প্রেমরাঙা জলছবি পর্ব-১৪

0
219

#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৪

সুরাইয়া চলে যেতেই আশরাফ আবার বলে ওঠে,“ আম্মা প্লিজ, তিনটা দিনেরই তো ব্যাপার। এর আগে তো সুরাইয়াকে নিয়ে আমি কোথাও যাইনি। আমি চাইলে তোমার অনুমতি ছাড়া অনেককিছুই করতে পারি কিন্তু করি না। আমি চাই সবকিছুই তোমার অনুমতিতে হোক। ”

ময়না বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,“অনেক টাকার ব্যাপার। এতগুলো টাকা জলে ফেলতে আমি দেব না। ”

আশরাফ এবার আন্তরিকতাহীন স্বরে বলে ওঠে,“আম্মা, তোমার মেয়ে নেহা আর তার জামাই কিন্তু বিয়ের দুই মাসের মাথায় কক্সবাজার আর বছর হওয়ার আগেই সাজেক গিয়ে ঘুরে এসেছে। আরও কোথায় কোথায় গিয়েছে কে জানে! মেয়ের সময় উৎসাহ দিতে পারলে ছেলের বেলায় কেন দিতে পারো না? নেহার যদি ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে সুরাইয়ার ইচ্ছে করতে পারে না? আমি বোন আর বউয়ের তুলনা করতে চাইছি না। শুধু এটা বলো তুমি চাও না আমি সুরাইয়ার সাথে ভালো থাকি?”

ময়না বেগম চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠেন,“ দিন দিন তোর গলার জোর বেড়ে যাচ্ছে, আশরাফ।”

আশরাফ মায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,“আমার এখন মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। আমার মনে হয় এখন থেকে তোমার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক হবে না। তোমার বয়স হচ্ছে, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছো না। টিপিক্যাল শাশুড়ির মতো আচরণ করছো। তুমি আমার মা, তোমাকে অসম্ভব রকমের সম্মান করি বিধায় সব ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তকেও সম্মান করি কিন্তু ইদানীং তোমার সিদ্ধান্ত আমার মন খারাপ করে দেয়। তোমার প্রতি আমার সম্মান কমিয়ে দেয়। আমার এই আম্মাকে চাই না আমি। ”

ময়না বেগম ভ্রু কুচকে বলেন,“তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস, আশরাফ?”

আশরাফ মাথানিচু করে বলে,“ তোমাকে অসম্মান করতে হবে এরকম দিন আমার জীবনে না আসুক। শুধু এটুকু বলব তুমি মা হিসেবেও ভালো, শাশুড়ি হিসেবেও ভালো কিন্তু সেটা তোমার মেয়ের জামাইয়ের ক্ষেত্রে, আমার বউয়ের ক্ষেত্রে না। তুমি যেমন আমার মা ঠিক তেমন সুরাইয়া আমার জীবনসঙ্গী। ওকে ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। আমি ওকে নিয়ে বিয়ের এতগুলো বছরে কোথাও যাইনি আমাদের যখন বাচ্চাকাচ্চা হবে তখন আরও সম্ভব হবে না। আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো নিজের বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে, ফিরতে, বাহিরে খেতে যেতে। সুরাইয়া কোনোকিছুর আবদার করে না তাই বলে কি আমার উচিৎ না ওর খেয়াল রাখা? আমি প্রায় সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, আম্মা। তোমার বোনের মেয়ে এসে তিনটা দিন তোমার কাছে থাকবে, আমরা এই তিনটা দিন একটু ঘুরে আসব। ”

ময়না বেগম কিছু বলে ওঠার পূর্বেই আশরাফ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ময়না বেগম আশরাফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন৷ আশরাফ মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। সুরাইয়া চুপচাপ বসে ছিল। আশরাফের উপস্থিতি বুঝতেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

আশরাফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,“খান সাহেব, মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে নেই সেটা তো আপনিই বলেছিলেন তাহলে আজ ছোট্টো একটা কারণে এরকম কেন করলেন? এটা কিন্তু ঠিক হলো না। আপনি তো জানেনই আম্মা একটু ওরকমই।”

আশরাফ সুরাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,“আমি আম্মার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চাই না, সুরাইয়া। তুমি তো দেখেছ আজ অবধি আমি আম্মার সাথে উঁচু গলায় কথা বলিনি কিন্তু আম্মা সেটারই সুযোগ নেয় বারবার।”

সুরাইয়া আশরাফের হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসায়। সে আশরাফের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,“মায়ের মনে কষ্ট দিতে নেই। আপনি তো ভালোভাবে বুঝাতে পারেন তাহলে এভাবে কেন কথা বললেন? আমি পরের মেয়ে আমি প্রতিবাদ করতেই পারি তবে নিজের ছেলে কষ্ট দিলে সেটা অনেক বেশি খারাপ লাগার কথা।”

আশরাফ বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,“আম্মাকে বুঝতে হবে। নিজের মেয়ের ভালো চাওয়ার সাথে নিজের ছেলের বউকেও ভালো রাখা তার দায়িত্ব। ”

“আমার ছেলেকে উস্কে দিয়ে এখন ভালো সাজতেছ? আচ্ছা শয়তান মেয়ে তো তুমি! কী দেখে যে ছোটো ছেলের বান্ধবীকে বড়ো ছেলের বউ বানাতে রাজি হয়েছিলাম আল্লাহ জানে।” কথাগুলো বলতে বলতে ঘরে ঢুকে পড়েন ময়না বেগম। তার কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি বাহিরে থেকে কথাগুলো শুনেছেন।

আশরাফ সুরাইয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে ওঠে,“ সুরাইয়া, তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে তোমার বাসায় রেখে আমি উমেদের কাছে চলে যাব। শহরও ঘুরা হবে। বউকে নিয়ে না ঘুরতে পারলাম, ভাইয়ের সাথে শান্তিতে কিছু মুহূর্ত কাটাতে পারব। তৈরি হয়ে নাও আমি আধাঘণ্টার মধ্যে আসছি। রোজ রোজ এই অশান্তি আমার একদম ভালো লাগে না। বছরের পর বছর বাহিরে খাটা-খাটনি করে তিনটা মাসের জন্য দেশে আসি৷ বউকে নিয়ে তিন-চারটাদিনই যদি বাহিরে ঘুরতে না পারি তাহলে প্রবাসী হয়ে কী করলাম। এবার আর বিদেশ যাব না। দেশে যা পারি তাই করব। টাকা উপার্জন করে যদি সেটা ইচ্ছেমতো খরচই করতে না পারি তাহলে এত টাকা উপার্জন করে কী হবে?”

কথাগুলো বলেই মাকে পাশ কাটিয়ে বাহিরে চলে যায় আশরাফ। ময়না বেগম কঠিনগলায় বলে ওঠেন, “আমার বাড়ি থেকে যাওয়াই ভুল হয়েছিল। এই ক’টা দিনে এই মেয়ে আমার ছেলেকে বশ করে নিয়েছে। ”

সুরাইয়া ময়না বেগমের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলে ওঠে,“ সবকিছুতে আমাকে টানবেন না,আম্মা। আমক আপনার ছেলেকে বলিনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে। আপনার মেয়ের বর যখন আপনার মেয়ের কথা শোনে তখন ফূর্তি লাগে আপনার। হেসে হেসে সবাইকে বলেন যে আপনার মেয়ের জামাই খুব ভালো আর আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে ভাবলে, তাকে বশ করা হয়ে যায়। ”

“তোমাকেও আমি দেখে নেব, কীভাবে ভালো থাকো সেটা দেখে নেব আমি।” সুরাইয়ার দিকে আঙুল উঠিয়ে বলে ওঠেন ময়না বেগম। সেখানে আর না দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
____

হাসপাতালের বাহিরেই কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এশার বাবার সাথে কথা বলছিলেন আজহার রেজা। অ্যাক্সিডেন্টের পর এশাকে হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। এশার যখন মোটামুটি উন্নতি হয়েছিল তখনই সুযোগ বুঝে এস.আই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এশার স্বীকারোক্তি নেওয়ার। তিনি জিদের বশে নিয়েছিলেনও আর তাতে এশার বাবাই রাজি হয়েছিলেন। কারণ এশার চিকিৎসা বন্ধের হুমকি দেয়া হয়েছিল। সত্যিটা না বললে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়া হবে এমন হুমকিতে স্বয়ং এশার বাবা টলে যান নিজের সিদ্ধান্ত থেকে। মেয়েকে রাজি করিয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। তিনি মনে করেছিলেন নিজের মেয়েকে একেবারে হারানোর চেয়ে নির্দিষ্ট সময় পর ফিরে পাওয়া হয়তো ভালো।

সবার কথা চলছিল এমন সময় হৃদিতা হাসপাতালের গেইট পেরিয়ে ভেতরের দিকে চলে আসে। আজহার সাহেব হৃদিতাকে দেখতে বলে ইশারায় সেখানেই দাঁড়িয়ে যেতে বলে।
আরও প্রায় দশ মিনিট কথা চলে সবার মাঝে। কথা শেষে আজহার রেজা বাদে সবাই একে একে বেরিয়ে চলে যায়।

সবাই চলে যেতেই হৃদিতা আজহার রেজার সামনে এসে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে বলে,“ কী হয়েছে স্যার?”

আজহার সাহেব হাতের ফোনটা পকেটে রেখে বলেন,“ এশার অবস্থা খুব খারাপ। জ্ঞান ফিরেনি অথচ তার সাত বছর কারাবাস হয়েছে। ওর ভাইকে গতরাতে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেকটা নিউজ আছে।”

হৃদিতা ভ্রু কুচকে বলে,“ কী, স্যার?”
“ আবরার নিজের দোষ স্বীকার করেছে। সে এশাকে সঙ্গ দিয়েছিল এবং অ্যাক্সিডেন্টটা সাধারণ অ্যাক্সিডেন্ট ছিল না। উনি নিজেই ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য এত বড়ো কান্ড ঘটিয়েছিলেন। আমার তো মাঝেমাঝে আবরার সাহেবকে মেন্টালি সিক টাইপ লাগে।”

হৃদিতা আজহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,“মেন্টালি সিক না হলে কেউ প্রেমিকাকে খু*নের কেস থেকে বাঁচতে সাহায্য করে! আবার সেই প্রেমিকার সাথেকার ঝামেলায় অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে পারে!”

আজহার সাহেব হৃদিতাকে কপাল চুলকে বলে,“ কী যেন জরুরি দরকার ছিল তোমার?”

হৃদিতা হাতের রিজাইন লেটার এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,“স্যার আমি জবটা ছাড়তে চাইছি। ”

আজহার সাহেব কাগজটা হৃদিতার হাত থেকে নিয়ে মৃদু হেসে বলে,“তোমার বাবা আমাকে কল দিয়েছিল। বলেছে সব। চিন্তা কোরো না, আমি অফিসে কথা বলব। ”

হৃদিতা হাফ ছেড়ে বাঁচে। মনে মনে অনেক ভয় পেয়েছিল সে। ভেবেছিল এত তাড়াতাড়ি জব ছাড়ার জন্য অনেক কথা শুনতে হবে তার কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। আজহার সাহেব কথা বলতে বলতে হৃদিতাকে বলে,“চলো ভেতরে সবকিছু শেষবারের মতো দেখে যাও। পরে তো আর এসবে আর নিজেকে জড়াতে পারবে না।”

“জি স্যার। ”

হৃদিতা আজহার রেজার সাথে সাথে ভেতরের দিকে চলে আসে। হাতের বামদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে আজহার সাহেব বলে ওঠেন,“ আবরারকে দেখতে যেতে চাইছিলে? সে লোক তো প্রেমিকার হাত ধরে বেডে শুয়ে আছে। কত কান্ড ঘটিয়ে নিজের বেড এশার বেডের সাথে নিয়েছে। কত কি হয়ে গিয়েছে এই তিনদিনে তুমি জানো না।”

আজহার সাহেবের কথা শুনে হৃদিতা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মনে মনে বলে,“ভালোবাসা এরকমও হয়!”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে