোবেসে অষ্টাদশী বিনা লাভে কষ্ট ধার করেছে।

_

একটি সুন্দর সকাল। চোখে-মুখে নতুন উদ্যম নিয়ে তার আগমন। তার আগমনে নাচছে মেঘ। প্রকৃতি আনন্দঘন। সওদাগর বাড়িতেও আনন্দ উপচে পড়ছে। আজ বাড়ির চঞ্চল প্রাণ বাড়িতেই ফিরে আসবে। অবনী বেগম ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছেন। তার সাথে সাহায্য করছেন রোজা সওদাগর। ব্যস্ত রান্নাঘরে হুট করে আগমন ঘটল ছোট্টো চেরির। এসেই মায়ের আঁচল টানল, শুধাল,
“কী রাঁধো, আম্মু?”

অবনী বেগমের ব্যস্ত হাত থামল না। কাজ করতে করতে মেয়ের উত্তর দিলেন,
“ইলিশ মাছ রান্না করছি, সোনা। তোমার চিত্রা আপা’র না অনেক পছন্দ? তাই।”

“চিত্রা আপা কী আজ আসবে, আম্মু? কতদিন আপার সাথে খেলি না। আপা না থাকলে মোটেও ভালো লাগেনা, আম্মু।”

অবনী বেগম এবার ব্যস্ত হাত থামালেন, মেয়ের দিকে চাইলেন স্নেহের দৃষ্টিতে। আর কেউ না জানুক, সে-তো জানে, তার মেয়েটা চিত্রা আপা বলতে পাগল। মায়ের বুকের স্নেহ ঢেলে দিল মিষ্টি চেরির পানে চেয়ে। কপালে আদর মাখা মিষ্টি চুমু এঁকে মেয়ের গাল টানলেন,
“তোমার ভালো লাগে না বলেই তো আপা চলে আসছে। আর মন খারাপ করে রেখ না। কেমন?”

চেরি গাল ভোরে হাসল। গোলগাল স্থুল আকার চেহারাটির ডাগর ডাগর অক্ষি যুগল হাসির দাপটে পিটপিট করল। সেই পিটপিট নেত্র মেলে সে বড়ো আম্মুর দিকে চাইল। বড়ো আম্মুকে কাজে ব্যস্ত দেখতেই সাবধানী ভঙ্গিতে মায়ের আঁচল টেনে নত হওয়ার ইশারা করল সে। মেয়ের সাবধানী হাবভাব এড়ায় না মায়ের দৃষ্টি। তাই সেও সাথে সাথে মাথা নামায়। শুধায়,
“সিক্রেট কিছু বলবে?”

চেরি সম্মতিতে মাথা নাড়ে উপর-নীচ। প্রায় ফিসফিস করে বলে,
“আম্মু, তরকারিতে ইলিশ মাছের দু’টো টুকরো বেশি দিও। বাহার ভাই আর বনফুল বুবুও তো ইলিশ মাছ অনেক পছন্দ করে।”

মেয়ের কথায় তাজ্জব বনে যায় অবনী বেগম। ও বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে তাদের আজকাল দেখা সাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। না আছে সম্পর্ক। তবুও বাচ্চা মেয়েটা ভালোবাসা ভুলেনি। অথচ বড়োরা অনায়াসে তা ভুলে ভালো আছে!

“দিবে তো, আম্মু? দিও প্লিজ। আর না থাকলে, আমারটা দিয়ে দিব। তুমি কাউকে বলো না কেমন?”

অবনী বেগমের চোখ ঝাপসা হয় মেয়ের এমন মায়া ভোরা বায়নায়। সে ঝাপসা চোখে মেয়েকে আদর দিতে দিতে বলে,
“ওদের জন্য দু’টো টুকরো বাড়িয়ে দিব। তুমি চিন্তা করো না।”

মায়ের আশ্বাসে আনন্দ হারা হয় চেরি। ছুটে যায় রান্নাঘর ছেড়ে। মনে মনে ফন্দি আঁটে বাহার ভাইদের বাড়ি যাওয়ার। এখন একবার গিয়ে বুবুকে বলে আসবে যেন দুপুরে ভাত তাড়াতাড়ি না খায়। চেরি মাছ নিয়ে আসবে।

সকাল হতেই চিত্রা হাঁসফাঁস শুরু করে। সে আর হসপিটাল থাকবে না। কোনো ভাবেই না। তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেই সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। মেয়ের নাছোড়বান্দা আবদারে মুনিয়া বেগম হার মানেন। সকাল সকালই তাকে ছেড়ে দেওয়ার আর্জি পেশ করেন ডাক্তারদের কাছে। তুহিন মা’কে আগেই পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। চাঁদনী ও অহি চিত্রাকে নিয়ে আসতে যায়।

চিত্রার চঞ্চল চিত্ত। বাড়ি আসলে সে সুস্থ হয়ে যাবে এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ঠিক কথা হলো— বাড়ির পাশে বসবাসকারী প্রেমিকের সান্নিধ্যে থাকলে সে সুস্থ হবে। ছন্নছাড়া বাহার ভাইয়ের গিটারের শব্দ শুনলে সে সুস্থ হবে। সে সুস্থ হবে আধ্যাত্মিক এক ওষুধের মাধ্যমে। যে ওষুধের কথা কেউ জানেনা, কেবল রোগ জানে আর রোগী জানে।

চিত্রাদের গাড়ি শব্দ তুলে সওদাগর বাড়ির সামনে এসে থামল। খানিক জার্নিতেই মেয়েটার শরীর ক্লান্ত। তুহিন দ্রুত গাড়ি ছেড়ে বের হলো। বোনের নিকট বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। চিত্রা এক পলক সেই হাতের দিকে চাইল, নির্লিপ্ত দৃষ্টি জোড়া সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি পারব।”

তুহিনের আশা ভরা হাতটা অগোচরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। চাঁদনী ভাই-বোনের এই মান-অভিমানের পালা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলল খুব গোপনে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই কিছুটা মিছে ধমক দিয়ে বলল,
“কী তুই পারবি হ্যাঁ? শরীর যা দুর্বল হয়ে আছে, নড়তেই তো পারিস না ভালো করে। আয়, আমার হাত ধর দেখি, আমি ধরছি।”

চিত্রা বাক্যব্যয় না করেই নিরবে চাঁদনীর হাতটি ধরল। তুহিন হতাশার শ্বাস ফেলল। চিত্রা গাড়ি থেকে নামতেই তার দৃষ্টি গেল একতলা বিশিষ্ট রঙ চটা দালানটির দিকে। যেই দালানের আধ-খষা ছাঁদের কোণে বসে ঝিমুচ্ছে শালিক। কয়েকটি মেটে রঙের নিত্য পরিহিত জামাকাপড় উড়ছে ছাঁদের কার্ণিশে। চিত্রা তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়ে রইল মিনিট দুই। হয়তে পরিচিত মানুষটাকে দেখতে পাওয়ার লোভে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। গাঢ় বিষাদ এসে জমল তার বুকে। কিন্তু হুট করেই সকলের দৃষ্টি আটকে গেল সেই রঙচটা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে। একটি ক্রন্দনরত বাচ্চার নিষ্পাপ মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই সকলের মন মুহূর্তেই হাপিত্যেশ করে উঠল। চিত্রা তো এই অসুস্থ, ব্যাথা যুক্ত শরীরটা নিয়ে ছুটে গেল নিষ্পাপ বাচ্চাটির দিকে। স্নেহের হাতে আগলে নিল মুহুর্তে। চিত্রার পেছনে পেছনে চাঁদনী, অহি এবং তুহিনও উপস্থিত হলো। চেরির মুখমন্ডল লাল হয়ে এসেছে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে বাচ্চাটা। চিত্রা উত্তেজিত হলো, চঞ্চল কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে আমার চেরি সোনার? কাঁদছে কেন আমাদের প্রিন্সেস?”

চেরির কান্নার স্রোত উত্তাল হলো। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“আ আপা, বুবু ভালো না। বনফুল বুবু পচা হয়ে গিয়েছে। সে মোটেও ভালো না।”

সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। চিত্রা আহত চোখে চাইল বন্ধ দরজার দিকে। মনের মাঝে মানতে না চাওয়ার এক ঝড় উথাল-পাতাল ধ্বংস তুলল। বনফুল নামক মিষ্টি মেয়েটা এমন পাষাণ হয়ে গিয়েছে, তা সে মানতে পারল না।

অহি নিজের ছোটো বোনকে বুকে চেপে ধরল। দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করল,
“কী করেছে বনফুল তোমার সাথে?”

চেরির ঠোঁট ভেঙে কান্নারা ততক্ষণে আরও প্রসস্থ হলো। তারা জানল না বনফুলের দোষ কি ছিলো। ততক্ষণে সওদাগর বাড়ির ভেতর পৌছে গেল এই সংবাদ। তাদের সামনের বাড়ির মানুষ গুলোর প্রতি এবার রাগ প্রগাঢ় হলো তাদের।

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২০ এর প্রেম বিশেষ পর্ব:

চঞ্চল দিবসের মেঘ স্থির হয়ে গগন বক্ষে বিরাজমান আছে। মুগ্ধ বিকেলের ভ্যাপসা গরমে শহুরে মানুষ অতিষ্ঠ। এবার তেমন শীত পড়েনি। জানুয়ারি শুরু হতে হতেই শীত প্রায় পোটলা-পুটলি নিয়ে বিদায় নিয়েছে সন্ন্যাসী বেশে। রাত হলে একটু ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলেও সূর্য উঠতে উঠতে তা হারিয়ে যায় কোন গহীনে। চাঁদনী বসে আছে তার বারান্দায়। ভিসার ঝামেলা কিছুটা মিটমাট করে এসে বসেছে। খুব শীগ্রই তার পাসপোর্ট চলে আসবে, তারপর সে পাড়ি দিবে চেনা মানুষ, চেনা শহর, চেনা অবহেলা-অবজ্ঞার ভীড় ঠেলে। যেখানে গেলে আর কেউ তার মন ভাঙার জন্য থাকবে না, ভালোবেসে ব্যাথা দেওয়ার জন্য থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। একটি হাসতে-খেলতে থাকা জীবন নষ্ট করার জন্য একটি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতাই হয়তো যথেষ্ট!

“তুই তো চলে যাবি বিদেশ। শান্তিতে থাকবি। আমি তো তোকে অনেক যন্ত্রণা দিতাম। ভালো থাকবি এবার, তাই না?”

মায়ের কণ্ঠ পেতেই চাঁদনীর ধ্যান ভাঙল। তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে চাইল। রোজা সওদাগর কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজায়। পড়নে তার বেগুনি রঙের একটি সুতি শাড়ি। পুরোনো হয়েছে বলে রঙটা আর ঝলমল করছে না। কিছুটা মেটে হয়ে আছে। স্বর্ণের মোটা চেইন গলায়, কানেও শোভা পাচ্ছে ভারী স্বর্ণ। চালচলনে পুরো রাজকীয় হাবভাব। মায়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল চাঁদনী। রোজা সওদাগর কফির মগ এগিয়ে দিলেন মেয়ের দিকে, কোমল কণ্ঠে বললেন,
“যাকে ভালোবাসতিস, সে কে ছিল?”

চাঁদনী কফির জন্য হাত এগিয়ে দিয়ে থম মেরে গেল মায়ের প্রশ্নে। হৃদপিণ্ডের গতি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হলো বোধহয়। তবুও সামলে নিল নিজেকে। ঝাপসা হয়ে আসা প্রেমিককে স্মৃতির পাতা থেকে সরানোর চেষ্টা করে উত্তর দিল,
“ছিল কেউ একজন, এখন তো আর নেই। যে নেই, তার কথা জেনে কোনো লাভ কী আছে, আম্মু?”

“লাভ-লোকসানের তুই কী বুঝবি? বুঝলে এভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারতিস না। তুই কীভাবে এমন একটা কাজ করলি? একটা ছেলেকে এত বছর ভালোবাসলি অথচ জানালি না। এখন আবার শুনি ছেলেটার সাথে সম্পর্ক নেই। সেই শোকে বিদেশ চলে যাবি। একটা বার মা-বাপের কথা কী ভাবার প্রয়োজন মনে করিসনি!”

চাঁদনীর মাথা নত। ধোঁয়া উঠা কফির মগ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। রোজা সওদাগর আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেললেন। ক্ষীণ স্বরে যেন গোপন আর্জি পেশ করলেন,
“বিদেশ যাওয়ার কী দরকার? বয়স তো হয়েছে, বিয়ে-থা করে নিলে কী হয়?”

চাঁদনী এবার পলক ঝাপটিয়ে মায়ের পানে চাইল। অন্তরে তার বসে আসা ক্ষতটায় আবার নতুন করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কণ্ঠে অসহায়ত্ব,
“মা, বিয়েই জীবনের সব নয়। বিয়ে ছাড়াও মানুষ বাঁচে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোর কাছে তো অন্য একটি ছেলে বড়ো। বাপ মা’র তো কোনো দাম নাই। একটা আইবুড়ো মেয়ে বাপ-মায়ের ঘাড়ে বসে থেকে বাপ-মা’র সুখ খাচ্ছে, বিয়ে করতে তার ভাল্লাগে না। সমাজও তো এ কথা শুনলে ছি, ছি করবে। আবার কয়দিন আগে কোন আন্ধারে এক ছেলের সাথে ধরা পড়ছিলি। কলঙ্ক কইরা রাখলি আমার গর্ভটারে। তোর মতন সন্তানের মুখে আগুন দিই।”

চাঁদনীর হাতে থাকা অতি সুন্দর সিরামিকের কফি মগটি বেশ শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেল। ভেঙে হলো কয়েক টুকরো। কিছু সেকেন্ড আগেও যে মগটা অতি সৌন্দর্যতা প্রকাশ করছিল, কিছু সময়ের পরিবর্তে সে এখন সকল সৌন্দর্যতা হারিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই ভাঙা কফি মগের সাথে চাঁদনী যেন নিজের মনের দারুণ এক মিল পেল। দু’টো সুন্দর জিনিসই অন্যের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আজ। অস্ফুটস্বরে চাঁদনী চেঁচাল,
“মা!”

রোজা সওদাগর ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে প্রস্থান নিলেন জায়গাটি ছেড়ে। একবার গাঢ় চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টাও করলেন না যে তার মেয়ের নরম আত্মাটি ভয়ঙ্কর ভাবে আজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। চাঁদনী নিজের ডান চোখের কোণ ঘেঁষে আসা টলমল করা অযাচিত অশ্রুটি ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে মুছে নিল। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে চোখের মনি ঘুরাতেই পাশের বিল্ডিং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ মুগ্ধ করা ছেলেটির তাজ্জব মুখমন্ডলে তার নজর পড়ল। চাঁদনী থমকে গেল সাথে সাথে। মৃন্ময় সবটা ঘটনাই যে দেখেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। মৃন্ময় হতভম্ব কণ্ঠে ডাক দিল,
“ইন্দুবালা……”

অথচ চাঁদনী কথা বলার সুযোগ দিল না তাকে। ঝড়ের বেগে চলে গেল বারান্দা ছেড়ে। একটি ছেলেতে তার আর মুগ্ধ হওয়ার কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই। ছেলেটি যে তার জীবন দূর্বিষহ করে দিয়েছে !

_

চিত্রার শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। সন্ধ্যার আকাশ তখন বিদায় ধ্বনিতে মুখরিত। বাসায় বিদ্যুৎ নেই। কেবল বাসায় বললে ভুল হবে, পুরো এলাকাতেই ইলেক্ট্রিসিটি নেই। জেনারেটরও আজকাল খুব বিরক্ত করছে। সন্ধ্যাবেলায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পুরো মহল্লা জুড়ে যেন ঝুপ করে নির্মল অন্ধকার নেমে এলো। তবে এই নির্মল আঁধার তেমন অসুন্দর নয়। পাখিদেরর নীড়ে ফেরার আনন্দ মেশানো আকাশটি অসুন্দর হতেই পারে না। চিত্রা এই অসুন্দর আকাশটি আজ মুগ্ধ চোখে দেখছে না। শরীর, মন খারাপ থাকলে পৃথিবীর সকল মুগ্ধতাও কেমন বিরক্তিকর ঠেকে!

চিত্রার ভারী পল্লব বিশিষ্ট চোখের পাতাটি বন্ধ। চোখ জুড়ে আবছা আবছা ঘুমু-ঘুমু ভাব। তবে মস্তিষ্ক কিঞ্চিৎ জাগ্রত। আর সেই জাগ্রত মস্তিষ্ক হুট করে চিত্রার জন্য আনন্দ বার্তা আনল। প্রেমের অদৃশ্য রথ নিয়ে এলো। তার জাগ্রত কর্ণে গিটারের মিহি সুর পৌঁছালো। বাহার ভাই বহুদিন পর গিটার বাজাচ্ছেন বোধহয়। চিত্রার মন পুলকিত করা গিটারের সুরটা বড়োই মোহনীয় ঠেকল। যেই মোহ শুয়ে থাকতে দিল না চিত্রাকে। মেয়েটা ঘোরগ্রস্তের মতন উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এই অন্ধকারে আবৃত পৃথিবীতে প্রেমিকের ছায়া কেমন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে!

চিত্রার ধ্যানমগ্ন মস্তিষ্ক পুরোটাই বাহারের উপর নিবদ্ধ। তার অক্ষি যুগলে বোধহয় বহু বছরের তৃষ্ণা। প্রেমিককে দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা বোধহয় পৃথিবীর সকল তৃষ্ণাকে হার মানায়। বাহারের আধাঁর শরীরটা আজ চিত্রাদের বারান্দার দিকেই ঘুরে দাঁড়ানো। মানুষটা এখানে কখনোই দাঁড়ায় না, তবে আজ কেন? চিত্রার উত্তর বিহীন প্রশ্ন কতক্ষণ উত্তরের আশায় আহাজারি করে নেতিয়ে গেলে। কানে ভেসে এলো মুগ্ধ করা কণ্ঠের গানের খানিক অংশ,
“যদি দেখার ইচ্ছে হয়,
তোমার নিঠুর মনে লয়,
কালিন্দীরও ঘাটে আইসো দুপুরের সময়।
আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখবো নয়ন ভরিয়া…
দেইখো আসিয়া।”

গিটার বাজছে। চিত্রা যেন গানের সুরে লুকায়িত প্রেমিকের আবদার খানি বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারল। বাহার ভাইয়ের চোখ দু’টি আজ হাসছে কী! আঁধারে ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে গেল রুমে। সকালে যখন চেরিকে কাঁদতে দেখল, তখনই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল ঐ বাড়ির মানুষদের সাথে আর কথা বলবে না। বিকেল হতেই সেই প্রতিজ্ঞার জোর কমে এলো। আর এখন যেন তা নিঃশেষ প্রায়।

চিত্রাদের সকল রুমে সৌরবিদ্যুৎ-র ব্যবস্থা থাকা স্বত্তেও আজ সেই ব্যবস্থাও কাজে লাগানো হয়নি। চিত্রার দাদীর আদেশেই সকল আলো বন্ধ। জ্বালানো হয়েছে হারিকেন। বৃদ্ধার নাকি আঁধারে লণ্ঠনের আলো পছন্দ। তার ভাষ্যমতে অন্ধকার নব যৌবন পায় লণ্ঠনের সেই হলুদ আলোয়। যেহেতু সন্ধ্যার সময়, সওদাগর বাড়ির মহিলারা তাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুম জুড়ে কেবল নিস্তব্ধতার সমাবেশ। চিত্রা সেই নিস্তব্ধতার সুযোগ পেতেই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অসুস্থ শরীর, ভাঙা হাত নিয়েই ধুপধাপ করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। লুকিয়ে মেইন গেইট পেরুতেই চিত্রা বুঝল— তার উপলব্ধি ভুল নয়। প্রেমিকের গান যে কেবল গানই ছিল না, তা প্রমাণ পেল বাহারের শীতল উপস্থিতিতে। চিত্রা কথা বলার জন্য ওষ্ঠ খানিক ফাঁক করতেই বাহারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হুসসস, কথা বলো না, রঙ্গনা। এই সুন্দর আঁধারে প্রেমের নিরব আলিঙ্গন কেবল অনুভব করে হাঁটো। পারবে হাঁটতে?”

বাহারের প্রশ্নের উত্তরে চিত্রা শব্দ ব্যয় বিহীন উত্তর দিল কেবল মাথা দুলিয়ে। চোখে ভর করেছে তার অভিমানী অশ্রু। দু’কদম এগুতেই চিত্রা নিজের হাতে উষ্ণ একটি হাতের নিরব উপস্থিতি পেল। এই ছোঁয়ায় বিস্মিত, হতভম্ব সে। বাহার ভাই নিজ থেকে তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে! কীভাবে সম্ভব! এবারও চিত্রার বিস্ময়ের কারণের কোনো সঠিক বিশ্লেষণ পেল না। কেবল তার ডাগর ডাগর নয়ন যুগল নির্নিমেষ বিস্ময় ভঙ্গিতেই রইল।

প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটতেই বাহারের গমগমে স্বর ভেসে এলো,
“মামা, যাবেন?”

চিত্রা চোখ তুলে তাকাল। হাঁটতে হাঁটতে তারা এলাকা পেরিয়ে চলে এসেছে। কেউ দেখে ফেলেনি তো! ভাবনার মাঝেই চিত্রার হাতে নরম টান পড়ল। সে চোখ তুলে চাইতেই চোখাচোখি হলো প্রিয় পুরুষের চোখ জোড়ার সাথে। শরীর বেয়ে বিদ্যুৎ এর গতিতে ছড়িয়ে গেল প্রেমের নতুন বীজের অস্তিত্ব। নতুন করে গাঢ় হলো যেন সেই প্রেম।

সোডিয়ামের আলোয় রিকশা চলছে গন্তব্যহীন। বাহার ভাইয়ের এত নিকটে থেকে এই বোধহয় চিত্রার গন্তব্য বিহীন ভ্রমণ। গলায় যেন আটকে আছে অবলিষ্ঠ শব্দ গুলো। প্রগাঢ় নিরবতায় কেটে গেছে আধাঘন্টা বোধহয়। চঞ্চল চিত্রা আজ চঞ্চলতার নামতা গুনেনি।

“কথা বলবে না, রঙ্গনা? প্রেমের চেয়েও কী রোষাবেশ গাঢ় হয়?”

বাহারে আদ্র কণ্ঠের প্রশ্নে, রঙ্গনার ধ্যানচুত্য হলো। সে খানিক গোঙানির শব্দ করল, “হুহ!”

বাহার হেসে উঠল উচ্চশব্দে। গা দুলিয়ে হাসছে লোকটা। নিরব রাস্তায় ঝঙ্কার তুলছে সে হাসি। কবি এবং তার কবিতা বলে— নারীর হাসির চেয়ে সুন্দর কিছু নাকি নেই। অথচ তারা যদি একবার প্রেমিকের হাসি দেখত, তাহলে তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা মুহূর্তেই মিশে যেত। চিত্রার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। লোকটা কী অকারণেই হাসছে আজ! এর আগে কখনো তো সে এমন আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে হাসেনি। চিত্রার শুধাল,
“এভাবে হাসছেন কেন?”

“কান্না করার কোনো কারণ নেই বলে।”

বাহারের তৎক্ষণাৎ উত্তরে খানিক হোঁচট খেল সে। চিত্রার হতভম্ব মুখ দেখে যেন প্রেমিকের বড়ো আনন্দ হলো। তাই তো সে মিহি স্বরে বলল,
“আমার হাসি কী বেশি অসুন্দর?”

বাহারের প্রশ্নে চিত্রা ডানে-বামে মাথা নাড়াল। নিভু নিভু কণ্ঠে বলল,
“একটু বেশিই সুন্দর।”

“তাহলে আমার সেই হাসি কেন কেড়ে নিচ্ছ, রঙ্গনা?”

বাহারের শীতল তবে তীক্ষ্ণ প্রশ্নে চিত্রার মুখ ভার হলো। সে কষ্ট দিচ্ছে বাহারকে! সে? হাহ্! অথচ লোকটার দেওয়া কষ্টে মেয়েটা প্রতিনিয়ত পুড়ছে। রাগে-দুঃখে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিল বাহারের দিক থেকে। বাহার তা দেখে শরীর এলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে রিকশায় হেলান দিয়ে বসল। ঘোরগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
“রঙ্গনা, অভিমান কী মুখ ফিরিয়ে নিতে বলে?”

“এখন এসব জিজ্ঞেস করছেন? আপনি মুখ ফিরিয়ে থাকেননি?”

“থেকে ছিলাম, বুঝি? আচ্ছা রঙ্গনা, চোখ যদি কিছু না দেখে তাহলে তার উপস্থিতি পৃথিবী কী মিথ্যে বলে ঘোষণা করে?”

বাহারের হেঁয়ালি প্রশ্নে চিত্রার হতভম্বতা —“কী!”

বাহার আকাশের দিকে চাইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানো মেয়ে, তোমার হসপিটালের করিডোরে মশা অনেক বেশি। আমাকে একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি।”

“হসপিটালে আপনি গিয়েছিলেন?”

চিত্রার প্রশ্নে হেঁয়ালি হাসল বাহার। উত্তর দিল না আর। মনে মনে অপরাধবোধে চিত্রার মাথা নুইয়ে এলো। লোকটা তাহলে হসপিটালে যেত রাতে! সে কখনো দেখেনি! দেখবেই বা কীভাবে? ঘুমের ইনজেকশন তাকে যে রাত জাগতে দিত না। চিত্রার ভাবনা ছেদ করে বাহারের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“রঙ্গনা, প্রেমের অপর নাম কী জানো? প্রেমের অপর নাম হলো- যন্ত্রণা। যা তুমি তুমুল আবেগে লুটেপুটে নিচ্ছ আর আমিও দান করছি। যন্ত্রণায় ভেতরটা ক্ষত হচ্ছে, তবুও প্রেমিক ছাড়ছ না কেন, মেয়ে?”

চিত্রা এবার আর প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হলো না, বরং হাসল। খোলা রাস্তায় হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে গেলে তাদের শরীর। চিত্রা মায়াময় চোখে চাইল বাহারের প্রশ্নে। নিখাদ কণ্ঠে বলল,
“আমার বোধহয় কেবল প্রেম নয়, ভালোবাসাও আপনি।”

“যন্ত্রণা তোমার এত প্রিয়?”

“উহু, আপনি আমার এত প্রিয়।”

“এই পৃথিবীতে হাজার খানেক ঋণ না থাকলে, যন্ত্রণার বাহার তোমার হতো, মেয়ে। অথচ সম্পর্কের ঋণে আজ তোমার প্রিয় পুরুষ দেউলিয়া হয়ে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। তাই যন্ত্রণাই হতে পারবে সে, মলম আর হয়তো হতে পারবে না।”

চিত্রা বিচলিত হলো বাহারের কথায়। কিছু বলার আগেই বাহার আলগোছে তার হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখল। গুনগুনিয়ে সুর তুলল,
“আমি গলা বেচে খাবো
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না,
কারো একদিন হবো
কারো এক রাত হব
এর বেশি কারো রুচি হবে না।

আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না…

রঙ্গনা, আমি তোমার যন্ত্রণা হয়ে থেকে যাব। ভুলে যাবে না তো আমায়? আমায় ভালোবাসা ছেড়ে দিবে কী?”

এই প্রশ্ন করা বাহার ভাইকে চিত্রার কাছে বড়ো অসহায় ঠেকল। মানুষটা কী ভেতর ভেতর ভেঙে গেছে?

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২১.

ক্লান্ত রজনী। ফুরিয়ে আসা দিনের বিজ্ঞাপন নিয়ে পথে নেমেছে নিবিড় রাত্রি। চিত্রার একা বসে থাকা তেপায়া যানটা এসে থেমেছে তাদের বাড়ির সামনেটায়। সাথে চিত্রার মলিন একাকীত্ব এবং পেছন ফেলে আসা প্রিয় প্রেমিকের স্মৃতিও এসেছে তার সাথে। রিকশা থেকে নামতেই এলাকার কোণায় কোণায় জ্বলতে থাকা হলুদ বাল্বের কল্যাণে আলোকিত পথটার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তার ভাইকে। কেবল ভাইজান একা নয়, একটু গাঢ় চোখে তাকাতেই খেয়াল করল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার আব্বু আর বড়ো আব্বু। মৃন্ময় ভাইয়াকেও দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিং এর মূল গেইটের সামনে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন বোন। চিত্রা রিকশা থেকে নামতেই সকলের ধ্যান যেন তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। বিস্মিত, হতভম্ব দৃষ্টি সকলের। সবার এই তাজ্জব দৃষ্টি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ছড়িয়ে যেতেই চিত্রার মনে হলো রাত ঘন হয়েছে অথচ সে অবলীলায় বাড়ির বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বাড়ির মানুষ গুলো কী তার চিন্তাতেই বাহির হয়েছে! চিত্রার দুরুদুরু বুকে প্রশ্নের স্তূপ। সেই স্তূপ চাপা দিয়েই সে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। ততক্ষণে তার বাড়ির সকলে ছুটে চলে এসেছে তার সামনে। চিত্রা রিকশা থেকে নামতে দেরি অথচ সশব্দে তার গালে চ ড় পড়তে দেরি হলো না। ভয়ানক চ ড়ে মেয়েটার চোখ-মুখ অন্ধকার করে এলো। চোখের সামনে আঁধার করে যেন পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠল। চিত্রা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়ন যুগল মেলে সামনে তাকাতেই নিজের বাবার অগ্নি দৃষ্টির ভয়ঙ্কর দাবানলে ঝলসে গেল তার চিত্ত। সে গালে হাত দিল, ভীত নয়ন নত করল। সাথে সাথে ভেসে এলো নুরুল সওদাগরের ভয়ঙ্কর হুঙ্কার,
“রাত-বিরাতে না বলে বাসা থেকে উধাও হয়ে গেছো যেহেতু, সেহেতু ফিরে আসার কী প্রয়োজন ছিল? ফিরে না আসলেই তো পারতে। ফিরে এলে কেন? হ্যাঁ?”

চিত্রাদের বিল্ডিং-এর আশেপাশের বিল্ডিং গুলোর বন্ধ থাকা প্রত্যেক রুমে আলো জ্বলে উঠল। প্রায় সবাই জানালা-দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বুঝার চেষ্টা শুরু করল কি হচ্ছে নিচে। আর ইতিমধ্যে যারা জেনেছে চিত্রার নিখোঁজের খবরটা তারা বলাবলি করছে কি যেন! তুহিন ছুটে এলো বোনের সামনে, আগলে দাঁড়াল বোনকে। ছেলেটার চোখ-মুখও রাগে লাল হয়ে গেছে। আশেপাশে তাকিয়েই সে রাগ সংবরণ করল, দাঁত কিড়মিড় করে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনার বুঝতে হবে যে সব জায়গায় সিনক্রিয়েট করা উচিৎ নয়। বয়সটা কী এমনেই হয়েছে?”

নুরুল সওদাগরের চেহারায় ক্রোধ নেমে গিয়ে ভর করল অবাক। সে তাজ্জব বনে গিয়ে বলল,
“কী বলছো তুমি এসব? তোমাদের আশকারার কারণে আজ ও মাথায় উঠেছে। তোমরা তা বুজছো না।”

“আশকারা যেহেতু আমরা দিয়েছি, শাসনও আমরাই করব। আপনি যেহেতু স্নেহের বেলায় উদাসীন সেহেতু শাসনের বেলায় এগিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন নেই।”

নুরুল সওদাগর আরেকটি ভয়ঙ্কর ধমক দেওয়ার জন্য মুখ খোলার প্রস্তুতি নিতেই তাকে থামিয়ে দিলেন আফজাল সওদাগর। গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“নুরু, বাড়ির সম্মান নিয়ে রাস্তায় মজা উড়ানোর কাজ তোকে মানায় না। আর বাড়ির মেয়ের গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না জানার পরও কাজটা কীভাবে করেছিস? আর একটা কথাও বাড়াবি না। যা কথা বলার, বাড়ির ভেতরে হবে।”

ভাইয়ের কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা নেই নুরুল সওদাগরের। তাই সে চুপ হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ পাশের বিল্ডিং থেকে একটি ধারাল কটুক্তি ধেয়ে এলো,
“সওদাগর বাড়ির মেয়েদের তো ভালো গুণ! কেউ রাত-বিরেতে ভাইরাল হচ্ছে, কেউবা ঘর ছাড়ছে। বাহ্! একেকজন খুব গুণী।”

কটুক্তিটা বেশ ভয়ঙ্কর ভাবেই তেড়ে এসে হামলে পড়ল যেন সওদাগর বাড়ির সম্মানের উপর। সবচেয়ে বেশি আঘাত করল চাঁদনীকে। যে মেয়েটা সারাটি জীবন সম্মান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল আজ তার সম্মান নিয়েই টানা-হেঁচড়া হচ্ছে খোলা রাস্তায়। মৃন্ময়ও তড়িৎ গতিতে চাঁদনীর দিকে চাইল কথাটি শুনে। মেয়েটা সদর দরজার ভেতর আরেকটু যেন আড়াল হয়ে গেল। হয়তো লজ্জায়! মৃন্ময়ের রাগ উঠল, হুঙ্কার দিয়ে উঠল কটুক্তি করা মানুষটির উপর। বেশ ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলল,
“সওদাগর বাড়ির কে কি করছে তা না দেখে, আপনার বাড়ির কে কি করছে তা দেখেন আন্টি। সওদাগর বাড়ি ভাইরাল হলেও মুখে চুন কালি মাখার মতন কিছু করেনি। অথচ আপনাদের এমন অনেক কাহিনী আছে যা ভাইরাল হলে আপনাদের মরা ছাড়া উপায় নেই।”

মৃন্ময়ের জবাবেই সকলের মুখ বন্ধ করতে যথেষ্ট ছিল৷ আশেপাশের বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ লাইট বন্ধ করে ভেতর চলে গেলো। কেউবা রয়ে গেলো শেষপর্যন্ত মজা দেখার লোভে। চাঁদনী ছুটে ভেতর চলে গেলো। আফজাল সওদাগর মৃন্ময়কে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না।

নিষ্ঠুর রজনী গাঢ় হলো, সাথে গাঢ় হলো সওদাগর বাড়ির আলোচনা। একেক জনের একেক রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হলো চিত্রা কিন্তু উত্তরে সে ছিল উদাসীন, ভাবুক, নিশ্চুপ। অবশেষে কথা বললেন মনোয়ারা বেগম। চিত্রার সম্মুখীন হয়ে রাশভারী কণ্ঠে শুধালেন,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কাউকে না বলে?”

আর সবাইকে তোয়াক্কা না করলেও দাদীকে অসম্মান করার ইচ্ছে নেই চিত্রার। তাই ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
“আমার একা একা ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই ভেবেছিলাম বাহির থেকে হেঁটে আসি। হাঁটতে হাঁটতে একটি জায়গায় বসলাম, অথচ এতটা সময় কেটে গেল টেরই পাইনি।”

চিত্রার সাজানো মিথ্যে উত্তরটা গ্রহণীয় হলো তা সকলের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও দাদী থেমে নেই, বরং নিজের ছেলেদের উদ্দেশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“আফজাল, নুরু, আমজাদ….. তোমরা তোমাদের সন্তানদের, বিশেষ করে মেয়েদের এত আহ্লাদ আর স্বাধীনতা দিয়েছ যে তারা তোমাদের সম্মান নিয়ে ভাবছে না। আফজাল তো তার মেয়েকে দেশ ছাড়া করে স্বাধীনতার পথ আরও সুদীর্ঘ করেছেই, তাকে আর আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু নুরু আর আমজাদ, তোমরা শক্ত হাতে হাল ধরো। যদিও অহিকে কখনো অস্বাস্থ্যকর কিছু করতে দেখিনি তবুও, এ পরিবেশে থাকলে অস্বাভাবিক হতে সময় লাগবে না। প্রত্যেকের বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ের তোরজোর করো। নাহয় একজন ধরা পড়েছে রাতে এক ছেলের সাথে, আরেকজন না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, এরপর কী হবে আমি ভাবতে পারছি না।”

আবারও কথার তীর চাঁদনীর বুকে এসে ক্ষত বাড়িয়ে দিল তার দ্বিগুণ। সে দাঁত মুখ শক্ত করে রাখল যেন তার দুর্বল সত্তা খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে না আসে। চিত্রাও অসহায় দৃষ্টিতে চাইল বোনের পানে। তার জন্যই আজ বার বার আপাটাকে মানুষ আকারে-ইঙ্গিতে কথা শোনাচ্ছে। কিন্তু দমে গেলেন না মুনিয়া বেগম, বরং মেয়েদের দেয়াল হয়ে কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বললেন,
“একটা মানুষের সারাদিন ঘরবন্দী জীবন ভালো না-ই লাগতে পারে, তাই বলে তাকে বিয়ে দিতে হবে আরও হেনতেন বলার কোনো মানে নেই। তাছাড়া চাঁদনীকেও কথায় কথায় টানার কোনো কারণ দেখিনা। রাত-বিরেতে ভাইরাল হওয়াটা ছিল ওর ভাগ্যের নির্মমতা, কিন্তু ওর চরিত্র এখনো দাগহীন আমি জানি। ঘরের মানুষই যদি দুর্বলতায় আঘাত করি তাহলে বাহিরের মানুষ আমাদের ছেড়ে কথা বলবে?”

মনোয়ারা বেগম তার পুত্রবধূর উপর ক্ষুব্ধ হলেন। কিছুটা রাগী কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে এ বাড়ির বউ করে আনাটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল।”

“সত্যিই তাই। আপনার ভুলের জন্য আমাকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ভুল একজনের আর আফসোসের জীবন কাটছে আরেকজনের। হাহ্! সবই ভাগ্য।”

মুনিয়া বেগমের মোক্ষম যুক্তির পরে হতবিহ্বল মনোয়ারা বেগম। নুরুল সওদাগরও সরু চোখে স্ত্রীর পানে চাইল। আর বাকিদের ঠোঁটে মিটমিট হাসি ছড়িয়ে গেল। দাদীকে এমন জবাব না দিল৷ তিনি চুপ হতেন না আর একমাত্র এই মানুষটি ছাড়া কেউ এমন জবাব দিতেও পারত না। মায়ের প্রতি ভালোবাসা চিত্রার দ্বিগুণ বাড়ল। বাবা তাকে অবিশ্বাস করলেও মা তাকে কত বিশ্বাস করে! বড়ো চাচীর মতন মা অবুঝ নয়। সন্তানকে আঘাত করেন না তিনি! সেই আলোচনার ইতি ঘটল সেখানেই।

_

অহির ব্যস্ত পা জোড়া নির্নিমেষ ছুটছে। আজ ইম্পর্ট্যান্ট একটি ক্লাস আছে অথচ ঢাকা শহরের জ্যামের জন্য তার বুঝি সেই ক্লাস আর করা হলো না! রিকশা একাধারে জ্যামে আটকে থাকায় সে পায়েই হাঁটা শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি তো পৌঁছানো যাবে। বড়ো রাস্তা ছেড়ে গলি ধরল সে। সূর্যের তেজ মাথার উপর তখন বাড়ছে। রোদে চোখ ঝিমিয়ে আসতেই তার মাথার উপর ছাতা তুলে ধরল কেউ। অহি অবাক হলো, বিস্মিত ভঙ্গিতে পাশ ফিরে চাইতেই দেখল ফর্মাল পোশাকে হাসছে এক সুপুরুষ। পুরুষটির হাসি ছড়িয়ে গেল অহির ঠোঁট অব্দি। মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,
“আরে, হুমুর বাপ যে! কী খবর শুনি?”

নওশাদের হাসির আরেকটু প্রশস্ত হলো। গা দুলিয়ে হেসে বলল,
“কোনো খবর নেই আপাতত। আপনি দু’কদম এগিয়ে এলে সম্ভবত নতুন কোনো খবর হয়তো তৈরী হবে।”

অহি ভ্রু জোরা কুঁচকাল, সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “কোন আগানোর কথা বলছেন?”

“যে আগানোতে আপনার সাথে হুমুর দেখা হবে। এই তো সামনে আমার গাড়ি। হুমু সেখানেই আছে। আসুন। এই আগানোর কথাই বললাম। অন্যকিছু ভাববেন না, ম্যাডাম।”

নওশাদের দুষ্টু কণ্ঠে হেসে উঠল অহি। মাথা দুলাতে দুলাতে বলল,
“আমার সাথে চালাকি? সাইকোলজির স্টুডেন্ট আমি। সব বুঝি, হুহ্৷”

“মন বুঝেন তো?”

নওশাদের গাঢ় ইশারায় অহি মাথা ঘুরিয়ে ফেলে। লোকটা লজ্জা দিচ্ছে আজকাল।

_

ধরায় তুমুল সূর্যের তাপ দেওয়ার পর গগন এখন শান্ত। গুরু-গম্ভীর ভাবে ডেকে উঠছে সে কিছুক্ষণ বাদে বাদে। চিত্রা উদাসীন চোখে সেই আঁধার আকাশ দেখছে। আজকাল তার আকাশ দেখতে ভালো লাগে। কেমন মন ভালো হয়ে যায় সেখানে চাইলে! চিত্রার ধ্যানের মাঝেই গগন চিরে বেরিয়ে এলো বৃষ্টির বিন্দু। শীতল করল ধরা। শান্তি, স্বস্তিতে ভোরে উঠল প্রকৃতি। বৃষ্টির ফোঁটায় ভেসে এলো অতীত। বেজে উঠল ব্যাথার সুর। আগে বৃষ্টি নামলেই চিত্রা আর বনফুল পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়তো। হৈচৈ করে ভিজতো অনেকক্ষণ। কী আনন্দ ছিল তখন! তখন চিত্রা দুঃখ চিনতো। অথচ আজ….!

চিত্রার বুক ভার করা অতীত বিশ্লেষণের মাঝেই পথ হতে বহু পুরোনো সেই খিল খিল হাসির হুঙ্কার শোনা গেলো। যেই হাসিতে মুগ্ধ হলো আকাশ, বাতাস, পাতাল ও পৃথিবী। মুগ্ধ হলো বন্ধুত্বের বীজ। চিত্রা বনফুলকে ভিজতে দেখে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলে নিচে। কারো ডাক শুনল না, বাঁধন মানল না। এই বুঝি বন্ধুত্ব তাকে দু-হাত মেলে ডাকছে। এখন আর কোনো পিছুটান তার জন্য নয়। আনন্দের রথে করে যখন চিত্রার সকল সুখ ফিরে এলো ঠিক তখনই থেমে গেল চিত্রা। মেইন গেইটটার সামনে এসে থামকে গেল পা। আজ বনফুল একা ভিজছে না, তার সঙ্গী হয়েছে নতুন। চিত্রার জায়গায় আজ নোঙর নামক মেয়েটির অবস্থান। দু’জনেই আনন্দে হাসছে। চিত্রা ড্যাবড্যাব করে সেই দৃশ্য দেখল। বুকের ভেতর তাজা ক্ষত। চোখে অশ্রুদের ভীড়। ভগ্নাবশেষ মনটুকু নিয়ে ফিরে যেতে নিলেই তার হাত আঁকড়ে ধরে বাঁধা দিল কেউ৷ চিত্রা থেমে গেল। তার ভাঙা মনটাকে জোরা দিতে দিতে প্রেমিক বলল,
“ভিজবে না, রঙ্গনা? বৃষ্টি না তোমার বড়ো প্রিয়?”

চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বাহার ভাইয়ের নিখাঁদ হাসি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। চিত্রা অভিমানী স্বরে বলল,
“কার সাথে ভিজবো? বনফুলের যে সঙ্গী হয়েছে নতুন।”

বাহার হাসল। ঝাকড়া চুল গুলো এলোমেলো করে বলল,
“কষ্ট পেয়ো না, রঙ্গনা। পৃথিবীর নিয়মই যে এমন! পুরাতন অবহেলা পায় নতুনের উন্মাদনায়। কোনো শূন্যস্থান পৃথিবী অপূর্ণ রাখে না যে! তাই তো আজ আমি তোমার সঙ্গী হলাম। তোমার এটুকু দুঃখের ভার নাহয় আমিই নিলাম কাঁধে। কষ্ট পেয়ো না, মেয়ে। দিনশেষে মানুষ যে বদলাবেই।”

“আমার ভীষণ কষ্ট হয়, বাহার ভাই।”

“তাইতো আমি, তোমার সুখ হয়েছি মেয়ে।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে