#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
১২.
ফোনের অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও চিত্রা ফোনটা নিজের কানেই ধরে রাখলো। তার কর্ণে কেবল প্রতিধ্বনিত হলো একটি কথা “ভালো আর রাখলে কই”! অষ্টাদশীর মনে প্রশ্নদের হামাগুড়ি, সত্যিই কী সে ভালো রাখেনি? অথচ যা ঘটেছে তা তো তার হাতের বাহিরে ছিলো তবে বাহার ভাইয়ের অভিযোগ তার উপর কেন? সে তো ভালো রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিলো অন্যরকম। তাতে সেই-বা কী করতে পারে! অথচ বাহার ভাইটা তার কথা শুনলে তো! বাহার ভাই তো নিজের অভিযোগের ছড়া শুনিয়েই বিচ্ছিন্ন হলো কল থেকে। চিত্রার অসহায়ত্বের কবিতাখানা আর পাঠ করতে দিলো কই!
চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো পুকুরপাড়ের ঘাট হতে। এই গ্রামে তার মোটেও মন টিকছে না। অথচ গ্রাম তার প্রিয় একটি জায়গা। তখন দুপুরের কড়া রোদে তার শরীরে ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। চিত্রা হেলতে দুলতে পুরোনো রাজকীয় বাড়িটায় প্রবেশ করলো। উঠোনের মাঝখানে বিরাট একটা বটগাছ আছে যা মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা। চকচক করছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে নিয়মিত এটা পরিচর্যা করা হয়। পরিচর্যা করাটাও স্বাভাবিক। দাদী যেমন কঠোর ও পরিষ্কার মানুষ, সে অপরিষ্কার জিনিস কখনোই পছন্দ করবেন না। চিত্রা মার্বেল পাথরে খোদাই করা বসার জায়গাটাই গিয়ে বসলো। মনের মাঝে আকাশ-পাতাল ভাবনা নিয়ে পা দুলাতে লাগলো। দুপুরের রোদের মাঝে কিছু মিঠে বাতাসও এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার শরীর। খারাপ লাগছে না। আবহাওয়াটা আরামদায়ক। এই আবহাওয়ায় খারাপ করে থাকা যায় না। দুপুরের সকল রোদ যেন শুষে নিয়ে যায় দুঃখ।
“এই, তুমি এখানে বসে আছো কেন ভরদুপুরে?”
দাদীর গম্ভীর কণ্ঠে চিত্রার ভাবুক সত্তা কেঁপে উঠলো। আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে ঘুম আসছিল না তো, তাই আরকি….”
“তাই আরকি ভূতের মতন এখন বসে আছো! তোমার কী ক্লান্তি টান্তি লাগে না? সারারাত জেগে এতদূর এলে। ঘুম কী নেই? তোমাদের বাড়িতে যখনই কথা হতো তখনই তো শুনতাম তুমি কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমাচ্ছো তবে এখানে ঘুমাচ্ছো না কেন?”
চিত্রা উত্তর দিলো না বৃদ্ধার কথায়। আসলে সচারাচর এমনই হয়, আমরা যাদের পছন্দ করিনা তাদের কোনো ভালো কথাও আমাদের ভালো লাগে না আর ঠেস মারা কথা তো মনে হয় শরীর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু দাদী বয়সে অনেক বড়ো দেখে হজম করতে হয় সে কথা।
চিত্রার নিরবতার মাঝেই আনোয়ারা সওদাগর আবার বললেন,
“যাও ঘরে। দেশ গ্রামে ভূতের অভাব নেই যে তোমাকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও।”
চিত্রা আরও কিছু বলতো কিন্তু থেমে গেলো। দাদীর সাথে কথা বলা মানেই এক কথায় দু’কথা, দু’কথায় তিন কথা করে কথা বাড়বে। এরচেয়ে নিরবতা শ্রেয়।
_
চিত্রা রুমে ঢুকতেই দেখে সকলেই ঘুমে নিমজ্জিত। কেবল জেগে আছে চাঁদনী আপা। খোলা বারান্দার গ্রিল চেপে বাহিরে তাকিয়ে আছে। নাকটা লাল হয়ে আছে। নিশ্চয় কেঁদেছিল। বড় আপার আর কী কাজ! কান্না ছাড়া সে কোনো কাজই করতে পারেনা যেন!
চিত্রা ঘরময় পায়চারী করল। বাহার ভাই কল কেটে দিয়েছে দ্রুত যার কারণে সে জিজ্ঞেসই করতে পারেনি যে বনফুল ঠিক আছে কিনা! অথচ তার ভেতর ভেতর চিন্তায় হাহাকার করছে। বিরক্তিতে তেঁতো অনুভব হচ্ছে অনুভূতি।
চিত্রার পায়চারীতে চাঁদনী আপাও স্থির হয়। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এই চিতাবাঘ, এমন ঘরের মাঝে ছুটোছুটি কেন করছিস? কী সমস্যা?”
চিত্রা থামলো। অসহায় চোখে তাকালো আপার দিকে। তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এমন নাস্তানাবুদ ধরণের পরিস্থিতে সে কখনো পড়েনি। তাই জানা নেই এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়। তার উপর চিন্তারা পেয়ে বসেছে আহ্লাদ। এবার বোধহয় বুক ভার করে জমেছে কান্না।
চাঁদনী বোধহয় বুঝলো তার বোন কিছু নিয়ে ভীষণ টানাপোড়েনে আছে তাই নিজেই এগিয়ে এলো বোনের কাছে। আশ্বস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে আমার চিতাবাঘের? তার এত চিন্তা কিসের শুনি?”
চিত্রা এবার হামলে পড়ল এই ভরসার বক্ষস্থলে। চোখের জমিয়ে রাখা এতক্ষণের অশ্রু গঙ্গা বাঁধ ভেঙে ফেলল। অসহায় ও ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“জানো আপা, কাল যখন এখান থেকে ফোন গেলো? তার কিছুক্ষণ আগেই বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে আমি একটা এম্বুলেন্স বের হতে দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু বলার আগেই দাদীর এমন ঘটনার কথা শুনলাম যে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গেলো। আজ বনফুলকে কল দিলাম ধরলো বাহার ভাই। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেটে দিলো। আমার মনে হচ্ছে বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে। আমি কী করবো, আপা!”
চিত্রার দীর্ঘ কথায় চাঁদনীর কপাল কুঁচকে এলো। চিন্তা নামক রোগটা কিছুটা সংক্রামিত। এটা একজনের মস্তিষ্ক থেকে খুব দ্রুতই আরেকজনের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই নীতি মোতাবেক রোগটা ছুঁয়ে ফেললো চাঁদনীকে। সে হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“তুই এত বড়ো ঘটনা এখন বলছিস, চিত্রা? কী সর্বনাশ কাহিনী হয়ে গিয়েছে আর তুই এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে ছিলিস? এটা ঠিক করিসনি।”
চাঁদনী আপার কথায় চিত্রার অপরাধবোধ যেন বেড়ে গেল তড়তড় করে। কান্নার দাপটও বাড়লো। নিস্তব্ধ কান্নারা এখন শব্দ ছুলো। চাঁদনী দ্রুত মুখ চেপে ধরলো চিত্রার। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“আস্তে আস্তে, চিতাবাঘ! অহি, চেরি ঘুমাচ্ছে। একবার যদি দাদী জানতে পারে তুই তোর বান্ধবীর জন্য হাউমাউ করে কাঁদছিস কী হবে ভাবতে পারিস? হৈচৈ করিস না। হৈচৈ করলে ঝামেলা বাড়বে।”
চিত্রা বহু কষ্ট করে কান্নাদের শব্দগুলো গিলে ফেলল। দু’হাতে চেপে ধরলো মুখ। যেন সেও চায় ঝামেলামুক্ত ভাবে একটা সমাধান। চাঁদনী চিত্রার অসহায়ত্ব দেখে ভরসা দিলো। আশ্বাস দিলো সে কিছু করবে।
_
দুপুরের খাবার টেবিলে জমেছে ভীড়। সওদাগর বাড়ির সকলে একসাথে খেতে বসেছে। এত মানুষ একসাথে বসার পরও কোনো রকমের টু শব্দ অব্দি হচ্ছে না। কেবল শোনা যাচ্ছে বাসনপত্রের খুটখাট শব্দ। একসাথেই খেতে বসেছে সব। খাবার বেড়ে দিচ্ছে বাড়ির কাজের মানুষেরা। চিত্রার খাবার ঠিক যেন গলা দিয়ে নামছে না। এক চিন্তা তার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। খালি চোখে ভেসে উঠছে বনফুলের মুখটা। কী স্নিগ্ধ, সহজ সরল সেই মুখমন্ডল! সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে সে বনফুল! আর এই বনফুলই না-কি গতকাল এমন বিরাট একটা কাজ করে বসেছে! ভালোবাসার মানুষটাকে পাবেনা বলে হাউমাউ করে কেঁদেছে! বিনা কারণে লজ্জায় নুইয়ে থাকা বনফুল কিনা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার লোভে বেহায়া, নির্লজ্জ কথা শুনেছে! মানুষ কী না করে একটু ভালোবাসার জন্য! আহারে ভালোবাসা!
চিত্রার চিন্তিত মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হয়না চাঁদনীর। সাথে সাথে মাথায় আসে বনফুলের ভাবনাও। অতঃপর হাজার দোনোমোনো নিয়ে নিজের বাবা আফজাল সওদাগরকে শুধায়,
“আব্বু, আমরা বাড়ি ফিরবো কবে?”
খাবার পাতে দীর্ঘ নিরবতার সমাপ্তি ঘটলো। সকলে চোখ তুলে তাকালো বনফুলের দিকে। আনোয়ারা সওদাগর পছন্দ করেনা খাবার পাতে কেউ কথা বলুক। অথচ বোনের জন্য চাঁদনী সেই অপছন্দের কাজটাও করলো। সাথে সাথেই দাদীর তীক্ষ্ণ বাণও ভেসে এলো,
“কেন? এটা কী বাড়ি না? বটতলা?”
চাঁদনী থেমে গেলো। দাদী যে এমন কোনো কথা বলবে তা তার আগেই জানা ছিলো। তবুও ভেতর ভেতর একটু লজ্জা ও অপমানও বোধ করলো। চাঁদনী আপার নতজানু মুখটা দেখে মায়া হলো চিত্রার। অতঃপর বোনের পক্ষ ধরে সে বলল,
“দাদী আমিই আপাকে এটা জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম। আসলে কলেজে পরীক্ষার নোটিশ দিয়েছে তো তাই।”
আনোয়ারা সওদাগর কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন চিত্রার দিকে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এখনও মানুষ হলেনা।”
ব্যস্! চিত্রার ও চাঁদনীর সকল সাজানো কথা মালার উপর পানি ঢেলে দিলো এই মহিলা। চিত্রা বলতে পারলো না তার অন্তর জ্বলে যাওয়ার কথা।
_
বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। বনফুলদের ছোটো দু’তালা বাড়িটা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্ত। বাড়ির ভেতরে আজ তত আলো জ্বলানো নেই। করুণ স্বরে কাঁদছে যেন কেউ। সময়টা রাতের দ্বিপ্রহর। ছাঁদ থেকে আবার ভেসে আসছে গিটারের সুর। বৃষ্টির মাঝেও বাড়ির বেপরোয়া ছেলেটা নিজের পছন্দের কাজটা করছে বোধহয়। বাড়ির বাহিরের হলুদ বাল্বটা আজ বন্ধ।
এই মধ্যরাত্তিরে আঁধারের সকল গম্ভীরতা ভেদ করে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো। খুব ব্যস্ত গতিতে পর পর কয়েকবার বাজলো। দরজার ওপাশের মানুষটা বোধহয় বড্ড অধৈর্য। সেই শব্দে ছাঁদ থেকে ছুটে এলো এলোমেলো মানুষটা। আঁধার হাতড়ে দরজা খুলতেই আবছা এক মেয়েলী অবয়ব ভেসে এলো। বাহার সেই অবয়বকে স্বচ্ছ করার জন্য বাহিরের আলো জ্বালালো। হলুদ আলো পড়তেই সিক্ত নারী দেহখানা চোখে ভেসে উঠলো। হলুদ আলোয় অষ্টাদশীর গোল মুখটা চকচক করে উঠতেই বাহার চমকালো। মেয়েটার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। বাহার বিচলিত হলো। মেয়েটার কপালে ব্যস্ত হয়ে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠলো বাহার। অবাক কণ্ঠে বলল,
“এই মেয়ে, এত জ্বর কেন শরীরে? আর এত রাতে কোথা থেকে এলে? তুমি না কাল গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলে? কাঁপছো কেন রঙনা? কি হয়েছে তোমার?”
বাহারের বিচলিত কণ্ঠের বিপরীতে অষ্টাদশী নির্বাক। তার আকাশ ছোঁয়া অসুখ যেন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। কাউকে দেখার অসুখ যে পৃথিবীর দীর্ঘতম অসুখ। জ্বর নিয়ে বাঁচা গেলেও সে অসুখ নিয়ে বাঁচা যায় আদৌও?
#চলবে
#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
১৩.
বাহিরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টির নৃত্যে প্রকৃতি মুগ্ধ। হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে মায়াবী মুখখানি যা পুরুষের সুঠাম হাতের কবলে নিত্যান্তই নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’হাতের আঁজলে যেন ফুটন্ত পদ্ম। কন্যার চক্ষু প্রায় নিভু নিভু। শরীর থেকে অসহনীয় একটা উত্তাপ বের হচ্ছে। সেই তাপেই ঘোর নেমেছে চোখে। মস্তিষ্ক ফাঁকা অনুভব হচ্ছে। প্রেমিকের চিত্ত তা দেখে উন্মাদ প্রায়। ছটফটিয়ে উঠছে প্রেম পায়রা। চিন্তিত চেহারায় কয়েক ভাঁজ পড়লো। আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক আছো রঙ্গনা! ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”
“শরীরের উত্তাপ দেখছেন আর মনের উত্তাপ লাগছে না বুঝি? ওটা ছুঁয়ে দেখা যায় না বলে কী ব্যাথা কম না তাপ কম? শুনি?”
চিত্রার বেসামাল কথায় বাহারের চিন্তা বাড়লো। গালে কোমল ভাবে ছুঁয়ে বলল,
“ভেতরে আসো দ্রুত। এত জ্বর নিয়ে ভিজেছো কেন? আর এত রাতে এখানে এসেছোই বা কীভাবে? ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার পথ তো অনেক! অনেক দূরত্ব রাস্তার।”
“দূরত্বের চেয়ে গুরুত্ব বেশি ভূমিকা রেখেছে। তাই তো দূরের পথও ব্যাপার নয়।”
চিত্রার কণ্ঠস্বর প্রায় জড়িয়ে আসছে। বাহার যখন অথৈয় ভাবনায় দিক ভ্রষ্ট তখনই চিত্রার পাশে এসে উপস্থিত হলো চিত্রার বটবৃক্ষের ন্যায় বড়ো ভাই- তুহিন। তার চোখে-মুখেও একটা চিন্তা লেপটানো। বাহার অবাক হলো তুহিনকে পাশে দেখে। প্রায় বিস্মিত কণ্ঠেই বলল,
“তুহিন, তুমি এসেছো! তোমরা সবাই কী চলে এসেছো? আর এত রাতে চলে আসার কারণ কী? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“সমস্যা তো আপনার সামনেই দাঁড়ানো, বাহার ভাই। ওর জন্যই তো এত রাতে আমার ফিরতে হলো এখানে।”
তুহিনের কথায় ভ্রু কুঁচকালো বাহার। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো চিত্রার পানে। কিছুটা সংশয় নিয়েই বলল,
“মেয়েটার তো জ্বর শরীরে। তার উপর ভিজেছে। কী বাজে অবস্থা ওর। লাল হয়ে গেছে মুখটা। কি এমন হয়েছে যে এই রাতে ফিরলে?”
বাহারের কথায় তুহিন তপ্ত একটা শ্বাস ফেলল। প্রায় অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে বলল,
“দোষ অবশ্য আমারই। সেদিন বনফুলের সাথে এত খারাপ আচরণ করে একবারও জানতে চাইলাম না মেয়েটার অবস্থা কী। অবশ্য সুযোগই পেলাম না। সেদিন রাতেই দাদীর গুরুতর অবস্থা শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। গতকাল খাবার টেবিলে চিত্রা আর চাঁদনী আপু হুট করে বলছে চিত্রার নাকি পরীক্ষা সে ঢাকায় আসবে। কিন্তু দাদীকে তো চেনেনই, বড্ড কঠোর। সে চিত্রাকে আসতে দিবে না। তারপরই বিকেল থেকে মেয়েটার জ্বর। ধীরে ধীরে জ্বর বাড়তে লাগলো। সেই গ্রামের বাড়িতে রাত একটা বাজে ডাক্তার ডাকা হলো। চিত্রা বেহুঁশ অবস্থায় কেবল বলছিল, ঢাকা আসবে। ডাক্তার জানালেন জ্বরটা ঋতু ভিত্তিক না, অতিরিক চিন্তার ফলে মস্তিষ্কে প্রেশার পড়াতে এই জ্বরের সৃষ্টি। ডাক্তার ওষুধ দিলেন কিন্তু জ্বর কমার নাম নেই। আজ সারাদিন সে কোনো খাবার মুখে তুলেনি। তার এক আবদার, সে বাসায় আসবে। কিন্তু দাদী এক কথার মানুষ, সে চিত্রাকে এ অবস্থায় কোনো রকমে ঢাকায় আসতে দিবেনা। অতঃপর আমি আর না পেরে তাকে আশ্বাস দিলাম আমি নিয়ে আসবো ওরে। সবাই যখন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমালো তখন ওরে নিয়ে রওনা হলাম সাথে চাঁদনি আপুও আসছে। তিনজন কাউকে না বলে চলে আসলাম। কাল একটা তুলকালাম হবে হয়তো। মেয়েটা বকাও খাবে। কিন্তু ওর জেদের কাছে আমরা পরাজিত। ও নাকি বনফুলকে যে কোনো মূল্যে দেখবে। নাহয় শান্তি পাবেনা।”
বাহার দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। চিত্রাও বাহারের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তন্মধ্যেই দক্ষিণ দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বনফুল। দু’দিনেই মেয়েটার লাবণ্য কমে গিয়েছে শতগুণ। চোখের নিচে দেখা দিয়েছে ক্লান্তির চিহ্ন, ডান হাতের মাঝে ব্যান্ডেজের ছোঁয়া যেন বুঝিয়ে দিলো মেয়েটার ভেঙে পড়ার মাপকাঠি। চিত্রা চোখ তুলে তাকালো, চোখ উপচে আসছে তার অবাধ্য অশ্রুরা। সে আর অপেক্ষা করলো না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বনফুলকে। বাচ্চাদের মতন মুহূর্তেই কেঁদে দিলো সে। বনফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে দাঁড়ানো সুঠামদেহী প্রিয় পুরুষের দিকে। বাহার খেয়াল করলো বোনের দৃষ্টি। মেয়েটা তো এ দুদিন উন্মাদের মতন করেছিল, আজও না আবার তেমন কিছু করে বসে! গা হীম হয়ে আসে তার। চিত্রার সাথে না আবার হিংস্রতা দেখিয়ে ফেলে! মেয়েটা যে তাহলে মানতে পারবে না। বনফুলকে চিত্রা কতটা ভালোবাসে তা কারোই অজানা নয়।
বাহারকে অবাক করে দিয়ে বনফুল চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টি হেসে বলল,
“কাঁদছিস কেন চিতাবাঘ? কী হয়েছে তোর?”
চিত্রা আরও শক্ত করে বনফুলকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার কণ্ঠ জড়িয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“বনফুল, তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো?”
“ক্ষমার কথা আসছে কোথা থেকে চিতাবাঘ? তোর সাথে কী আমার সেই সম্পর্ক?”
চিত্রা মাথা তুললো। বনফুলের ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো ছুঁয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন, বনফুল? কী হয়েছে তোর?”
চিত্রার প্রশ্ন পুরোপুরি এড়িয়ে গেল বনফুল,
“তোর শরীর তো মারাত্মক গরম, চিতাবাঘ? শীতে কাঁপছিস। এই অবস্থা কেন শরীরে!”
চিত্রা উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। বনফুল শক্ত হাতে আগলে ধরলো মেয়েটাকে। ছুটে এলো বাহার আর তুহিনও। বোনকে জাপটে ধরলো ভাই পরম যত্নে। ক্রমশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“চিত্রা, এই চিত্রা, কী হয়েছে তোর? কী হলো তোর? চিত্রা, শোন বাবু, কি হয়েছে তোর? ভাইকে বল।”
চিত্রা ততক্ষণে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। জ্ঞান নেই এক ফোঁটাও। এত হৈচৈ শুনে ছুটে এলেন বাহারের মা আয়েশা খাতুন। চিত্রা আর তুহিনকে দেখেই আয়েশা খাতুনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো কিন্তু চিন্তার একটা স্বচ্ছ রেখা গেল তার মুখ জুড়ে। সে ছুটে এলেন চিত্রার কাছে। চিত্রার গালে ছোটো চ ড় দিয়ে বার কয়েক ডাকলেনও মেয়েটাকে। কিন্তু ওর হুশ নেই। আয়েশা খাতুন ছুটে পানি নিয়ে এলেন কয়েক বার চোখ মুখে ছিটালেনও। তবুও ভাবান্তর ঘটেনা মেয়েটার। আয়েশা খাতুন গম্ভীর স্বরে বলে,
“ওকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডাকো। ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”
_
তুমুল বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়। ছেলেটার চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। কতক্ষণ যাবতই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছেও না আবার চাঁদনীকেও যেতে দিচ্ছেনা। এক পর্যায়ে বিরক্ত হলো চাঁদনী, কিছুটা ধমকে বললো,
“মৃন্ময় সমস্যা কী তোমার? এত রাতে রাস্তাতে কী তোমার? আর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“আপনাকে আগলাতে পারছি না বলেই পথ আগলাচ্ছি।”
“উল্টোপাল্টা কথা বলে চ ড় খেও না মৃন্ময়।”
“সোজা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ বলো।”
মৃন্ময় কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হুট করে বললো,“ভাইয়ার মতন আমায় ভালোবাসবেন?”
কথা শেষ করতেই চাঁদনী সশব্দে একটা চ ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে।
#চলবে