প্রেমের মেলা পর্ব-০৩

0
344

#প্রেমের_মেলা
পর্ব: [ ৩ ]
#বর্ষা

দিনটা ভয়ে ভয়ে কাটায় ইনায়া।জানালার ধার থেকে একবারের জন্যও সরেনি সে।ইশান,রুমানা,আশিক বহুবার কল করেছে।রিসিভ করেনি ইনায়া।মনে যে ভয় জেঁকেছে তখন কি আর কথা বলার অবস্থা থাকে! রাত্রিবেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে পাপাইয়ের সাথে কথা বলে নেয় সে।সকালবেলা ড্রপ করলেও কোনো এক কারণে ফ্লাইট লেইট করেছিলো।তাইতো পৌঁছাতেও দেরি হওয়া!

নিজেকে ধাতস্থ করে ডিনার সেরে মোবাইল হাতে নেয় ইনায়া।প্রথমে ইশানকে কল দেয়।প্রথম দুইবার মিস হয়ে যায় কল।তাই রাগে আর ওকে কল না দিয়ে রুমানা আর আশিককে কল দিয়ে কথা বলে নেয়।আজকে ভার্সিটিতে না যাওয়ায় ওরা অনেক প্রশ্নই করে।তবে ইনায়া তা এড়িয়ে যায়।পাপাই ছাড়া কারো সাথেই কোনো গোপন কথা শেয়ার করার অভ্যাস তার নেই।

রাত এগারোটার দিকে ইনায়া আবারো ইশানকে কল দেয়।এবার কল ধরতেই ইনায়া নিজের ধমকানি শুরু করে।তবে ওপাশের মেয়েলী ধমকে থতমত খেয়ে যায় ইনায়া।

”এই মেয়ে এতো রাতে ফোন দিয়ে আমার ছেলেকে ধমকাচ্ছো কে তুমি?”

ইনায়ার ধমকে যতটা না খারাপ লেগেছিলো তার চেয়েও বেশি খারাপ লেগেছে ‘আমার ছেলে ‘বলা শব্দটায়। কেননা আমরা যে জিনিসটা পাইনা সেই জিনিসটা অন্য কেউ পাচ্ছে তা আমরা সহ্যও করতে পারি না।ইনায়ারও তেমনি হচ্ছে। তবুও নিজেকে স্থির রেখে বললো,

”সরি,ইশান আমার ফ্রেন্ড তো তাই এভাবে কথা বলেছি।ও আমাকে অনেকবার কল দিয়েছিলো তবে ব্যস্ততার কারণে ধরতে পারিনি।তাই কল করেছিলাম ”

”ইশান‌ ঘুমিয়ে পড়েছে।আর ওর ফোন আমার কাছে।কেউ যদি দুইবার কল দেওয়ার পরও রিসিভ না করে এর মানে সে ব্যস্ত নয়তো কল ধরার অবস্থায় নেই।তাই দ্বিতীয়বার ফোন দিয়ে ডিস্ট্রাব করো না।”

ইনায়া ফোন কেটে দেয়।কান্নায় ভেঙে পড়ে।সে তো পিপির কাছে শুনেছিলো তার মা অনেক কিউট।তবে কেন তার মায়ের ব্যবহার অপরিচিতদের সাথে এতো রুক্ষ।ফোন কেটে মায়ের ভালোবাসার পূর্ণতার জন্য ”এমেলি মির্জা ”দিয়ে সেভ করা নাম্বারে কল দেয় ইনায়া।

”আসসালামু আলাইকুম পিপি,কেমন আছো?”

”আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস পুচকি?”

”আলহামদুল্লিলাহ।পিপি ওই একটা প্রশ্ন করি?”

”পুচকি তোর জ্বর হয়েছে কি নাকি তুই অসুস্থ!”

”আমি তো সুস্থ!এমন কেন‌ জিজ্ঞেস করছো পিপি?”

”না মানে আমার পুচকি আদৌ কখনো কারো কথা মেনে কিছু করেছে নাকি আপনদের সাথে ফর্মালিটি করেছে তা তো আমার মনে পড়ছে না!তবে আজ কেন?”

”সরি পিপি। আচ্ছা পিপি তুমি তো বলেছিলে মাম্মাম অনেক কিউট তাই না?”

”হুম ভাবিপু তো অনেক কিউট।কেন?”

”আমাকে মায়ের গল্প শোনাবে।”

”তোর পাপাইকে তুই যদি না জানাস তবে বলবো!”

”আচ্ছা বলবো না”

”তাই”

”আমি জানিয়ে দিবো”

”প্রথমে না বললি জানাবি না”

”তাহলে আবারো জিজ্ঞেস করছো কেন?একবার তো বলেছি জানাবো না”

”ভাবিপুকে আমি আগে থেকেই চিনতাম।ভাইয়ের সাথেই তো পড়তো।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষেই ভাবিপু দেশে গেল।সেখানে নাকি তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।ভাই তো পাগল প্রায়।ভাবিপুও‌ ভাইকে ছাড়া বাঁচবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।ভাই গেল,আমরা সবাই গেলাম।এমনও হয়েছে যে তোর নানা ভাইয়ের কাছে ভাই জেদ ধরে বসেছিলো।তোর মা দরজায় খিল দিয়ে সে কি কান্ড ঘটিয়েছিলো বলার বাইরে।সবাই তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো উল্টা পাল্টা কিছু না করে বসে।যখন তোর নানাভাই রাজি হলো তোর বাবার সাথে তোর মায়ের বিয়ে দিতে।তোর মা দরজা খুললো।ভাই যখন ধমকে বলেছিলো যে এভাবে কেউ দরজায় খিল দেয়।তখন ভাবিপু মুখটা চোখা করে কিউট ফেসে বলেছিলো যে আমি বোকা নই তাইতো খিল দিয়েছিলাম যাতে বাবা তাড়াতাড়ি রাজি হয়!হাহাহা”

ইনায়াও হাসতে থাকলে ওর পিপির সাথে।কার না হাসি পাবে এ ঘটনায়।তবে বলতেই হয় ইনায়ার মা বেশ বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন।ইনায়ার কিঞ্চিত পূর্বের ঘটনা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।কল রেখে শুয়ে পড়ে।

ভোরবেলা সূর্যের কিরণ চোখে লাগতেই ইনায়া উঠে বসে। আলসেমি না করে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।বাসে যাবে ভাবলেও পরক্ষণে মনে পড়ে যায় আশিয়ান দেশে এসেছে।যখন তখন পালানো লাগতে পারে।তাই গাড়ি নিয়েই বেড়িয়ে পড়ে।

ভার্সিটিতে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে কোনো মতে ছুটে গিয়ে ছাপিয়ে পড়ে ইশানের ওপর ইনায়া। ভার্সিটির অধিকাংশই ওদের গফ/বফ মনে করে কেননা দুইজনের পদবী যে আলাদা। আফসোস পিতা-মাতা এক হয়েও তাদের পদবী ভিন্ন হয়েছে।

ইনায়া ভার্সিটির বাইরে আসার সময় কি জানি দেখেছে।তা দেখাতেই ইশানকে সেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। ওদের সামনে হঠাৎ করে ডার্ক ব্লাক কালারের কার ফুল স্পিডে থামে।ইনায়া ইশানকে ঠেলে আগেই পেছনে পাঠিয়ে দিলেও নিজে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয় তবে তার পূর্বেই কেউ দ্রুততার সাথে আগলে নেয় ইনায়া।চোখ খিচে বন্ধ করে রাখলে সামনের ব্যক্তিটির শরীর থেকে আসা মিষ্টি গন্ধে ইনায়া বুঝে ফেলে কে এই ব্যক্তি!বড় বড় করে তাকায়।আশিয়ান চোখ মারে।

ইনায়া ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে নেয় আশিয়ানকে তবে আশিয়ান ইনায়া কোমড় জড়িয়ে আরে কাছে টেনে আনে ওকে। ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা হা হয়ে সব দেখছে।এতো হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে অধিকাংশ মেয়েদের অবস্থা তো টাইট। নিজেদের দিকে এটরাক্ট করার জন্য চুল ঠিক করছে,বারবার হাসছে।তবে আশিয়ানের নজর তার প্রেয়সীতেই নিবদ্ধ।

ইশান ক্ষেপে যায়। কোনো ভাই তার বোনের সাথে এরকম সহ্য করতে পারে না কেননা মানুষ হিসেবে একটা ছেলে যেমনই হোক ভাই হিসেবে সব সময়ই সেরা।ইশান তেতে এগিয়ে যেতে নিলেই আশিয়ান বডিগার্ডদের ইশারা করে।ইশানকে ধরে ফেলে বডিগার্ডরা।ইশান চেঁচিয়ে হুমকি দিতে থাকে তবে কারোই কিছু যেন যায় আসে না তাতে।ইনায়ার সহ্য হয় না ভাইয়ের সাথে করা এরূপ রুদ্র আচরণ।

”মিষ্টার আশিয়ান মির্জা দয়া করে ওদেরকে বলুন ইশানকে ছেড়ে দিতে।প্লিজ।ইশান কষ্ট পাচ্ছে ”

ইনায়ার সামান্য এক কথায় যেন আগুন ধরে যায় আশিয়ানের মস্তিষ্কে।আশিয়ান ইনায়াকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে মেরে ইনায়ার গাল চেপে ধরে নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলে,

”আমার যে এখানে কষ্ট হয় তোমার থেকে দূরে থাকতে তা তুমি বোঝো না?আর ওই ওই ছেলেটার কষ্টে তোমার এতো কষ্ট হয়”

আশিয়ানের কন্ঠে ঘোর লাগা কিছু ছিলো।যা ইনায়ার মাঝেও শীতল বাতাস বইয়ে দেয়।ইনায়া গভীর থেকেও গভীরতর শ্বাস নেয়।আশিয়ান গার্ডদের কিছু ইশারা করে ইনায়াকে নিয়ে গাড়ি করে চলে যায়।ইনায়া মুক্ত হয়েও পালিয়ে যেতে হলুস্থ করে না।শান্ত হয়ে বসে থাকে।

ইনায়াকে নিয়ে চলে যেতেই ইশানকে ছেড়ে দেয় ওরা।ইশান মুক্ত হয়ে ওদের দিকে তেড়ে আসে।তবে ওরা তা পাত্তা না দিয়েই গাড়ি করে চলে যায়। ইশান নিজ ব্যর্থতায় হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। রিনি এসে ইশানকে ধরতে নেয়।তবে ইশান তেজ দেখিয়ে হাত ছিটকে সরিয়ে দেয়।রিনি পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। চেঁচিয়ে বলে,

”আমি তোমার গালফ্রেন্ড হই ইশান।আর তুমি আমার সাথে এমন করছো এই কয়েকদিনের মেয়েটার জন্য ”

”হ্যা হ্যা করছি।কারণ আমি নিজের থেকেও বেশি ওকে ভালোবাসি।আই লাভ হার সো মাচ”

ইশান বাইকে করে চলে যেতে নিলেই আশিক,রুমানা পথ আটকায়।আশিক,রুমানাকে চোখ গড়ানো দিয়ে বলে,

”যখন দেখলি ওরা ইয়ুকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় ছিলি তোরা? নামমাত্রিক বন্ধুতে দেখাতে আসিস!সর তোরা আমার সামনে থেকে ”

রুমানা,আশিক কিছু বলতে চাইলেও ইশান কিছু না বলেই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে যায়।রিনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কলেজ লাইফ থেকে ওদের সম্পর্ক। পারিবারিক ভাবেও বিয়ের কথা ঠিকঠাক হয়ে আছে।আর এখন নাকি ইশান বলছে সে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে!অতি শোকে পাথর হওয়ার মতে হয়ে আছে সে।

”নেমে আসো”

”কোথায় এই জায়গাটা ”

”তুমি চেনো না বিধায় এনেছি।তাই বলবো না জায়গাটা কোথায়।বুঝলে জান”

আশিয়ানের কথায় ইনায়া চুপ হয়ে যায়।এখন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে বলে মনে হচ্ছে ওর।ইনায়া ভেবে পাচ্ছে না তখন ওর কি হয়েছিলো যে ও আশিয়ানের সাথে চলে আসলো।

আশিয়ান ইনায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে নদীর কিনার দিয়ে।ইনায়ার আজ ভয় করছে না একদমই।মনে হচ্ছে কোনো দায়িত্বশীল হাত তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে।ইনায়ার মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে আর আহত করতে পারবে না কেননা তার পাশে যে এমন কেউ আছে যে ইনায়াকে ছাড়া আর কাউকেই বুঝতে চায় না। ইনায়ার মাঝেই নিজেকে খোঁজে!

”ফুচকা খাবা?”

”আনহাইজেনিক ফুড ইনায়া সেহরিশ খান খায় না”

”ও.এম.জি আমি তো জানতাম মেয়েরা আর কিছু না খেলেও ফুচকা দেখলে লাফিয়ে ওঠে খুশিতে। সেখানে তুমি উলটো কথা বলছো”

”ইনায়া সেহরিশ খান সব মেয়েদের মতো না”

”তাইতো আমি তোমাতেই এতো আসক্ত জান”

ইনায়া থেমে যায়।শান্ত দৃষ্টিতে আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

”আপনি আমায় ভালোবাসেন কেন?”

”কে বললো আমি তোমায় ভালোবাসি?”

”ভালো যদি নাই বাসেন তাহলে আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?”

”আমি তোমায় একদমই ভালোবাসি না।আমি তো তোমার মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে।আমি এককথায় আসক্ত তোমাতে!”

আশিয়ান শেষ কথাটা ইনায়ার একদম কাছাকাছি এসে বলে। আশিয়ানের গরম নিঃশ্বাস ইনায়ার মুখশ্রীতে পড়ে।ইনায়া চোখ বন্ধ করে নেয়।কেমন যেন এক অচেনা, অদৃশ্য অনুভূতি তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে