#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং-০২
প্রিয় হেমেন্দ্র,
কেমন আছো? জানতে চাইব না, উত্তরটা কি আগেই জানি!হেমেন্দ্র আজ সাতাশ বছর পর তোমাকে চিঠি লিখছি।সাতাশ বছর আগের আমাদের প্রথম দেখার স্মৃতি তোমার কি মনে পড়ে?তুমি তো ভুলে গেছো!আমার যে আজ ও মনে পড়ে তোমার সাথে কাঠানো সেই প্রতিটি মূহুর্ত।আমি আমার মানসলোকের কুঠুরিতে বারবার ফ্ল্যাশব্যাকে দেখি সেই মুহুর্তগুলো।
শিশিরভেজা এক শুভ্রসকালে ভার্সিটির খেলার মাঠে দেখেছিলাম তোমায়,তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে নতুন আসা আমাদের ব্যাচমেটদের র্যাগ দিচ্ছিলে।আমার কাছে ছিলে মূর্তিমান আতঙ্ক।তাই তো সারাদিন পালিয়ে বেড়াতাম তোমার কাছ থেকে।কিন্তু গোধুলিবেলায় কন্যাসুন্দর আলোয় তোমার চোখে চোখ পড়েছিলো,স্তব্ধ হয়েছিলো দুই চোখের দৃষ্টির মধ্যে,কি দেখেছিলাম জানি না, পালিয়ে গিয়েছিলাম ভীত হরিণীর মতো।বেশ কিছুদিন ভার্সিটিতে পা দেয়ার সাহস করি নি।তারপর একদিন লাইব্রেরী যাবার পথে পাকড়াও করলে,ভালোলাগার, ভালোবাসার কথা আদায় নিলে মূহুর্তেই।তার পর আর কি আমাদের সেই সোনালী বিকেলগুলো আরো রঙিন হলো এক সাথে পথ চলতে গিয়ে।কিন্তু সোনালী বিকেলগুলোর তো শেষ আছে, রাতের অন্ধকার নেমে আসলো আমাদের জীবনে!…..
মনে পড়ে তোমার?তুমি প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ করে পারিবারিক ব্যবসায় বসতে শুরু করলে আর আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দেব দেব এর মধ্যে কি নেশায় চাপলো তোমার আমার সর্বস্ব চাইলে,চাইলে আমার পূর্ণ সমর্পণ।গোড়া মুসলিম পরিবারের মেয়ে,তাই ধ্যান ধারণায় বিয়ের পূর্বে সম্পর্কে মন মানতে চাইলো,আমাকে তো আমার চেয়ে বেশি বুঝতে, আমার দ্বিধা মুহুর্তেই বুঝে নিলে,হাত টেনে নিয়ে গেলে আদালত পাড়ায়।দুই ধর্মের বিভেদে রেজিস্ট্রি করাই ঠিক হলো,দুটি নাম জুড়ে গেল।এবার ছিলো পূর্ণ সমর্পণের,আমার মনের মণিকোঠায় তোমার বসবাস ছিলোই কিন্তু এবার আমার রক্তকণিকায় মিশে গেলে,আমি পূর্ণতা পেলাম।ভাবলাম এটাই বোধ হয় ছোটবেলায় পড়া সেই সিন্ড্রেলার গল্পের চমৎকার পরিণতি& they lived happily ever after…….কিন্তু এই বোধ হয় আমার সুখের দিনের শেষ ছিলো, দুঃখের অমানিশার সূচনা।
পরীক্ষা শেষ হলো আমার,অসুস্থ হলাম আমি, এদিকে তোমার ব্যস্ততা বেড়ে গেলো,অফিসের শেষে নানা পার্টিতে ঘুরে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে,এর মাঝেই টের পেলাম নতুন অস্তিত্বের সন্ধান এই আমির মাঝে।এই সুখবর দেয়ার আগেই ব্জ্রাহত হলাম তোমার বিয়ের খবর শুনে!তোমার বাড়িতে তোমার বাবার কাছে সবকিছু খুলে বললাম,উনি ক্ষীয়কাল চুপ করে থেকে তোমাকে ডাকলেন,তুমি আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলে, অস্বীকার করলে আমার অস্তিত্ব।আমি রিক্তের মতো ফেরত এলাম হোস্টেলের ঘরে,এতটাই শক পেয়েছিলাম,আরও বেশি অসুস্থ হয়েছিলাম।একটু সুস্থ হলে ভাবলাম, বাড়ি যাবো!মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদলে কষ্ট জুড়াবে আমার,কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।চিঠি পেলাম আব্বুর হার্টফেল হয়েছে,আব্বুর ইন্তেকালের সাথে পরিবার থেকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছে আমায়।আমার অপরাধ আমি ভিন্ন ধর্মের রাজপুত্রের সাথে ঘর বাধতে চেয়েছিলাম!তোমার বাবা আমার অন্য উপকার না করতে পারলেও ভার্সিটি থেকে ঠিকানা নিয়ে বাড়িতে খবর দেয়ার দায়িত্বটুকু দারুণ পালন করেছিলেন।নিজের উপর রাগে দুঃখে আমি হাতের রগ কেটে সুইসাইড এটেম্পট নেই,কিন্তু রুমের দীর্ঘদিনের সাথী মেডিক্যালে নিয়ে যায়,বেঁচে যাই আমি নাকি মরেও বেঁচে থাকি জানি না…..
তোমার হয়তো মনে হচ্ছে এতদিন পর এই পুরাতন কাসুন্দি কেন ঘাটছি,বিশ্বাস করো আমার ও বলতে ইচ্ছে করছে না,
তোমার গলার শব্দদূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর
তুমি অন্য কারো ছন্দে বেধো গান…….
তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত বিভীষিকার মতো লাগছিলো।সেই সময় আমার অন্ধকারআচ্ছন্ন জীবনে একটুকরো আলোর দিশা হয়ে জয় এসেছিলেন।তোমার বন্ধু জয়,আমাদের বিয়ের সাক্ষী।আমার এই দুর্দশার কথা জেনেই নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলেন,আমাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন হয়তো সাক্ষী হবার দায় থেকে।আমি বললাম সহায়তা যদি করতেই হয় চাকুরির ব্যবস্থা করে দিন,কিন্তু এই শহরে নয়, এই শহর কেড়ে নিয়েছে আমার আমিত্ব।তাই তো জয়ের ব্যবস্থায় দূর এক পাহাড়ি গ্রামে চলে গেলাম শিক্ষকরূপে,ছোট ছোট পাহাড়ি বাচ্চাদের পড়িয়ে কেটে যেতে লাগলো সময়, তারপর জন্ম নিলো নক্ষত্র,আমার ভালোবাসার ফসল বা আমার ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন।কিন্তু আমি যে ওকে বোঝা ভাবিনি,নক্ষত্রের জন্মের পরেই অসহায় নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করলাম নক্ষত্র এনজিও যা আজ নক্ষত্র এম্পায়ারে পরিণত হয়েছে।জয়ের সেই সহায়তা আমার শক্তিতে পরিণত হলেও আমায় কখনো অসম্মান করেনি,আমাকে ভালোবাসতেন স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন,কিন্তু বাসীফুল দিয়ে পূজার নৈবেদ্য সাজানো যায়?
তোমার কোম্পানি নক্ষত্র এম্পায়ার টেক ওভার করেছে খবর পেয়েছো নিশ্চিত,মদ্যপ মেয়ে আর লোভী স্ত্রীকে নিয়ে আশা করি বাকি জীবন তোমার রাস্তায় ভালোই কাটবে।তোমার ঘরে লাগা আগুনে আমার ঘর দিয়াবাতির মতো আলো দিবে, তোমার দেয়া শিক্ষাকে কাজে লাগালাম।
ইতি তোমার
কাবেরি।