#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৮
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় সৌদিয়া বাস যাত্রা শুরু করলো কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সময়মতো বাস চলতে শুরু করায় নবাব নিজ মনে বলে উঠেছিল, “বাব্বা! একদম সময়মতোই ছেড়েছে দেখছি।”
সৌদিয়া বাসে এয়ারকন্ডিশনারের সুবিধা না থাকায় এখন বাসের জানালাই একমাত্র এয়ারকন্ডিশনারের কাজ দিচ্ছে। বরাবরের মতো জানালার পাশের সিট মিষ্টির দখলে। মিষ্টিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনও এক চিন্তায় আচ্ছন্ন সে। সিটে মাথা এলিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে নির্বিঘ্নে।
আজকের আকাশ আলো শূন্য। সূর্যের থেকে ধার নিয়ে চাঁদ যদিও বা আলোকিত করে বিশ্বপ্রকৃতিকে। কিন্তু আজ ঘোর অমাবস্যায় সেই চাঁদ লুকিয়ে আছে কোনও এক প্রান্তে। তবে পৃথিবী আঁধারে ঢাকা নয়। কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে প্রকৃতি আর বাতাস এসে নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে জানান দিচ্ছে মিষ্টি সুগন্ধ। এত কিছুর ভিড়ে মিষ্টির মনে একটা গান ভেসে উঠলো,
“আজ কেন এ মনে ভালোবাসা
উঁকি দেয় লুকোচুরির মতো।
যদি থাকো এই আমার কাছে
আমি থেকে যাই অবিরত।
সাদা মেঘে বর্ষা তুমি
আমি বৃষ্টি ভেজা রাত।” হঠাৎ এই গানটা মনে পড়তেই আনমনে হেসে উঠলো মিষ্টি আর নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখলো, “এই গান কেন মনে ভাসছে? আজকে তো বৃষ্টিও হচ্ছে না। তবে কেন এই গানের সুর আমার ঠোঁট নাড়াচ্ছে?” এই সব ভাবনার ভিড়ে আচমকা মনের কোণে ভেসে উঠলো সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা।
“এই মিষ্টি, কী করছো?”
বিকাল থেকেই একটানা বৃষ্টি হচ্ছে; ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘ গর্জে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর ভেজা বাতাস রোমাঞ্চিত করছে। একলা ঘরে মিষ্টি এখন ফোনে অবসর সময় পার করছে। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা রেখে দুলিয়ে দিতে ডান পায়ের পায়েলে মৃদু গুঞ্জন উঠছে। হাতে ফোন আর কানে ইয়ারফোন যেখানে মেয়েলি কন্ঠে সুর উঠছে,
“চোখেতে অনেক ছবি ভালো লাগে,
আপন করে পেতে সাধ যে জাগে।
তবু ভালোবাসা ভালো লাগা এক নয়।
ভালোবাসা ভালো লাগা এক নয়।” এই গান শোনবার মাঝেই নবাবের ম্যাসেজের এলো আর আচম্বিতে মিষ্টির মুখে হাসি ফুটলো। প্রায় সাথে সাথেই সে জবাব দিলো, “এই তো, গান শুনছি। তুমি?”
“আমিও গান শুনছি। তা কী গান শুনছো?”
“ভালোবাসা ভালোলাগা এক নয়– কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গান।”
“আগের দিনের গান, না?”
“হুম কিন্তু আমার খুব পছন্দের।” সানন্দে জবাব দিলো মিষ্টি।
“মিষ্টি?” এখন নবাব মিষ্টিকে আর আপু বলে ডাকে না। মিষ্টির প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হতো কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে গিয়ে অভ্যাসে পরিণত হলো। মিষ্টিও ইদানীং নিজের অজান্তে নবাবকে ভাই সম্বোধন করা কমিয়ে দিয়েছে। মানুষের মাঝে অনেক পরিবর্তন হুট করেই আসে, যেখানে তার কোনও হাত থাকে না।
“হুম।” জবাব দিলো মিষ্টি।
“আমি একটা গানের নাম বললে শুনবে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাও। ভালো লাগলে অবশ্যই শুনবো।” জবাব দিয়ে পা দু’খানা চেয়ারের ওপর তুলে ভাঁজ করে বসলো মিষ্টি। চেয়ারে হেলান দিয়ে এবার যেন আরও আরাম বোধ হলো তার।
“আজ কেন এ মনে ভালোবাসা
উঁকি দেয় লুকোচুরির মতো।
যদি থাকো এই আমার কাছে
আমি থেকে যাই অবিরত।” নবাবের ম্যাসেজ পড়তে গিয়ে মিষ্টি একটু হকচকিয়ে গেল। মিষ্টির কারণহীন মনে হলো এই চার বাক্য গান নয়, নবাবের মনের কথা।
“এটা গান?” মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ। শুনে দেখো খুব সুন্দর।”
“ঠিক আছে।” নবাবের কথা মতো মিষ্টি ইউটিউবে গানটা খুঁজতে শুরু করলো আর সেট পেয়ে চটজলদি শুনতে আরম্ভ করলো। একটুখানি শুনেই নবাবকে ম্যাসেজ পাঠালো, “হুম, আসলেই সুন্দর গানটা।”
“হ্যাঁ, একদম তোমার মতো সুন্দর।” নবাবের প্রশংসাসূচক বাক্যে মিষ্টি মৃদু হেসে জবাব দিলো, “ফাজলামি করো না তো। আমি মোটেও সুন্দর না।”
“এই মিষ্টি, এটা কী বললে তুমি?”
“কেন? ভুল কী বললাম?”
“আলবাত ভুল বলেছো। এখন শিগগির সরি বলো আর বলো যে কখনও নিজেকে অসুন্দর বলবে না।”
“দেখো, আমি নিজেকে অসুন্দর বলিনি। বলেছি আমি সুন্দর নই।”
“এতে কোনও তফাৎ আছে? আমি তর্ক করতে চাই না। আমার এক কথা, তুমি নিজেকে এসব বলতে পারবে না। যদি বলো তো।”
“তো?” কৌতূহল প্রকাশ করলো মিষ্টি।
“তাহলে আমি কখনও তোমার সাথে কথা বলবো না।”
“কী বলছো তুমি এসব?” আঁতকে উঠলো মিষ্টি।
“মিষ্টি, আমি সত্যি বলছি। আচ্ছা শোনো, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?”
“হঠাৎ এ কথা কেন জানতে চাইছো?” প্রশ্নটা লিখতে গিয়ে বাইরে মেঘের গর্জন শুনতে পেল মিষ্টি। কিঞ্চিৎ অবাক হওয়ার বিষয়টা এখন ভয়ের রূপ পেল।
“বলো না আমায় বিশ্বাস করো কি না?”
“করি তো। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি।” ম্যাসেজ পাঠিয়ে মিষ্টি অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু নবাব কোনো উত্তর দিচ্ছে না। প্রায় পাঁচ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন জবাব আসছে না, তখন মিষ্টি ফোন রেখে দেওয়ার চিন্তা করলো। কিন্তু হঠাৎ নবাবের ম্যাসেজ এলো আর সেটা পড়তে গিয়ে মিষ্টি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো, “তাহলে সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে আমি যদি বলি আমি তোমায় ভালোবাসি। তবে কি অবিশ্বাস করবে মিষ্টি?”
সশব্দে বিদ্যুৎ চমকালো। এতটা জোরে মেঘ ডাকলো যে মিষ্টি নড়েচড়ে উঠলো। মনের ভেতরেও বিদ্যুৎ চমকেছে আর তাই অতি সাধারণ মেঘের গর্জন তার কাছে ভয়াবহ ঠেকেছে। হৃদয় থমকে দেবে এমন ম্যাসেজ মিষ্টি আশা করেনি নবাবের কাছ থেকে। সে স্পষ্টত বুঝতে পারছে নবাব কীসের ইঙ্গিত করছে। কিন্তু সেটা অতি সহজে বুঝতে দেওয়া বোকামি হবে বিধায় মিষ্টি জবাব দিলো, “বোনকে ভালোবাসো সেটা অবিশ্বাস কেন করবো?”
“মিষ্টি, আমি কিন্তু তোমাকে বোন ভাবা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বন্ধু তুমি আমার। সেটা এখন অন্য সম্পর্কে রূপ নিতে আপত্তি কোথায়? আশা করি অন্য সম্পর্কের মানে তুমি বুঝতে পারছো।”
মিষ্টি সবই বুঝতে পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই মিষ্টি প্রতিবাদ করলো, “ভাই, এমন রসিকতা করো না। এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।” ভাই লিখতে গিয়ে মিষ্টির হাত যেন কেঁপে উঠলো। সে অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এই সম্বোধন করলো আর হৃদয় বলে উঠলো, “ভাই? সম্বোধনটা আজকে মন থেকে আসছে না কেন?”
“আমার সিরিয়াস কথা তোমার রসিকতা মনে হচ্ছে?”
“নয়ত কী? কে বিশ্বাস করবে বলো? কে বিশ্বাস করবে আমার চেয়ে চার বছরের ছোট একটা ছেলে আমাকে…” ম্যাসেজ অসম্পূর্ণ রেখেই পাঠিয়ে দিয়েছে মিষ্টি।
“তোমাকে কী? হুম? ম্যাসেজ পুরোটা লেখোনি কেন? আর ছোট তো কী হয়েছে? ছোট হলে সেটা সমাজের রীতিনীতির বাইরে এমনটা কোথাও উল্লেখ আছে?”
“নাহ, তা নেই।” মিষ্টি অনেকটা সময় নিয়ে জবাব দিলো আর এরচেয়েও বেশি সময় নিয়ে নবাব জবাব পাঠালো, “আমি জানতাম তুমি এসব যুক্তি দেখাবে তাই তো আমিও।” নবাবের এমন ম্যাসেজে মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেল কিন্তু কৌতূহল বোধ জন্মাতে জিজ্ঞেস করলো, “তাই তো কী?”
“মজা করছিলাম তোমার সাথে… হা হা হা।” নবাবের কথায় মিষ্টি এবার অকূলে কূল খুঁজে পেল। হুট করে ওর মাথায় যেসব চিন্তা এসে ভীড় করেছিল তা এখন নিমিষেই মিলিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস হৃদয় থেকে নির্গত হতে হালকা হেসে জবাব দিলো, ” ফাজিল ছেলে। দাঁড়াও তোমার রসিকতার খবর নিচ্ছি। দেখা হোক একবার তোমাকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করবো।” প্রতিত্তোরে নবাব জানালো, “হা হা হা… তুমিও না মিষ্টি বড্ড বোকা। কী সুন্দর করে তোমায় দিলাম ধোঁকা।”
“এই মিষ্টি, ঘুমিয়ে পড়লে?” নবাবের ডাকে সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলো, “নাহ।”
“এই বাসে কি সমস্যা হচ্ছে?” নবাবের প্রশ্নের বিপরীতে মিষ্টি প্রশ্ন করলো, “আমার সবকিছু তুমি এত নিখুঁত করে কেন মনে রাখলে? একটা মূহুর্তও কি তোমার স্মৃতি থেকে বিলীন হয়নি?”
শেভ না করায় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি অনেকটা গজিয়ে গেছে সাথে প্রয়োজনের চেয়ে বড় হওয়া চুল বাসের ঝাঁকুনিতে নেচে উঠছে। ক্যাপ দিয়ে চুল সামলাতে হয়ত নবাবের বিরক্ত লাগছে তাই সেটা খুলে হাতে নিয়ে বসে আছে। মিষ্টির প্রশ্নের জবাব দিলো না নবাব বরং নত দৃষ্টিতে হাতের ক্যাপ আর মাস্ক দেখতে শুরু করলো।
“চুপ করে আছো কেন?”
নবাব চোখ তুলে জানতে চাইলো, “কী বলবো?”
মিষ্টিকে পাওয়ার জন্য নবাব নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছে, সেটা তার প্রকৃত চেহারা নয়। বিয়ে করা সত্ত্বেও নবাব এখনও মিষ্টির সাথে কথা বলতে নিলে শ্রদ্ধা ফুটিয়ে তুলে। তার আচরণে মিষ্টি বুঝতে পারে বড়-ছোটোর যেই ব্যবধান, সেটা এখনও নবাব পুষে রেখেছে। আর সেটা অনুভব করে মিষ্টি বললো, “আমি জানি তুমি আমাকে এখনও সমীহ করো। তোমার আচরণ সেটা স্পষ্টত বুঝিয়ে দেয় কিন্তু এখন তোমার বলার কিছু নেই?”
“আছে তো। অনেক কথা বলার আছে তোমায় কিন্তু…” নবাব থেমে গেল আর মিষ্টিও কথা বাড়ালো না।
সিটে হেলান দিয়ে আবারও কৃষ্ণ রাতে আলোর খোঁজ শুরু করলো মিষ্টি। এদিকে নবাব মিষ্টিকে এক ঝলক দেখে নিজেও সিটে হেলান দিলো কিন্তু হঠাৎ মিষ্টির হাতের উপর তার নজর গেল। হাঁটুর ওপরে রাখা হাতে এখনও মেহেদীর রঙ লেগে আছে। নবাবের খুব ইচ্ছে করছে ঐ হাত স্পর্শ করে মিষ্টিকে বলতে, “এই মিষ্টি, তোমাকে আমি ভালোবাসি কতটা তা নিজেরও অজানা। কিন্তু টুকরো টুকরো স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে আঠার মতো লেগে থাকে। আমি চাইলেও যে মুছে দিতে পারি না।”
আচম্বিতে নবাবের সিলেটের কথা মনে পড়লো। সে যখন মিষ্টির হাত নিজের মুঠোয় বন্দী করেছিল, তখন মিষ্টি বারংবার বলেছিল, “হাত ছাড়ো আমার, হাত ছাড়ো আমার।” এখন সেটা মনে পড়তেই হালকা হাসলো নবাব আর মিষ্টির দিকে মুখ করে বলে উঠলো, “মিস টিউন।” ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি। তার চোখে নবাব দেখতে পেল হাজারও বিস্ময়ের ছড়াছড়ি।
“মিস টিউন?”
“হুম।” নবাব মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো।
“এটা বললে কেন? এখন তো কোনও কথা একাধিক বার বলিনি।”
“হয়ত বলতে।”
“কেন?” বুঝতে না পেরে।
“তোমার হাত স্পর্শ করলে। কারণ সিলেটে এমনটা করার পর একই কথা একাধিকবার বলেছিল।”
“অকারণে হাত ধরতে যাবে কেন?” হঠাৎ লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।
“কারণেই ধরতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই, তাই না? আমার গোটা জীবনের চাবিকাঠি তো ঐ হাতেই বন্দী। একটু ছুঁয়ে দিলে যদি পায় মুক্তি, সেটা ভেবে খুব লোভ খুব হচ্ছিল।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির চোখের পাতা নেমে গেছে। লজ্জায় গলা ধরে এসেছে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কোনও রাগ হচ্ছে না তার মাঝে আর না কোনও বিরক্তি। কিন্তু অন্যদিন হলে হলে সেটা রাগ অথবা বিরক্তির রূপ পেত।
“দয়া করে এমন লাগামহীন হবে না কারণ এতে অসহ্য লাগে আমার।” নিচু গলায় মিষ্টি বলতেই নবাব মিষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “দয়া করে এমন লজ্জাকাতুর হবে কারণ এতে তৃপ্তি লাগে আমার।”
.
কক্সবাজারের ঘুম এখনও ভাঙেনি কিন্তু অগত্যা নবাবকে জেগে উঠতে হলো। বাস থেমেছে আর সবাই একে একে বাস ত্যাগ করছে। ঘুম জড়ানো চোখে নবাব আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এখনও আকাশে কালো রঙের মেলা। চট করে সময় দেখতে গিয়ে জানলো এখন রাত চারটা। এমন অসময়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে সে বিষয়ে নবাবের ধারণা ছিল। কিন্তু মিষ্টির ঘুম ভাঙাতে হয়ত একটু সমস্যা হবে তাই নিয়ে চিন্তিত হলো নবাব।
“এই মিষ্টি?” নরম কন্ঠে নবাব ডাকলো মিষ্টিকে কিন্তু জবাব পেল না। তাই এবার একটুখানি জোরে লাগাতার ডাকতে লাগলো, “এই মিষ্টি? মিষ্টি?”
“হুম।” ঘুমের ঘোরে মিষ্টি জবাব দিতে নবাব বললো, “কক্সবাজার এসে গিয়েছি আমরা। এখন বাস ছাড়তে হবে। উঠো শিগগির।”
“আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“তা তো আমারও পাচ্ছে। প্লিজ উঠো।”
খুব একটা ঝামেলা না করে মিষ্টি উঠে পড়ে আর বাস ছেড়ে নেমে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, “এ কি! এখনও তো রাত শেষ হয়নি।”
হালকা হেসে নবাব জবাব দিলো, “শেষ হওয়ার দরকার কি? একটু সামনে গেলেই আমাদের হোটেল৷ এসো।”
মিষ্টি ঘুমের আঁকড়ে হাঁটছে বলে নবা বললো, “দেখেশুনে হাঁটো। এভাবে হাঁটলে কিন্তু গাড়ির তলায় পড়তে বেশি সময় লাগবে না।”
“সকাল সকাল এমন কথা বলছো কেন?” অবাক এবং রাগ দু’টোই প্রকাশ করলো মিষ্টি। কিন্তু নবাবের নির্বিকায় উত্তর, “এখন সকাল নয় বলেই এসব বলছি। সাবধানে হাঁটো।”
“তোমাকে বলতে হবে না। আমি শিশু নই।” বিরক্তি মেখে নবাবকে জবাব দিলো মিষ্টি।
চলবে…
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৯
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“তো সেটার প্রমাণ দাও তর্ক না করে।” এই বলে নবাব চলার গতি বাড়িয়ে দিলো। নবাবের সাথে চলন গতির সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে মিষ্টি বাক্য ব্যয় থামিয়ে দিলো।
হোটেলে প্রবেশ করেই নবাব চমকে উঠলো। এমন ভোর রাতেও হোটেলের রিসিপশনে উপচে পড়া ভিড়। রিসিপশনের লোকের সাথে কথা বলে নবাব জানতে পেরেছে দুপুর একটার আগে হোটেল রুম খালি পাওয়া যাবে না। বিষয়টা শুনে নবাবের চিন্তা হলেও এখন করার মতো কিছুই নেই কারণ সূর্যের রশ্মি আকাশে ভাসমান হয়নি।
“এই মিষ্টি, রুম পেতে তো অনেক দেরি। এখানেই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
রিসিপশনের উল্টোদিকের একটা সোফায় বসে ঘুমে ঢুলতে থাকা মিষ্টি জবাব দিলো, “সমস্যা নেই কিন্তু আমার তো বড্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি কি সোফায় একটু…” মিষ্টির কথার মাঝেই নবাব বলে উঠলো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
“আর তুমি?”
হালকা হাসলো নবাব, “আমি? দেখি কী করতে পারি?” মিষ্টি জবাব দিলো না কিন্তু ওর চোখ হাসলো যেন।
প্রায় বিশ মিনিটের মতো চুপচাপ বসে থেকে নবাবের চোখেও ঘুম এসে হাতছানি দিচ্ছে। এদিকে মিষ্টি ঘুমে কাদা হয়ে আছে। সোফায় হেলান দিয়ে নবাব ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজে দিয়েছিল কিন্তু এর মাঝেই কারোর স্পর্শে জেগে উঠলো। মিষ্টি ঘুমের ঘোরে নবাবের বাহু চেপে কাঁধে মাথা রেখেছে। এটা দেখে নবাব হালকা হেসে উঠলো আর অতি সাবধানে ওর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তবে সোফায় নয়, নিজের বুকে মিষ্টিকে মাথা রাখতে দিলো। মিষ্টিও ঠাঁই পেয়ে নির্বিঘ্নে মাথা রাখলো।
বাম হাতে মিষ্টিকে জড়িয়ে হালকা হাসলো নবাব, “নিজের অজান্তে কতকিছুই হয়ে যায়, কত কাহন জীবনে নতুন রঙের প্রলেপ লাগায়। কিন্তু এসব কাহনে একটু প্রীতি থাকুক সেটাই একান্ত কামনা আমার। ভাগ্যক্রমে যদি সেই কাহনে তুমি আমি মিলিত হই মিষ্টি তবে দেখে নিও তুমি। দেখে নিও নবজন্ম লাভ করা আমাদের অমোঘ প্রীতিকাহন।” নবাবের আনমনে বলা কথার মাঝে ঘুমের ঘোরে মিষ্টি ‘হুম’ উচ্চারণ করে বাম হাতে টি-শার্ট খামচে ধরলো। আর হিজাব পরা সত্ত্বেও নবাবের বুকে নাক ঘষে ঘুমকে জিতিয়ে দিলো।
আস্ত দানার মুগডালে পরোটা গড়িয়ে নিয়ে মুখে পুড়লো মিষ্টি। এর আগে কখনও মিষ্টি মুগডাল খায়নি। মাকে যখন বলতো, “মা, মুগডাল রান্না করলে খেতে পারতাম।”
“আমাকে দিয়ে এসব হবে না। বড় হয়ে নিজে রান্না করে খাবি।” মায়ের জবাব শুনে মিষ্টি ঠোঁট উল্টে একাই বিড়বিড় করতো, “সামান্য মুগডাল খাওয়ার জন্য আবার বড় হতে হবে?”
মিষ্টি তার নিজের এলাকার হোটেলের পরোটা বহুবার খেয়েছিল। তার বাবা প্রায়শই এনে দিতেন কিন্তু সেখানে পরোটার সাথে ছোলার ডাল, সবজি, হালুয়া আর ডিম ভাজা পাওয়া যেত। এদিকে কক্সবাজারের হোটেলে ছোলার ডালের পরিবর্তে মিষ্টি মুগডাল খুঁজে পেল। খেতে গিয়ে অদ্ভুত স্বাদে বিড়বিড় করলো, “একই দেশ অথচ জায়গা ভেদে খাওয়ায় কত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।”
“এই মিষ্টি, খাসির পায়া খাবে?”
খাবারের দলা মুখের ডান পাশে রেখে মিষ্টি চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, “খাসির পায়া?”
“হুম।”
“আমার খাসির নাম শুনলেই বমি পায়। তুমি খাও।”
“তাহলে চা খাবে?” নবাব সহজ গলায় প্রশ্ন করলেও মিষ্টি বুঝতে পারলো নবাব চট্টগ্রামের চা খাওয়ার বিষয়টা ইঙ্গিত করছে। কারণ প্রশ্ন করেও নবাব ঠোঁট টিপে হাসছে আর এতে মিষ্টির চোয়াল শক্ত হলো। তবে নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো, “সকাল সকাল শুরু করে দিয়েছো?”
“চা তো মানুষ সকাল সকালই খায়। তাছাড়া তুমি যা ভাবছো আমি কিন্তু মোটেও সেটা ভেবে বলিনি।”
“আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়?”
“নাহ, তুমি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। আর সেজন্যই আমার সাধারণ প্রশ্নের আড়ালে থাকা অসাধারণ বিষয়টা বুঝতে পারো।” এই বলে নবাব আবার হাসতে শুরু করলো। আর মিষ্টি কিঞ্চিৎ রেগে বললো, “আবার যদি চা খাওয়ার কথা বলো তবে কেতলি ভর্তি চা তোমার মাথায় ঢালবো। ফাজিল কোথাকার।” মিষ্টির রাগ মিশ্রিত বাক্য শুনে নবাব কেবল হাসলো আর কাঁধ নাচিয়ে বিড়বিড় করলো, “পাগল একটা।”
.
কোনও শব্দ হলো না, কারো কন্ঠ ভেসে এলো না অথচ আচমকা জেগে উঠলো মিষ্টি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার অজানা কারণে। বিছানায় বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সে। আজ বিছানায় সে একা– এটা ভাবতে গিয়েই কষ্ট হলো তার অথচ সিলেটে আলাদা বিছানার জন্য নবাবের সাথে ঝগড়া করেছিল। কিন্তু কক্সবাজারে আলাদা রুম আর বিছানা দেখে মিষ্টির মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তবে সেটা নবাব টের পেয়েছিল কি না মিষ্টির তা অজানা।
এখন মধ্যরাত। পাশাপাশি ছোট্ট দু’টো রুমের একটাতে অবস্থান করছে মিষ্টি। ওর নাক বরাবর যেই রুম রয়েছে, সেখানে ঘুমিয়ে আছে নবাব। মিষ্টির হঠাৎ ইচ্ছে করছে নবাবকে দেখতে। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ধীর পায়ে নবাবের রুমে যখন উঁকি দিলো, তখন আধ আলোয় নবাবের ঘুমন্ত মুখ ওর চোখে দৃশ্যমান হলো।
নবাবের বিছানার পাশে মেঝেতে বসলো মিষ্টি। নবাব উপুড় হয়ে বালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে আছে। অবাধ্য চুল তার সারা মুখ ঢেকে যেন দেয়াল তৈরি করেছে। মিষ্টি আলতো হাতে চুল সরিয়ে দিতে মনে পড়লো ঘুমানোর আগে বলা নবাবের কথা, “সিলেট আর চট্টগ্রামে তোমার ঘুমাতে অনেক সমস্যা হয়েছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি। তাই এখানে আর সেই ভুলটা করিনি। হোটেলে বলেছি আমাদের সুবিধার জন্য ডাবল বেডের রুম দিতে। এই হোটেলে লোকের সমাগম বেশি হলেও রুমের ভাড়া অনেকটাই কম। আশা করছি তোমার অসুবিধা হবে না।” এসব শুনে মিষ্টি হৃদয়ে কিছু একটা অনুভব করেছিল। এমন প্রাপ্তি সে চায় না তার হৃদয় সেটা বুঝতে পেরে ব্যথিত হয়েছিল আর তাই উত্তর দিতে গিয়ে বাক্যে দুঃখ প্রতিফলিত হয়েছিল, “আরও তো অসুবিধা আছে, সেগুলো কেন সমাধান করছো না?”
এক গাল হেসে নবাব বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে জবাব দিয়েছিল, “অন্য অসুবিধার সমাধানে বিচ্ছেদের জ্বালা নেই বলে।” মিষ্টি তখন নবাবের কথা বুঝতে পারিনি তাই নিরব থেকে ছিল। কিন্তু এই মধ্য রাতে নবাবের সম্মুখে বসে ঠিকই ঠাওর করতে পারছে, “তুমি আমাকে শায়েস্তা করতে এমনটা করেছো নবাব।” লজ্জায় নত চোখে মিষ্টি বিড়বিড় করলো আর হালকা হেসে নবাবকে মন ভরে দেখে নিলো।
বিছানার ওপর রাখা নিজের হাতে মাথা রেখে চোখ বুজে ভাবনায় ডুব দিলো মিষ্টি, “তুমি আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছো নবাব। আমার মন এখন তোমার জন্য শক্ত পাথর হয়ে থাকতে পারছে না। তোমার ভালোবাসার কুড়াল আমার মন পাথরে আঘাত করে দ্বিখণ্ডিত করছে আর সেথায় হয়ত অচিরেই কিছু একটার সূচনা হবে।”
পাশ ফিরতে গিয়ে শরীরে কোনও কিছুর অস্তিত্ব বোধ হতেই জেগে উঠলো নবাব। আধশোয়া অবস্থায় সে মিষ্টিকে দেখে চমকে উঠলো, “এ কি! তুমি এখানে?”
নবাব নড়তেই মিষ্টির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু জেগে উঠে চুপটি করে বসে থাকা ছাড়া তার মাথায় অন্য কোনো ভাবনা আসেনি। নবাব মিষ্টির উত্তরের অপেক্ষা করলেও মিষ্টি জবাব দেওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না বিধায় আমতা-আমতা করলো, “না মানে…”
“ভয় পাচ্ছিলে?”
“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।” নিজের অজান্তেই সত্যি বলে ফেললো মিষ্টি আর এতে অবাক-খুশি হলেও কথায় সেটা স্পষ্ট করলো না নবাব, “ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল কেন বকছো? আর মেঝেতে বসেছো কেন? জলদি উঠো নয়ত সর্দি হতে পারে।” মিষ্টি ভাবেনি নবাব এমন জবাব দিবে কিন্তু এমনটা পেয়ে সে খুশি হয়নি বিধায় মলিন মুখে বিছানায় বসলো।
নবাব চটজলদি বাতি জ্বালিয়ে চুলে হাত চালালো, “কী হয়েছে মিষ্টি? খারাপ স্বপ্ন দেখে কি জেগে উঠলে?”
মিষ্টি তার নত মাথা দুইবার নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “উঁহু।”
“তাহলে?” বলতে বলতে নবাব মিষ্টির ডান হাত মুঠোয় বন্দী করলো। আচম্বিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে আর অনুভব করলো তার গলা লজ্জায় ধরে এসেছে৷ ঢোক গিলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে সাথে চোখ পিটপিট করছে আর এতসব দেখে নবাব ঠোঁট টিপে হাসছে, “এই মিষ্টি, তুমি কি ঠিক আছো?”
মিষ্টি যেন সব গুলিয়ে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, “হুম?”
“বললাম, তুমি কি ঠিক আছো না-কি…” এই বলে নবাব মিষ্টির দিকে ঝুঁকে এসে ধীর গলায় বললো, “মনটা এলোমেলো হয়ে গেছে।” এবার ঢোক গিলে স্থির হলো মিষ্টি এরপর স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমার কিছু বলার ছিল নবাব। তুমি কি রেগে যাবে?”
সোজা হয়ে বসলো নবাব এরপর বললো, “না মিষ্টি, তুমি আমাকে যা খুশি বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না গো।” নবাবের কন্ঠ অনেক আদুরে শোনালো। এত মায়া জড়ানো কন্ঠে নবাব কখনও কথা বলেছিল কি না মিষ্টির মনে নেই। নবাবের চেহারাতেও মায়া ফুটছে অবিরাম আর সেই মুখ পানে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “নবাব, আমি তোমার কাছে অনেক ভালো আছি। এমন ভালো কত বছর আগে ছিলাম আমার জানা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো এমন ভালো থাকতে গিয়ে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় আমায়। জানি না আমার শোকে মায়ের হাল কী হয়েছে? জানি না আমার জন্য তোমার পরিবারকে কী কী সহ্য করতে হচ্ছে? এসব ভেবে আমি শান্তি পাই না নবাব।” কথাগুলো বলতে গিয়ে মিষ্টির কন্ঠস্বর ভারী হলো আর চোখ ছলছল হলো জলবিন্দুতে।
“আমার মিষ্টি কখনও স্বার্থপর হতে পারে না আর তাকে এত কষ্ট পেতেও দিবো না আমি৷ এখানে আমরা বেশিদিন থাকবো না মিষ্টি।”
“কিন্তু নবাব…” মিষ্টি বিচলিত হতেই নবাব বললো, “কালকের দিন তো চলেই গেল। আজকে আর আগামী কালকে থেকে আমরা পরশু সরাসরি বাসায় চলে যাবো।”
“সত্যি নবাব?” মিষ্টির যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না নবাবের কথা।
“হুম, সত্যি আর আমি বিদেশেও ফিরে যাবো। তুমি তো তাই চাও।” এবার মিষ্টি নবাবের হাত নিজের দিকে টেনে মুঠোয় আবদ্ধ করলো। কন্ঠে মায়া ছড়িয়ে নিজের দ্বিধা তাড়াতে প্রশ্ন করলো, “তুমি সত্যি এসব করবে?”
“হ্যাঁ মিষ্টি, আমি সত্যিই এসব করবো৷ তোমার মুখে এক টুকরো হাসির জন্য আমি সব মেনে নিতে পারবো।” বলেই চোখ নামিয়ে ম্লান হাসলো নবাব।
“তুমি খুব ভালো নবাব। আমার বিশ্বাস ছিল এটাই আমার নবাব যাকে সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি৷ পিস্তল হাতে ঐ উগ্র নবাব তুমি হতে পারো না। এমনটা হয়ত ক্ষণিকের জন্য করেছিলে। তবে সেসব আমি মনে রাখতে চাই না। তুমি যদি বিদেশে ফিরে যাও আমি সত্যিই খুব খুশি হবো। কিন্তু তুমি দুঃখ পাবে না তো?”
…চলবে।